সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন খালেদা
এম রফিক রাফি
ঢাকা, ১৬ জানুয়ারি- সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। গুলশান কার্যালয়ে এই প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের জন্য ত্যাগী নেতাকর্মীরা দলের চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে পারছেন না। একটা শ্রেণী ইচ্ছা করেই খালেদা জিয়াকে নেতাকর্মীদের কাছ থেকে দূরে রাখছে। তবে এই সিন্ডিকেটের সদ্যদের উপঢৌকন দিলে চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা মিলে। এমন অভিযোগ নেতাকর্মীদের।
জানা গেছে, চেয়ারপারসনের গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে রয়েছে একাধিক সিন্ডিকেট। এদের মধ্যে কয়েকজন শোকেসের নেতাও আছেন, যাদের কোনো কর্মসূচিতেই দেখা যায় না। তারাই বিএনপির চেয়ারপারসনের চারপাশ ঘিরে রেখে মূলধারার নেতাদের সাক্ষাৎ করতে দেন না। ফলে মাঠের নেতাদের কোনো খবরই জানতে পরেন না খালেদা জিয়া। তাদের কারণে নেতাকর্মী ও মিডিয়ার সঙ্গেও চেয়ারপারসনের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। এ নিয়ে সাক্ষাৎ প্রত্যাশীসহ সাধারণ নেতাকর্মীদের ক্ষোভের অন্ত নেই। এমনই এক ঘটনা ঘটে বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে।
হোটেল ওয়েস্টিনে বুধবার সংবাদ সম্মেলন শেষে বাসায় ফিরে যান খালেদা জিয়া। রাত পৌনে ৯টার দিকে কার্যালয়ে আসেন তিনি। এসময় অন্যান্য দিনের চেয়ে কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল কম। চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে প্রত্যাশী বেশ কয়েকজন ওয়েটিং রুমে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। এদের একজন মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি রফিকুল ইসলাম মাহতাব।
রাত সাড়ে ৯টার দিকে চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য উপরে যেতে চাইলে সিএসএফ (চেয়ারপারসনের সিকিউরিটি ফোর্স) তাকে বাধা দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি উঠেন। তিনি বলতে থাকেন, 'আমি নির্বাহী কমিটির সদস্য, অঙ্গসংগঠনের সভাপতি ও একজন মুক্তিযোদ্ধা। অথচ আমাকে ম্যাডামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতে দেয়া হচ্ছে না।'
তিনি বলেন, 'আমি রাজপথের রাজনীতি করি। চুরি করি না, দুর্নীতি করি না। আমি সব জানি। এও জানি কারা ঘুষ নিয়ে ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করায়। ঘুষ খাওয়ার একটা সীমা থাকে। ম্যাডাম নিচে নামার সময় আমি সব বলে দেবো।'
তার চেঁচামেচি শুনে চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফার নুরুদ্দিন আহমেদ নুরু এসে তাকে উপরে নিয়ে যান।
এসময় যুবদলের সদস্য হাজী ইউসুফকেও উচ্চস্বরে বলতে শোনা যায়, 'তিনি (রফিকুল ইসলাম মাহতাব) দীর্ঘদিন একটা সংগঠনের প্রেসিডেন্ট, অথচ তাকে যেতে দেয়া হয় না।'
তিনি বলেন, 'আমরা তো সবই দেখি, রাস্তা থেকে ডেকে উপরে নিয়ে যাওয়া হয় অথচ আমাদের যেতে দেয়া হয় না। গুলশান অফিসে একটা সিন্ডিকেট আছে। এই সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। এরা ম্যাডামকে ঘিরে রেখেছে। প্রকৃত নেতাকর্মীদের ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে দেয় না। সাক্ষাৎ করতে দিলেই চেয়ারপারসন সবকিছু জেনে যাবেন, এই জন্য দেখা করতে দেয়া হয় না। এদের জন্যই বিএনপির আজ এই অবস্থা।'
তখন তিনি ক্ষেপে গিয়ে সিএসএফকে জানাতে বলেন কারা নেতাকর্মীদের মাডামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নিষেধ করে?
জানা গেছে, গুলশান কার্যালয়ে চেয়ারপারসনকে ঘিরে রয়েছে একাধিক বলয়। এসব বলয়ের লোকজন তাদের পছন্দের লোকজন ছাড়া কাউকে চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দিতে চান না।
সূত্র জানায়, চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন তার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। তিনি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। প্রেস সচিব মারুফ কামাল সোহেলও কার্যালয়মুখি নন। এর সুযোগ নিয়েছেন গুলশান কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা, যিনি ইঞ্জিনিয়ারও। তার নেক নজরের ওপর ভাগ্য নির্ধারিত হয় চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের।
গত সোমবার রাজশাহী থেকে চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করতে আসেন নির্বাহী কমিটির এক সদস্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, 'দুইদিন ধরে ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করার জন্য গুলশান কার্যালয়ে আসছি কিন্তু দেখা করতে পারছি না। কর্মকর্তারা বলছেন নিষেধ আছে। কার নিষেধ আছে তা তারা বলছেন না।' অনেকক্ষণ বসে থাকার পর খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে না পেরে অবশেষে চলেই যান তিনি।
সূত্রে জানা গেছে, সিন্ডিকেট ছাড়াও গুলশান কার্যালয়ে প্রবেশ ও চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সিএসএফ সদস্যরা। যেখানে রাজপথের ত্যাগী অনেক নেতাকর্মী চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ তো দূরের কথা কার্যালয়েই ঢুকতে পারে না। অবশ্য সিএসএফকে 'ম্যানেজ' করে অনেকেই আবার কার্যালয়ে প্রবেশ করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক ছাত্রনেতা ও যুবদলের এক সহ-সভাপতি এ প্রতিবেদককে বলেন, 'চেয়ারপারসনের সঙ্গে নেতাকর্মীদের কথা বলার এমন প্রতিবন্ধকতা আগে ছিল না। ১৯৯১ থেকে ৯৬ তে বিএনপি যখন সরকারি দলে তখনও প্রতিদিন সন্ধ্যায় ম্যাডাম আসতেন সুগন্ধায়। সবস্তরের নেতাকর্মীরা ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলতেন। ৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত বিএনপি যখন বিরোধী দলে তখনও ম্যাডামের সঙ্গে মিন্টু রোডে দেখা করতে যেতেন ঢাকাসহ সারাদেশ থেকে আসা নেতাকর্মীরা। প্রতিদিন তিনি সবার কথা শুনতেন।'
তিনি বলেন, '২০০১ থেকে ০৬ সারের মধ্যে হাওয়া ভবনেও নেতাকর্মীরা ম্যাডাম ও তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলতে পারতো। অবশ্য তখন তারেক ভাই সবার কথা শুনতেন, তাই ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলার অতটা প্রয়োজন হয়নি।'
তিনি আরো বলেন, '২০০৮ এর পরেও নেতাকর্মীরা গুলশান কার্যালয়ে ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলতে পারতো। কিন্তু ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে কাউন্সিল হওয়ার পর পদবঞ্চিতরা গুলশানে গিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ জানাতে থাকলে সুবিধাবাদীরা নতুন অলিখিত আইন জারি করে অনুমতি ছাড়া ম্যাডমের সঙ্গে দেখা করা যাবে না।'
যুবদলের এ নেতা বলেন, 'এখন বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা, নির্বাহী কমিটির সম্পদক, ছাত্রদল, যুবদল, শ্রমিকদল, স্বেচ্ছাসেবকদল, মহিলাদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়া কাউকেই উপরে যেতে দেয়া হয় না। যেতে হলে অনুমতি নিতে হয়। এতে করে নেতাকর্মীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন চেয়ারপারসন।'
তিনি বলেন, 'আগে ম্যাডামের চারপাশে ছিলেন নেতারা। তারা নেতাকর্মীদের বুঝতেন। আর এখন ম্যাডামকে ঘিরে আছে আমলারা। তারা ম্যাডামকে বৃত্তে বন্দী করে ফেলেছে। ম্যাডামকে এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রাজপথের নেতাকর্মীদের সুখ-দুঃখের কথা শুনতে হবে, মূল্যায়ন করতে হবে। তবেই বিএনপি আবার ঘুরে দাঁড়াবে। আন্দোলন সফল হবে।'
বিএনপির কেন্দ্রীয় মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম বলেন, 'বিভিন্ন কারণে গুলশান অফিসে সবাই ম্যাডামের কাছে যেতে পারে না। যার কারণে ওনার (খালেদা জিয়ার) পার্টি অফিসে (নয়াপল্টন) যাওয়া দরকার।'
দলটির নির্বাহী কমিটির সদস্য রফিক শিকদার বলেন, 'গুলশান অফিসে গিয়ে ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। সবস্তরের নেতাকর্মীদের জন্য ম্যাডামের দ্বার উন্মুক্ত হওয়া উচিৎ।'
- See more at: http://www.deshebideshe.com/news/details/25147#sthash.nJ2v0BLq.dpuf
Also Read: