'এবারের সংগ্রাম বেঁচে থাকার সংগ্রাম'
শিতাংশু গুহ, ২২ মার্চ ২০২০, নিউইয়র্ক।। এবারের সংগ্রাম, সুস্থ থাকার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম বেঁচে থাকার সংগ্রাম। বেঁচে থাকলে আনন্দফুর্তি করা যাবে, পার্টি করা যাবে, মন্দির-মসজিদে যাওয়া যাবে। বেঁচে না থাকলে কিছুই করা যাবেনা। তাই, আসুন আগে বাঁচি, অন্যকে বাঁচতে সাহায্য করি। করোনা ভাইরাস এই সময়ে পুরো বিশ্বকে একত্রিত করেছে। ঐক্যবদ্ধভাবে এই ভাইরাসকে পরাজিত করতে হবে। প্রশাসনের কথা শুনুন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কথা মানুন। উন্নত দেশগুলো এর নাগরিকদের রক্ষায় সর্বতোভাবে সচেষ্ট রয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত ঘনবসতি, অবহেলা ও অজ্ঞতার কারণে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে রক্ষা থাকবে না! উপমহাদেশের মানুষের 'এন্টিবডি' শক্তিশালী, চৈত্রমাস-তাপমাত্রা বেশি, ধারণা করি, আশা রাখি এজন্যে 'করোনা ভাইরাস' ততটা সুবিধা করতে পারবে না? তবু, ব্যবস্থা নিতে হবে, 'লক-ডাউন' অপরিহার্য। রাশিয়াতে পুটিন বলেছেন, 'দুই সপ্তাহ ঘরে থাকুন, না মানলে পাঁচ বছর জেলে থাকুন'। বাংলাদেশ-ভারতে হয়তো এমনটা প্রয়োজন হতে পারে?
পৃথিবীতে এর আগেও মহামারী'র প্রার্দুভাব ঘটেছে, মানুষ মন্দির/মসজিদে গেছে প্রতিকারের আশায়। পানিপড়া, দোয়া, মন্ত্রের জন্যে ধর্মগুরুদের শরণাপন্ন হয়েছে। এবার পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। সামান্য এক 'করোনা' এবার ধর্মীয় উপাসনালয়ে তালা দিতে সক্ষম হয়েছে। মানুষ ধর্মগুরুদের দিকে যাচ্ছেনা, , ঈশ্বর/আল্লাহ'র দিকে তাকিয়ে নেই, প্রতিকারের জন্যে মানুষ বিজ্ঞানের দিকে তাকাচ্ছে। এরমানে কি ধর্ম ব্যবসায়ীরা থেমে গেছেন, মোটেও তা নয়! তাঁরা আশায় আছেন, 'যদি লাইগ্যা যায়' কোন তরিকা/মন্ত্র? তখন তাঁরা বলবেন, ''আগেই কৈছিলাম না' --? 'ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে'। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী হুজুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ বলেছেন, 'ইসলামে সংক্রামক ব্যাধি নামে কিছু নেই'। ভারতে ঘটা করে কিছু লোক 'গোমূত্র' খাওয়াচ্ছেন। খবরটি'র সত্যমিথ্যা জানিনা, তবু বলছি, কারণ কোন ক্ষতি নেই, হয়তো হাসির? রাশিয়ায় রাস্তাঘাট ফাঁকা রাখতে পুটিন নাকি ৮০০ বাঘ-সিংহ রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছেন!
বাংলাদেশে অনেকে বলতে চাচ্ছেন যে, প্রবাসীরা করোনা ছড়াচ্ছেন? এটি সত্য নয়। বিশ্বে ১৭৬টি দেশ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। উন্নত দেশগুলো তাঁদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ভারত উপদ্রুত চীনের সোয়ান প্রদেশ থেকে এর নাগরিকদের ফিরিয়ে এনেছে, সাথে ১৪জন বাংলাদেশী। এঁরা সবাইকে ১৪দিন কোয়ারেন্টিন রেখেছেন। তারপর ছেড়েছেন। বাংলাদেশে কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা সম্পর্কে হয়তো সুস্পষ্ট ধারণা না থাকায় সবাইকে রাখা সম্ভব হয়নি। দোষ প্রবাসীর নয়। কেরানীগঞ্জে উপজেলা প্রশাসন ৫১ বাড়িতে লাল পতাকা উড়িয়ে প্রবাসী হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। মনে পড়ে একাত্তরে পাকিস্তানীরা 'এইচ' লিখে হিন্দু বাড়ি চিহ্নিত করেছিলো? একটি পোষ্টারে বলা হচ্ছে, 'প্রবাসীদের প্রবেশ নিষেধ'। প্রবাসীরা যেকোন সময় তাদের জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার অধিকার রাখেন। যথাযথ ব্যবস্থা নিলে হয়তো এমন দোষারূপের ঘটনা ঘটতো না! এখন অন্যের দিকে অঙ্গুলি হেলনের সময় নয়, সময় এখন সবাই মিলে করোনা ভাইরাস মহামারী ঠেকানো।
বলিহারি আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের! ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আমরা করোনা ভাইরাসের চেয়েও শক্তিশালী। রিজভী বলেছেন, আওয়ামী লীগ করোনা ভাইরাসের চেয়েও ভয়ানক। আরো কিছু নেতার কথা শুনি? মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, শেখ হাসিনার মতো নেত্রী পেয়েছি বলেই করোনা প্রতিরোধ করতে পারছি। ড: হাসান মাহমুদ বলেছেন, বিএনপি করোনা নিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। শাহরিয়ার আলম বলেছেন, করোনা প্রতিরোধে ঢাকা বিমানবন্দরের মতো ব্যবস্থা উন্নত দেশগুলোতেও নেই। ডঃ আব্দুল মোমেন বলেছেন, করোনা মারাত্মক কোনো রোগ নয়, এটা সর্দি জ্বরের মতো। খালিদ মাহমুদ বলেছেন, শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন কোনো ভাইরাস নিয়েই চিন্তা নেই। এই যখন আমাদের দেশের অবস্থা, তখন আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও সিনেটে ডেমক্রেট দলীয় নেতা চাক শ্যুমার একসাথে বললেন, এখন রাজনীতির সময় নয়, সময় এখন একসাথে করোনা মোকাবেলার। বিভেদ ও রাজনীতি ভুলে বাংলাদেশে এখন সরকার, পুলিশ, মিলিটারি একযোগে কাজ করতে হবে, মানুষকে রক্ষা করতে হবে।
সবাই বলেন, সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ। তাই হয়তো নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নির্বাচন করা সম্ভব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ভোট দিয়েছেন। সরকার সবাইকে ঘরে বসে নামাজ আদায়ের পরামর্শ দিয়েছিলো। নির্দেশ নয়, পরামর্শ? এর বিরুদ্ধে হবিগঞ্জে বিক্ষোভ হয়েছে। রায়পুরে ৫০ হাজার মানুষের দোয়া মাহফিল হয়েছে। রাজবাড়ীর ভবদিয়া গ্রামে এক ব্যক্তি মারা গেছেন, তিনি কি করোনা আক্রান্ত হয়ে মরেছেন না অন্য কোন কারণে মরেছেন, এনিয়ে সংষর্ষে লাবলু মোল্লা নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। আহত ১১। হয়তো রবীন্দ্রনাথ এদের জন্যেই বলেছেন, 'রেখেছো বাঙ্গালী করে মানুষ করোনি'। সংবাদ হচ্ছে, করোনা ভাইরাস নিয়ে যখন পৃথিবী স্তব্ধ তখন খুলনার পাইকগাছার লতা ইউনিয়নের দেলুটী গ্রামে একটি হিন্দু পরিবারকে দেশত্যাগের হুমকী দিয়ে তাদের জমিজমা, মাছের ঘের জবরদখল হয়েছে। আরো একটি খবর হচ্ছে, ফরিদপুরের শিবরামপুরে পান্নু হাওলাদার ও তাঁর তিন গুনধর পুত্র শনিবার সন্ধ্যায় মতিউর রহমানের বাড়িতে হামলা করে প্রায় এক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি করেছেন।
'সোশ্যাল ডিসটেনসিং' বা 'সামাজিক দূরত্ব' বজায় রাখা করোনা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। দেশে দেশে 'লকডাউন' বা 'পজ' সামাজিক দুরুত্ব বজায় রাখার জন্যেই করা হচ্ছে। বাংলাদেশে হুজুররা এর বিরুদ্ধে ধর্মের দোহাই দিয়ে হুঙ্কার ছাড়ছেন। একাত্তরে বেশিরভাগ ধর্মান্ধরা 'ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষার' নামে রাজাকার হয়েছিলেন? এবার না আবার ওয়াজ ও দোয়া মাহফিলের অজুহাতে নিজেদের ব্যবসা ঠিক রাখতে, করোনা মহামারী ছড়িয়ে নুতন করে 'রাজাকার' হয়ে যান? ধর্ম মানুষের জন্যে, ধর্মের জন্যে মানুষ নয়। মানুষ বাঁচলে ধর্ম বাঁচবে। মানুষ না থাকলে ধর্ম থাকবে না! বিশ্বব্যাপী মানুষ এখন বাইরে থেকে ঘরে ঢুকছে। করোনা ভাইরাস যদি ধর্মগুলোকে বাইরে থেকে ঘরে ঢুকিয়ে দিতে পুরোপুরি সক্ষম হতো, তবে পৃথিবীতে ধর্মের নামে হানাহানি হয়তো কিছুটা কমতো। সামাজিক মাধ্যমে কিছু কিছু মানুষ নিজেদের ধর্মের মাহাত্ম্য দেখাতে চাচ্ছেন। তাঁদের জানা উচিত, করোনা ভাইরাস ভয়ানক ধর্মনিরপেক্ষ, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান কাউকেই ছাড়ছে না?
এখন সময় হচ্ছে বিশ্বব্যাপী করোনা প্রতিরোধে একে অপরকে সহায়তা করা। বিশ্ব আবারো প্রমান করছে, 'মানবতা ও সেবাই ধর্ম'। ধারণা করি করোনা ভাইরাস যখন শেষ হবে, পৃথিবী আবার চন্ডিদাসকে স্মরণ করে বলবে, 'সবার উপর মানুষ সত্য--'। একটি আশার বাণী দিয়ে শেষ করবো: এস্ট্রোনমি বাস্তব, যদি সঠিক গণনা করা যায়। এস্ট্রোনমির ওপর ভিত্তি করে বেদিক রিসার্স নামে একটি সংস্থা জানাচ্ছে, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ছিলো 'বলয়গ্রাস সূর্য্যগ্রহণ', সেদিন করোনা ভাইরাসের শুরু। সাধারণত: এই কুফল তিনমাস পর্যন্ত চলে। ৩১শে মার্চ ২০২০ জুপিটার মকর রাশিতে যাবে, অর্থাৎ করোনার কুফল কমতে শুরু করবে। ১৩ই এপ্রিল সূর্য্য মেষ রাশিতে যাবে, এদিন থেকে আরোগ্য শুরু। ১৯ এপ্রিল-২১জুন বেদিক গ্রীষ্ম শুরু, করোনা দুর্বল হতে থাকবে। ২৩শে সেপ্টেম্বর কেতু থেকে বৃশ্চিক, করোনার সমাপ্তি। স্নাতকে আমার 'এস্ট্রোনমি' একটি সাবজেক্ট ছিলো। তখনো বুঝিনি, এখনো কিছু বুঝিনা। তবে এই গণনা সঠিক হলে, 'স্বাগতম'। পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকেই করোনা মুক্তি আসুক, যেভাবেই ঘটুক, সেটাই সু-স্বাগতম। করোনা ভাইরাস নিপাত যাক, মানবতা মুক্তি পাক। # guhasb@gmail.com;