গত ৩৯ বছরে ঢাকায় জমির দাম বেড়েছে ১২ শতগুণ পর্যন্ত। দাম বৃদ্ধির এ প্রবণতা বিপজ্জনক। ক্রমেই ঢাকার জমি চলে যাচ্ছে উচ্চবিত্তদের হাতে। জমির এত দাম উঠায় ধীরে ধীরে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা হারাচ্ছে মালিকানা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জমি চলে যাচ্ছে কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর কাছে। জমির দাম বৃদ্ধির এ প্রবণতা কথিত উন্নত বিশ্বের কিছু কিছু শহরকেও হার মানিয়েছে।
এক শ্রেণীর মানুষের কাছে প্রচুর কালো টাকা আছে। এই বিপুল পরিমাণ কালো টাকা জমিতে বিনিয়োগ করার কারণেই জমির দাম এতো অস্বাভাবিক বেড়েছে। কারণ কালো টাকার মালিকদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ হচ্ছে জমিতে বিনিয়োগ। ৫০ লাখ টাকার জমি কিনে বিনা বাধায় তা পাঁচ লাখ টাকা মূল্য দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করা সম্ভব। ৪৫ লাখ টাকা দ্রুত সাদা করে ফেলা সম্ভব। এভাবে সরকারের হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। আর ভূমি অফিসের সামান্য কেরানি পর্যন্ত এই দুর্নীতিতে সহযোগিতা করে বিপুল বিত্তের মালিক হচ্ছে।
এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৫ পরবর্তীকাল থেকেই জমির দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকায় গড়ে কাঠাপ্রতি জমির দাম ১৯৭৫ সালে ছিল ২০ হাজার ২০০ টাকা। ১৫ বছর পর অর্থাৎ ১৯৯০ সালে একই পরিমাণ জমির দাম বেড়ে হয় ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। জমির দাম বৃদ্ধির পরিমাণ ২২গুণের উপরে। পরবর্তী ১০ বছরে অর্থাৎ ২০০০ সালে এক কাঠা জমির গড় দাম দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। অর্থাৎ এক দশকে দাম বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৪গুণ। ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে জমির দাম দাঁড়ায় কাঠাপ্রতি ১ কোটি ২৫ লাখে। বৃদ্ধির পরিমাণ ৭ দশমিক ১৪গুণ। পরবর্তী এক বছরে অর্থাৎ ২০১১ সালে সেই একই পরিমাণ জমির দাম দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকায়।
দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ঢাকার নিম্ন মধ্যবিত্ত অথবা মধ্যবিত্ত এলাকার তুলনায় অভিজাত এলাকার মধ্যে অনেক তফাৎ। অভিজাত এলাকায় দাম বেড়েছে তুলনামূলক বেশি। বলা চলে ক্ষেত্র বিশেষে ১০গুণেরও বেশি।
সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, বারিধারায় ২০১৫ সালে এক কাঠা জমি বিক্রি হয়েছে ৩ কোটি টাকায়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বারিধারার জমি বিক্রি হয়েছে কাঠাপ্রতি পাঁচ কোটি টাকায়। এই এলাকার জমি ১৯৭৫ সালে বিক্রি হয়েছে গড়ে মাত্র ২৫ হাজার টাকা কাঠায়। বারিধারায় ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে দাম বেড়েছে ২৪গুণ। অপরদিকে ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০০০ পর্যন্ত দাম বেড়েছে ৮গুণ। ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এলাকা গুলশান-বারিধারায় ২০১৬ সালের শুরুতে জমির দাম কাঠাপ্রতি ৩ থেকে ৫ কোটি টাকার মধ্যে থাকলেও এখন তা ৫-৬ কোটি টাকায় পৌঁছে গেছে। আর গুলশান এভিনিউয়ে এখন প্রতি কাঠা জমির দাম হাঁকা হচ্ছে ১০-১২ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, যে মূল্যবৃদ্ধি দীর্ঘকাল স্থায়ী থাকে, তার কারণ অনুসন্ধান করা সরকারের কাজ। কিন্তু রাজউক, গণপূর্ত ও ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, জমির দাম নিয়ে সরকারি কোনো নীতিমালা নেই। যে কারণে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে এর দাম। জমির তুলনায় চাহিদা বেশি। একশ্রেণীর মানুষের হাতে অগাধ টাকা ও অর্থনীতিতে বড় ধরনের বৈষম্য জমির দামকে উসকে দিচ্ছে। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছে, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ কোথাও বেশি দাম দিয়ে জমি কিনলে সেটাই প্রচলিত দাম হয়ে যাচ্ছে। কোনো জমি আজ যে দামে কেনা হচ্ছে, পরদিনই তা বেড়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, ঢাকায় জমির দাম ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের মতো পার্শ্ববর্তী দেশই শুধু নয়, বরং লন্ডন-নিউইয়র্কের তুলনায়ও অনেক বেশি।
জমিতে বিনিয়োগ বরাবরই লাভজনক। ব্যাংকে উচ্চসুদে টাকা রাখলেও মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকৃত আয় যেখানে অনেক কমে যায়, সেখানে জমির দাম মূল্যস্ফীতির চেয়েও কয়েকগুণ বেশি হারে বাড়ে। তাই অনেকেই জমি কিনছে। এভাবে চাহিদা তৈরি হয়ে দাম বাড়তে থাকে। দাম বাড়া দেখে আরো অনেকেই জমি কিনতে শুরু করে। এতে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়ে দাম আরো বেড়ে গেছে। আবার ২০১৫ সাল পর্যন্ত যারা শেয়ারবাজারে ব্যবসা করেছে তাদেরও অনেকে জমিতে বিনিয়োগ করেছে।
অন্যদিকে বিভিন্ন আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানও অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে জমি নিতে গিয়ে দাম বাড়ানোয় ভূমিকা রেখেছে।
জমির মূল্যবৃদ্ধিতে ফ্ল্যাটের দাম বাড়ছে। এখন কোনো মধ্যবিত্তের পক্ষেও ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব নয়। স্বাধীনতার পরপর মধ্যবিত্তরা একখ- জমি কিনে বাড়ি করতে পারতো। তারপর এক সময় জমি কিনে বাড়ি করা দুরূহ হয়ে পড়লো। তখন তারা ফ্ল্যাটের দিকে ঝুঁকলো। কিন্তু এখন মধ্যবিত্তরা ফ্ল্যাটও কিনতে পারছে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা শহরে এলাকাভেদে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের সর্বনিম্ন দাম ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। সে হিসেবে ১২০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের দাম পড়ছে ৮০ লাখ টাকারও উপরে। আরেকটু ভালো ফ্ল্যাট কিনতে গেলে কোটি টাকার উপরে পাওয়া যায়। কিন্তু মধ্যবিত্তের পক্ষে এত টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনা কিছুতেই সম্ভব নয়।
জানা যায়, শুধু ঢাকা শহর নয়, বাংলাদেশের সব এলাকাতেই জমির দাম এখন খুবই চড়া। তাই মধ্যবিত্তদের পক্ষে ঢাকা শহর কেন, গ্রামে গিয়েও জমি কেনা সম্ভব নয়। কালো টাকার মালিকরা আর প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমি কেনায় বিনিয়োগ করা হয়। ফলে কৃষকরা আর জমি রাখতে পারছে না। ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোর সব জমি তো টাকাওয়ালারা কিনে নিয়েছেই অজপাড়া গাঁয়েও এখন টাকাওয়ালারা জমি কেনায় জমি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে।
এতে করে একটা বিরাট জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা বাসস্থান ক্রমেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত ছিলো- কালো টাকার মালিক এবং কালো টাকার উৎস উভয়ই নিয়ন্ত্রণ করা। একটা জমির দর মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা। যেখানে সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞ থাকবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটা আছে। এ কমিটি নির্দিষ্ট সময় পরপর এলাকাভেদে জমির একক প্রতি নির্দেশক দাম নির্ধারণ করবে। অর্থাৎ এ দাম বিবেচনায় নিয়ে বাজারে অন্যরা জমি বেচাকেনায় নিজস্ব দর ঠিক করবে। আর সরকারি দরটি আয়কর নির্ধারণে ও জমি নিবন্ধনে অনুসৃত হবে। অনেক ক্ষেত্রেই এখন সরকার নির্ধারিত দরে জমি নিবন্ধন হলেও প্রকৃত কেনাবেচা অনেক বেশি দরে হয়। তাই নিবন্ধন মাশুলও কমানো উচিত। সাধারণ মানুষের আবাসনের দিকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। সরকারের উচিত- গ্রহণযোগ্য একটা সমাধান বের করা। এছাড়া সাধারণের জন্য আবাসন বাবদও সরকারের ভর্তুকি দেয়া উচিত।
__._,_.___