''ইন্ডিয়া নিয়া এত উইঠা পইড়া লাগছেন কেন?''
মাঝে মাঝে কেউ কেউ এই ধরণের প্রশ্ন করেন, আজকেও একজন করেছেন। উত্তর দেয়া জরুরী।
বাংলাদেশীরা নিজেদের আইডেন্টি'র ক্যাচাল বাদ দিলে অধিকাংশ সময় দেখা যায় নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়কে আলোচনায় কমই আনে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আওয়ামীলীগ-বিএনপি-জামায়াত-জাপা বা বামপন্থী পরিচয়গুলোকে সামনে রেখেই আমরা আড্ডা, আলোচনা, সমালোচনা, ঝগড়া চালাই। ৭১ এর কারণে আমাদের এখানে ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের আলোচনা খুব কমই হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে ৪৭ এর দেশভাগ বেশ সতেজ।
আগের একটি লেখায় দেখেছি অনিমিত্র চক্রবর্তী নামে পশ্চিমবঙ্গের এক লেখক আওয়ামীলীগের লোকদের ''ইসলামিস্ট'' এবং গণজাগরণ মঞ্চের সাথে সংশ্লিষ্ট স্বঘোষিত নাস্তিক নিহত রাজিব হায়দারকে ''উদারবাদী মুসলিম''(liberal Muslims) বলে চিত্রিত করছে।(১) কারণ, ভারতের জাতীয় চেতনায় দেশভাগের প্রভাব এখনো মারাত্মক।সে আলোকে নির্মিত পরিচয়েই ভারতীয়রা আমাদের বিবেচনা করে।অর্থাৎ, ৪৭ এর চশমা দিয়েই আমাদেরকে মুল্যায়ন করে।
আমরা যখন কে স্যাকুলার, কে প্রগতিশীল,ইসলামিষ্ট, অসাম্প্রদায়িক বা নাস্তিক এসব নিয়ে বিতন্ডা করি, তখন সীমানার ওপারে আমাদের সবাইকে একই ব্রাশ দিয়েই কালার দেয়া হয়ে থাকে। ধর্মের প্রতি আমাদের উন্নাসিকতা যতই থাকুক, ধর্মীয় পরিচয় থেকে মুক্তি মিলছেনা। একই চিত্র ইউরোপ এবং আমেরিকার বেলায়ও সত্য যা ''সাবেক-মুসলমান (Ex-Muslim)'' নামে নতুন প্রজাতির এক গ্রুপকে মিডিয়ায় প্রমোট করা বিষয়ক মন্তব্যে আলাপ করেছিলাম।(২)
ইন্ডিয়া নিয়ে উঠে পড়ে লাগার কারণ ইন্ডিয়া বিদ্বেষ না, বরং আমরা চাই বাংলাদেশীরা ফ্যাক্টসের ভিত্তিতে ইন্ডিয়াকে বুঝুক এবং সেই অনুসারে এক্টিভিজম চালাক। ইন্ডিয়া নিয়ে আলোচনার অন্য কারনও আছে। অনলাইনে যে ঘৃণার ছড়াছড়ি এসবের উৎস খুঁজতে গিয়ে আমাদেরকে বারবার ৪৭ এ ফিরে যেতে হয়। যখনি ৪৭ এর আলোচনায় যাবেন দেখবেন মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে অধিকাংশ বয়ান, যেগুলোর অধিকাংশই ইন্ডিয়া কেন্দ্রিক।বাংলাদেশের মতাদর্শিক সংকটের অন্যতম সুত্র সেসব বয়ানে নিহিত। সেজন্য সেগুলোকে যাচাই করা জরুরী। এই পেইজের আলোচনাগুলো থেকে হয়ত এতদিনে কিছুটা অনুমান করতে পারছেন এসবের প্রয়োজনীয়তা।
ভারতের সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের সকল জাষ্টিফিকেশন হচ্ছে ৪৭ কে কেন্দ্র করে। তাঁদেরকে বলা হয়-তোরা (মুসলমানরা) তো আলাদা দেশ চাইছিলি, এখন ভারতে থাকার কোন অধিকার নেই! বিজেপি, আরএসএস এর পেইজগুলো ঘুরে আসলেই দেখবেন এই জাতীয় আলোচনা। সকল ভারতীয় মুসলমানই সেখানে 'পাকিস্তানী' হিসেবে ট্রিটেড হয়। অর্থাৎ, আমরা না চাইলেও ভারতীয়রা বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীরা আমাদেরকে দেশভাগের সময়ে নিয়ে যাবেই।
অনলাইনে বাংলাদেশী হিন্দুরা কেন নিজের দেশের নাগরিকদের গালাগাল করে, ঘৃণা প্রকাশ করে? সেসব বিষয়ে খুঁজতে গেলে দেখবেন- সংখ্যালঘু নির্যাতনের কাল্পনিক চিত্র, হিন্দু জনসংখ্যা কমে যাওয়া, অর্পিত সম্পত্তি, ৪৬ এর দাঙ্গা, নোয়াখালীর দাঙ্গা ইত্যাদি বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসা হয় বারবার। অর্থাৎ, তোরা (বাঙালী মুসলমান) অতীতেও খারাপ ছিলি, সাম্প্রদায়িক ছিলি এখনো সাম্প্রদায়িক, এই হচ্ছে সোজাসাপ্টা বয়ান।প্রচলিত বয়ান অনুসারে দেশভাগের সব দায় আমাদের-মুসলমানদের! প্রমাণ কি? উইকিপিডিয়া! উইকিপিডিয়ায় বয়ানের স্বার্থে বানোয়াট ইতিহাস লিখে লিখে প্রোপাগান্ডা চলে। কিন্তু যখনই এসব বিষয়ের প্রকৃত চিত্র রেফারেন্স সহ তুলে ধরতে চাই, আসল কারন বুঝতে চাই, বলা হয়-ভাই, এসব পুরাতন কথা কেন তুলছেন?
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের বিরুদ্ধে অন্যায়ের জাষ্টিফিকেশন হচ্ছে- তোদের জ্ঞাতি ভাইরা (বাংলাদেশী মুসলমানেরা) হিন্দুদেরকে মেরে শেষ করে দিচ্ছে...অথচ, বাস্তবতা ভিন্ন। আমরা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের আসল চিত্র তুলে ধরে দেখছি ভারতের তুলনায় তাঁরা অনেক ভাল আছেন।(৩) এরপর সীমানার ওপারের সংখ্যালঘুদের অবস্থা জানার চেষ্টা করলাম, ফ্যাক্টস দেখার চেষ্টা করলাম, তখন থলের বিড়াল বের হয়ে আসছে।
আমরা আরো লক্ষ্য করলাম, পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচারের উৎস হচ্ছে বাংলাদেশের হিন্দুদের দেয়া তথ্য। ৩ আনা সত্যের সাথে ১৩ আনা মিথ্যার মিশেলে বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচার সেখানে চলে। আরো মজার ব্যাপার খেয়াল করলাম, অধিকার চাওয়ার সময় বাংলাদেশী হিন্দুরা ৭১ কে খুঁটি ধরে 'বাঙালী' পরিচয় ধারণ করেন। শুধু তাই নয়, যারা মুসলিম পরিচয় দিতে চায় তাঁদেরকে 'পাকিস্তানি' বানিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে।কিন্তু তাঁরাই আবার কোন কারনে আক্রান্ত হলে ৪৭ সালে নির্ধারিত 'হিন্দু' পরিচয়কে সামনে আনেন! এসব বুঝতে হলেও ৪৭, ভারতীয় বয়ান বুঝা জরুরী।
আশাকরি, প্রোপাগাণ্ডার ওপর ভিত্তি করে যে ঘৃণার চর্চা চলেছে সত্য জানার পর অনেকে সেসব থেকে বের হয়ে আসবেন। যারা নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে (৪), দেশের শত্রু হিসেবে ট্রিট করেন সেই কলকাতার বাবু, ভদ্রলোকেরা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে পেরেশানী দেখান! এর মধ্যে মানবতার উপস্থিতি থাকলেও সেটা হবে ১ আনা আর বাকী ১৫ আনাই রাজনীতি। হাজার বছরের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতা থেকেই এসব করা হয়। সেজন্যই 'ইন্ডিয়া অধ্যয়ন' জরুরী।
নোটঃ
(১) দেখুন; অনিমিত্র চক্রবর্তীর মন্তব্য; ইসলামিস্ট আওয়ামীলীগ ও শেখ মুজিবের কাল্ট নির্মাণের নেপথ্যে https://www.facebook.com/muldharabd/posts/1575711899158794
(২) পশ্চিমে 'সাবেক-মুসলমান' নামে আইডেনটিটি পলিটিক্স
https://www.facebook.com/muldharabd/posts/1595672057162778
(৩) দেখুনঃ বাংলাদেশের সরকারী চাকুরীতে সংখ্যালঘুদের অবস্থান, http://www.muldharabd.com/?p=716
(৪) দেখুন; পশ্চিমবঙ্গ মুসলমানের করুণ অবস্থা স্বত্বেও চলছে অপপ্রচার,https://www.facebook.com/muldharabd/posts/1597315853665065
__._,_.___