জামায়াতী মদদে কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে জঙ্গী-প্রশিক্ষণ

জোট আমলের সেই প্রভাবশালীরাই এখন আশ্রয় দিতে নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন

শংকর কুমার দে ॥ বিগত তিন দশকে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারের গহীন অরুণ্যে সামরিক ও কমান্ডো জঙ্গী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোটের অন্যতম শরিক দল জামায়াতে ইসলামীর সহায়তায় তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রায় এক যুগ আগে ২০০১ সালে জঙ্গীবিরোধী অভিযানের সময়ে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের প্রধান রোহিঙ্গার সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ সেলিম ওরফে সেলিম উল্লাহকে ওরফে মোহাম্মদকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে দেয়া জবানবন্দীতে এ ধরনের তথ্য উঠে এসেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রভাবশালী ৩ মন্ত্রী ও দুই সাংসদ এবং আইনজীবীদের সহায়তায় জামিন পেয়ে পালিয়ে জাপান চলে যায়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ওইসব মন্ত্রী-এমপিই এখন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে দেশেÑবিদেশে তৎপরতা চালাচ্ছে। মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে অপরাধের বিষ ছড়াচ্ছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বিগত তিন দশকে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী। এসব শরণার্থীকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর জন্য সামরিক ও জঙ্গী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। জামায়াতের অর্থ ও অস্ত্র সহায়তায় প্রশিক্ষণ দেয়ার পর প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে অনেকেই ধরা পড়েছে। আবার অনেকে ধরা পড়ার পর জামিনে মুক্ত হয়ে আত্মগোপনে চলে গেছে। এখনও পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে অসংখ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রোহিঙ্গা।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে সারাদেশে জঙ্গীদের তৎপরতা যখন তুঙ্গে তখন সরকারের ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার সুযোগ নিয়ে জঙ্গী প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য বেছে নেয় রোহিঙ্গাদের। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো থেকে দলে দলে লোকজন এনে গহীন অরণ্যে জড়ো করে জঙ্গী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। জঙ্গী প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও জিহাদে জড়ানোর উস্কানি দেয় জামায়াত-শিবির। কক্সবাজার এলাকার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জিহাদী লিফলেট, বই, সিডিসহ জিহাদী গানের ক্যাসেট বিলি করা হয়।
মিয়ানমার সরকার তখন বাংলাদেশ সরকারের কাছে জামায়াতের নির্দেশে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সামরিক ও জঙ্গী প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যাপারে আপত্তি করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অংশীদার জামায়াত হওয়ার কারণে তখনকার ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এ কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের এখন অবনতি ঘটে। রোহিঙ্গারা কক্সবাজার এলাকায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করার পর থেকেই তাদের সামরিক ও জঙ্গী প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যাপারে নেতৃত্ব ও নির্দেশ দিয়ে আসছে জামায়াতÑশিবির।
দীর্ঘদিন ধরেই জঙ্গীরা কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায় ট্রেনিং নিচ্ছে এমন খবর পুলিশের কানে পৌঁছে। পুলিশ অভিযানে নামে। অভিযানে ১৯৯৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের উখিয়া থেকে ট্রেনিংরত অবস্থায় হুজির ৪০ সদস্য বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে কক্সবাজার থানায় অস্ত্র আইনে মামলা হয়। আদালত গ্রেফতারকৃত হুজি সদস্যদের যাবজ্জীবন সাজা দেয়। পরে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুই স্থানীয় সাংসদ ও ৩ মন্ত্রীর নির্দেশে তাদের জামিনে কারামুক্ত করতে জামায়াত তৎপরতা শুরু করে। পরে অবশ্য বিএনপি-জামায়াত জোটের আশীর্বাদে হুজি সদস্যরা জামিনে ছাড়া পায়। মুক্ত হয়েই আবার তারা গোপনে সংগঠিত হতে থাকে।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে। ২০০০ সালের ১৭ এপ্রিল এনকে পালিত নামে এক পুলিশ কর্মকর্তা কক্সবাজার জেলার উখিয়া সার্কেলের এএসপি হিসেবে দায়িত্ব পান। তিনি ২০০১ সালের জানুয়ারিতে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালান। বাড়ি থেকে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের প্রধান ও রোহিঙ্গার সামরিক শাখার প্রধান কমান্ডার মোহাম্মদ সেলিম ওরফে সেলিম উল্লাহকে গ্রেফতার করেন। সেলিম উল্লাহর সঙ্গে ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলাকারী হুজি নেতা কারাবন্দী মুফতি হান্নান, মুফতি মাওলানা আব্দুস সালাম, আবু জান্দাল, ভারতের তিহার জেলে বন্দী দুই সহোদর আনিসুল মুরসালিন ও মুত্তাকিন, ভারতীয় শীর্ষ জঙ্গী নেতা ওবায়দুল্লাহ, হাবিবুল্লাহ, পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়্যেবার নেতা আমির রেজা খান, খুররম খৈয়াম ছাড়াও বহু জঙ্গীর সঙ্গে তার সখ্য ছিল।
হুজিরা সেলিম মোহাম্মদের কাছ থেকে অস্ত্রও সংগ্রহ করে। সেলিম উল্লাহ গ্রেফতার হওয়ার খবর ঢাকার এমপি হোস্টেলে পৌঁছে। এতে ক্ষিপ্ত হয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুই এমপি। প্রসঙ্গত, সেলিম মোহাম্মদ আরাকানের অধিবাসী। দীর্ঘদিন ওই এলাকায় থাকায় স্থানীয় দুই সাংসদ মোহাম্মদ শাহজালাল ও মোহাম্মদ শাহজাহানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। এই দুই সাংসদ মূলত দুই সহোদর। পরে দুই সাংসদ তাদের বোনকে সেলিম মোহাম্মদের সঙ্গে বিয়ে দেন। এদের একজন বিএনপি থেকে নির্বাচিত সাংসদ। অপরজন জামায়াতে ইসলামী থেকে নির্বাচিত সাংসদ। দুই এমপির বোনের স্বামী হওয়ায় স্থানীয়ভাবে সেলিম উল্লাহ খুবই প্রভাবশালী ছিল।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম উল্লাহ জানিয়েছেন, জামায়াতÑশিবির তাদের অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করে সামরিক ও জঙ্গী প্রশিক্ষণে নেতৃত্ব দিয়েছে। জামায়াতÑশিবিরের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয় যে, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের ওপর গ্রেফতার, হয়রানি, নির্যাতনমূলক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। সেলিম উল্লাহ গ্রেফতারের পর জামিনে ছাড়া পেয়ে জাপানে চলে গেছে বলে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন প্রধান ও রোহিঙ্গা সামরিক কমান্ডার সেলিম উল্লাহর সঙ্গে যে ৪০ জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছিল তাদের মধ্যে হরকত-উল-জিহাদের (হুজি) ও রোহিঙ্গা জঙ্গী ছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে কক্সবাজার এলাকার গহীন অরণ্য থেকে প্রশিক্ষণ দেয়ার সময়ে গ্রেফতার করা হয় জঙ্গীদের। গ্রেফতারের পর তাদের বিচার হয় কক্সবাজার জেলা দায়রা ও জজ আদালতে। রোহিঙ্গা প্রশিক্ষকের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গীদের দেয়া জবানবন্দীতে উল্লেখ করা হয় যে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুই স্থানীয় এমপি ও ৩ মন্ত্রী তাদের জামিন লাভের ব্যাপারে সহযোগিতা করেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী উচ্চ আদালত থেকে জঙ্গীরা জামিনে মুক্তি পাওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করেছে।
গ্রেফতারের খেসারত ॥ রোহিঙ্গার সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের প্রধান ও সামরিক প্রশিক্ষক সেলিম উল্লাহসহ জঙ্গীদের গ্রেফতার করায় কক্সবাজার জেলার উখিয়া সার্কেলের এএসপি এনকে পালিতের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল বিএনপি জামায়াত জোট সরকার। ২০০২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলে জঙ্গী গ্রেফতারকারী পুলিশ কর্মকর্তা এএসপি এনকে পালিতকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে নাশকতা চালানোর মিথ্যা অভিযোগ এনে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাঁকে দফায় দফায় রিমান্ডে নেয়া হয়। রিমান্ডে তাঁকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। রিমান্ডে নিয়ে তাঁর কাছ থেকে সাজানো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বলেছেন, জাতিগত সহিংসতা উস্কে দিতে বাংলাদেশে অবস্থানকারী কিছু রোহিঙ্গা সংগঠককে সশস্র সহায়তা দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। এ জন্য মিয়ানমার সরকার তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে সরকারকে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আইনমন্ত্রী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ রোহিঙ্গাদের দেশের ভেতরে ঢুকতে দেয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেছেন।
ট্রেনিং ক্যাম্প সমাচার ॥ হরকত-উল-জিহাদের (হুজি) প্রধান ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অন্যতম প্রধান আসামি মুফতি হান্নানের পরামর্শে সুনামগঞ্জ জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার পেছনে, নাইক্ষ্যংছড়ি, হিমছড়ি, বিলাইছড়ি, খাগড়াছড়ি, মানিকছড়ি, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, পটিয়া, লালখানবাজার, সিলেট ও কক্সবাজারের উখিয়াসহ আশপাশের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় মাদ্রাসার নামে ১৫টি ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করে জঙ্গীরা। ট্রেনিংয়ের দায়িত্ব পালন করে মুফতি হান্নান, মুফতি মাওলানা আব্দুস সালাম, আফগান ফেরত ভারতীয় শীর্ষ জঙ্গী মুফতি মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ও মাওলানা হাবিবুল্লাহ। পাকিস্তানের শীর্ষ জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়্যেবার শীর্ষ নেতা আমির রেজা খান, খুররম খৈয়াম ওরফে শাহজাহান, মাওলানা আকরাম, মাওলানা আবু খালেক, মাওলানা জালাল উদ্দিনসহ বিদেশী শীর্ষ জঙ্গীরা ট্রেনিং পরিদর্শন করে। পরে জঙ্গীদের মাঝে সনদ বিতরণ করে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ এখাতে অর্থ বরাদ্দ করে।
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে
০ নাফ নদীতে জেলেদের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল ০ নাসাকাকে পতাকা বৈঠকের প্রস্তাব
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে নতুন করে আর কোন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেনি। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। নাফ নদীর বাংলাদেশ সীমান্তে জেলেদের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞাও শিথিল করা হয়েছে। তবে এখনও বন্ধ রয়েছে টেকনাফ স্থলবন্দরের কার্যক্রম। এদিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে ৪২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষা বাহিনী নাসাকাকে পতাকা বৈঠকের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তবে সেখানকার উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে এখনও বৈঠকের দিনক্ষণ ঠিক হয়নি।
বিজিবি কর্মকর্তারা বলছেন, সীমান্ত পরিস্থিতি ক্রমেই স্বাভাবিক হচ্ছে। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের দাঙ্গাকবলিত এলাকাতেও পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। গত তিন দিনে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে নতুন করে আর কোন রোহিঙ্গা অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেনি।
গত সপ্তাহে মিয়ানমারে রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে দাঙ্গা বাধলে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা চালায়। তবে গত দুই দশকে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে চাপে থাকা বাংলাদেশ এবার অনুপ্রবেশে বাধা দেয়। সীমান্ত এলাকায় পাহারা জোরদার করা হয়।
বিজিবির দেয়া হিসেব মতে, মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গার পর থেকে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ চেষ্টাকারী ৭২৮ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। এর মধ্যে ১৩ জন বাদে অন্যদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাকি ১৩ জনকেও ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। এর বাইরে কোস্টগার্ড সদস্যরা ৪৪ জনকে আটক করেছিল, যাদের ইতোমধ্যে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া মিয়ানমারের ঘটনার পর নাফ নদীর টেকনাফ অংশে জেলেদের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা শনিবার থেকে শিথিল করা হয়েছে। বিজিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নাফ নদীতে মাছ ধরার সাময়িক নিষেধাজ্ঞা কিছু বিধিনিষেধ আরোপের মধ্য দিয়ে তুলে নেয়া হচ্ছে। জেলে নৌকাগুলো যাতে অনুপ্রবেশ চেষ্টাকারী রোহিঙ্গাদের বহন করে নিয়ে আনতে না পারে সেদিকে কঠোর নজরদারি থাকবে।
কক্সবাজার থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা এইচএম এরশাদ জানান, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা-রাখাইন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চাঙ্গা করতে জামায়াতের পক্ষে পাঠানো পনের বোতল পেট্রোল উদ্ধার করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। শনিবার সকালে মংডু কাহারিপাড়ায় এক সন্ত্রাসী রোহিঙ্গার বাড়ি থেকে পেট্রোল ভর্তি ওসব বোতল উদ্ধার করা হয়েছে বলে সীমান্তের একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
টেকনাফ ও উখিয়ার শরণার্থী শিবির ও বস্তিতে অবস্থানরত রোহিঙ্গা সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আরও চাঙ্গা করে তুলতে পেট্রোলের বোতলগুলো মিয়ানমারে পাঠিয়েছিল বলে জানা গেছে। কক্সবাজার ও বান্দরবানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এবং শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠনকে আগে থেকেই সশস্ত্র সহায়তা প্রদান করে আসছিল জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মীরা। টেকনাফ-উখিয়ায় আশ্রিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ মৌলবাদী জামায়াত নেতাকর্মীদের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় নিষিদ্ধ ঘোষিত আরএসও, আরএনও, এআরএনও, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠন হরকাতুল জিহাদ, হিজবুত তাহরীর, আলহারামাইন ও আল্লার দলসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের গোপন অপতৎপরতার সঙ্গে লিপ্ত রয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা-রাখাইন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে পুঁজি করে সীমান্ত পরিস্থিতি ঘোলাটে করে ব্যাপকহারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটানোর জামায়াত-শিবিরের সেই ফন্দি-ফিকির নস্যাত করে দিয়েছে স্থানীয় জনগণ। জামায়াতের হীন উদ্দেশ্য সফল করতে মিথ্যা অপপ্রচার ও গুজব ছড়িয়ে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে লাগানো শত শত পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছে স্থানীয়রা। শনিবার দৈনিক জনকণ্ঠে এ সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় জনগণ। তারা দলবদ্ধভাবে শহরের রোমালিয়ারছড়া, হাসেমিয়া গেট, আলীর জাহাল, সাহিত্যিকা পল্লী, চৌধুরীপাড়া, লারপাড়া, উপজেলা বাজারসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদরদী জামায়াত-শিবিরের লাগানো ওসব পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে।
মিয়ানমার থেকে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, শনিবার সেদেশের সেনাবাহিনী ১৫টি পেট্রোলের বোতল উদ্ধার করার পর আরাকানজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় চলছে। শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠনকে সশস্ত্র ট্রেনিং ও সহায়তাদানকারী জামায়াতের পক্ষে কোন অস্ত্রশস্ত্র মিয়ানমারে পাঠিয়েছে কি-না, সে বিষয়কে কেন্দ্র করে সেদেশের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশ বিভিন্ন রোহিঙ্গা পল্লীর সন্দেহাতীত স্থানে খোঁজ-খবর ও তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে। উদ্ধারকৃত ১৫ বোতল পেট্রোল বাংলাদেশ থেকে সেখানে রোহিঙ্গারা নিয়েছে বলে সেদেশের লুণ্ঠিনের কাছে স্বীকার করেছে বলে সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা-রাখাইন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বসবাসকারী রাখাইনদের ওপর যাতে কোন রকমের সমস্যা সৃষ্টি না হয়, এ লক্ষ্যে স্থানীয় প্রশাসন ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রাখাইন পল্লীগুলোতে বিজিবি-পুলিশ নিয়মিত টহল দিচ্ছে। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছে পুরো কক্সবাজার জেলা। বিশেষ করে রাখাইন উপজাতিসহ সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে কেউ যাতে রাজনীতি করতে না পারে, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে ব্যাপক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা।
কক্সবাজারে কর্মরত সাংবাদিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে জেলা প্রশাসন সম্মেলন কক্ষে শুক্রবার সকালে অনুষ্ঠিত এক সভায় জেলা প্রশাসক জয়নুল বারী বলেন, সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের টহল জোরদার রয়েছে। সীমান্ত পরিস্থিতি এখন অনেকটা শান্ত। তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে পত্রিকা কিংবা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় উস্কানিমূলক সংবাদ পরিহার করতে হবে। কোন মহলের স্বার্থ হাসিল হয়, এমন সংবাদ পরিবেশন করা থেকেও সংযত হওয়ার জন্য সাংবাদিকদের আহ্বান জানান তিনি।
টেকনাফ থেকে সংবাদদাতা জানিয়েছেন, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কাজ কারবারে টেকনাফ-উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারা ত্যক্তবিরক্ত। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষাবৃত্তির ছদ্মাবরণে ঘরবাড়ি-দোকানপাটে ছিঁচকে চুরি, কারেন্ট জাল নিয়ে সমুদ্র সৈকত-নাফ নদীতে শামুক-ঝিনুক ও চিংড়ির পোনা আহরণের মাধ্যমে সমুদ্র-নদীর বিভিন্ন প্রজাতির পোনা ধ্বংস, বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজের নামে গৃহকর্তা কিংবা উঠতি বয়সীদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে পারিবরিক অস্থিরতা, জ্বালানির জন্য লাকড়ি সংগ্রহের নামে সংরক্ষিত-সামাজিক বনায়ন থেকে মূল্যবান গাছ কেটে বনাঞ্চল উজাড়, পাহাড়-টিলা-উপত্যকা দখল করে অবৈধ বসতি স্থাপন, উপজেলার বিভিন্ন সড়ক-জনপদ-মেঠোপথ-দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় প্রতিনিয়ত ঘরবাড়ি-দোকানপাট-গৃহস্থের মূল্যবান মালামাল, আসবাবপত্র, গরু-ছাগল চুরি, ছিনতাই, পৈশাচিকভাবে খুন, লোমহর্ষক ডাকাতি, ভদ্রতার মুখোশে পকেটমারা, অমানবিক লোলুপতায় ধর্ষণ, ধর্মীয় লেবাসে জঙ্গী কানেকশনসহ নানা অপরাধ করে এক সময়ের অসহায়-নির্যাতিত শরণার্থী মিয়ানমারের আরকানী রোহিঙ্গারা এখন টেকনাফ-উখিয়ার মানুষের কাছে বিষ ফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে।
কারও কারও মতে পর্যটন নগরী কক্সবাজার, সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ ও উখিয়ায় রোহিঙ্গা আগ্রাসন আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে। হাজার একর বনভূমি ও লোকালয়ে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অবৈধ বসবাস করে জীবিকার তাগিদে নির্বিচারে ধ্বংস করছে বনজ সম্পদ। স্থানীয় শ্রমবাজারসহ বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা। তাছাড়া চুরি, ডাকাতি, খুন, রাহাজানি, আদম পাচার, সাগরে জলদস্যুতাসহ অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকার পরিবেশ বিষিয়ে তুলেছে। তাদের কারণে স্থানীয়রা এক প্রকার সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। সীমান্ত এলাকায় কর্তৃত্ব চলছে রোহিঙ্গা নাগরিকদের। মুসলিম এইড, ইসলামিক রিলিফ, এসিএফ, হ্যান্ডিক্যাপ, সলিডরিটিজ, টাই, এমএসএফ হল্যান্ড নামের বিভিন্ন এনজিও সংস্থা মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয়, জেলা ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহায়তায় রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। ইস্যু জিইয়ে রাখছে।
মিয়ানমারের আরকান প্রদেশে সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা-রাখাইন সংঘর্ষের পর টেকনাফ-উখিয়ায় অবস্থিত দু'শরণার্থী শিবিরে সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, ওই দু'শরণার্থী শিবিরে ২৭ হাজার রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। শিবিরের বাইরে বিভিন্ন বস্তি নির্মাণ করে আরও লক্ষাধিক অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বসবাস করছে। এসব রোহিঙ্গার একটি বড় অংশ মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় নিষিদ্ধ ঘোষিত আরএসও, আরএনও ও আন্তর্জাতিক নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠন হরকাতুল জিহাদ, হিযবুত তাহরীর, আলহারামাইন ও আল্লার দলসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের গোপন তৎপরতার সঙ্গে লিপ্ত আছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৭৮ সালে তৎকালীন জিয়া সরকারের আমলে শরণার্থী হিসেবে এদেশে রোহিঙ্গাদের প্রথম আগমন ঘটে। ওই সময় টেকনাফ, উখিয়া, রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত অতিক্রম করে প্রায় দু'লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে সরকার প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করে। পরবর্তীতে দু'দেশের সফল কূটনৈতিক তৎপরতায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ওই সময় প্রায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে গেলেও বাকিরা কক্সবাজারের বিভিন্ন বন-জঙ্গল ও লোকালয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করে। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে দ্বিতীয় দফায় সীমান্তের নাফ নদী অতিক্রম করে ২ লাখ ৫০ হাজার ৮শ' ৭৭ জন রোহিঙ্গা টেকনাফ, উখিয়া, রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করে। ওই সময় বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমার সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দফায় দফায় বৈঠক করে পুনরায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চালু করে। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫শ' ৯৯ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হলেও টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে ১ হাজার ৭শ' ৬৮ পরিবারে ১৪ হাজার ৭শ' ৮৬ জন এবং উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ১ হাজার ১শ' ৯৭ পরিবারে ১০ হাজার ২শ' ৪৮ জনসহ ২৫ হাজার ৩৪ জন নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
১৯৯৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৫ বছরে আর কোন প্রত্যাবসন তো হয়নি; উল্টো ওই ১৫ বছরে টেকনাফ-উখিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করে উল্লিখিত এনজিও সংস্থার প্রত্যক্ষ মদদে বস্তি নির্মাণ করে টেকনাফের লেদা এলাকায় ১৪ হাজার ২শ' ৭৫ জন এবং উখিয়ার টিভি টাওয়ার সংলগ্ন এলাকায় ১২ হাজার ৫শ' ৩৪ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু অনিবন্ধিতভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
কক্সবাজারে শরণার্থী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতরের তথ্যানুযায়ী ১৯৯১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ২০ বছরে টেকনাফ-উখিয়ার দু'শরণার্থী শিবিরে ৪৬ হাজার ৭শ' ৬৫ জন শিশু জন্ম নিয়েছে। এরমধ্যে মারা গেছে ১০ হাজার ৬শ' ৩৬ জন। বাকি ৩৬ হাজার ৬শ' ৩৬ রোহিঙ্গা শিশু দু'শরণার্থী শিবিরে বেড়ে উঠছে। যাদের বয়স এখন ১-২০ বছর পর্যন্ত। শরণার্থী শিবিরে জন্ম নেয়া এসব শিশু- যারা বর্তমানে কৈশোর-তরুণ ও যৌবনে পা রেখেছে- তারা এখন বাংলাদেশের নাগরিক দাবি করে বেড়াচ্ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত কতিপয় এনজিও সংস্থা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের উৎসাহিত করার কারণে এদেশে জন্ম নেয়া উঠতি বয়সের যুবক-যুবতীরা প্রকাশ্যে প্রত্যাবাসন বিরোধী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে।
ইতোমধ্যে ২০০৯ সালের নবেম্বর মাসে নতুন করে আরও ৪০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে টেকনাফ ও উখিয়া শরণার্থী ক্যাম্পের পাশে সরকারী বনভূমি দখল করে ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস শুরু করে আসছে। অনেক সময় তাদের উচ্ছেদ করতে গেলে রোহিঙ্গা ও বন কর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। উক্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিতসহ ৭ দফা দাবি সংবলিত স্মারকলিপি টেকনাফ-উখিয়ার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দফতরে প্রেরণ করেছে অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদ। এরপরও অদ্যাবধি রোহিঙ্গা প্রতিরোধের চেয়ে অনুপ্রবেশ গাণিতিক হারে বেড়েই চলেছে।
গত ২০১০ সালের শুরু থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে দু'দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কূটনৈতিক পর্যায়ে একাধিকবার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরের সময় দু'দেশের সরকার প্রধান পর্যায়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইতোমধ্যে দু'দেশ প্রত্যাবাসন বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ শুরু করলে উল্লিখিত মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের ইশারায় এনজিও সংস্থাগুলো অপতৎপরতা শুরু করে দেয়। এমতাবস্থায় মিয়ানমারের টাংগোপ প্রদেশে সৃষ্ট বিচ্ছিন্ন ও তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবারও রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে প্রত্যাবাসনের জন্য তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে তা সম্ভব হয়নি। এ সমস্যার সমাধান কি আদৌ হবে!
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী শিবির ও লেদা ভাসমান রোহিঙ্গা বস্তির কয়েক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে অনুমিত হয় তারা শর্তসাপেক্ষ প্রত্যাবাসনের পক্ষে। ভাসমান রোহিঙ্গা বস্তিতে অবস্থানরত মংডু এলাকার মৃত নূর আহমদের পুত্র মোঃ ছালেহ (৪৫), মৃত কালুর পুত্র মোঃ ইউনুছ (৪৮), মৃত নজির হোছনের পুত্র দিল মোহাম্মদ (৫৫) বলেন, 'আঁরারে দুঁরাই (প্রত্যাবাসন) দিয়া ন'ফরিব। এড়ে (মিয়ানমারে ) আঁরারে জোর গরি পাঠাইলে দইজ্জা আঁচুরি পরান দিওইম। জোর করে পাঠালে নিজেরা নাফ নদীতে প্রাণ দেবে। এড়ে আঁরারে ধর্ম গইত্ত ন'দে, মজসিদ ভাঙ্গি জাদি বানাইয়ে, ও¹াতুন দু'য়া বিয়া গইত্ত ন'দে, জাগা জমিন হারি ল' (কেড়ে নেয়), হাঁস-কুরা-গরু-ছ'অল ডঁর অইলে লইযাগই, তারবাদে খাই ফেলা, আঁরার ঘরত ডঁ'অর অইয়া (কিশোরী থেকে বালিকা-যুবতী হলে) সুন্দর-সান্দর মাইয়া-পোয়াইন মগ'র জোয়ান পোয়াইন্দে ইজ্জত হানি গরে। এতল্লা (এ কারণে) আঁরা সহ্য গরি ন'ফারি এদেশত আয় গিয়িগই। ইন বে¹ুলুন ফাসালা ন'ইলে (এসব অত্যচার-নির্যাতন বন্ধ না হলে) আঁরারে দুঁরাই (প্রত্যাবাসন) দিয়া ন'ফারিব (করতে পারবে না)।'
বাম গণতান্ত্রিক শক্তির উদ্বেগ ॥ মিয়ানমারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে কক্সবাজারের বাম গণতান্ত্রিক দলের নেতৃবৃন্দ এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে দাঙ্গা পরিস্থিতি আর নেই। বলতে গেলে মিয়ানমার এখন মোটামুটি শান্ত। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের অনতিবিলম্বে এগিয়ে আসা উচিত। এ ধরনের জুলুম-অত্যাচার সভ্য সমাজ কখনও মেনে নেবে না এটা ঠিক। কিন্তু এ পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে যাতে মৌলবাদী চক্র একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করতে না পারে, সেদিকে সরকার তথা জনগণকে সজাগ থাকতে হবে। বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষও মিয়ানমার একজন নাগরিক বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে অরাজকতা সৃষ্টি করুক সেটা কামনা করেন না।