http://www.bhorerkagoj.net/pri
মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার
শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬
রোহিঙ্গা নির্যাতন ইস্যুটি স্তিমিত হয়ে আসছে। ইস্যুটি নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। জাতিসংঘের সামনে বেশ কটি সমাবেশ হয়েছে। এমন একটি সমাবেশে রোহিঙ্গাদের জন্যে 'একটি স্বাধীন রাষ্ট্র' দাবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড অনেকের দৃষ্টিতে পড়েছে। তাদের এই দাবিটি যৌক্তিক কি অযৌক্তিক তাতে আমাদের কিচ্ছু আসে-যায় না; কিন্তু এই দাবির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ভেতরে রোহিঙ্গাদের অবস্থান বা তাদের ভূমিকা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা থাকা উচিত। রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমাদের অতি-উৎসাহ বুমেরাং হতে পারে। কদিন আগে একটি সংবাদ দেখেছিলাম, যাতে বলা হয়েছে, বিহারি ক্যাম্পগুলো বারুদের স্ত‚প। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং বিহারি ক্যাম্প দুটোই চেতনার দিক থেকে একই! অথচ আমরা বিহারিদের খেদাতে চাই, আর রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে আন্দোলন করি? মানবিক প্রশ্নে রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থন থাকা ভালো, তবে তাদের জন্য ক্যাম্প বানিয়ে 'বারুদাগার' তৈরি দেশের জন্য শুভ নয়।
আমাদের দেশটি বিচিত্র। এখানে শুধু যে মৌলবাদ বাড়ছে তা নয়, বরং প্রত্যেক সরকারের আমলে 'মুক্তিযোদ্ধার' সংখ্যাও বাড়ছে। বাস্তবে উভয় ক্ষেত্রেই এই সংখ্যাটি প্রতিনিয়ত কমার কথা? মনে হয়, মৌলবাদ বা মুক্তিযোদ্ধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উন্নয়নের পরশ লেগেছে! এ বছর শাহরিয়ার কবির নিউইয়র্কে এলে তাকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান হয়। সেখানে একজন যথেষ্ট আবেগ নিয়ে শাহরিয়ার কবিরকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। উত্তরে শাহরিয়ার কবির বলেন, শর্ষিনার পীর যেই পুরস্কার পেয়েছেন, আমি সেই পুরুস্কার চাই না। পক্ষান্তরে ওবায়দুল কাদের ফুল নিয়ে মান্নাকে দেখতে গিয়ে কি মেসেজ দিলেন তা দুর্বোধ্য নয়, নির্বাচন আসছে। আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার কথা বলেছেন। জামায়াত সামনের নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না, তা মোটামুটি নিশ্চিত, কিন্তু জামায়াতি ভোট নিশ্চিত করতেই কি হেফাজতিদের সঙ্গে দহরম-মহরম?
যা হোক, সামনে নতুন বছর। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। এরপর বইমেলা। শ্রাবণী প্রকাশনীর রবিন আহসানকে বাংলা একাডেমি দুই বছরের জন্য বইমেলায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কারণ তিনি একাডেমির সমালোচনা করেছিলেন। আমরা অযথাই সরকার সমালোচনা শুনতে পারে না বলে অপবাদ দেই; আসলে সমালোচনা শোনার অভ্যাসই আমাদের নেই, আমরা শুধু প্রশংসা শুনতে অভ্যস্ত। আসুন, আমরা তাই ওই ৩০ জন আলেমের প্রশংসা করি, যারা ৩০ জন রোহিঙ্গা নারীকে বিয়ে করেছেন। বাংলা ক্যালেন্ডারে এখন পৌষ মাস, ধারণা করি, আলেমদেরও সব দিক থেকে পৌষ মাস। তবে একটু ভয় এই যে, এরপর রোহিঙ্গা নারীরা কি বাঙালি হবেন, না আলেমরা রোহিঙ্গা হয়ে যাবেন? আমাদের দেশে কিন্তু রাজাকার প্রগতিশীল হয়ে গেছেন এমন উদাহরণ নেই, যদিও মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার হয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি।
এটুকু লেখার পর মনে হচ্ছে, মানে একটি কবিতা মনে পড়ছে : 'মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার…'। আসলেই তো দেশে অনেক প্রশ্নের জবাব নেই? ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির কথা দুধের শিশুও জানে। এই ঘাটতি কমা উচিত। কিন্তু চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ভারতের কয়েকগুণ, দেশবাসী তা জানে না, তাদের জানানো হয় না। কারণ চীন আমাদের বন্ধু, মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের বাঁশ দিয়েছিল! ভারতকে ব্যালান্স করার জন্য আমাদের চীন থেকে সাবমেরিন কিনতে হয়! কারণ আমাদের বিদেশনীতির মূলমন্ত্র হচ্ছে, শত্রু-মিত্র সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। এ জন্য আমরা এখন রাশিয়ার দ্বারস্থ হচ্ছি, আমেরিকাকে বোঝাতে হবে, তুমি চাপ দিলেও রাশিয়া সেই মুক্তিযুদ্ধকালে ষষ্ঠ নৌবহর পাঠিয়ে আমাদের উপকার করেছিল, এখন ব্রেজনেভ নেই কিন্তু বন্ধু পুতিন আছেন।
রাজনীতিতে বাঁশ দেয়া নতুন কিছু নয়, যেমন ওবামা বিদায় নেয়ার আগে ট্রাম্পের জন্য যথেষ্ট বাঁশের ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন। শুধু ওবামা নন, ডেমোক্রেটরাও তাই করছেন। যেমন এবার রেকর্ড সংখ্যক মানুষ ওবামা কেয়ারে রেজিস্ট্রি করেছেন। আবার ট্রাম্প যাতে মুসলমানদের পৃথকভাবে রেজিস্ট্রি না করতে পারেন, তৎজন্য চেষ্টার কোনো কমতি নেই। স্বাধীনতার পরপরই ঘরবাড়ি বানাতে ভারত বাংলাদেশকে বাঁশের খুঁটি দিয়ে সাহায্য করেছিল, পত্রিকা তখন হেডিং করেছে, 'ভারত বাংলাদেশকে বাঁশ দিয়েছে'। ওবামা পুনরায় ট্রাম্পকে বাঁশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার সুযোগ থাকলে তিনি ট্রাম্পকে হারাতে পারতেন। উত্তরে ট্রাম্প বলেছেন, 'নো ওয়ে'। গাজায় ইসরাইলি বসতি স্থাপনের নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘ গৃহীত প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো না দেয়ায় ইসরাইল ওবামা প্রশাসনের ওপর ক্ষেপেছে। ট্রাম্পও ক্ষেপেছেন। তিনি জাতিসংঘকে এলিটদের আড্ডার ক্লাব বলে মন্তব্য করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ২৭টি স্টেট সিরীয় রিফিউজিদের নিতে অস্বীকার করছে, এতে ক্ষেপেছেন ওবামা।
পৃথিবী আজকাল ছোট হয়ে গেছে, তাই দেশের কথা উঠতেই বিদেশের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। আমেরিকায় বসে কেউ যদি আমেরিকার পতাকা পোড়ায় সেটা অপরাধ নয়, দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন ওঠে না। বাংলাদেশেও কেউ পাকিস্তানি পতাকা ওড়ালে দেশপ্রেমের ঘাটতি চোখে পড়ে না। কিন্তু কেউ ভারতের পতাকা নিয়ে রাস্তায় নামলে খবর আছে। যদিও পাকিস্তানি পতাকা নিয়ে রাস্তায় মিছিল হলে কারো চোখে পড়ে না! যেমন পুলিশ নাসিরনগরে হাজার খানেক লোক ধরেছে, কিন্তু প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজেই পাচ্ছে না। আবার এ দেশের কোনো মেয়ে আফ্রিদীকে জড়িয়ে ধরে সেলফি তুললে (এটি খারাপ কিছু নয়) কারো দেশপ্রেমে আঘাত লাগে না, কিন্তু কোনো হিন্দু যদি কোহলিকে জড়িয়ে সেলফি তোলে, নিঃসন্দেহে তিনি ভারতীয় দালাল এবং তার দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করা হবে। আবার বাংলাদেশে কেবল একটি ধর্মের অনুভূতিতেই বারবার আঘাত লাগে, অন্য ধর্মগুলো ক্লোরোফরম দিয়ে অবচেতন করে রাখা হয়েছে, কোনো অনুভূতিই নেই! অনেকটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মতো, কেতাবে আছে, মননে নেই।
এইমাত্র দেখলাম, হান্নান শাহের স্ত্রী অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল! আশা করি তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। তবে এও ভাবলাম, স্বামীর পাপে স্ত্রীর কপালে আগুন? 'পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য' কবিগুরুর এ কথা যদি সত্যি হয়, তবে পতির পাপে স্ত্রী অগ্নিদগ্ধ হতেই পারেন। বৈজ্ঞানিক নিউটনের কথা সবার জানা। গাছ থেকে আপেল কেন মাটিতে পড়ল সেই চিন্তা করতে করতে তিনি 'মধ্যাকর্ষণ' শক্তি আবিষ্কার করেন। এক শিল্পী বা কবি এই দৃশ্যটির একটি কাল্পনিক ছবি আঁকেন, তাতে দেখা যায়, নিউটন আপেল গাছের তলায় বসে আছেন, আর টুপ করে একটি আপেল তার মাথায় পড়ে। পাগলা কবির কল্পনার কিন্তু ওখানেই শেষ নয়, এরপর তিনি কবিতার ভাষায় লেখেন, 'আপেলের বদলে যদি পড়িত তাল, তবে বুঝিতে নিউটন কত ধানে কত চাল…'।
যাক গে, শেষ করব 'মেরি ক্রিস্টমাস' দিয়ে, যদিও বড়দিন পেরিয়ে গেছে। সবাইকে বড়দিনের শুভেচ্ছা। দেশে বড়দিনের এক অনুষ্ঠানে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি খ্রিস্টানদের নিজেদের 'সংখ্যালঘু' না ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন। উত্তম পরামর্শ। মহামান্য আদালত যখন একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছিলেন, তখন যদি প্রতিমন্ত্রী সরকারকে দুটোই বাদ দেয়ার কথা বলতেন। আহা, তখন সবাই ভুলে গেলেন! আর এখন গাছের গোড়া কেটে আগায় জল ঢেলে লাভ কি? রাষ্ট্রধর্ম থাকলে সংখ্যালঘুও থাকবে।
নিউইয়র্ক থেকে
শিতাংশু গুহ : কলাম লেখক।
__._,_.___