প্রবীর সিকদারের মুক্তি স্বস্তি এনেছে
শুক্রবার, ২১ আগস্ট ২০১৫
প্রবীর সিকদার মুক্তি পেয়েছেন। ভালো সংবাদ। শুনে সবাই খুশি। কথায় বলে 'শেষ ভালো যার, সব ভালো তার'। শেষ পর্যন্ত সবাই আশ্বস্ত। সত্য জয়ী হয়েছে। মুক্তির পরে একই কথা বলেছেন প্রবীর সিকদার, 'অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় জয়ী হয়েছে'। কিন্তু সমস্যার পূর্ণ সমাধান এখনো হয়নি। জামিন হয়েছে। অযথা হয়রানি থামেনি। মামলা প্রত্যাহার হয়নি। সেটাও হওয়া প্রয়োজন। যারা এই গ্রেপ্তার নাটকের পেছনে তাদের মুখোশ উন্মোচন হওয়াটাও জরুরি। গণতন্ত্র, প্রগতিশীলতার স্বার্থেই তা দরকার।
পঙ্গু সাংবাদিক প্রবীর সিকদার গ্রেপ্তারে ক্ষমতার পেছনে ঘাপটি মেরে থাকা 'রাজাকার শক্তি' জয়ী হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি জয়ী হয়। মন্ত্রীর চেয়েও শক্তিশালী কেউ এই মুক্তির পেছনে তা বলা বাহুল্য। বিশ্বাসের এই জায়গাটি এখনো অটুট আছে বলেই প্রগতিশীল শক্তি বারবার হোঁচট খেলেও মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়ে আছে এবং থাকবে। জাতীয় শোক দিবসে বিটিভিতে জাতির পিতার সামনে দাঁড়িয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার সেই অঙ্গীকারটি দেখছিলাম, যেখানে তিনি বলছেন, 'জীবন গেলেও তোমার অসম্পূর্ণ কাজ আমি সম্পন্ন করব'। এটাই বিশ্বাস, এখানেই আমাদের আস্থা।
শহীদ পরিবারের সন্তান শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বিএনপি আমলে। পঙ্গু সাংবাদিক প্রবীর সিকদার গ্রেপ্তার হলেন আওয়ামী লীগ আমলে। তিনি শহীদ পরিবারের সন্তান। তার পরিবারে বাবাসহ ১৪ জন ১৯৭১ সালে নিহত হয়েছেন। রাজাকারের বিরুদ্ধে লেখনি ধরে তিনি গ্রেপ্তার হলেন। তিনি পঙ্গু। বিএনপি আমলে একই কারণে তিনি মার খেয়ে পঙ্গু হয়েছেন। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও এ ঘটনায় ব্যাপক হৈচৈ পড়ে যায়। চেঞ্জ ডট অর্গ-এ প্রবীর সিকদারের মুক্তির দাবিতে একটি পিটিশন দিলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ হাজার স্বাক্ষর পড়ে। প্রবীর বাবুর মুক্তির পরও তা চলতে থাকে। স্টেট ডিপার্টমেন্টসহ বিশ্বের বিভিন্ন সরকার এবং মানবাধিকার সংস্থার কাছে আবেদন পৌঁছায়। তার মুক্তির দাবিতে বিশ্ব নড়েচড়ে বসে। ঠিক সেই মুহ‚র্তে তাকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্তটি অভিনন্দনযোগ্য।
প্রবীর সিকদার গ্রেপ্তার নাটকের পেছনে ক্ষমতাধর কে আছেন, তা এখন আর অস্পষ্ট নয় কারো কাছেই। প্রবীর বাবুর মুক্তিতে তিনি হেরেছেন। জনগণ জিতেছে। সাংবাদিকরা জিতেছেন। আওয়ামী লীগ জিতেছে। পঙ্গু সাংবাদিক প্রবীর সিকদার গ্রেপ্তার কেসটি একটু পর্যালোচনা করা যাক। তিনি গ্রেপ্তার হন সন্ধ্যা ৬টায়। রাত ১১টায় ফরিদপুরে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। মামলাটি আইসিটি অ্যাক্ট-এ। রাতেই বন্দিকে তড়িঘড়ি ফরিদপুর নিয়ে যাওয়া হয়। সকালে কোর্টে হাজিরা। ভাবতে অবাক লাগে আমাদের পুলিশ এত দক্ষ হয়ে গেল কবে থেকে?
এখানে দুটি বিষয় বিবেচ্য- এক. এত দ্রুততার সঙ্গে তাকে ফরিদপুর নেয়ার প্রয়োজন পড়ল কেন? দুই. মন্ত্রী নিজে মামলা না করে একজন হিন্দু স্বপন পালকে দিয়ে মামলা করালেন কেন? দুটো প্রশ্নের একটিই উত্তর, ফরিদপুর ক্ষমতাধর এক মন্ত্রীর রাজত্ব, মন্ত্রীর অঙ্গুলি হেলনে সেখানে সবকিছু হয়। রাজনীতি, প্রশাসন, সবই তার নিয়ন্ত্রণে। তদুপরি, স্বপন পালকে দিয়ে মামলা করানোর অভিসন্ধি হয়তো 'হিন্দুর বিরুদ্ধে হিন্দু' পলিসি। যদিও বাদী মামলা করেছেন পূজা পরিষদের নেতা হিসেবে, কিন্তু এ তথ্যও মিডিয়ায় এসেছে যে, তিনি এপিপি, এসিস্টেন্ট পাবলিক প্রসিকিউটর। প্রশাসনের লোক। তবে কি স্বপন পাল মামলা করতে বাধ্য হয়েছেন?
যিনি এ নাটক ঘটিয়েছেন তার এখানে একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল। তিনি একজন সাংবাদিকের গায়ে হাত দিয়েছেন। আমরা ভুলে যাই, সামান্য একজন সাংবাদিক পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পতন ঘটিয়েছিলেন। কে জানে সামান্য সাংবাদিক প্রবীর সিকদার গ্রেপ্তার নাটকের মধ্য দিয়ে মন্ত্রীর পতন প্রক্রিয়া শুরু হলো কিনা! এখন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুতেও পারে! প্রবীর সিকদার গ্রেপ্তারে দেশের সাংবাদিক সমাজ বিগড়ে যায়। সরকারের একটি অংশ প্রমাদ গোনে। এই অংশটিই এগিয়ে এসে সমস্যার সমাধান করে। এদের সাধুবাদ জানাতে হয়। প্রথমে তিনি গ্রেপ্তার হলেন আইসিটি আইনে। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, তা নয়, তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন সুনির্দিষ্ট অভিযোগে। এতে বোঝা গেল সরকারের ওপরের মহল সজাগ। কারণ আইসিটি আইনে মামলা হলে জামিন হতো না, কাজেই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এল। আবার রিমান্ড হলো তিনদিনের জন্য, একদিন পরই পুলিশ জানাল তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ। কে বলে আমাদের পুলিশ অদক্ষ? গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছিল পুলিশ তাদের শিকার উগড়ে ফেলতে চাইছে, দক্ষতার কারণ সেটাই।
সাংবাদিকদের বিশাল ভূমিকা এতে স্পষ্ট। গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গে মনজুরুল আহসান বুলবুলের ফেসবুক পোস্টিং, 'তিনি মুক্তি পাচ্ছেন' ইঙ্গিত করে যে সাংবাদিকরা বসেছিলেন না। বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকদের ভূমিকাও চমৎকার। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথা, 'আর বসে থাকা যায় না'- সঠিক সময়ে সঠিক বক্তব্য। সাকা চৌধুরীর ফাঁসির নির্দেশের পর দেশব্যাপী নতুন করে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল, এই গ্রেপ্তার তাকে ঘনীভূত করে। কিন্তু মুক্তিতে অচিরেই সেটা দূরীভূত হয়। আমার একটি ঘটনা সব সময় মনে পড়ে, তাহলো, বঙ্গবন্ধুর বৃদ্ধ পিতা মারা যাওয়ার পর টিভিতে আমরা মোশতাককে যত কাঁদতে দেখেছি, জাতির পিতাও ততটা কাঁদেননি। আমাদের ভয়টা সেখানেই। কথায় বলে, 'অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ'।
প্রবীর সিকদারের মুক্তিতে 'মহাক্ষমতাধর ব্যক্তিটি' হোঁচট খেয়েছেন। শিকার তিনি ধরে রাখতে পারলেন না। সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হলো, ফরিদপুরের প্রশাসন, রাজনীতিক বা সাধারণ মানুষ জানলো, 'বাঘের ওপরে টাগ আছে'। হয়তো ফরিদপুরে এখন অনেকে কথা বলতে সাহস পাবেন। দেশের সাংবাদিক মহল তার ওপর নজর রাখলেও রাখতে পারেন। দেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এগিয়ে আসতে পারেন। প্রবীর সিকদার গ্রেপ্তার ঘটনায় দেশের ভাবমূর্তি আর একবার ক্ষুণœ হলো। কার কারণে এটা হলো তা এখন পরিষ্কার। প্রবীর সিকদার দাগি আসামি নন যে তাকে চোরের মতো গ্রেপ্তার করতে হবে। এতে সরকারের কট্টর সমর্থকরাও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন। এটা ক্ষমতার অপব্যবহার। মিডিয়ায় তাই এসেছে, সরকার কি ক্ষমতায় থাকতে চান না? একটু ঘুরিয়ে বললে এভাবে বলা যায়, সরকারের মধ্যেই কি কেউ চান না এই সরকার ক্ষমতায় থাকুক? মোশতাক কিন্তু ক্ষমতাতেই ছিল। এই ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র জাসদের সভাপতি আব্দুল মুসাব্বির ফোন করে খুব দুঃখের সঙ্গেই বললেন, 'দাদা, বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছি, নেত্রীকে হারাতে চাই না'। বাতাসে গুঞ্জন আছে, আত্মীয়তার সুবাদে কেউ কেউ সরকার প্রধানকে ব্লু্যাকমেইল করতে চাইছেন।
নিউইয়র্ক, ১৯ আগস্ট ২০১৫।
শিতাংশু গুহ : কলাম লেখক।
SitangshuGuha 646-696-5569
__._,_.___