কালান্তরের কড়চা
বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে থাকলে সন্ত্রাস দমনে কী করতেন
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
কথায় বলে 'একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর।' তথাকথিত ইসলামী জঙ্গিদের তাণ্ডবে যখন দেশ জর্জরিত, তখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস। আগস্টের এই শোকের মাসের প্রথম দিন লিখতে বসেই খবর পেলাম, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থা চিন্তা করে আমি মাঝেমধ্যে নিজেই বড় অসহায় বোধ করি। কত দিক সামলাবেন তিনি? তাঁর বাইরে শত্রু, ঘরেও শত্রু। বাইরের শত্রু কঠোর হাতে দমন করেন তো ঘরের শত্রু মাথা তুলে দাঁড়ায়।
ছাত্রলীগ অর্ধশতকেরও বেশি সময়ের একটি ছাত্রসংগঠন। বঙ্গবন্ধু নিজেই একসময় এই ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধ—দেশের এমন কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম নেই, যাতে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব দেয়নি। পাকিস্তান আমলেও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও দাঙ্গার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ রুখে দাঁড়িয়েছে। সেই ছাত্রলীগের আজ এই পরিণতি কেন? এই কেনর উত্তর কে দেবে?
ছাত্রলীগ এখন দেশের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী ছাত্রসংগঠন। ছাত্রলীগের সমর্থন ছাড়া ঘাতক-দালাল নির্মূল অভিযান, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলন এবং এই যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দানের দাবিতে শাহবাগ চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চের বিশাল সমাবেশ সফল করা—কোনোটাই সম্ভব হতো না। সাম্প্রতিককালে আত্মদ্বন্দ্বে, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসে ছাত্রলীগ শক্তি ক্ষয় করেছে। দুর্নাম কুড়িয়েছে। এই সেদিন ছাত্রলীগের হাজার হাজার সাধারণ নেতাকর্মীর দাবিতে দলটিকে আবর্জনামুক্ত করে নতুনভাবে সংগঠিত করায় আশা হয়েছিল, ছাত্রলীগ আবার ঘুরে দাঁড়াবে এবং দেশের মানুষের আস্থা আবার অর্জন করবে।
কুমিল্লার ঘটনাটির সঙ্গে নিশ্চয়ই বৃহত্তর ছাত্রলীগের কোনো সম্পর্কে নেই। তথাপি এই ঘটনা অনেকের মতো আমার মনেও নৈরাশ্য সৃষ্টি করেছে। আমার মনে আশা জন্মেছিল, সদ্য পুনর্গঠিত ছাত্রলীগ দেশে জঙ্গি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। অতীতে দেশকে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করতে ছাত্রলীগ যে ভূমিকা নিয়েছিল, বর্তমানে দেশকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে ছাত্রলীগ একই ভূমিকা নেবে। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেভাবে তরুণ জঙ্গি রিক্রুট ও সন্ত্রাস সৃষ্টিতে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে, ছাত্রলীগ তা আদর্শের অস্ত্রে ও আন্দোলনের শক্তির মাধ্যমে রুখে দেবে। কুমিল্লার ঘটনা আমাদের সেই প্রত্যাশায় আঘাত হেনেছে।
শুধু আইন ও প্রশাসনিক শক্তি দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা বা জঙ্গিবাদের সমস্যা মোকাবিলা করা যায় না। প্রশাসনিক শক্তির পাশাপাশি চাই ছাত্র-জনতার শক্তি। এই ছাত্র-জনতাই অতীতে দেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস রুখে দিয়েছে। বর্তমানেও এই ছাত্র-জনতাই জঙ্গি সন্ত্রাস দমনে বড় সহায়ক শক্তি হবে—এটা আশা করা গিয়েছিল। আমাদের এই আশা যে পূর্ণ হচ্ছে না তার বড় কারণ, দেশের প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ এখন বিভক্ত ও দুর্বল। ছাত্রলীগের একটা অংশ স্বার্থদ্বন্দ্বে ও আত্মদ্বন্দ্বে লিপ্ত। দেশের উচ্চবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত এক শ্রেণির তরুণের মধ্যেও যে জঙ্গিবাদের সম্প্রসারণ ঘটেছে, তা শুধু কড়া আইন করে, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কড়া পাহারা বসিয়ে বন্ধ করা যাবে না। এসব ব্যবস্থার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও ভেতরের প্রতিরোধ চাই। এই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে একমাত্র সুস্থ মানসিকতার প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের ঐক্য। কিন্তু সেই ছাত্রসমাজ ও ছাত্রঐক্য এখন কই?
আগস্ট মাস শুরু হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবরণের মাস এটি। স্বতঃই মনে পড়ছে, বঙ্গবন্ধু আজ যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে এই ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদের মোকাবিলায় তিনি কী করতেন। তাঁর আমলে জঙ্গিবাদের সন্ত্রাস নয়, ছিল সাম্প্রদায়িকতার সন্ত্রাস। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন এই সাম্প্রদায়িকতার সন্ত্রাস আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, তখন বঙ্গবন্ধু সরকারি ক্ষমতায়ও ছিলেন না। তবু তিনি এই সন্ত্রাস মোকাবিলায় কী করেছিলেন।
১৯৬৪ সালের কথা। পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) স্বায়ত্তশাসন লাভের আন্দোলন তখন দানা বেঁধে উঠছে। এই আন্দোলনে বিভেদ সৃষ্টির জন্য তত্কালীন আইয়ুব-মোনায়েম সরকার (এই মোনায়েম খানের পৌত্র এবার কল্যাণপুরে একজন জঙ্গি হিসেবে মারা গেছে) পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করে। আদমজী জুট মিল তখন বিরাট প্রতিষ্ঠান। সেখানে হাজার হাজার অবাঙালি শ্রমিকও কাজ করে। তাদের একটা অংশকে টাকা ও খাবারের পুঁটলি দিয়ে ঢাকায় আনা হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু করার জন্য।
আমি তখন থাকি ঢাকার আজিমপুরে একটি গলিতে। সাংবাদিকতা করি। সকাল ১০টার দিকে বঙ্গবন্ধুর জিপ এসে আমার বাসার সামনে দাঁড়াল। শেখ ফজলুল হক মনি এসে বললেন, 'গাফফার ভাই, লিডার ডাকছেন। তাড়াতাড়ি আসুন।' আমি কোনো রকমে কাপড় পাল্টে জিপে গিয়ে উঠলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, 'আমরা তোপখানায় সাইদুল হাসানের অফিসে যাচ্ছি।' তখন তোপখানায় প্রেস ক্লাবের উল্টো দিকে সাইদুল হাসান (একাত্তরে শহীদ) ও আহমেদুল কবিরের (সংবাদের সাবেক সম্পাদক) একটি যুক্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অফিস ছিল। সেখানে পৌঁছে দেখি, বঙ্গবন্ধুর জন্য তখনকার অনেক বিশিষ্ট নেতাকর্মী ও ছাত্রনেতা অপেক্ষা করছেন।
এই সভায়ই দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু বললেন, 'আমরা সরকারি ক্ষমতায় নেই। পুলিশ দিয়ে দাঙ্গা থামাতে পারব না। আর শুধু পুলিশ দিয়ে দাঙ্গা থামানো যায় না; জনপ্রতিরোধ দরকার। আমাদের ছাত্র-জনতাকেই সেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।' বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের দ্বারা ছোট ছোট স্কোয়াড তৈরি করা হয়। তারা শহরের প্রতিটি মহল্লায়, দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় যাবে। দাঙ্গা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করবে। প্রয়োজনে দাঙ্গাকারীদের রুখবে। আমার মনে আছে, এ ধরনের একটি স্কোয়াডের সদস্য হয়ে আমি, ওয়াহিদুল হক (ছায়ানট), আহমেদুর রহমান (ইত্তেফাকের ভীমরুল) ও তরুণ প্রগতিশীল ব্যবসায়ী রেজা আলী দাঙ্গা উপদ্রুত সাভারে গিয়েছিলাম।
দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির দ্বিতীয় ও বৃহত্তর সভা হয় প্রেস ক্লাবের দোতলায়। এই সভায় অন্য নেতাদের মধ্যে হামিদুল হক চৌধুরী, এমনকি জামায়াতের গোলাম আযমও এসেছিলেন। ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও সংবাদের সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরীও ছিলেন। এই সভায়ই 'পূর্ববঙ্গ রুখিয়া দাঁড়াও' শীর্ষক দাঙ্গাবিরোধী ঐতিহাসিক ইশতেহারটি তৈরি হয়। এই ইশতেহারের একটি বান্ডেল গভর্নর মোনায়েম খানের গাড়ির দিকে ছুড়ে মেরেছিল দাঙ্গাবিরোধী মিছিলের একদল কর্মী। এই 'অপরাধে' মামলা করা হয়েছিল প্রেস ক্লাবের বৈঠকে হাজির নেতাদের বিরুদ্ধেও। তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, হামিদুল হক চৌধুরী ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াও ছিলেন।
সে বছর দাঙ্গা পুরান ঢাকার ওয়ারী ও লারমিনি স্ট্রিটেও ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা শহরের সর্বত্র শান্তি মিছিল করেছি। দাঙ্গাকারীদের কোথাও কোথাও রুখেছি। স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যলয়ে প্রচারপত্র বিলি করেছি, যাতে তরুণসমাজ বিভ্রান্ত হয়ে দাঙ্গায় অংশ না নেয়। ফলে আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। পুরান ঢাকার তরুণরাও দাঙ্গায় অংশ না নিয়ে দাঙ্গা প্রতিরোধে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। শুধু ঢাকা শহরে নয়, গোটা পূর্ব পাকিস্তান সাম্প্রদায়িকতার সন্ত্রাসমুক্ত হয়।
আমার সন্দেহ নেই, আজ যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন তাহলে সাম্প্রদায়িকতার সন্ত্রাসের চেয়ে আরো ভয়াবহ জঙ্গি সন্ত্রাস দমনের জন্য প্রশাসনিক শক্তির পাশাপাশি ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতেন। বুদ্ধিজীবীদের প্রচারে নামাতেন। ছাত্রলীগকে নির্দেশ দিতেন ছোটবড় স্কোয়াড গঠন করে প্রতিটি স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আদর্শবাদ ও আন্দোলনের অস্ত্রে জঙ্গিবাদ রুখতে। বিভ্রান্ত তরুণদের সুস্থ করে তুলতে। ছাত্ররাই পারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তরুণদের মধ্যে জঙ্গিদের মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের গোপন প্রচারণা ব্যর্থ করে দিতে। হয়তো বঙ্গবন্ধু নিজেই যেতেন বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে, এমনকি মাদ্রাসাগুলোতেও। তাঁর বজ্রকণ্ঠের ডাকে তরুণসমাজের বিভ্রান্তি ঘুচত। জঙ্গিবাদের পক্ষে না দাঁড়িয়ে তারা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াত।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বর্তমানে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের চেয়েও ভয়াবহ ও আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তির জঙ্গি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ছেন। এমনকি এই লড়াইয়ে তাঁর সাফল্যের সম্ভাবনা তাঁর সমালোচকরাও এখন স্বীকার করছে। কিন্তু তাঁর বড় সমস্যা, এই সংগ্রামে তিনি ছাত্র জনতা বুদ্ধিজীবীদের ঐক্যবদ্ধ সহায়তা পাচ্ছেন না। বঙ্গবন্ধুর আমলে বুদ্ধিজীবীরা সাম্প্রদায়িকতার দানবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাজপথে আন্দোলনে নামতেন। বর্তমানের বিরাটসংখ্যক বুদ্ধিজীবী আন্দোলনে নেমে জঙ্গিদানব দমনে নিজেদের দায়িত্ব পালন করেন না; সংবাদপত্রের কলামে বা টেলি টক শোতে নানা তাত্ত্বিকতার আড়ালে শুধু সরকারের ত্রুটি খুঁজে বেড়ান।
শেখ হাসিনার দুর্ভাগ্য, তাঁর পাশে বঙ্গবন্ধুর মতো ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-জনতা নেই। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল যে শক্তিশালী ছাত্র ও যুব সংগঠন, সেটিও আজ আত্মকলহে দুর্বল এবং তাদের মধ্যেও রয়েছে সন্ত্রাসের বীজ। এই আগস্ট মাসে তাই বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে প্রার্থনা করি, 'তোমার পতাকা যারে (শেখ হাসিনাকে) দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি।'
লন্ডন, সোমবার, ১ আগস্ট ২০১৬
__._,_.___