ধরা যাক চায়ের আড্ডা। কেউ যদি নিজের জীবনে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার কোনো ঘটনা তুলে ধরে, রাত করে বাড়ি ফিরে আড্ডায় থাকাে এমন মানুষদের খুব কমই পাওয়া যাবে যার জীবনে এক বা একাধিক এরকম ঘটনা ঘটেনি।
এ ঢাকা শহরে আমি নিজে দুইবার ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছি। একবার রি-রি টেম্পোতে, আরেকবার ঝনঝনি মিশুকে।
প্রথম ঘটনায় টেম্পোটি ফার্মগেটে না থেমে মানিক মিয়া এভিনিউ চলে গেলো। এর মধ্যে যার কাছে যা ছিলো যাত্রীবেশী ছিনতাইকারীরা নিয়ে গেলো। সেসময় আমি সিটিসেল ফোন ব্যবহার করতাম, তাই ফোন সেটটি তারা নেয়নি। আর পকেটে টাকা-পয়সাও খুব বেশি ছিলো না। তবে সহযাত্রী অন্যদের ক্ষতির পরিমাণ ছিলো ভালোই।
পরে কাছেই টহল পুলিশের কাছে গিয়ে কোনো লাভ হয়নি। তাদের ভাব ছিলো এমন যে এমন ঘটনা খুব স্বাভাবিক।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ওইদিনের যেদিন চিকিৎসক নিশ্চিত করলেন যে আমার স্ত্রী মা হতে যাচ্ছেন আর আমি বাবা। স্ত্রীকে বাসায় রেখে কিছু ওষুধ কেনার পাশাপাশি আরো কিছু টেস্টের রেজাল্ট আনার জন্য আমি মিশুকের যাত্রী ছিলাম। মিশুকটি সোনারগাঁও হোটেলের পাশে জ্যাম অথবা সিগন্যালে দাাঁড়ানো মাত্র দু'দিক থেকে দু'জন উঠে আসলো। একজন আগ্নেয়াস্ত্র অথবা আগ্নেয়াস্ত্র জাতীয় কিছু একটা এবং অন্যজন ছুরি চেপে ধরে যা আছে দিয়ে দিতে বললো। আমি কিছু একটা বলার চেষ্টা করলে একজন ঘাড়ে বসিয়ে দিলো এক ঘা।
আমাকে অবশ্য বেশি কষ্ট করতে হলো না। এবার আর সিটিসেল না, বিক্রয়যোগ্য ফোনসেট। মুহূর্তেই অামার মোবাইল ফোন তাদের হাতে। আমার জন্য ভালো পরিমাণের টাকাসহ ওয়ালেটও দখলে তাদের। আর যে আঙটি বিয়ের পর বাড়তি কয়েক ছটাক মাংসের কারণে আঙুলে স্থায়ীভাবে আটকে গিয়েছিলো মুহূর্তে সেটাও বের করে নিতে পারলো ক্রিয়েটিভ ছিনতাইকারী যুবক।
না, এবারও পুলিশকে জানিয়ে কিছু হলো না। সাংবাদিক হিসেবে প্রয়োজনে থানার কর্মকর্তা ছিনতাইয়ের কারণে যে ক্ষতি সেটা পুষিয়ে নেওয়ার আগ্রহ দেখালেন। যদি কখনো আসল জিনিসগুলো পাওয়া যায় তাহলে উদ্ধারের অনুরোধ জানিয়ে ভদ্রভাবে তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম।
আগে পরে জেনেছি, সোনারগাঁও হোটেল সংলগ্ন ওই সড়ক ছিনতাইকারীদের স্বর্গরাজ্য।
যেমন আরেকটি কুখ্যাত জায়গা ঢাকা পলিটেকনিক এলাকা। মাত্র কয়েকদিন আগে সেখানে ছিনতাইয়ের শিকার হলেন সহকর্মী নাসিমুল শুভ। অন্ততঃ সিমকার্ডটি যেনো তারা না নেয় সেই অনুরোধ বারবার জানিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। ছিনতাইয়ের ঘটনার পর কয়েক কদম এগিয়ে তিনিও পুলিশ ভাইদের দেখা পেয়েছিলেন। তবে তাদের হাসিটা এমন ছিলো যে এটা কোনো ঘটনাই না।
'পুলিশ জনগণের বন্ধু' হলেও এভাবেই সহায়তা পান মানুষ। আর পুলিশ এমনই বন্ধু যে পারতপক্ষে মানুষ পুলিশের কাছে যেতে চান না। কারণ তারা জানেন, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা-পুলিশ ছুঁলে ঘায়ের পরিমাণ দ্বিগুণ, পদে পদে হেনস্তা।
তবে আপনি পুলিশের কাছে যেতে না চাইলেও মাঝেমধ্যে পুলিশই আপনার কাছে চলে আসে। যেমন হেনস্তার শিকার হয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী এবং সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র দাশ।
তারা কিভাবে পুলিশের দ্বারা অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হয়েছেন সেটা নতুন করে আর বলার দরকার নেই। দু'জনকেই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। রাব্বীর শারীরিক আঘাতের সঙ্গে মানসিক আঘাতটা এতোটাই যে সাইকো থেরাপি নিতে হচ্ছে তাকে। রাব্বী এবং বিকাশের সঙ্গে পুলিশ যে অন্যায় আচরণ করেছে এটা কি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা? মোটেই তা না। এমন ঘটনা নৈমিত্তিক। পার্থক্য হচ্ছে যে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা রাব্বী একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদ পাঠক ছিলেন বলে গণমাধ্যম বিষয়টা সামনে তুলে এনেছে, তার ধারাবাহিকতায় বিকাশের ঘটনা। রাব্বী গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট বলেই বিষয়টি গণমাধ্যমে এতো আলোচিত যে সর্বোচ্চ আদালতও রুল জারি করেছে। মাসুদ নামে যে পুলিশ কর্মকর্তা রাব্বীর কাছে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেছে, তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করেছে, তার মানসিক বিপর্যয়ের কারণ হয়েছে; তাকে শুধু সাময়িক বা স্থায়ী বরখাস্ত করার সঙ্গে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করার কথাও বলেছে।
সেই উপযুক্ত শাস্তি হচ্ছে ফৌজদারি ব্যবস্থা। ফৌজদারি অপরাধের ফৌজদারি শাস্তি হবে সেটাই স্বাভাবিক, আর সেটা স্বাভাবিক বলেই ব্যবস্থা নিতে বলেছেন হাইকোর্ট।
কিন্তু, হাইকোর্টের ওই আদেশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেখলাম, এএসআই মাসুদ সিকদার যে বাহিনীর লোক তার প্রধান বলেছেন, চেকপোস্টে তল্লাশিতে বাধা দিয়ে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন রাব্বী। উপযুক্ত পুলিশের প্রধান হিসেবে উপযুক্ত কথাই বলেছেন আইজি একেএম শহীদুল হক।
অথচ এই আইজিপিই কয়েকদিন আগে বলেছিলেন, থানার ওসি যদি ঘুষ চায় তাহলে যেনো তাকে বেঁধে রেখে পুলিশে খবর দেওয়া হয়। ভাগ্য ভালো যে রাব্বী বা তার কাছে পরে ছুটে যাওয়া রাব্বীর বন্ধুরা ঘুষ না দিলে ক্রসফায়ারে পাঠানোর হুমকি দেওয়া এএসআই মাসুদ সিকদারকে বেঁধে রেখে পুলিশে খবর দেননি।
শুধুমাত্র ঘুষ চাওয়ার প্রতিবাদ জানানোর কারণেই আজ পুলিশ প্রধান বলছেন, রাব্বী ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। যদি আইজিপির আগের বক্তব্য বিশ্বাস করে রাব্বী বা তার বন্ধুরা যদি এএসঅাই মাসুদ সিকদারকে বেঁধে রেখে পুলিশে খবর দিতেন তাহলে এতোক্ষণে এতোবড় অপরাধের কারণে রাব্বীকে হয়তো ফায়ারিং স্কোয়াডেই পাঠিয়ে দেওয়া হতো।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)
Related:
1 day ago - বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে নির্যাতনের ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনার মধ্যে নিজের বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে নির্যাতিতকেই দুষেছেন পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক। সেই রাতে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প চেকপোস্ট অতিক্রম করার সময় রাব্বী দেহ তল্লাশিতে 'বাধা দিয়েছিল' দাবি করে পুলিশ মহাপরিদর্শক ...