পুলিশি গ্রেফতারবাণিজ্যে শিকার নিরীহ মানুষ চরম ভয়, উৎকন্ঠা ও হতাশ; বিপন্ন জনমনে সৃষ্টি করছে শোচনীয় অসন্তোষ ।
চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় অনেক নিরাপরাধ মানুষকেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আটক করছে বলে অভিযোগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অনেককে আবার মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে ছেড়েও দেয়া হচ্ছে। অন্যথায় নাশকতার মামলায় জড়িয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে।
১৭ই জানুয়ারি-২০১৫ রাত সাড়ে দশটায় গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল রাজধানীর খিলগাঁও এলাকা থেকে এক ব্যবসায়ীকে আটক করে নিয়ে যায়।
নিরাপত্তা জনিত কারণে ওই ব্যবসায়ী পরিচয় প্রকাশে নারাজ। তাকে আটক করে নাশকতার মামলায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে আড়াই লাখ টাকা নিয়ে দুই দিন পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
দক্ষিণখানের ব্যাবসায়ী ফায়েজ আলী পঙ্গু হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কাতরাচ্ছে। অভিযোগ- কোনো দলীয় পরিচয় না থাকলেও তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে, টাকা না দেয়ায় তার পায়ে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করা হয়।
৫ জানুয়ারি-২০১৫ থেকে ২০দলীয় জোটের সর্বনাশা হরতাল-অবরোধে সংঘটিত সহিংস ঘটনাকে কেন্দ্র করে মানুষের চরম ভয়, উৎকন্ঠা ও হতাশার মধ্যে সন্ত্রাসী গ্রেফতারের নামে চলছে কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তার অর্থবাণিজ্য। বিশেষ করে যেসব এলাকায় হরতাল-অবরোধে বাস-ট্রাক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে এবং মামলা হচ্ছে সেখানেই পুলিশের অর্থবাণিজ্য বেশি।
চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের সাথে সাথে সাধারণ মানুষকে ধরে অজ্ঞাতনামা আসামির নামে বোমাসহ চালান করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে নিরীহ মানুষের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। আর এতে পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে।
হরতাল ও লাগাতার অবরোধে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে, কিন্তু তার বিপরীতে চলছে পুলিশের চলছে রমরমা গ্রেফতারবাণিজ্য ।
অবরোধের নামে পেট্রোলবোমা ও ককটেল হামলা চালিয়ে দল বা জোটবিশেষের সন্ত্রাসী ক্যাডাররা সাধারণ মানুষের মানবাধিকার কেড়ে নিচ্ছে। জননিরাপত্তার দায়িত্ব যাদের, সে-ই পুলিশের কোনো কোনো বিপথগামী সদস্য সাধারণ মানুষের এই দুর্দিনে বোমাবাজদের দমন করার বদলে নিরপরাধ লোকজনকে গ্রেফতার করে নাশকতার মামলায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে উৎকোচ বা মুক্তিপণ আদায় করছে। যারা ব্যর্থ হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে নাশকতার অভিযোগ।
সর্বনাশা অবরোধ-হরতাল আহ্বানকারীদের পেট্রোলবোমা ও ককটেল চার্জ যেমন জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি করছে; ঠিক তেমনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিপথগামী সদস্যদের গ্রেফতারবাণিজ্যও জনমনে সৃষ্টি করছে অসন্তোষ। অভিযোগ উঠেছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অসৎ সদস্যরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আওয়ামী পরিবারের তরুণ সদস্যদেরও বোমাবাজ অভিধায় অভিযুক্ত করে মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করছে। বিরোধী দলের নিরীহ কর্মীদেরও একইভাবে হয়রানি করা হচ্ছে কল্পিত অভিযোগ তুলে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ নিরীহ মানুষদের অবস্থা কী শোচনীয় তা বলাই বাহুল্য।
পেট্রোলবোমা ও ককটেল ছোড়ার অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের পক্ষে বহু স্থানে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতা-কর্মীরা অবস্থান নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ভুয়া হওয়ার কারণে। দেশের সাধারণ মানুষের মানবাধিকার ও জীবনের নিরাপত্তা কেড়ে নিচ্ছে ঘৃণিত বোমাবাজরা। তাদের গ্রেফতার করে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব হলেও তার ব্যত্যয় হওয়ায় বোমাবাজদের দৌরাত্ম্য কমছে না। সম্ভাব্য সহিংসতা রোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো যেসব অভিযান চালাচ্ছে তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈধতার সীমা অতিক্রম করছে এমন অভিযোগও শোনা যাচ্ছে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের পাশাপাশি চলছে সাধারণ নাগরিকদের হয়রানি করার অনভিপ্রেত কর্মকা-। রাজনীতির সাতপাঁচে নেই এমন লোকজনকে গ্রেফতার করে পকেট পূর্তির অনৈতিক কাজে যেভাবে পুলিশের কিছু দুর্নীতিবাজ সদস্য লিপ্ত হচ্ছে, তাতে গোটা পুলিশবাহিনীর ভাবমর্যাদা চরমভাবে ক্ষুণœ করেছ।
আরো অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালীরা পুলিশকে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ধরিয়ে দিচ্ছে। পুলিশের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ নতুন নয়। পুলিশ সুযোগ পেলেই গ্রেপ্তারবাণিজ্য করে- এ ধরনের সংবাদ বহুবার সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। আর পুলিশের বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ- সে তো অনেক পুরনো।
এবার ২০দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধ ও হরতালে আটকবাণিজ্যের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে যে হয়রানি করছে পুলিশ তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে খতিয়ে দেখতে হবে। এবার হয়রানির পরিমাণ বহুগুণ বেড়েছে। সারাদেশ থেকে অভিযোগ অনুসন্ধান করে এই সত্যতা মিলেছে বলে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। আটক ও হয়রানির পাশাপাশি রাজধানীতে আবার শুরু হয়েছে ডিবি বা পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই। এছাড়াও ডিবি পরিচয় দিয়ে তুলে নেয়ার হুমকি দিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো হচ্ছে, ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে টাকা। এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।
পুলিশ অবরোধ-হরতাল ঠেকানোয় ব্যস্ত থাকার কারণে একদিকে যেমন চুরি-ছিনতাই বেড়ে গেছে একইভাবে পুলিশ দেশের সাধারণ মানুষকে হয়রানি ও গ্রেপ্তার করছে। এর আগেও পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা-সম্ভ্রমলুণ্ঠন, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধের অভিযোগ উঠেছে। বেশির ভাগ অপরাধেই পুলিশ পার পেয়ে গেছে। ফলে 'আইন সবার জন্য সমান'- রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত এ কথাটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ের কারণে 'পুলিশ জনগণের বন্ধু'- এ ধারণাটি মিথ্যা প্রমাণ হতে চলেছে।
এমনিতেই লাগাতার অবরোধ-হরতালে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত, তাদের জীবন আজ বিপন্ন। তার উপর যদি তারা পুলিশি হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়, এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে। আমরা মনে করি রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও অপরাধী গ্রেপ্তারের নামে পুলিশের এ ধরনের বিপজ্জনক প্রবণতা দ্রুত বন্ধ করার বিকল্প নেই। নচেৎ বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারকেই এসবের দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে।
সন্ত্রাসী দমনের নামে কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তার গ্রেফতারবাণিজ্য বিশেষভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার আতঙ্কে রাখলে তথা নিরপরাধ ব্যক্তিকে হয়রানি করলে-এর দায়দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে।
__._,_.___