http://www.sonarbangladesh.com/article.php?ID=6718
সুভাষ বনাম জওয়াহেরলাল
এবনে গোলাম সামাদ
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ইতিহাসে সুভাষচন্দ্র বসু [১৮৯৭-১৯৪৫] একটি খুবই স্মরণীয় নাম। তার কথা বাদ দিয়ে এই উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস রচিত হতে পারে না। সুভাষ বসু ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। তিনি বিলাত থেকে আইসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং প্রশাসনের ব্যাপারে গ্রহণ করেন বিশেষ প্রশিক্ষণ। কিন্তু বিলাত থেকে ফিরে তিনি লোভনীয় সরকারি চাকরি গ্রহণ না করে, গ্রহণ করেন ব্রিটিশ শাসন থেকে এই দেশকে স্বাধীন করার ব্রত। তিনি যোগ দেন দেশবরেণ্য নেতা চিত্তরঞ্জন দাসের সাথে। ১৯২১ সালে জেলে যান আইন অমান্য আন্দোলন করে। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। কিন্তু আবার হলেন কারারুদ্ধ। ব্রিটিশ ভারত সরকার এবার তাকে পাঠায় বার্মার [মিয়ানমার] মান্দালয় জেলে। সেখানে তার স্বাস্খ্যের অবনতি ঘটায় তাকে মুক্তি দেয়া হয়। সুভাষ কংগ্রেস দলে যোগদান করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি হরিপুরা কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধীর বিরোধিতা সত্ত্বেও। সে সময় কংগ্রেস মূলত পরিচালিত হতো গাìধীজির নেতৃত্বে। গান্ধীজির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কংগ্রেসের সভাপতি হওয়া সহজ ব্যাপার ছিল না। পরে সুভাষ বসু কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গড়েন নতুন রাজনৈতিক দল যার নাম দেন 'ফরোয়ার্ড ব্লক'। দলটি কিছু দিনের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সুভাষ বসুকে ব্রিটিশ সরকার আবার গ্রেফতার করে। কিন্তু স্বাস্খ্যগত কারণে তাকে তার নিজ বাড়িতে নজরবন্দী করে রাখে। সুভাষ একদিন পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন কলকাতা থেকে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে। পরে কাবুল থেকে মস্কো হয়ে যান জার্মানির রাজধানী বার্লিনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি বার্লিন থেকে চলে যান জাপানের রাজধানী টোকিওতে। তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে জাপানের হাতে বন্দী ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে গড়েন আজাদ হিন্দু বাহিনী। তিনি এই বাহিনীর সাহায্যে এই উপমহাদেশ স্বাধীন করতে চান। কিন্তু তার আশা সফল হয়নি। জাপান পরাজিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। সুভাষ বসু মারা যান এক বিমান দুর্ঘটনায়।
জওয়াহেরলাল নেহেরু [১৮৮৯-১৯৬৪] ছিলেন ভিন্ন ধরনের নেতা। তার জন্ম ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ শহরে। তিনি ছিলেন বিশেষভাবে হিন্দিভাষী এলাকার মানুষ। তিনি আগাগোড়া রাজনীতি করেছেন গাìধীজির নেতৃত্বে। জওয়াহেরলালের বাবা মতিলাল নেহরুও ছিলেন একজন খুবই খ্যাতিমান কংগ্রেস নেতা। তিনি আইন ব্যবসা করে প্রচুর বিত্তের অধিকারী হন। তিনি ছেলে জওয়াহেরলালকে পড়াশোনার জন্য পাঠান বিলাতে। জওয়াহেরলাল তার স্কুলজীবনে পড়াশোনা করেন বিলাতের বিখ্যাত স্কুল হ্যারোতে। পরে তিনি পড়াশোনা করেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। গ্রহণ করেন ট্রাইপোজ ডিগ্রি। বিলাতে তিনি ব্যারিস্টারিও পাস করেন। তিনি ছিলেন মনের দিক থেকে বিশেষভাবে ব্রিটেনের চিন্তা-চেতনার দ্বারা আচ্ছন্ন। তিনি বিলাতে মিশেছেন সে দেশের খুবই উচ্চবিত্তসম্পন্ন পরিবারের সন্তানদের সাথে। তার চিন্তা-চেতনায় পড়েছে তাদের প্রভাব। জওয়াহেরলাল কোনো দিন এই উপমহাদেশে আমজনতার নেতা ছিলেন না। জনগণের সাথে ছিল বিশেষ দূরত্ব। তিনি জেল খেটেছেন একাধিকবার। জেলে বসে লিখেছেন একাধিক বই। এ দিক থেকে তাকে বলা যায় একজন বুদ্ধিজীবী নেতা। জওয়াহেরলাল ছিলেন সুভাষ বসুর বিশেষ সমালোচক। কেবল যে রাজনৈতিক কারণেই তিনি সুভাষ বসুর সমালোচনা করতেন তা নয়, তিনি ছিলেন বিশেষভাবেই বাঙালিবিদ্বেষী। জওয়াহেরলালের সুভাষ বসু বিরোধিতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় বাঙালিবিদ্বেষের বিশেষ প্রচ্ছায়া। জওয়াহেরলাল আত্মজীবনীতে লিখেছেন 'বাংলার তরুণরা সন্ত্রাসবাদী। এই সন্ত্রাসবাদ স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য হয়ে উঠেছে ক্ষতিকর।' ১৯৪৭ সালে জওয়াহেরলাল হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনি মারা যান ১৯৬৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্খায়।
জওয়াহেরলালের মধ্যে ছিল অনেক স্ববিরোধিতা। তিনি ছিলেন গণতন্ত্রে আস্খাশীল, কিন্তু তিনি তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে করে যেতে চান কংগ্রেসের কর্ণধার। চান তাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী করে যেতে। তিনি রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী না হলেও ভারতে করে গেছেন বংশের রাজনীতির সূত্রপাত, যা হয়ে উঠতে চাচ্ছে প্রায় রাজতন্ত্রেরই শামিল। জওয়াহেরলাল বলেছেন সেকুলারিজমের কথা। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি প্রথমেই যে কাজটি করেন তা হলো, সোমনাথের মন্দির পুনর্নির্মাণের জন্য রাষ্ট্রিক অর্থ প্রদান। তিনি মনের দিক দিয়ে থেকে গেছেন হিন্দুত্ববাদী। সুভাষচন্দ্র বসু ও জওয়াহেরলালের মধ্যে আমরা তুলনামূলক আলোচনা করছি। এই তুলনামূলক আলোচনার একটি বিশেষ কারণ আছে। বসু পরিবারের কন্যা শর্মিলা বসু Dead Reckoning নামে একটি বই লিখেছেন। বইটিতে তিনি দেখিয়েছেন '১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী বাংলাদেশে হত্যা, লুটপাট, নারী ধর্ষণ করেনি। তাদের সম্পর্কে যা বলা হয়, তার বেশির ভাগই হলো তৈরি করা মিথ্যা। শর্মিলা বসু খুবই উচ্চশিক্ষিতা। তিনি লেখাপড়া করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে তিনি পিএইচডি অর্জন করেন। তিনি গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন বিলাতের বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার দুই ভাই সুগত ও সুমন্ত্র বসু ইতিহাস পড়াচ্ছেন যথাক্রমে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন School of Economics–এ। শর্মিলা বসুর দাদু শরৎচন্দ্র বসু হলেন সুভাষ চন্দ্র বসুর আপন ভাই। শরৎচন্দ্র বসুও ছিলেন একজন নামকরা নেতা যদিও সুভাষচন্দ্র বসুর মতো অতটা বড় নেতা ছিলেন না তিনি। শরৎচন্দ্র বসু ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মিলে ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল প্রস্তাব রেখেছিলেন স্বাধীন বাংলার। কিন্তু তাদের এই প্রস্তাব পাস হতে পারেনি কংগ্রেসের বিরোধিতার কারণে। জওয়াহেরলাল ছিলেন পৃথক স্বাধীন বাংলা গঠনের ঘোরবিরোধী।
তিনি চেয়েছিলেন বাংলার বিভক্তি। তিনি ভেবেছিলেন বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্ত হলে যে পাকিস্তান গঠিত হবে তা টিকবে না। কিন্তু তার এ ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। জওয়াহেরলাল তনয়া ইন্দিরা গাìধী ষড়যন্ত্র আঁটতে থাকেন সাবেক পাকিস্তান ভেঙে দেয়ার। যার সুযোগ তিনি পেয়ে যান ১৯৭১ সালে। ভারত বাংলাদেশে পাক সেনাবাহিনীর অত্যাচার সম্পর্কে অনেক কথা প্রচার করেছে, শর্মিলা বসুর লেখায় যা সত্য প্রমাণিত হতে পারছে না। আমাদের দেশের অনেক আওয়ামী লীগপন্থী এর জন্য শর্মিলা বসুর নিন্দায় মুখর হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তাকে খণ্ডন করার জন্য প্রকাশ করছেন না কোনো গবেষণামূলক গ্রন্থ। সাবেক পাকিস্তান ভেঙেছে ইন্দিরা গান্ধীর ষড়যন্ত্রে ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে। শেখ মুজিব এরকম ভাঙন চাননি। তিনি চেয়েছিলেন একটা আলাদা ধরনের ফেডারেশন গড়তে। তিনি তার কন্যার মতো ইন্দিরা গাìধীকে পুরস্কৃত করার কথা কল্পনাও করতে পারেননি।
আজকের ভারতের রাজনীতি হয়ে উঠেছে বিশেষভাবে জওয়াহেরলাল নেহরু কন্যার ঐতিহ্য-নির্ভর। সোনিয়া গাìধী জন্মেছিলেন ইটালির তুরিন [Turin] শহরের কাছে ১৯৪৬ সালে। তার কুমারী নাম সোনিয়া মাইনো [Sonia Maino]। তিনি জওয়াহেরলালের দৌহিত্র রাজীব গাìধীকে বিবাহ করেন ১৯৬৮ সালে। সেই সুবাদে সোনিয়া গাìধী এখন হতে পেরেছেন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। তার ছেলে রাহুল হতে পেরেছেন কংগ্রেসের সেক্রেটারি। কিন্তু তাদের মা-ছেলের শাসন ভারতে কত দিন চলবে, তা বলা যাচ্ছে না। ভারতে অভ্যুদয় ঘটছে আন্না হাজারের মতো ব্যক্তিদের। শর্মিলা বসুর মতো গবেষকরা গবেষণা করে লিখছেন বই, যাতে প্রকাশ পাচ্ছে এমন অনেক সত্য, যা ভারত সরকার ও তার প্রচারযন্ত্র রাখতে চেয়েছে ঢেকে। শর্মিলা বসু, বসু পরিবারের কন্যা। তার সাথে ইন্দিরা গাìধী ও তার বংশের রাজনীতি খাপ খেতেই পারে। শর্মিলা বসু কেন বইটা লিখেছেন আমরা তা বলতে পারি না। তবে মনে হচ্ছে, এর মধ্যে থাকছে তার বংশগত ঐতিহ্যের ছাপ। শর্মিলা বসু হলেন খ্যাতনামা লেখক। নিরদচন্দ্র চৌধুরীর ভাগ্নিও। মাতুলের কিছু প্রভাবও পড়ে থাকতে পারে। নিরদ চৌধুরী মনে করতেন পাকিস্তান হওয়াটা ছিল অনিবার্য। হিন্দুসমাজের গোঁড়ামি মুসলমান সমাজকে দিয়েছে দূরে ঠেলে। তারা মেনে নিতে পারেনি কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে।
শর্মিলা বসু তার Anatomy of Violence; Analysis of Civil War in East Pakistan in 1971 নামক একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধে বলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে বিষয়গতভাবে আলোচনা হওয়া উচিত। না হলে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে টিকে থাকবে ভুল বোঝাবুঝি। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ একদিক থেকে দেখলে, ছিল অখণ্ড পাকিস্তানপন্থী ও স্বাধীন বাংলাদেশপন্থীদের মধ্যে যুদ্ধ। দুই পক্ষেরই ছিল যুক্তি। দুই পক্ষই করেছে বাড়াবাড়ি, কেবল একপক্ষই নয়। বাংলাদেশে বাংলাভাষী মুসলমান যেমনভাবে উর্দুভাষী মুসলমানকে হত্যা করেছে, সেটাকে সমর্থন দেয়া যায় না; যা পড়ে কার্যত যুদ্ধাপরাধেরই মধ্যে। যুদ্ধাপরাধের ঘটনা একতরফাভাবে ঘটেনি। যুদ্ধাপরাধের বিচার হতে গেলে সব পক্ষের যুদ্ধাপরাধীদেরই হতে হবে।' তার এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে ৮ অক্টোবর। শর্মিলা বসু তার তথ্যানুসন্ধানের জন্য নিজে বাংলাদেশে এসে অনেক অঞ্চলে ঘুরেছেন এবং গ্রহণ করেছেন একাধিক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার। তিনি কেবলই পত্রপত্রিকার খবরের ওপর নির্ভর করে তার গবেষণামূলক প্রবìধটি লিখেন নি। শর্মিলা বসু বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার কথা। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে পাকবাহিনী গুলি করে। কিন্তু তার স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাদের তারা গুলি করে হত্যা করেনি। একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ইমারতে বসবাসকারী একজন মুসলিম অধ্যাপক মুনিরুজ্জামানকে হত্যা করে তার তিনজন আত্মীয়সহ। মুসলিম জেনেও পাকবাহিনী তাদের হত্যা করেছিল। পাকবাহিনী যে কেবল হিন্দুকেই হত্যা করেছে এমন নয়। সাংবাদিক ম্যাসকারেনহাস লিখেছেন পাকবাহিনী ঢাকার বিখ্যাত শাঁখারীপট্টিতে গুলি চালিয়ে নরনারী ও শিশুসহ প্রায় আট হাজার মানুষকে মেরে ফেলে।' কিন্তু এই বিবরণ সম্পূর্ণ মিথ্যা। শর্মিলা বসুর মতে, শাঁখারীপট্টিতে হত্যা করা হয় মাত্র ১৪ জন পুরুষ ও একজন শিশুকে। শিশুটি ছিল তার বাবার কোলে। শিশুটির বাবার নাম ছিল ভূদেব সুর। আর তার সন্তানের নাম চন্দন। পাক সৈন্যরা বাড়ি বাড়ি ঢুকে কাউকে হত্যা করেনি। শর্মিলা বসু এটা জেনেছেন নিজেই অনুসìধান করে; শাঁখারীপট্টির বেঁচে যাওয়া লোকদের সাথে কথা বলে। এরকম অনেক তথ্যই শর্মিলা বসু উল্লেখ করেছেন। আমরা তার সিদ্ধান্তগুলোর সাথে একমত না হতে পারি। কিন্তু তিনি ১৯৭১ সালের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে লিখতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন, তাকে সহজেই মিথ্যা বলতে পারি না। শর্মিলা বসু যথেষ্ট সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা, যে পরিবার এই উপমহাদেশের রাজনীতির সাথে বিশেষভাবে জড়িত। শর্মিলা বসু ভুল করতে পারেন, কিন্তু তাই বলে তাকে 'পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে কাজ করছেন' বলে সমালোচনা করা যায় না।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
[সূত্রঃ নয়া দিগন্ত, ২৯/০৮/১]
__._,_.___