Banner Advertiser

Friday, June 24, 2016

[mukto-mona] ২৩ জুন পলাশী দিবস



২৩ জুন পলাশী দিবস

ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম

২৩শে জুন পলাশী দিবস। আজকাল অনেকটা অলক্ষ্যেই কেটে যায় দিনটা।
ভারতবর্ষের বিচিত্র ইতিহাসের মধ্যে পলাশীর মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন মীর জাফর আর জগৎশেঠদের মত এদেশিয় কিছু মতালিপ্সু স্বার্থান্বেষী বিশ্বাসঘাতকের চরম বিশ্বাসঘাতকতায় চতুর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। সাথে সাথে এদেশের আকাশে নেমে আসে দুর্যোগের ঘনঘটা; বাংলার জমিনে নেমে আসে দুর্ভেদ্য অমানিশা; এদেশের মানুষের উপর চেপে বসে পরাধীনতার জগদ্দল পাথর। সেই থেকে সমগ্র ভারতবর্ষ ১৯০ বছর ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল। তাই প্রতি বছর জুন মাস আসলেই এদেশের স্বাধীনচেতা মানুষের অন্তরে জেগে উঠে পলাশীর আম্রকাননের বিভীষিকা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শুরু থেকেই ভারতবর্ষের মুসলমানদের হেয় করার ল্েয এবং বাঙালি মুসলমান নেতাদের নামে কালিমা লেপনের উদ্দেশ্যে সুস্থ মস্তিষ্কে পলাশীর প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে সে চাপাপড়া ইতিহাস অনেকাংশে স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাই নতুন প্রজন্মকে প্রকৃতপে ইতিহাস সচেতন করে গড়ে তোলার ল্েযই আলোচ্য নিবন্ধে ঐতিহাসিক পলাশীর ট্র্যাজেডি সংপ্তিাকারে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। 
আজ২৩ জুন।ঐতিহাসিক পলাশী দিবস। এটি বাঙালির ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। দুশসাতান্ন বছর আগে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভাগীরথী নদী তীরে পলাশীর আমবাগানেনবাবের বাহিনীর মুখোমুখি হয় ইংরেজ বাহিনী। এ দিনে পলাশীর আম বাগানে ইংরেজদের সঙ্গে এক যুদ্ধে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য। পরাজয়ের পর নবাবের বেদনাদায়ক মৃত্যু হলেও উপমহাদেশের মানুষ নবাবকে আজও শ্রদ্ধা জানায়। তার সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। ইতিহাসবিদ নিখিল নাথ রায়ের লেখা 'মুর্শিদাবাদ কাহিনী' থেকে জানা যায়, নবাবের সেনা বাহিনীর তুলনায় ইংরেজদের সেনা সংখ্যা ছিল অনেক কম। সেখানে বিশ্বাসঘাতকতা না হলে নবাবের বিজয় ছিল সুনিশ্চিত।
বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব ছিলেন আলীবর্দী খাঁ (১৭৪০-১৭৫৬)। তার প্রকৃত নাম মীর্জা বন্দি বা মীর্জা মুহাম্মাদ আলী। তার বড় ভাইয়ের নাম হাজী আহমাদ। তাদের পিতামহ ছিলেন আরব বংশোদ্ভূত, আর মাতা ছিলেন আফগান-তুর্কি বংশোদ্ভূত। সেই সুবাদে তারা ছিলেন সুজাউদ্দীন খাঁর আত্মীয়। সুজাউদ্দীন ছিলেন বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর জামাতা। শ্বশুরের মৃত্যুর পর তিনি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাবী লাভ করেন। এদিকে ১৭০৭ সালে সংঘটিত জজুর যুদ্ধে যুবরাজ আজম শাহ নিহত হলে মীর্জা মুহাম্মাদ আলী ও বড় ভাই হাজি আহমাদ নিরুপায় হয়ে আত্মীয় সুজাউদ্দীন খাঁর দরবারে আসেন। সুজাউদ্দীন খাঁ তাদের দুই ভাইকে সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত করেন। দুই ভাই সরকারি চাকরি পেয়ে অত্যন্ত দতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে রাজকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। তাদের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে সুজাউদ্দীন খাঁ মীর্জা মুহম্মদকে রাজমহলের ফৌজদার নিযুক্ত করেন। তখন থেকে মীর্জা মুহম্মদ আলী 'আলীবর্দী খাঁ' উপাধিতে ভূষিত হন। এরই ধারাবাহিকতায় এক পর্যায় আলীবর্দী খাঁ বিহারের সহকারী শাসনকর্তা নিযুক্ত হন (১৭৩৩)। সুজাউদ্দীন খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সরফরাজ খাঁ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন মারাঠা ও বর্গীদের লুণ্ঠন দমনের জন্য গভর্ণর আলীবর্দী খাঁ নবাবের অনুমতি প্রার্থনা করলে নবাব সেেেত্র গুরুত্ব না দেয়ায় বীর আলীবর্দী খাঁ নবাব সরফরাজ খাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নবাবকে পরাজিত ও নিহত করে আপন বুদ্ধিমত্তা ও রণকৌশলের বলে বাংলার নবাবী লাভ করেন।
নবাব আলীবর্দী খাঁর তিন কন্যা ছাড়া কোন পুত্র সন্তান ছিল না। তিনি তার তিন কন্যাকে আপন বড় ভাই হাজী আহমাদের তিন পুত্রের সঙ্গে বিবাহ দেন। তার তিন জামাতাই তিনটি পরগনার শাসনকর্তা ছিলেন। একজন ঢাকার, একজন পূর্ণিয়ার এবং ছোট জামাতা জৈনুদ্দীন ছিলেন বিহারের নায়েবে-নাযিম। এদিকে নবাব আলীবর্দী খাঁ কর্তৃক পদচ্যুত সমসের খাঁ ও সরদার খাঁ নামে দুই আফগান বীর বিদ্রোহ করলে তাদেরকে বশ্যতা স্বীকার করার জন্য রাজ দরবারে ডেকে পাঠানো হয়। তারা বশ্যতা স্বীকারের ছলে ১৭৪৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি যথাযোগ্য সমাদরে জৈনুদ্দীনের নিকটে উপস্থিত হয়ে অতর্কিতে তার উপর আক্রমণ চালায়। জৈনুদ্দীন নিজ তরবারী কোষমুক্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। মুহূর্তের মধ্যে তার ছিন্নমুণ্ডু মসনদের উপর লুটিয়ে পড়ে। হাজী আহমাদ বন্দী দশায় নিদারুণ উৎপীড়ন সহ্য করতে না পেরে সতের দিনের মাথায় ভগ্নহৃদয় বন্দীশালায় মৃত্যুবরণ করেন। সিরাজুদ্দৌলার মাতা ও নবাব আলীবর্দী খাঁর ছোট মেয়ে আমেনা বেগম সন্তান-সন্ততিসহ আফগান শিবিরে বন্দী হলেন।
এই মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক সংবাদ পাওয়া মাত্রই নবাব আলীবর্দী খাঁ আফগান বিদ্রোহ দমন এবং তাদের হাত থেকে দুহিতার বন্ধন মোচন করতে বিহারের উদ্দেশ্যে সসৈন্যে যাত্রা করেন। এেেত্র তিনি পদচ্যুত ও পদগৌরবান্বিত সকল সেনাপতিকে সম্মিলিত করে কাতর কণ্ঠে যখন এই শোকাবহ কাহিনী বর্ণনা করেন, তখন সকলে একে একে কুরআন স্পর্শ করে নাঙ্গা তরবারি হাতে নিয়ে তার সঙ্গে প্রাণ-বিসর্জ্জনের শপথ করেন। এ উপলে পূর্বের সকল কলহ-বিবাদ মিটে গেল, মীরজাফর পুনরায় সেনাপতি পদে নিযুক্ত হলেন। সিরাজুদ্দৌলা তখন বয়সে বালক হলেও এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় অতিমাত্রায় ব্যাকুল হয়ে উঠেন। কারণ তার পিতা ও পিতামহ শত্রু হাতে নিহত এবং মাতা বন্দিনী। এমত পরিস্থিতিতে তিনিও তরবারি হাতে মাতামহের সাথে যুদ্ধে যাত্রা করলেন। অতঃপর ১৭৪৮ সালের ১৬ই এপ্রিল গঙ্গার তীরবর্তী কালাদিয়ারা নামক স্থানে উভয় পরে মধ্যে তুমুল লড়াইয়ে বিদ্রোহী সমসের খাঁ নিহত হয় এবং তার সহযোগী বাহিনীকে বিধ্বস্ত করে আলীবর্দী খাঁ বন্দী কন্যা ও তার সন্তানদের মুক্ত করার মাধ্যমে বিহার পুনরুদ্ধার করেন। নবাব আলীবর্দী খাঁ তখন নিজ স্ত্রী শরফুন্নেসার সাথে পরামর্শ করে নিহত জামাতা জৈনুদ্দীনের সুযোগ্য উত্তরসূরি ও নবাবের প্রিয় দৌহিত্র সিরাজুদ্দৌলাকে বিহারের পরবর্তী নায়েবে-নাযিম নিযুক্ত করেন। এটা ছিল তার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার একটা অংশ। যেহেতু সিরাজুদ্দৌলা তখন বয়সে বালক, তাই রাজা জানকীরামকে বিহারে সিরাজের নায়েব নিয়োগ করা হল।
যেহেতু নবাব আলীবর্দী খাঁর কোন পুত্র সন্তান ছিল না, তাই তিনি মৃত্যুর পূর্বেই তার কনিষ্ঠ কন্যার পুত্র প্রিয় দৌহিত্র সিরাজুদ্দৌলাকে বাংলার পরবর্তী নবাব মনোনীত করে যান। এদিকে হঠাৎ করে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে তার অন্য এক দৌহিত্র এবং দুই জামাতার (ও ভ্রাতুষ্পুত্র) মৃত্যুতে তিনি খুবই শোকাভিভূত হয়ে পড়েন এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যান। যার ফলে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে ১৭৫৬ সালের ১০ই এপ্রিল ৮০ বছর বয়সে নবাব আলীবর্দী খাঁ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অবশ্য নবাব আলীবর্দী খাঁর জীবদ্দশাতেই তার তিন জামাতাই মৃত্যুবরণ করেন।বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব আলিবর্দী খাঁ মৃত্যুর আগে দৌহিত্র সিরাজ-উদ-দৌলাকে নবাবের সিংহাসনের উত্তরাধিকারি করে যান। নবাব আলিবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর ১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে তারই মনোনীত প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র সিরাজ-উদ-দৌলা সিংহাসনে বসেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র তেইশ বছর। তার নিকট আত্মীয়ের মধ্যে অনেকেই নবাব আলীবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর সিংহাসন লাভের আশায় বুক বেঁধে ছিলেন। তাই তিনি যখন সিরাজুদ্দৌলাকে পরবর্তী নবাব মনোনীত করেন, তখন স্বভাবতই অন্যদের অন্তরে চাপা অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। যার ফলে তারা মনে-প্রাণে সিরাজকে নবাব হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। তাই নবাব আলীবর্দী খাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা এবং ঢাকার ভূতপূর্ব শাসনকর্তার বিধবা পতœী মেহেরুন্নেসা ওরফে ঘসেটি বেগম পূর্ণিয়ার ভূতপূর্ব শাসনকর্তার পুত্র শওকত জঙ্গ সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই সুযোগে ধূর্ত ব্রিটিশ কোম্পানি নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের নিমিত্তে গোপনে শওকত জঙ্গ ও ঘসেটি বেগমের পাবলম্বন করে। এমনকি নতুন নবাব হিসেবে ইংরেজগণ সিরাজকে উপঢৌকন প্রেরণের চিরাচরিত রীতিও অমান্য করে।প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী অন্যাণ্য ইউরোপিয় বনিকরা সিরাজকে উপহার স্বরুপ উপঢৌকন প্রদান সহ তাকে অভিবাদন জানান। কিন্তু ইংরেজরা তা করেনি। এছাড়াও ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কৃষ্ণবল্বভ সহ নবাবের অবাধ্য সকল কে আশ্রয় দেন। এসময় কোম্পানী ব্যাক্তিগত ব্যবসা শুরু করে।এর ফলে সিরাজের রাজস্ব ঘাটতি দেখা দেয়। ইংরেজদের অবাধ্যও অপরাধ স্বরুপ ১৭৫৬ সালে ৪ জুন কাশিম কুটি অদিকার করে। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গর্ভনর ড্রেককে নির্দেশে জাহাজে আশ্যয় নেয়। নবাব সিরাজদৌলা বির ধর্পে ১৭৫৬ সালের ২০ জুন কলিকাতা দখল করে। নবাব তার অন্যতম সেনা মানিক চাদেঁর উপর কলিকাতার শাসন ভার অর্পন করে মুর্শিদাবাদে চলে যায়।এর রে শুরু হয় নবাবের বিরুদ্দে অমাত্যবর্গের ঘৃন্য ষড়যন্ত্র।রবার্ট ক্লাইভ ও ওটারসনের অধীনে অন্যান্য একদল সৈন্য ও নৌবহর পাঠান। ইংরেজ নৌবহর ১৭৫৬ সলে ১৪ই ডিসেম্বর ভাগিরতী নদীর তীরে প্রবেশ করে। বিশ্বাস ঘাতক মানিক চাঁদ ষড়যন্ত্র ও নিষ্ক্রিয়তার সুযোকে ১৭৫৭ সালে ২ জানুয়ারী ক্লাইভ ও ওটারসন বিনা বাধায় কলিকাতা দখল করে। এবং ফোর্ট উলিয়াম দুর্গ সুরক্ষিত করে।১৭৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আলীগরের সস্ধি স্বাক্ষরীত হলে নবাবক ইষ্ট ইনিডয়া কোম্টানিকে বানিজ্যর সুবিধা প্রদান করে।কিন্তু কোম্পানি সন্ধির স্বান্ধ্য উপেক্ষা করে চন্দন নগর ফরাসি বানিজ্য কুটি আক্রমন করলে নবাব ক্লাইভকে যুদ্ব বিগ্রহ হতে নিষেধ করে। এ সময় রাজা রাজবল্লভ ঢাকার দেওয়ান ছিলেন। নবাব সিরাজুদ্দৌলা তাকে হিসাব দাখিল করতে বললে সে নবাবের নির্দেশ অমান্য করে নিজ পুত্র কৃষ্ণদাস মারফত প্রচুর ধনরতœসহ কলকাতায় পাঠায়। এ সংবাদ নবাব সিরাজ জানতে পেরে কৃষ্ণদাসকে গ্রেফতারের আদেশ দিলে ইংরেজরা তাকে আশ্রয় দেয়।
নবাবের বিরুদ্ধে ঘসেটি বেগম, রাজা রাজবল্লভ প্রভৃতির ষড়যন্ত্রে যে ইংরেজরাও জড়িত, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ ছিল না। এমতাবস্থায় ইউরোপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের (১৭৫৬-১৭৬৩) অজুহাতে ইংরেজ ও ফরাসি বণিকরা বাংলায় দুর্গ নির্মাণ শুরু করে। নবাব এ সংবাদ জানতে পেরে তাদের নিরস্ত্র হতে এবং দুর্গ নির্মাণ বন্ধ করার আদেশ দেন। ফরাসিগণ নবাবের নির্দেশ মত দুর্গ নির্মাণ বন্ধ করলেও উদ্ধত ব্রিটিশ বণিকরা নবাবের আদেশ তো মানেইনি; উপরন্তু তার দূতকে তারা অপমান করতেও দ্বিধা করেনি। এমনকি নবাব কৃষ্ণদাসের সমর্পণ দাবি করলেও তারা তা অমান্য করে। এ প্রসঙ্গে ইংরেজ কর্মচারী রিচার্ড বেচারের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, 'এটা কি কখনও কল্পনা করা যায় যে, কোন নৃপতির প্রজাকে একদল বিদেশি বণিক আশ্রয় দেবে? কিংবা তাঁর দূতকে অপমানিত করলে রাজা সে অপমান নির্দ্বিধায় মেনে নেবেন? দূতকে ফেরত দেওয়াটা পুরো দুনিয়াতে রাজার অবমাননা বলে মনে করা হবে'।
ইত্যবসরে বুদ্ধিমান সিরাজ বিনা রক্তপাতে সুকৌশলে বড় খালা অর্থাৎ ঘসেটি বেগমকে নিজ প্রাসাদে আনতে সমর্থ হন। নবাব বিরোধী ষড়যন্ত্রের প্রধান হোতা এভাবে সিরাজের হাতে বন্দী হয়েছে, জানতে পেরে ব্রিটিশ বণিকরা ঘসেটি বেগমের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার বিপদ আঁচ করতে পারে। এতে তড়িঘড়ি করে পূর্বের আচরণের জন্য সিরাজের নিকট অনুতাপ প্রকাশ করে। নবাব তখন ইংরেজদেরকে অবিলম্বে দুর্গ নির্মাণ বন্ধ এবং নির্মিত অংশ ভেঙে ফেলার আদেশ দেন।
এদিকে ঘসেটি বেগমকে রাজদরবারে অন্তরীণ রেখে অপর ষড়যন্ত্রকারী শওকত জঙ্গকে দমনের উদ্দেশ্যে নবাব ১৭৫৬ সালের ১৬ই মে মুর্শিদাবাদ থেকে সসৈন্যে পূর্ণিয়ার দিকে অগ্রসর হন। ২০ মে নবাব যখন রাজমহল পৌঁছেন তখন রোজার ড্রেকের পত্র তার হস্তগত হয়। এ পত্রে ড্রেক অত্যন্ত বিনম্র ভাষায় ইংরেজদের সদিচ্ছার কথা জানালেও তাতে দুর্গ নির্মাণ বন্ধ কি-না সে বিষয়ের উল্লেখ না থাকায় নবাব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। এতে নবাব পূর্ব সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পূর্ণিয়ার দিকে না গিয়ে মুর্শিদাবাদে ফিরে এসে ইংরেজদের উপযুক্ত শাস্তিদানের উদ্দেশ্যে সসৈন্যে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে তিনি কাশিম বাজারের ইংরেজ কুঠি দখল করে নিয়ে ১৬ই জুন কলকাতার উপকণ্ঠে পৌঁছেন। যদিও সংবাদ পেয়ে নবাবের গতিরোধ করতে হলওয়েল যথাসাধ্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল, তথাপি কলকাতাস্থ ইংরেজ ঘাঁটি ফোর্ট উইলিয়াম দখল করতে নবাবকে বেগ পেতে হয়নি। যুদ্ধে ইংরেজ পরে বেশ কিছু সৈন্য নিহত হয়। গভর্নর হলওয়েল আত্মসমর্পণ করেন এবং রোজার ড্রেকসহ অপরাপর ইংরেজরা দুর্গ ত্যাগ করে নদী পথে পলায়ন করে ফুলতায় আশ্রয় নেয়। এমনি পরিস্থিতিতে ২০শে জুন নবাব সিরাজুদ্দৌলা বিজয়ী বেশে কলকাতা দুর্গে প্রবেশ করেন। অতঃপর কলকাতার অভিযান সমাপ্ত করে মাণিক চাঁদের উপর কলকাতার ভার অর্পণ করে নবাব পুনরায় মুর্শিদাবাদ ফিরে আসেন।
ইতোমধ্যে শওকত জঙ্গ নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে মসনদ থেকে অপসারণের ল্েয যুদ্ধযাত্রা শুরু করেন। এদিকে নবাবও কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ ফিরে এসে শওকত জঙ্গকে দমনের জন্য ১৭৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে সসৈন্যে পূর্ণিয়া অভিমুখে অগ্রসর হন। ১৭৫৬ সালের ১৬ই অক্টোবর নবাবগঞ্জের মনিহারী গ্রামে দু'পরে মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধে শওকত জঙ্গ পরাজিত ও নিহত হন। মতা গ্রহণের মাত্র ছয় মাসের মধ্যে নবাব সিরাজুদ্দৌলা ঘসেটি বেগম, ইংরেজ ও শওকত জঙ্গের মত তিনটি প্রধান ষড়যন্ত্রকারীকে কঠোর হস্তে মোকাবিলা করতে সমর্থ হন।
এদিকে নবাব কর্তৃক কলকাতা অধিকারের সংবাদ মাদ্রাজে পৌঁছলে ব্রিটিশ সেনাপতি রবার্ট কাইভ সঙ্গে সঙ্গে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে কলকাতা পুনরুদ্ধারে বেরিয়ে পড়েন। একই সাথে এডমিরাল ওয়াটসনের নেতৃত্বে এক নৌবহরও কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। প্রথমে তারা ফুলতায় এসে বিনা বাধায় উদ্বাস্তু ইংরেজদের সাথে মিলিত হয়। অতঃপর সম্মিলিতভাবে কলকাতার দিকে যাত্রা করে। মানিক চাঁদের নেতৃত্বে কিছু সৈন্য অতর্কিতে তাদের উপর হামলা চালালে ইংরেজদের বেশ কিছু সৈন্য নিহত হয়। কিন্তু অর্থের প্রলোভনে শেষ পর্যন্ত মানিক চাঁদ ইংরেজ সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে পালিয়ে যান। এই সুযোগে ইংরেজরা নবাবের বজবজ দুর্গ ধ্বংস করে এবং ১৭৫৭ সালের ২রা জানুয়ারি কলকাতা অধিকার করে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ সুরতি করে। এেেত্র মানিক চাঁদ গোপনে ইংরেজদের পাবলম্বন করে চরম বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দেয়। অথচ কলকাতা পতনের পর যদি উমিচাঁদ, নবকিষেণ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, মানিক চাঁদের মত হিন্দু-প্রধানরা রজার ড্রেক, হলওয়েল, কাইভ, ওয়াটসনদের সাহায্য না করত, তাহলে ইংজেদের আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না।
কলকাতা অধিকার করেই ইংরেজরা পরের দিন ৩ জানুয়ারি নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অপর দিকে নবাবও এ সংবাদ জানতে পেরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। ইতোমধ্যে কাইভ ১০ই জানুয়ারি হুগলী অধিকার করে শহর লুণ্ঠন করে এবং পার্শ্ববর্তী বহু গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। ১৯শে জানুয়ারি নবাব হুগলী পৌঁছলে ইংরেজরা পিছু হটে কলকাতায় প্রস্থান করে। ৩ ফেব্রুয়ারি নবাব কলকাতার শহরতলীতে উমিচাঁদের বাগানে শিবির স্থাপন করলে ৫ই ফেব্রুয়ারি শেষ রাতে কাইভ ও ওয়াটসন অকস্মাৎ নবাব শিবিরে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে নবাবের পরে প্রায় ১৩০০ সৈন্য হত্যা করে। কিন্তু সকালেই নবাবের সৈন্য সুসজ্জিত হয়ে পাল্টা আক্রমণ চালালে কাইভ প্রস্থান করে। সেদিন কলকাতা জয়ের মত নবাবের যথেষ্ট সৈন্য ও শক্তি থাকার পরও ৯ই ফেব্রুয়ারি '৫৭ সেনাপতির পরামর্শে ও ষড়যন্ত্রে নবাব ইংরেজদের সাথে এক অপমানজনক সন্ধি স্থাপনে সম্মত হন। যে সন্ধি 'আলিনগর সন্ধি' নামে অভিহিত হয়। এই সন্ধির ফলে নবাবের প্রতিপত্তি অনেকাংশে হ্রাস পায় এবং ইংরেজের শক্তি, প্রতিপত্তি ও ঔদ্ধত্য বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এ েেত্র ইংরেজদের পে কাজ করেন বঙ্গের বিখ্যাত ধনী জগৎশেঠ, কলকাতার বড় ব্যবসায়ী উমিচাঁদ ও রাজা রাজবল্লভ, মানিক চাঁদ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ
এ ঘটনায় ইংরেজদের মনোবলও বৃদ্ধি পায়। ফলে ২৩ এপ্রিল '৫৭ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতা কাউন্সিল নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ল্েয মে '৫৭-র প্রথম সপ্তাহে মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠের বাড়িতেই উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, রাজা রাজবল্লভ, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, জগৎশেঠ, মীরজাফর প্রমুখ প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের এক গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত ষড়যন্ত্রমূলক গোপন বৈঠকে কলকাতা থেকে কোম্পানির দূত হিসেবে ওয়াটসনকে স্ত্রীলোকের ছদ্মবেশে পালকিতে করে আনা হয়।
বৈঠকে বসে ওয়াটসন প্রথমে সকলকে প্রলোভনের জালে আঁটকে ফেলে। অতঃপর সিরাজুদ্দৌলার সিংহাসনচ্যুত করার কথা সুকৌশলে ব্যক্ত করে। ওয়াটসন আরো বলে, নবাব মতাচ্যুত হলে সারা ভারতের মুসলমানদের উত্তেজনা প্রশমণের ল্েয তারই আত্মীয় মীরজাফরকে সিংহাসনে বসাতে হবে। মীরজাফর প্রথমে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি ছিলেন পরলোকগত নবাব আলীবর্দী খাঁর ভগ্নীপতি এবং বাংলার সিপাহসালার। তিনি সিরাজুদ্দৌলা কর্তৃক ক্রমাগত অপমানিত ও পদচ্যুত হলেও নিজে কখনো সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার কল্পনাও করেননি। তিনি বলেন, 'আমি নবাব আলীবর্দী খাঁর আত্মীয়, অতএব সিরাজও আমার আত্মীয়, এটা কি করে সম্ভব?' তখন উমিচাঁদ বললেন, 'আমরা তো আর সিরাজকে মেরে ফেলছি না অথবা আমরা নিজেরাও নবাব হচ্ছি না, শুধু তাকে সিংহাসনচ্যুত করে আপনাকে বসাতে চাচ্ছি। কারণ শুধু আমি নই, ইংরেজ এবং মুসলমানদের অনেকেই, এক কথায় অমুসলমানদের প্রায় প্রত্যেকেই আপনাকে গভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখে'। এরপরও যখন দেখলেন, তিনি রাজি না হলে তারা নবাবকে হটিয়ে সেখানে ইয়ার লতিফকে বসানোর ষড়যন্ত্র করছে; তখন তিনি আর উদাসীন না থেকে তাদের প্রস্তাবে সম্মত হলেন। তখন ওয়াটসন বলেন, এই মুহূর্তে সিরাজের সাথে লড়তে গেলে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন তা আমাদের নেই। তখন জগৎশেঠ বলেন, 'টাকা যা দিয়েছি আরও যত দরকার আমি আপনাদের দিয়ে যাব, কোন চিন্তা নেই, আপনারা প্রস্তুতি নিন'। তখন উপস্থিত দেশিয় ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে ইংরেজ কোম্পানির মধ্যে শুধু নবাব বিরোধী নয়, সাথে সাথে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী একটি সন্ধিপত্র রচিত হয়। উক্ত সন্ধিপত্রে ওয়াটসন ১৯ মে স্বার করলেও মীরজাফর স্বার করেন ৪ জুন।
এবার রবার্ট কাইভ সামান্য অজুহাতে নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। নবাবও ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে সসৈন্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন প্রাতঃকালে ভাগীরথীর তীরে পলাশীর প্রান্তরে উভয় পরে মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। নবাবের সৈন্য সংখ্যা ৫০ হাজার, অপর দিকে ইংরেজ সৈন্য সংখ্যা মাত্র ৩ হাজার। মীরজাফর ও রায়দুর্লভদের চক্রান্ত্রে নবাবের সৈন্যের একটা বড় অংশ যুদ্ধ থেকে বিরত থাকে। কেবল মীর মদন, মোহনলাল ও সিনফ্রের অধীনে মুষ্টিমেয় কিছু সৈন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। মীরমদন ও মোহনলালের সমরকুশলতার সম্মুখে ইংরেজ বাহিনী টিকতে না পেরে কাইভের সৈন্য বাহিনী পার্শ্ববর্তী আম্রকাননে আশ্রয় নেয়। নবাব বাহিনীর জয় যখন সুনিশ্চিত, ঠিক সেই মুহূর্তে মীরমদন নিহত হন। অনন্যোপায় হয়ে নবাব তখন মীরজাফরের শরণাপন্ন হন। তিনি আলীবর্দী খাঁর আমলের আনুগত্যপূর্ণ ব্যবহারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নিজ উষ্ণীষ মীরজাফরের সম্মুখে নিপে করে বললেন, 'জাফর খাঁ, এই উষ্ণীষের সম্মান রা করুন'।
তখন মীরজাফর মুখে আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দিলেও তলে তলে সবচেয়ে বড় সর্বনাশটাই করলেন। তিনি সিরাজকে যুদ্ধ বিরতির আত্মঘাতী পরামর্শ দিলেন। অথচ মীর মদনের মৃত্যুর পর মোহনলালের প্রচেষ্টায় যুদ্ধের গতি নবাবের অনুকূলেই ছিল। কিন্তু নিজ অদূরদর্শিতা ও মীরজাফরের সর্বনাশা পরামর্শে তিনি মোহনলালকে যুদ্ধ বন্ধের আদেশ দেন। প্রথমে মোহনলাল তার আদেশ মানেননি। কিন্তু নবাবের নিকট থেকে পুনঃ পুনঃ আদেশের ফলে তিনি যুদ্ধ বন্ধ করেন। এই সুযোগে রবার্ট কাইভ পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে নবাব বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। নবাব পালিয়ে গিয়ে কোনোক্রমে প্রাণে রা পান।
যুদ্ধেেত্রই রবার্ট কাইভ মীরজাফরকে নতুন নবাব বলে অভিনন্দন ও কুর্নিশ করে। ২৬শে জুন তার অভিষেক হয় এবং ২৯ জুন সিংহাসনে আরোহণ করেন। নবাব সিরাজুদ্দৌলা রাজধানীতে ফিরে এসে প্রচুর অর্থ বিতরণ করে সৈন্য সংগ্রহের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অবশেষে নিরুপায় হয়ে তিনি স্বীয় পতœী ও কন্যাসহ পালিয়ে যান। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস পথিমধ্যে রাজমহলে রাত কাটাতে গিয়ে ৩০ জুন তিনি ধরা পড়েন।
২ জুলাই রাতে সাধারণ বন্দীর মত শৃঙ্খলিত অবস্থায় সিরাজুদ্দৌলাকে নতুন নবাব মীরজাফরের সম্মুখে উপস্থিত করা হয়। ঐ রাতেই মীরজাফরের পুত্র মীরণের আদেশে মুহাম্মাদী বেগ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
নবাবকে হত্যা করতে মুহাম্মাদী বেগ রাজি না হলে তারা তার ও তার স্ত্রী-পুত্রের প্রাণনাশের হুমকি দেয়। অনন্যোপায় হয়ে অশ্রু সম্বরণ করে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিকল্পনামাফিক সংকেত পাওয়া মাত্র সিরাজুদ্দৌলাকে হত্যা করতে সম্মত হন। মুহাম্মাদী বেগ যখন উলঙ্গ তরবারি নিয়ে রাতে তার কে প্রবেশ করেন, তখন নবাবের আর বুঝতে বাকি ছিল না, তার মৃত্যুর সময় সমাগত। তখন তিনি কাতর কণ্ঠে বললেন, 'মুহাম্মাদী বেগ, আমাকে কি তোমরা সামান্য একটা অসহায় গরিবের মত বেঁচে থাকতেও দেবে না?' তখন মুহাম্মাদী বেগও দৃঢ়ভাবে বললেন, 'না তারা তা দেবে না'। তখন নবাব মুহাম্মাদী বেগকে বলে দু'রাকআত ছালাত আদায়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। ইতোমধ্যে ছালাত শেষ হওয়ার আগেই দূর থেকে বাঁশি বাজিয়ে সংকেত দেয়া মাত্র তাঁর উপরে তরবারি চালানো হয়। নবাব সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটে পড়ে 'আল্লাহ' 'আল্লাহ' শব্দ করতে করতে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিলেন। এটাই হল পলাশীর প্রান্তরের নির্মম ট্র্যাজেডি। বাহ্যিকভাবে নবাব সিরাজুদ্দৌলার চরম পরিণতির জন্য শেষ দিকের কিছু ঘটনাবলীর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত কয়েকজন বিশ্বাসঘাতককে দায়ী করা হলেও মূলত পলাশীর বিয়োগান্ত ঘটনা কোন কাকতালীয় বিষয় ছিল না। এটি ছিল ব্রিটিশ বেনিয়াদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার চূড়ান্ত পরিণতি। প্রথম থেকেই যদি জগৎশেঠের মত এদেশের নামি-দামি ধনাঢ্য এবং পরবর্তীতে মতালোভী কিছু মীরজাফররা ইংরেজদের সহযোগিতা না করত, তাহলে কোন দিনই ইংরেজরা এদেশের মানুষদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে সমর্থ হত না। বাংলার এসব বিশ্বাসঘাতকরা কখনই উপলব্ধি করতে পারেনি যে, নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয় শুধু তাঁর একার পরাজয় নয়, শুধু বাংলার পরাজয় নয়, বরং সমগ্র ভারতবাসীর পরাজয়। তবে অতি অল্প সময়ের ব্যবধানেই, অতি সহজেই তারা এই চরম সত্য বিষয়টি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
১৭৫৭ সালে ২৩ শে জুন পলাশীর যুদ্ব শুরু হয়।মোহন লাল,সিনফ্রের আক্রমনে ইংরেজরা আম্রকাননে আশ্রয় নেয়।জয় যখন নিশ্চিত তখন মীরজাফর যুদ্ব বন্দের পরামর্শ দেয়।
যুদ্ধের নামে এক প্রাসাদষড়যন্ত্রে শিকার হয়ে পরাজিত হন বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা।এই পরাজয়ের মধ্যদিয়ে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য। ইতিহাসথেকে জানা যায়, আলীবর্দী খাঁর পর ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল সিরাজউদ্দৌলাবাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আসীন হন। তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। তরুণনবাবের সাথে ইংরেজদের বিভিন্ন কারণে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।এছাড়া, রাজ সিংহাসনের জন্য লালায়িত ছিলেন, সিরাজের পিতামহ আলীবর্দী খাঁর বিশ্বস্তঅনুচর মীর জাফর ও খালা ঘষেটি বেগম। ইংরেজদের সাথে তারা যোগাযোগ স্থাপন ওকার্যকর করে নবাবের বিরুদ্ধে নীলনকশা পাকাপোক্ত করে। দিন যতই গড়াচ্ছিলো এভূখণ্ডের আকাশে ততোই কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছিলো।১৭৫৭ সালের ২৩ এপ্রিল কোলকাতা পরিষদ নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার পক্ষে প্রস্তাব পাস করে। এপ্রস্তাব কার্যকর করতে ইংরেজ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ রাজদরবারের অভিজাত সদস্যউমির চাঁদকে এজেন্ট নিযুক্ত করেন। এ ষড়যন্ত্রের নেপথ্য নায়ক মীরজাফর, তা আঁচ করতে পেরে নবাব তাকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করেআব্দুল হাদীকে অভিষিক্ত করেন। কূটচালে পারদর্শী মীর জাফর পবিত্র কুরআন শরীফছুঁয়ে শপথ করায় নবাবের মন গলে যায় এবং মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতি পদেপুনর্বহাল করেন। সমসাময়িক ঐতিহাসিকরা বলেন, এই ভুল সিদ্ধান্তই নবাব সিরাজেরজন্য কালহয়ে দাঁড়ায়।ইংরেজ কর্তৃক পূর্ণিয়ার শওকত জঙ্গকেসাহায্য করা, মীরজাফরের সিংহাসন লাভের বাসনা ও ইংরেজদের পুতুল নবাব বানানোরপরিকল্পনা, ঘষেটি বেগমের সাথে ইংরেজদের যোগাযোগ, নবাবের নিষেধ সত্ত্বেওফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ সংস্কার, কৃষ্ণ বল্লভকে কোর্ট উইলিয়ামে আশ্রয় দানপ্রভৃতি কারণে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আমবাগানে সকালসাড়ে ১০টায় ইংরেজ ও নবাবের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মীর মদন ও মোহনলালের বীরত্ব সত্ত্বেও জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, উমির চাঁদ, ইয়ার লতিফ প্রমুখকুচক্রী প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে নবাবের পরাজয় ঘটে। সেইসাথে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য্য পৌনে দু'শ বছরের জন্য অস্তমিত হয়।পরাজয়েরপর নবাবের বেদনাদায়ক মৃত্যু হলেও উপমহাদেশের মানুষ নবাবকে আজও শ্রদ্ধাজানায়। তার সাথে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি।ঐতিহাসিকমেলেসন পলাশীর প্রান্তরে সংঘর্ষকে 'যুদ্ধ'বলতে নারাজ। তার মতে, 'নবাবেরপক্ষে ছিলো ৫০ হাজার সৈন্য আর ইংরেজদের পক্ষে মাত্র ৩ হাজার সৈন্য কিন্তুপ্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারী ও কুচক্রী মীরজাফর, রায় দুর্লভ ও খাদেম হোসেনের অধীনেনবাব বাহিনীর একটি বিরাট অংশ পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেকার্যত কোনো অংশগ্রহণই করেনি। এই কুচক্রীদের চক্রান্তে যুদ্ধের প্রহসনহয়েছিলো।
' ইতিহাসবিদ নিখিল নাথ রায়ের লেখা 'মুর্শিদাবাদ কাহিনী' থেকে জানা যায়, 'নবাবের সেনা বাহিনীর তুলনায় ইংরেজদের সেনা সংখ্যা ছিলো অনেককম। সেখানে বিশ্বাসঘাতকতা না হলে নবাবের বিজয় ছিলো সুনিশ্চিত।আরেকঐতিহাসিক ড. রমেশ চন্দ্র বলেন, 'নবাব ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন ষড়যন্ত্রের কথাজানার পর যদি মীর জাফরকে বন্দি করতেন, তবে অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারী ভয় পেয়েযেতো এবং ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলে পলাশীর যুদ্ধ হতো না।'ইতিহাসবিদমোবাশ্বের আলী তার 'বাংলাদেশের সন্ধানে' লিখেছেন, 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা প্রায়লাখ সেনা নিয়ে ক্লাইভের স্বল্পসংখ্যক সেনার কাছে পরাজিত হন মীর জাফরেরবিশ্বাসঘাতকতায়।'অতি ঘৃণ্য মীর জাফরের কুষ্ঠরোগে মৃত্যু হয়। কিন্তুবাংলাদের ট্রাজেডি এই যে, মীর জাফরেরা বার বার উঠে আসে। ইতিহাস সাক্ষ্যদেয়, মীর জাফর ও ঘষেটি বেগম প্রচণ্ড ক্ষমতালোভী ও জাতীয়তাবিরোধী ছিলেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে, বিশেষ করে উপমহাদেশের ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধ একটি অন্যতম মোড় পরিবর্তনকারী যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। মূলত পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ই অন্য ইউরোপীয়দের হটিয়ে ভারতে ইংরেজ আধিপত্য বিস্তারের পথ তৈরি করে দেয়। পলাশীর যুদ্ধে জয়ের খবরে লন্ডনে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শেয়ারের দাম নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়, কারণ বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারছিলেন বাংলার সম্পদে কোম্পানীটি এখন হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠবে।
বাংলার ঐশ্বর্যে রবার্ট ক্লাইভ এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি মুর্শিবাদাবাদকে তাঁর দেশের লন্ডন নগরীর সাথে তুলনা করেছিলেন। ক্লাইভের মতে তফাত ছিল একটাই, মুর্শিদাবাদে একটা ধনিক শ্রেণী রয়েছে। সে সময় ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশর বণিকগণ ভারতে আসত ব্যবসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু মোগল শাসকের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে ইংরেজরা কিছু বিশেষ সুবিধা (বাংলায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা) পেয়ে ব্যবসায় সমৃদ্ধি লাভ করে। এক পর্যায়ে বাংলায় ইংরেজ এবং ফরাসীদের মধ্যে ব্যবসায়িক বিরোধ তৈরি হয়। বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার নবাব ছিলেন আলীবর্দী খান। তিনি স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল তাঁর মৃত্যুর পর তরুণ সিরাজউদ্দৌলা নবাব হন। এটি নওয়াব পরিবারের অনেকেই মেনে নিতে পারেন নি। পরিবারের এবং প্রশাসনের অনেকের অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজরা সিরাজউদ্দৌলাকে অপসারণের পথ খুঁজতে থাকে। এক বছরের কিছু বেশি সময় তিনি নবাবী করতে পরেছিলেন।

সিরাজ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই একযোগে তাঁর সকল প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ষড়যন্ত্রকারীদের দমন করতে মনযোগী হন। মুর্শিদাবাদের যে ধনিক গোষ্ঠী সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখছিল নবাব তাদের দমন করে নতুন গোষ্ঠীর উত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেন। যখন ইংরেজরা তাঁর নির্দেশ অমান্য করে ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ নির্মাণ করে, তখন সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং কলকাতার নাম বদলে আলীনগর রাখেন। পরবর্তীতে ইংরেজরা শক্তিবৃদ্ধি করে কলকাতা পুনর্দখলের চেষ্টা করে। এসময় ইংরেজ এবং নবাবের মধ্যে একটি সমঝোতা হলেও ইংরেজরা সেটি মানে নি।

ইরেজদের সাথে নবাবের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আরও কিছু কারণ ছিল:

ইংরেজরা মোগল সম্রাটের দেয়া বাণিজ্যিক সুবিধার অপব্যবহার করতে থাকলে নবাব সেটি বন্ধ করেন এবং ইংরেজ বণিকদের ব্যক্তিগত ব্যবসা বন্ধ করেন।

নবাবের প্রচুর ধনসম্পদসহ রাজবল্লভ পুত্র কৃষ্ণদাস ইংরেজদের আশ্রয় নিলে নবাব তাকে ফিরিয়ে দিতে বলেন। কিন্তু ইংরেজরা তার করতে অস্বীকৃতি জানায়।

ইংরেজরা নবাবের দূত নারায়ণ সিংহকে অপমান করার খবরে নবাব ক্রুদ্ধ হন।

যুদ্ধ
একটি পর্যায়ে ইংরেজরা নবাবকে উৎখাতের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সৈন্যবাহিনী নিয়ে মুর্শিদাবাদের পথে অগ্রসর হয়। সিরাজও তাঁর বাহিনী নিয়ে পলাশীর পথে অগ্রসর হন। ২৩শে জুন সকাল আটটার দিকে যুদ্ধ শুরু হয়। ইংরেজদের বাহিনীর তুলনায় নবাবের বাহিনীর আকার অনেক বড় হলেও মীরজাফর, ইয়ার লতিফ এবং রায় দুর্লভের অধীনস্থ প্রায় দুই তৃতীয়াশ সৈন্য নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে থাকে। মীর মর্দান, মোহনলাল, খাজা আব্দুল হাদী খান, নব সিং হাজারীর নেতৃত্বাধীন সৈন্যরা এবং ফরাসী সৈনিকদের একটি দল যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ক্লাইভ যুদ্ধে ধারণার চেয়ে বেশি প্রতিরোধের সন্মুখীন হন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বৃষ্টিতে নবাব এবং ফরাসীদের কামানের গোলায় ব্যবহৃত গানপাউডার ভিজে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু ইংরেজরা তাদের গান পাউডার সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হয়। জানা যায়, ক্লাইভ দিনে যুদ্ধ চালিয়ে রাতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের এক পর্যায়ে বেলা তিনটার দিকে কামানের গোলার আঘাতে মীর মর্দান নিহত হলে নবাব ভেঙে পড়েন এবং মীর জাফরের কাছে পরামর্শ চান। মীরজাফর নাবাবকে যুদ্ধ বন্ধ করে পরবর্তী দিনে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ করার পরামর্শ দেন।

মোহনলালের প্রবল আপত্তির মুখে নবাব যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দেন। নবাবের সৈন্যরা পিছু হটে আসে। মীরজাফরের বার্তা পেয়ে ইংরেজরা নবাবের অপ্রস্তুত বাহিনীর ওপর হামলা চালায় এবং যুদ্ধে জয়লাভ করে। ফলে প্রায় ২০০ বছরের জন্য বাংলা স্বাধীনতা হারায়। প্রতি বছর সে জন্য ২৩ জুন পলাশী দিবস হিসাবে পালিত হয়। ১৭৫৭ সালের এইদিনে পলাশী প্রান্তরে রবার্ট ক্লাইভ, মীরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফচক্র এই কালো দিবসের জন্ম দেয়। ঘৃণিত কলঙ্কজনক এই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অধ্যায় সৃষ্টির পেছনে জড়িত ছিল বিশ্বাসঘাতক জগৎশেঠ, মাহতাব চাঁদ, উমিচাঁদ, মহারাজা স্বরূপচাঁদ, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, রায়দুর্লভ, মীর জাফর, ঘষেটি বেগম, রাজা রাজবল্লভ, নন্দকুমার প্রমুখ কৌশলী চক্র। এই স্বার্থান্বেষী ষড়যন্ত্রীদের প্রথম শিকার ছিল স্বাধীনতার অতন্দ্রপ্রহরী, মুক্তি সংগ্রামের প্রথম সিপাহসালার নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং তার বিশ্বস্ত সেনাপতি মীরমদন ও প্রধান আমাত্য মোহনলাল কাশ্মিরী। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। কিন্তু তা অন্যসব দিনের চেয়ে ছিল আলাদা। কারণ ওইদিন মুর্শিদাবাদ থেকে ১৫ ক্রোশ দক্ষিণে ভাগিরথী নদীর তীরে পলাশীর আম্রকাননে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাসহ পুরো উপমহাদেশের স্বাধীনতার কবর রচিত হয়েছিল। ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও লর্ড ক্লাইভের মধ্যে এক যুদ্ধ নাটক মঞ্চায়িত হয়। এতে নবাব বাহিনীর পক্ষে সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৬৫ হাজার এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে ছিল মাত্র ৩ হাজার। যুদ্ধের ময়দানে নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীরজাফর ও তার অনুসারী প্রায় ৪৫ হাজার সৈন্য নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। ফলে যুদ্ধে স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির পরাজয় অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের সেবাদাসদের সাহায্যে এভাবেই বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এরপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দীর্ঘ ১৯০ বছর এদেশে শাসন শোষণ করে। কোটি কোটি টাকার অর্থ সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার করে। বাংলাদেশ থেকে লুটকৃত পুজিঁর সাহায্যে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটে। আর এককালের প্রাচ্যের স্বর্গ সোনার বাংলা পরিণত হয় শ্মশান বাংলায়, স্থান পায় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশে। এ যুদ্ধের রাজনৈতিক ফলাফল ছিল ধ্বংসাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। এ যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাংলা ব্রিটিশদের অধিকারে চলে আসে। বাংলা অধিকারের পর ক্রমান্বয়ে ব্রিটিশরা পুরো ভারতবর্ষ এমনকি এশিয়ার অন্যান্য অংশও নিজেদের দখলে নিয়ে আসে। পলাশীর রক্তাক্ত ইতিহাস, পরাধীনতার ইতিহাস, মুক্তিসংগ্রামীদের পরাজয়ের ইতিহাস, ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস, ট্রাজেডি ও বেদনাময় এক শোক স্মৃতির ইতিহাস। এই নৃশংস ও কলঙ্কজনক ঘটনার মাধ্যমে কলকাতা কেন্দ্রিক একটি নতুন উঠতি পুজিঁপতি শ্রেণী ও রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে। ইংরেজ ও তাদের এ দেশীয় দালালগোষ্ঠী দেশবাসীর ওপর একের পর এক আগ্রাসন চালায়। ফলে দেশীয় কৃষ্টি-সৃংস্কৃতি ও সামাজিক জীবনে ব্যাপক বিপর্যয় নেমে আসে। বিকাশমান ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরির ক্ষেত্রে তারা মরণ কামড় দেয়। পলাশী বিপর্যয়ের পর শোষিত বঞ্চিত শ্রেণী একদিনের জন্যও স্বাধীনতা সংগ্রাম বন্ধ রাখেনি। এ জন্যই বৃটিশ কর্তৃপক্ষ সাধারণ জনগণকেই একমাত্র প্রতিপক্ষ মনে করত। ফলে দীর্ঘ দুইশ' বছর ধরে আন্দোলন সংগ্রামের ফলে বৃটিশরা লেজ গুটাতে বাধ্য হয়। পরে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্মলাভ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে নানা রকমের রটনা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক নবাব। যিনি বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রের কারণে স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারেননি। তিনি নিজের ব্যক্তিগত লাভের জন্য দেশপ্রেমকে বিকিয়ে দেননি। জীবন দিয়ে নবাবের সম্মান বজায় রেখেছিলেন।
প্রশ্ন জাগে! নবাব কি যুদ্বে হেরেছিল? না, কুঠনৈতিক ভাবে হেরেছিল?

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর উদ্যোগে প্রথম পলাশী দিবস উদযাপিত হয়েছিল কলকাতায়। সাথে ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং মওলানা আকরম খাঁ। এ ব্যাপারে কবি নজরুলের একটি বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছিল দৈনিক আজাদ এবং মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় ১৯৩৯ সালের জুনে। বিবৃতিতে নজরুলের আহবান ছিল 'মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর নেতৃত্বে কলিকাতায় সিরাজউদ্দৌলা স্মৃতি কমিটি উক্ত অনুষ্ঠানকে সাফল্যমন্ডিত করিবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করিতেছেন। কলিকাতা কমিটিকে সর্বপ্রকার সাহায্য প্রদান করিয়া আমাদের জাতীয় বীরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিবার জন্য আমি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের নিকট আবেদন জানাইতেছি। বিদেশীর বন্ধন-শৃক্মখল হইতে মুক্তি লাভের জন্য আজ আমরা সংগ্রামে রত। সিরাজের জীবনস্মৃতি হইতে যেন আমরা অনুপ্রাণিত হই। ইহাই আমার প্রার্থনা'। (২৯.০৬.১৯৩৯)।
এই প্রার্থনা বিফলে যায়নি। পলাশী দিবস প্রতি বছরই আসে। কখনো সরবে কখনো নীরবে। জাতীয় বীর সিরাজউদ্দৌলাকে স্মরণ করে অনুপ্রাণিত হয়, ব্যথিত হয়। একথা সত্য, নবাব সিরাজ ইতিহাসের এক ভাগ্যাহত বীর, দেশপ্রেমিক। চতুর্মুখি ষড়যন্ত্র তার উত্থানকে ব্যাহত করেছিল।
পরিশেষে করুণ পরিণতি। সিরাজকে হত্যা করা হয় ২রা জুন। এই হত্যাকান্ডের সাথে সাথে বাংলার স্বাধীনতার ঘটে অবসান। যা উদ্ধারে সময় ব্যয় হয়েছিল প্রায় দু'শ বছর। পলাশীর দুর্বিপাক এবং সিরাজ উৎখাতের সাথে যেসব বিশ্বাসঘাতক জড়িত ছিল তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই অপঘাতে মৃত্যু হয়েছিল। জীবনকালেই নানা গঞ্জনা-লাঞ্ছনার ঘূর্ণিপাক তাদের গ্রাস করেছিল। ইতিহাস এমন সত্যকেই উপস্থিত করেছে। বিশ্বাস-হন্তারকদের পরিণতি শুভ হয় না কখনো। দেশ এবং দেশের মানুষকে যারা প্রতারিত করে আখেরে তারা নিজেরাই প্রতারণার ফাঁদে আটকা পড়ে। কিন্তু ইতিহাসের এমন প্রমাণকে অনেকেই আমলে আনতে চায় না। যদিও শতাব্দীর পর শতাব্দী এই জাতীয় ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছে পৃথিবীর মানুষ। বাংলার স্বাধীনতাকে যেসব কুলাঙ্গার বিদেশিদের হাতে সমর্পণ করেছিল নানা কায়দা-কৌশল করে, তাদের প্রতি দেশবাসীর ঘৃণা আর ধিক্কার জুটেছিল অবশেষে। হয়তো এই ধিক্কার এবং ঘৃণা কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে। আসলে সর্বকালেই বিশ্বাস হন্তারকদের ভাগ্যে এমনটাই ঘটে। কেউ অনুভব করে কেউ করতে চায় না।
সিরাজউদ্দৌলা বাঙালি ছিলেন না বিদেশি ছিলেন, সাম্প্রতিক কিছু লেখায় এমন প্রশ্নের অবতারণা করেছেন দু'একজন। স্বাভাবিক নিয়মেই প্রশ্ন আসে, ভারত উপমহাদেশের কত সংখ্যক মানুষের স্থায়ী বসতি ছিল এখানে? অধিকাংশ লোকই তো বাইরে থেকে আসা। বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠী। এরা এখানে এসেছে শাসন করেছে। বিয়ে-শাদি করেছে, সন্তান-সন্তুতি নিয়ে বসবাস করেছে। তাদের শেষ আশ্রয়ও এ মাটিতেই। নবাব সিরাজউদ্দৌলাও এদেরই একজন। ব্যতিক্রম কেবল বৃটিশ। এরা এসে সম্পদ লুণ্ঠন করে আবার নিজ দেশে ফিরে গেছে ধন-সম্পদ নিয়ে। এই যে বাংলা, বাংলাদেশের নামকরণ এবং সীমা সহরতওতো করেছিলেন সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ। তা-ও ১৩৩৮ সালের দিকে। তার রাজ্যের নাম ছিল সুবেহ বাঙ্গালা। তিনি বিশ্বদরবারে নিজেকে পরিচিত করেছিলেন শাহে বাঙ্গালা নামে। তাহলে বাঙালি অবাঙালির ফারাকটা কোথায় গিয়ে ঠেকল? নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যারা বাঙালি-অবাঙালির বেড়াজালে ফেলতে চায় তারা আসলে মীরজাফর-জগৎশেঠদেরই উত্তরপ্রজন্ম। ক্লাইভ-হেস্টিংসদের তল্পিবাহক। নবাব সিরাজ ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। তিনি বাংলাকে ভালবেসেছিলেন, এদেশের মানুষকে ভালবেসেছিলেন। এদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছিলেন এটিই ইতিহাসের চরম সত্য। পরবর্তী সময় ইংরেজদের বেতনভুক কিছু কর্মচারী-চাটুকার ইতিহাস রচনা করেছিলেন, যে ইতিহাসে নবাবকে 'অপরিণামদর্শী চরিত্রহীন' ইত্যাকার বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়েছে। যার ধারাবাহিকতা অদ্যাবধি চলমান।'
রজতকান্তি রায় 'পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ' শিরোনামে একটি পুস্তক রচনা করেছেন। প্রচুর পরিশ্রম করেছেন, সময় ব্যয় তো অবশ্যই হয়েছে। তবে রজত বাবু পূর্বসুরীদের পদাংকই অনুসরণ করেছেন তার সমগ্র গবেষণায়(?)। এসব পুস্তক রচনার একমাত্র উদ্দেশ্যই যেন সিরাজ-সিরাজের গোটা পরিবারের চরিত্র হনন। রজত বাবুও ইনিয়ে বিনিয়ে কায়দা কৌশলে এই 'মহত' কর্মটি করেছেন। পলাশী ষড়যন্ত্রের মূল চক্রান্তকারী জগৎশেঠকে তিনি 'ঋষি-যুধিষ্ঠি' রূপে চিহ্নিত করেছেন। তিনি লিখেছেন-দেওয়ানী বিভাগের প্রভাবশালী হিন্দু মুৎসুদ্দিয়ান এবং মুর্শিদাবাদ খাজাঞ্চীখানার অধিপতি জগৎশেঠ পরিবার আদপেই কোম্পানীর ধামাধরা ছিলেন না।' চমৎকার গবেষণা তো বটেই। রজত বাবু নবাব সিরাজের চরিত্রের উপর রাজ্যের কলঙ্ক চাপিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, সিরাজের আম্মা আমেনা বেগমের চরিত্র হননেও যথেষ্ট মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। তিনি লিখছেন-গহসেটি বেগম তাঁর প্রণয়ের পাত্র হোসেন কুলী খানের উপরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। হোসেন কুলী খানের অপরাধ তিনি গহসেটি বেগমকে ত্যাগ করে তার ছোট বোন আমিনা বেগমের কাছে যাতায়াত শুরু করেছেন।' রজত বাবু আমেনা বেগমের পরিচয় প্রকাশ করতেও আগ্রহের আতিশয্য দেখিয়েছেন। আমেনা বেগম কে? 'আমিনা বেগম সিরাজের মা।' এগুলো আসলে রজত বাবুদের স্বভাবজাত অভ্যাস। সিরাজের প্রতি রাগ-গোস্যা থেকে উদ্গত। রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ হতে শুরু করে আজকের রজতকান্তি রায়দের চেহারা স্বভাবে তেমন কোন পরিবর্তন লক্ষ্যযোগ্য হচ্ছে না। ক্লাইভের তস্য প্রজন্মরূপেই যেন এদের উপস্থিতি এবং উপছায়া। নবাব সিরাজের চরিত্র হনন করে এমন তথাকথিত গবেষণা পুস্তক রচিত হয়েছে অনেক। বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে বা বিভ্রান্ত হয়ে যারাই সিরাজকে কলঙ্কিত করেছে শেষাবধি এরা নিজেরাই লজ্জিত হয়েছে, অপদস্থ হয়েছে। ইংরেজদের বিষয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাকি প্রায়শই বলতেন, 'এদের শায়েস্তা করতে হলে একজোড়া পয়জার চাই, আর কিছু না'। নবাব সিরাজ যদি জীবিতাবস্থায় তাঁকে নিয়ে অর্বাচীনদের রচিত পুস্তকসমূহ পাঠ করার সুযোগ পেতেন তবে হয়তো তিনি এদের ব্যাপারেও উচ্চারণ করতেন -এইসব তথাকথিত গবেষকদের(?) শায়েস্তা করতে হলে একজোড়া পয়জার চাই। অর্থাৎ একজোড়া চটি।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধরগণ এখন ঢাকায়। এটি একটি আনন্দের বার্তা। আনন্দের বার্তা এজন্যে যে তারা ঢাকায় বসবাস করছেন। খোদানাখাস্ত যদি তারা কলকাতা বা ভারতের কোন এলাকায় বসবাস করতেন তবে তাদের অস্তিত্ব নিয়েই সংশয় দেখা দিত। কয়েক বছর আগে পত্রিকায় এসেছিল মহিশূরের বাঘ টিপুর বংশধররা এখন কলকাতায় রিকশা চালক। সে সব এলাকায় এরকম আরো অনেক ঐতিহ্যমন্ডিত পরিবার ধ্বংসের দরজায় উপনীত। সৌভাগ্য যে, নবাব সিরাজের পরিবার মূল বাংলার নাগরিক। যে বাংলার শাসক ছিলেন তাদেরই পূর্বপুরুষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা জং বাহাদুর। নবাব সিরাজ তো কেবল বাংলাই নয় বিহার এবং উড়িষ্যারও নবাব ছিলেন। বিহার ও উড়িষ্যায় সিরাজের অবস্থান কতটুকু? 
শেষকথা
যদিও ইংরেজরা আরও কিছুদিন নবাবী ব্যবস্থা বহাল রাখে, কিন্তু তারা সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে ইংরেজদের অধীনে ছিলেন। এরপর নবাব মীর কাসিম একটি চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ১৭৬৪ সালে বাক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন।
পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের বিজয় কোন সামরিক বিজয় ছিল না। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক বিজয়। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে আট ঘন্টার এই যুদ্ধকে 'যুদ্ধ' না বলে ছোট দাঙ্গার সাথে তুলনা করা যায়। কিন্তু এ যুদ্ধই ভারতে ইংরেজ উপনিবেশের সূচনা করে এবং বাংলা প্রায় ২০০ বছর ইংরেজদের অধীনে থাকে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন পলাশীর যুদ্ধের ফল বিপরীতটি হলে ইংল্যান্ড নয় বাংলাই বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিতে পারত।
নবাব সিরাজের শাহাদাত দিবস আজ। সিরাজকে স্মরণ করলে বিশ্বাসঘাতকদের চেহারা উন্মোচিত হয়। স্বাধীনতার দুশমনদের চিহ্নিত করা যায়। তাই যত অধিক নবাব সিরাজকে স্মরণে আনা যায় ততই মঙ্গল।

লেখক : ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম , বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও 
রাজনীতিবিদ, জিয়া পরিষদের সহ আর্ন্তজাতিক বিষয়ক সম্পাদক, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের যুক্তরাজ্য শাখার যুগ্ম আহবায়ক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম 
যুক্তরাজ্য শাখার সাবেক সহ সভাপতি, শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক রিসার্চ ইনস্টিটিউট'র প্রতিষ্ঠিতা এবং চার্টাড ইনস্টিটিউট অব লিগ্যাল এক্সিকিউটিভের মেম্বার 



__._,_.___

Posted by: Shahadat Hussaini <shahadathussaini@hotmail.com>


****************************************************
Mukto Mona plans for a Grand Darwin Day Celebration: 
Call For Articles:

http://mukto-mona.com/wordpress/?p=68

http://mukto-mona.com/banga_blog/?p=585

****************************************************

VISIT MUKTO-MONA WEB-SITE : http://www.mukto-mona.com/

****************************************************

"I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it".
               -Beatrice Hall [pseudonym: S.G. Tallentyre], 190





__,_._,___