http://www.bhorerkagoj.net/
'হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়ে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসিত করা হোক'
তখন এরশাদ ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন। দেশে সীমিত রাজনীতি চালু হয়েছে। বায়তুল মোকাররমে সম্ভবত: পনের দলের এক জনসভায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলছিলেন: "দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলো। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন ড: কামাল এবং বিচারপতি সাত্তার। জনগণ ভোট দিলো ড: কামালকে; জিতলেন বিচারপতি সাত্তার। আর ক্ষমতায় বসলেন জেনারেল হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ"। এতদিন পরে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার ঘটনায় দাদার এ কথাটি আবার মনে পড়লো এবং তার বক্তব্যের সাথে তাল মিলিয়েই একজন বললেন, 'কাবার ওপরে শিবের ছবি বসালো জাহাঙ্গীর, জেলে গেল রসরাজ, আর বাড়ী পুড়লো, মন্দির ভাঙলো মালাউনের'। নাসিরনগর নিয়ে লেখার ইচ্ছে নেই, তবে বেচারা রসরাজ, বিনা দোষে জেল খাটছে, এই যা! ফেসবুকে একজন লিখেছেন, "সাংস্কৃতিক রাজাকার বলায় যদি সাগর সাহেবের ১০০কোটি টাকার মান যায়, তবে বিনা দোষে রসরাজ বা উত্তমের রাষ্ট্রের কাছে কত হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া উচিত"? উত্তর জানা নেই। তবে বাঘের গলায় আটকে যাওয়া হাড্ডি বের করে আনার পর বকের পুরস্কার চাওয়ার প্রেক্ষিতে বাঘের কথা সবার মনে আছে নিশ্চয়?
পত্রিকায় দেখলাম নূরে আলম সিদ্দিকী রোহিঙ্গাদের দেশে ঢুকতে দেয়ার আহবান জানিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের জন্যে সমবেদনা থাকা ভালো, কিন্তু ভিনদেশী রোহিঙ্গাদের জন্যে যাদের এত দরদ দেশের সংখ্যালঘুরা যখন অত্যাচারিত তারা তখন নীরব থাকেন কেন? রোহিঙ্গাদের ওপর যা ঘটছে সেটা প্রত্যক্ষ জেনোসাইড; কিন্তু বাংলদেশে হিন্দুদের ওপর বিরামহীনভাবে যা ঘটছে সেটা পরোক্ষ জেনোসাইড। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় ১৯৪৭ থেকে বাংলাদেশ নামক ভুখন্ড থেকে প্রায় ৫কোটি হিন্দু হারিয়ে গেছে। আবার ভারত বিভাগের পর থেকে পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশে হিন্দুর সম্পত্তি দখলের যে একটি বদভ্যাস অনেকের মধ্যে গড়ে উঠেছে, সেটা আজো চলছে তো চলছেই। হিন্দুদের বাধ্য হয়ে দেশত্যাগের কাফেলা বন্ধ হবে কবে? এভাবে একটু একটু করে হিন্দু বিতাড়ন না করে একবারে খেদিয়ে দিলে কেমন হয়? নূরে আলম সিদ্দিকীর পরামর্শে অবাক হবার কিছু নেই, বরং হিন্দুর বাপের ভাগ্য যে কেউ এখনো এমত পরামর্শ দেননি যে, "হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের জায়গায় মুসলমান রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসিত করা হোক"।
সরকার দেখলাম হিন্দুদের রক্ষায় আইন প্রণয়ন করছেন। সরকারকে সাধুবাদ জানাতে হয়। তবে দেশ থেকে আমার এক প্রগতিশীল বন্ধু লিখেছেন, কোন আইনই বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে পারবেনা। তারমতে, দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা মৌলবাদী চিন্তাধারায় পুরোপুরি কলুষিত। বন্ধু ভালোভাবেই জানেন আমি সংখ্যালঘু আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত, তাই তিনি লিখেছেন, শুধু সংখ্যালঘু নয়, তোমাদের আন্দোলনের সাথে আমাদেরও নাও, কারণ দেশে এখন সেক্যুলার মুসলমানরা সংখ্যালঘুর চেয়েও সংখ্যালঘু। তাছাড়া তোমরা তো ভারত যেতে পারবে, আমরা যাবো কোথায়? বন্ধুর মতে উগ্রবাদীদের ঠেকাতে সেক্যুলার মুসলমানদের হাতকে শক্তিশালী করাটা জরুরী। বাংলাদেশ নিয়ে যারা ভাবেন এবং যারা দেশকে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে দেখতে চান, তারা বন্ধু'র কথার সাথে একমত নাহয়ে পারবেন না। দেশকে মধ্যপন্থী, গণতান্ত্রিক রাখতে হলে সংখ্যালঘু ও প্রগতিশীল মুসলমানদের রক্ষা করতে হবে এবং উভয় গোষ্ঠী একে অপরের সাথে একযোগে কাজ করতে হবে বা একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। এ প্রসঙ্গে একথা জোর দিয়েই বলা যায়, মৌলবাদকে উৎসাহিত করে উগ্রবাদ ঠেকানো যায়না।
অতি সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একটি কথা বলেছেন, যা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রধর্ম থেকে সরে যাওয়ার কোন পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের নেই। রাষ্ট্রধর্ম তো আছেই, তবু কেন তাকে নুতন করে একথা বলতে হলো? এর কারণ সম্ভবত: তাকেও মৌলবাদের সাথে ব্যালান্স করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রযন্ত্রটি এখন অনেকটা সাম্প্রদায়িক, জননেত্রী শেখ হাসিনা বা সেক্যুলার ওবায়দুল কাদের চাইলেও সবকিছু করতে পারেন না। তাদের ব্যালান্স করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রধর্মের অবদান অনেক। আওয়ামী লীগ ইচ্ছে করলেও রাষ্ট্রধর্ম বাদ দিতে পারবে না, এটাই বাস্তবতা। জিয়া-এরশাদ রাষ্ট্রযন্ত্রে যে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন, তা থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা আওয়ামী লীগের নাই। আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ চেহারাটা তাই প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। এ সময়ে সংখ্যালঘুর ওপর যতগুলো ঘটনা ঘটেছে এর সবকটি'তে দলীয় নেতারা জড়িত। সদ্য অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত বলেছেন, বিশ বছর পর দেশে কোন হিন্দু থাকবেনা। তাকে আশ্বাস দিয়ে বলা যায়, দেশে তখন আওয়ামী লীগও থাকবে না; বরং আওয়ামী লীগ পুনর্মুষিক ভব, অর্থাৎ 'মুসলিম আওয়ামী লীগ' হয়ে যাবে।
রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে কথা বলা অবান্তর। মানুষ ধর্ম করে মূলত: পরকালের জন্যে। রাষ্ট্রের কি পরকাল আছে? মানুষ মরলে স্বর্গ বা নরক যেখানেই যাক, রাষ্ট্রের কি স্বর্গ-নরক আছে? বা রাষ্ট্রের কি মরণ আছে? রাষ্ট্রের আকার পরিবর্তন হতে পারে, রাষ্ট্র মরেনা। তাই এর ধর্ম থাকতে পারেনা। রাষ্ট্রধর্ম 'তত্বাবধায়ক সরকারের' মত একটি উদ্ভট উদ্ভাবন, যদিও এতে ধর্মান্ধদের পোয়াবারো। দেশ যেমন একটু একটু করে ইসলামী হচ্ছে, আওয়ামী নেতারাও একটু একটু করে রাজনৈতিকভাবে ইসলামী হচ্ছেন বা হতে বাধ্য হচ্ছেন। খেলাফতের সাথে আব্দুল জলিলের চুক্তির কথা সবার মনে থাকার কথা। তখন বলা হয়েছিলো, কৌশলগত কারণে ওটা হয়েছে। কৌশলগত কারণেই হয়তো এখন সবাই একটু একটু করে মুসলমান হচ্ছেন। সম্ভবত: একই কারণে ঢাকার মেয়র হানিফ মরার আগে আওয়ামী লীগের নীতিমালায় 'শরিয়া' অন্তর্ভুক্তির আবদার করেছিলেন। সবাই লক্ষ্য করেছেন যে, নাসিরাবাদ ঘটনার পর প্রতিমন্ত্রী সায়েদুল হক প্রেস-কনফারেন্স করেছেন টুপি পরে। এমনিতে ধর্মীয় কারণে একজন মুসলমান টুপি পড়বেন সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এই টুপি সেই টুপি নয়; এটা 'রাজনৌতিক' টুপি, মানুষকে ধোঁকা দেয়ার রাস্তা। আর একটু পেছনে গেলে দেখা যাবে, নারায়ণগঞ্জের এমপি সেলিম ওসমান যখন শিক্ষক শ্যামল ভক্তকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার ভুয়া ধুঁয়া তুলে 'চরম অপমান' করেছিলেন, তৎপরবর্তী সকল কর্মকান্ডে তার মাথায় টুপি ছিলো। এদের টুপিকে 'মোশতাক টুপি' বললে কি খুব একটা বেমানান হবে?
শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবী এখন ধীর লয়ে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হচ্ছে। ট্রাম্পের বিজয় সেটাকে এগিয়ে দেবে। ফ্রান্স ও জার্মানীতে রক্ষণশীলদের বিজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কেউ কি কখনো ভেবেছেন, পৃথিবীর সব দেশ যদি ধর্মভিত্তিক দেশ হয়, তাহলে কেমন হয়? অর্থাৎ, আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ক্রিস্টান রাষ্ট্র এবং জাপান, শ্রীলংকা বৌদ্ধ বা ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে গেলে কেমন হবে? তারাও যদি বলতে শুরু করে, তাদের দেশে অন্য ধর্মের মানুষ থাকতে পারবেন না, বা অন্য ধর্মের মানুষদের খেদিয়ে বিদায় করে, তাহলে কি হবে? পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র যদি ধর্মীয় রাষ্ট্র হয়ে যায়, তাতে তো কারো আপত্তি থাকার কোন কারণ নাই? আবার দেখুন, সৌদি আরবে গেলে মহিলাদের বাধ্যতামূলক হিজাব পড়তে হয়। এখন ইউৰোপ-আমেরিকা যদি বলে, তাদের দেশে এলে মহিলাদের তাদের মত খোলামেলা ড্রেস পড়তে হবে, তাতে কি খুব অন্যায় হবে? রাষ্ট্রের আইন তো সবাইকে মানতে হবে! এদিক থেকে অবশ্য পুরুষদের সুবিধা আছে, স্যুট-কোট-টাই সর্বত্র সমাদৃত। ঢাকায় একদা দেশবাংলা নামে একটি কাগজ ছিলো, এর মালিক-সম্পাদক ছিলেন ফেরদৌস আহমদ কোরেশী। তিনি বলতেন, একজন হিন্দুকে জনাব বললে তার মনে যেমন ব্যাথা লাগে; একজন মুসলমানের নামের আগে শ্রী লাগালেও তিনি রাগ করেন, কিন্তু এই হিন্দু বা মুসলমানের নামের আগে মিষ্টার যুক্ত করলে কিন্তু কেউ অখুশি হ'ন না।
কথাটা সত্য। আমরা মুসলিম বিশ্বের সাথে পরিচিত। কিন্তু কোন ক্রিস্টান বিশ্ব কিন্তু নাই! থাকলে কেমন হতো? ওআইসি আছে, ওসিসি মানে অর্গানাইজেশন অফ ক্রিষ্টান কান্ট্রিজ নাই। চীন যদি হটাৎ বৌদ্ধ রাষ্ট্র হয়ে যায়, তাহলে কেমন হয়? একেবারেই কি অসম্ভব? সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে বেশ ক'টি মুসলিম রাষ্ট্র এবং বাকিগুলো (ক্রিষ্টান রাষ্ট্র নয়) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে। ফিদেল ক্যাস্ট্রো মারা গেছেন। রাহুল ক্যাস্ট্রোর পর হয়তো কিউবায় সমাজতন্ত্রও মারা যাবে। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে গণতন্ত্রের ওপর কোন সুন্দর ব্যবস্থা নেই; বাংলাদেশ সেই গণতন্ত্র আসুক। আর সাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্র একসাথে থাকতে পারেনা। তাই দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাস্ত করতে হবে। পত্রিকায় দেখলাম, ২৬ নভেম্বর বুয়েট সিভিল সামিটে হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের চালাকি করে গরুর মাংস খাওয়ানো হয়েছে। কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পুনর্মিলনীতে একই কান্ড ঘটেছিলো। আচ্ছা গরুর মাংস খেলে যেমন হিন্দুর হিন্দুত্ব যায়না, তেমনি অন্যকে গরুর মাংস খাইয়ে বেহেস্তের চাবি পাওয়া যায়না, এটা শুধুই হীনমন্যতা। তাও আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে, সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্টানে! ছেলেবেলায় পড়েছিলাম, বিদ্যা বিনয় দান করে। আমাদের ভার্সিটির কর্মকর্তারা কি শুধুই শিক্ষিত, বিনয়ী বা বিদ্বান নন?
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
নিউইয়র্ক। ৫ ডিসেম্বর ২০১৬।
http://www.bhorerkagoj.net/print-edition/2016/12/03/119287.php
বিক্ষোভের পর এবার তিনটি ষ্টেটে ভোট পুন্:গণনার দাবি
ট্রাম্পকে শান্তিতে থাকতে দেয়া হবেনা?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গ্রীনপার্টি প্রার্থী ছিলেন যিল ষ্টেইন, ভোট পেয়েছেন এক শতাংশের কম, কিন্তু এখন বলছেন মিশিগান, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিনের ভোট পুন্:গণনা করতে হবে। এও বলছেন, এতে ফলাফল হয়তো পরিবর্তন হবেনা, কিন্তু বাইরের প্রভাব আছে কিনা তা স্পষ্ট হবে। বাইরের প্রভাব বলতে ইঙ্গিত করা হচ্ছে, 'সাইবার প্রভাব' এবং রাশিয়াকে। হিলারি নিজে কিছু বলেননি, কিন্তু তার ক্যাম্পেইন বলেছে, পুন্:গণনা হলে তারা তাতে যোগ দেবেন। যিল ষ্টেইন গণনার খরচ বাবদ ইতিমধ্যে ৫মিলিয়ন ডলার তুলেছেন। ট্রাম্প এটাকে চাঁদা তোলার ধান্ধা বলে বর্ণনা করে বলেছেন, নির্বাচন শেষ। সোমবার অপর এক টুইটে ট্রাম্প বলেছেন, ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে জিতেছি, পপুলার ভোটেও আমি জয়ী হতাম, কিন্তু হিলারি অনেক অবৈধ ভোট পেয়েছেন। হোয়াইট হাউজ অবশ্য ভোট পুন্:গণনায় তেমন উৎসাহ দেখাচ্ছেনা বরং বলছে, ট্রাম্প ট্র্যানজিশন ভালোমত এগুচ্ছে। মিডিয়া সোমবার বলছে, ইতিমধ্যে ওবামা-ট্রাম্প বেশ কয়েকবার টেলিফোনে কথা হয়েছে এবং সর্বশেষ এই উইকেন্ডে।
কথা হচ্ছে, ভোট পুন্:গণনা আদৌ হবে কিনা? আলগোর যখন কয়েকটি এলাকায় ভোট পুনরায় গণনা চেয়েছিলেন বুশ টিম তখন আদালতের শরণাপন্ন হন, আদালত বুশের পক্ষে রায় দেন। ট্রাম্প টিম সোমবার সেই সম্ভবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তারা মেশিনে ভোট গণনার পক্ষে, হাতে নয়। এনিয়ে পাবলিক শুনানী হওয়ার সম্ভবনা আছে. ক্লিন্টনের সমর্থকদের অনেকেই এনিয়ে অর্থ অপচয়ে রাজি নন। মোদ্ধা কথা হচ্ছে, ভোট পুন্:গণনা যদি হয়ও তাতে রেজাল্ট পরিবর্তনের সম্ভবনা নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী চার বছরের জন্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট। বিজয়ের পর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিলো, তা ধীরে ধীরে প্রশমিত হচ্ছে। বিরুদ্ধবাদীরা এখন বলছেন, আমরা হিলারিকে ভোট দিয়েছি, কিন্তু ট্রাম্প আমাদের প্রেসিডেন্ট। হ্যাঁ, ২০শে জানুয়ারি থেকে ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ইতিমধ্যে ট্রাম্প তার প্রথম একশ' দিনের কর্মসূচি তিনি ঘোষণা করেছেন এবং তাতে বিতর্কিত অনেক কিছুই নাই।
অর্থাৎ ট্রাম্প নরম হচ্ছেন এবং গদিতে বসলে, অনেক বিষয়েই তাকে আপোষ করতে হবে, তিনি আপোষ করবেন, তারকাছে মার্কিন স্বার্থই হবে প্রধান। এখন কেউ কেউ বলছেন ট্রাম্প একজন ভালো প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। ট্রাম্প অবশ্য এখন তার মন্ত্রী পরিষদ গঠন নিয়ে ব্যস্ত আছেন। এ সময়ে তিনি ভালোই খেলছেন। ভাগ্য তার সহায়, হয়তো বৃহস্পতি তুঙ্গে। তার ক্যাবিনেটে রক্ষণশীলরা আসছেন, এতে অনেকে চিন্তিত। তিনি নিজে রক্ষণশীল, তার ক্যাবিনেটে তো সমাজতন্ত্রীদেড় জায়গা হবার কথা নয়। এবারের নির্বাচনটি ছিলো লিবারেল ভার্সেস রক্ষণশীলদের। লিবারেলরা হেরেছেন কিন্তু তাই বলে কি তারা ঘরে বসে থাকবেন? বিনা যুদ্ধে এরা কেউ কাউকে একচুল ছাড় দেবেন না। ডেমোক্রেটরা প্রতি পদে পদে ট্রাম্পকে জ্বালাবেন এবং রিপাবলিকান দলকে সাথে নিয়েই ট্রাম্পকে চার বছর পর আবার জিততে হবে! তাই তার মন্ত্রিসভায় বিদ্রেহীরাও স্থান পাচ্ছেন। মিট রমণী মঙ্গলবার পুনরায় তারসাথে দেখা করছেন। অথচ ট্রাম্পের প্রধান ক্যাম্পেইন ম্যানেজার প্রকাশ্যে রমণীর বিরুদ্ধে।
স্পিকার পল রায়ানের সাথে নির্বাচনী প্রচারণাকালে ট্রাম্পের মতানৈক্য সবার মনে থাকার কথা। এখন দু'জনায় কত মিল; কারণ একজন ছাড়া আর একজন অচল। ট্রাম্প যেই ওবামার চৌদ্ধগোষ্ঠী উদ্ধার করেছেন এবং ওবামাও ট্রাম্পকে যাইচ্ছেতাই বলেছেন, এখন দু'জনে দু'জনার; একে অন্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন। হিলারির বিরুদ্ধে ট্রাম্প কিনা বলেছেন, এখন সুর উল্টা, বলছেন, ই-মেইল বা ক্লিন্টন ফাউন্ডেশনের ব্যাপারে হিলারির বিরুদ্ধে আর কোন ব্যবস্থা তিনি চাননা। ট্রাম্প বদলাচ্ছেন, চেয়ারে বসলে আরো পাল্টাবেন। কারণ, প্রবাদ আছে, 'চেয়ার মেইকস এ পারসন'। আর ট্রাম্পকে অত বোঁকা ভাবার কোন কারণ নেই, মনে রাখতে হবে, ৬জন জীবিত প্রেসিডেন্ট, নিজের দলের বাঘা বাঘা নেতারা, হোয়াইট হাউস, জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট, মিডিয়া বা এস্টাব্লিস্টমেন্টের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি একাই এই ফাইটে জিতেছেন। জেতার পর তিনি এখন আপোষ করছেন এবং জাতীয় ঐক্যের ডাক দিচ্ছেন। এক কালের অনেক ট্রাম্প বিরোধীদের সুর এখন নরম।
ট্রাম্প সাউথ ক্যারোলিনার গভর্নর ভারতীয় বংশোদভূত নিকি হিলিকে জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিয়েছেন। আর একজন ডেমোক্রেট কংগ্রেসম্যান তুলসী গ্যাবার্ড তারসাথে দেখা করেছেন। জল্পনা রয়েছে তুলসী যোগ দিতে পারেন ট্রাম্পের ক্যাবিনেটে। তুলসী ছিলেন বার্নি স্যান্ডার্সের সমর্থক ও এন্টি-হিলারি, এবং ওবামার অনেক কিছুরই বিরুদ্ধে। মিট রমনি দেখা করেছেন ট্রাম্পের সাথে। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে। নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানীর নামও শোনা যাচ্ছে। ট্রাম্প দলকে খুশি রেখে তার ক্যাবিনেট সাজাচ্ছেন। তার চিফ অফ ষ্টাফ রিপাব্লিকান ন্যাশনাল পার্টি চেয়ারম্যান রিনস প্রিবিয়াস সারাক্ষন ট্রামকে সাপোর্ট দিলেও মূলত: স্পিকার রায়ানের সমর্থক। ট্রাম্পের প্রধান স্ট্রাটেজিস্ট স্টিফেন কে ব্যানন কট্টর সাদা ও ক্রিষ্টান এবং মুসলিম-ইহুদী বিরোধী। নিকি হিলি, কৃষাঙ্গ বেন কারসন ও শিক্ষামন্ত্রী বেস্টি ডিভাস কেউ তার পক্ষে ছিলেন না, কিন্তু এরা এখন ক্যাবিনেটে অন্তর্ভুক্ত। জুলিয়ানি বা সারা প্যালনের মত রক্ষণশীল যেমন ট্রাম্পের ক্যাবিনেটে ঠাঁই পাবেন, তেমনি মধ্যপন্থীরাও অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন।
প্রায় সকল সেক্রেটারি এবং গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে সিনেটের অনুমোদন লাগে, ট্রাম্পকে সেদিকেও নজর রাখতে হচ্ছে, যাতে প্রথমেই ধাক্কা না খান। ট্রাম্পের যেকোন বৃহৎ প্রস্তাবনা হাউস ও সিনেটে পাশ হতে হবে। আর কংগ্রেস বা সিনেট প্রেসিডেন্টের কথায় লেফট-রাইট করেনা। তবে যেসব ক্ষেত্রে হাউজের অনুমোদন লাগেনা, সেখানে হয়তো তিনি ছড়ি ঘোরাবেন। তাহলে ট্রাম্প যা বলে এসেছেন তার কিছুই কি হবেনা? হবে। নীচতলার মার্কিনীরা তারা চায় চাকুরী, টাকা। তারা জানে ব্যবসায়ী ট্রাম্প, ব্যবসা আনবেন। ট্রাম্প জেতার পর মার্কিন শেয়ার বাজার তুঙ্গে। ব্যবসায়ীরা উৎসাহিত। নাফটা তিনি নুতন করে সাঁজাতে চাইবেন। যুক্তরাষ্ট্র যাদের নিরাপত্তা দেয়, তাদের হয়তো এখন বাড়তি পয়সা গুনতে হবে। সেটা অন্ততঃ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের জন্যে প্রযোজ্য হবে। ন্যাটোতে এখন যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার ২৪%, সেটা কমে ২০% হলেও বা মন্দ কি? ইমিগ্রেশন প্রশ্নে তিনি কিছু করবেন। মিলিট্যান্ট ইসলামকে 'জূজূ' বানাবেন, যাতে প্রয়োজনে 'জুজুর ভয়' দেখানো যায়। বাইরে চলে যাওয়া ব্যবসা হয়তো তিনি ফিরিয়ে আনতে পারবেন না, কিন্তু আর যেন না যায়, বা কম যায়, সেই ব্যবস্থা নিতে পারেন।
মেস্কিকো সীমান্তে দেয়ালের কথা তিনি হয়তো ভুলে যাবেন। স্মর্তব্য যে, নির্বাচনী প্রচারণাকালে তিনি মেস্কিকো গিয়েছিলেন, সেখানকার প্রেসিডেন্টের সাথে তার কি কথা হয়েছে তা পরিষ্কার নয়, কিন্তু তিনি রমনির চেয়ে কম মেস্কিকান ভোট পাননি! মেস্কিকানরা ক্রিষ্টান, সামাজিক চিত্র আমেরিকার মতই, এরা কঠোর পরিশ্রমী, আমেরিকায় তাদের কদর আছে। হয়তো ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে দেয়াল নিয়ে কথা হবে, এবং দুই জার্মানীর মধ্যেকার বর্তমান প্রতীক দেয়ালের মত একখন্ড দেয়াল হবে? আর মোটামুটি দুই দেশের মধ্যে একটি দেয়াল যদি হয়ও, জার্মানির দেয়ালের মত সেটি ভাঙতে খুব একটা সময় নেবেনা। ওবামা ক্রিষ্টান শরণার্থীদের ঢুকতে দেয়নি, ট্রাম্প দেবেন। মি: ট্রাম্প হয়তো জঙ্গি অধ্যুষিত মুসলিম দেশগুলো থেকে মানুষ আনতে যথেষ্ট সতর্ক হবেন। তবে বর্তমান অবৈধদের ব্যাপারে তাকে কিছু করতে হবে বটে।
তবে ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হলে আইএস হয়তো থাকবেনা বা শক্তিহীন হয়ে পড়বে। ভারত-রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ঘনিষ্ট হতে পারে। তাহলে কি চীন তো বসে থাকবে? এমনিতে চীন-পাকিস্তান দীর্ঘিদিনের সম্পর্ক। এখন নুতন সম্পর্ক গড়ে উঠছে চীন-রাশিয়া-পাকিস্তানের মধ্যে। আমেরিকা যদি নিজের ঘর নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পরে তাহলে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানকে নুতন করে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে। সৌদি আরবকেও। ট্রাম্প ন্যাটোর বিরুদ্ধেও বলেছেন, তাই বলে কি তিনি ন্যাটো থেকে বেরিয়ে যাবেন? মনে হয়না। বিশ্বের অর্থনৈতিক এবং সমরতান্ত্রিক ভারসাম্য কি এত তাড়াতাড়ি বদল হয়ে যাবে? ইউরোপ আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল, আমেরিকা বেরিয়ে এলে ওই স্থান তো নেবে রাশিয়া বা চীন। আমেরিকানরা কি এতোই বোকা? ট্রাম্প ব্যাবসায়ী, ট্রাম্পের অস্ত্র ব্যবসা না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ব্যবসা। যুদ্ধ না থাকলে অস্ত্র বিক্রী হবে কি করে? ট্রাম্প আগে যা বলেছেন তাতে বিশ্বে ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে, সম্ভবত: পেন্টাগন তা হতে দেবেনা।
এদিকে তিনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ষ্টেটে ভোট পুন্:গণনার আবেদন নিয়ে হয়তো কিছুদিন হৈচৈ চলবে। আর একদল আছেন যারা বলেছেন, যেহেতু পপুলার ভোট বেশি পেয়েছেন তাই হিলারির প্রেসিডেন্ট হওয়া উচিত এবং এরা ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি বাতিলের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এরা বলছেন, হিলারির উচিত ফলাফল চ্যালেঞ্জ করা। এদের বক্তব্য, হিলারি চ্যালেঞ্জ করলে, ১৯শে ডিসেম্বর ইলেকটোরাল কলেজ ভোটাররা তাদের ভোটটি ট্রাম্পকে না দিয়ে হিলারিকে দেবেন এবং হিলারি প্রেসিডেন্ট হবেন। এসব-ই পরাজিতের নিষ্ফল কান্না। এতে কান না দেয়া উচিত। হিলারিও কান দেবেন না। এটা ঠিক যে, ট্রাম্প কোন ষ্টেটে জিতলেও আইনগতভাবে ডেলিগেটরা তাকে ভোট দিতে বাধ্য নন, কিন্তু ২২৮বছরের প্রথা কে ভাঙবে, এমন বিশ্বাসঘাতকতা কখনো ঘটেনি, ঘটবেও না। যদি কোনদিন ঘটে সেদিন রক্তক্ষয়ী বিপ্লব ঘটে যাবে। আর ইলেকটোরাল কলেজ ব্যবস্থা বানচালের কোন সম্ভবনা নেই।
তবে ট্রাম্প নির্বাচনে জয়ী হবার পর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে বাঘা বাঘা সাংবাদিকদের এক হাত নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আপনারা তো আমার একটি ভালো ছবিও ছাপাননি! নিউইয়র্কের ডেইলি পোষ্ট হেডিং করেছে: Donald Trump's media summit was a 'f−−−ing firing squad'. যার ভাবানুবাদ সম্ভবত: "ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাংবাদিক সম্মেলন যেন ফায়ারিং স্কোয়াড/ ডেকে এনে মিডিয়ার পশ্চাৎদেশে বাঁশ"! এটাই ট্রাম্পের স্টাইল। ট্রাম্প কাউকে ছেড়ে কথা বলেন না।আর ট্রাম্পের সাথে মার্কিন মিডিয়া এবার যে বিমাতাসুলভ আচরণ করেছে তাতে মিডিয়ার ওটা প্রাপ্য ছিলো। বাংলাদেশের মিডিয়ার আচরণও খুব স্বচ্ছ ছিলোনা। মার্কিন নির্বাচন নিয়ে ঢাকায় এখনো কথাবার্তা হয় এবং সেখানে তাকে 'নির্বোধ' রূপে তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষণীয়। কথায় বলে, হাতির চতুর হবার দরকার পড়েনা, কারণ সে বনের রাজা; চালাক হতে হয় শিয়ালের। তেমনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের চালাক না হলেও চলে।
মার্কিন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রচন্ড ক্ষমতাশীল। তবে বহির্বিশ্বে তিনি যতটা ক্ষমতাশীল দেশের ভেতরে তাকে ততটাই জমাখরচ দিয়ে চলতে হয়। কেউ হয়তো ভাবছেন, কংগ্রেস-সিনেট তো তারই। আসলে তার নয়, রিপাবলিকানদের। আপাতত: ট্রাম্পের পূর্ণাঙ্গ ক্যাবিনেট গঠিত হোক, দেখা যাক বাতাস কোনদিকে ধাবিত হয়। যারা ট্রাম্পের ইম্পিচমেন্টের স্বপ্ন দেখছেন, তাদের বাস্তবে ফিরে আসা উচিত। মার্কিন ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কোন প্রেসিডেন্ট ইমপিচ হননি। নিক্সন ইমপিচের মুখোমুখি হয়ে পদত্যাগ করেন। বিল ক্লিন্টন পার্টি লাইনে ভোটে জেতেন। এবং এন্ড্রু জ্যাকসন ১৮৬৮ সালে মাত্র একভোটের জন্যে বেঁচে যান। ট্রাম্পের বর্তমান মডেল স্ত্রী ম্যালেনিয়া তিন নম্বর বউ.। তার অপূর্ব সুন্দরী কন্যা ইভাঙ্কা সম্ভবত: হোয়াইট হাউজে অলিখিতভাবে মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন। তার স্বামী ইহুদী, তিনিও শ্বশুরের প্রশাসনে জায়গা পাবেন বলে মনে হয়। ট্রাম্পের পুরো পরিবারের একটি ছবি দেখলে যেকেউ বলবেন, চমৎকার। ট্রাম্প সমর্থকরা তাই বলছেন, যার পরিবার এত সুন্দর তিনি খারাপ হতে পারেন না! তবে সাম্প্রতিক সময়ে কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টের এত বড় পরিবার হোয়াইট হাউসের অধিবাসী ছিলেন না।
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
২৮শে নভেম্বর, নিউইয়র্ক।
__._,_.___