শংকর কুমার দে ॥ রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারসহ তিনজন ৭০ লাখ টাকাসহ বিজিবির সদর দফতরে আটক নাটকের কাহিনী শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না। কোন প্রভাবশালী মহলের ইন্ধনে ড্রাইভারকে হাত করে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলার অপচেষ্টা কিনা তা নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। রেলমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘোষণা, রেলমন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক তালুকাদারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি, রেলের পূর্বাঞ্চলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও রেলের কমান্ড্যান্ট এনামুল হককে সাসপেন্ড করার পর এখন ঘুরেফিরে এ ধরনের প্রশ্ন তদন্তের সামনে চলে আসছে। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), তদন্ত কমিটি, গোয়েন্দা সংস্থা।
এক সপ্তাহ আগে গত ৮ এপ্রিল মধ্যরাতে ৭০ লাখ টাকাসহ রেলমন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার, রেলের পূর্বাঞ্চলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা, রেলের কমান্ড্যান্ট এনামুল হক রেলমন্ত্রীর বাসভবন অভিমুখে যাওয়ার পথে তাদের বহনকারী গাড়িটি বিজিপি সদর দফতরে ঢুকিয়ে দেয় ড্রাইভার আলী আজম। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সোমবার সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত তদন্তের স্বার্থে ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব নিয়ে তিনি পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু সেই রাতের ঘটনার পরদিন রেলমন্ত্রী বলেছেন, গভীর রাতে তাদের আটকের সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়ার টিভি ক্যামেরা ঘটনাস্থলে গেল কিভাবে? গভীর রাতে তাদের খবর দিয়েছে কে? কেউ না কেউ তাৎক্ষণিকভাবে ফোন করে মিডিয়া, বিশেষ করে টিভি ক্যামেরাকে খবর দিয়েছে। তা না হলে তো গভীররাতে তাদের আসার কথা নয়। কে বা কারা মিডিয়া, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে আটকের ঘটনার পর পর খবর দিয়েছে তা খুঁজে বের করা না গেলে ঘটনার নেপথ্যের অনেক কাহিনীই অজানা থেকে যাবে।
রেলমন্ত্রী সেই রাতের ৭০ লাখ টাকাসহ সেই আটক কাহিনীর ঘটনার ব্যাপারে সাংবাদিকদের জানানোর জন্য ১২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তিনি। তিনি রেলকে দুর্নীতিমুক্ত করতে গিয়ে একটি গ্রুপ তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। আজীবন তীর ছুড়েছি। এবার তীরবিদ্ধ হয়েছি। তীরের কি জ্বালা আমি বুঝি। রাজনৈতিক মিত্রের সঙ্গে তাঁর শত্রুর সংখ্যাও কম নয়। তাহলে কি তিনি সত্যিই ষড়যন্ত্রের শিকার? রেলমন্ত্রীর নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত তদন্তের স্বার্থে পদত্যাগের পর তিনি ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন বলে যে দাবি করেছেন তা এখন তদন্তকারীদের খুঁজে বের করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
সেই রাতের আটক ও ছাড়া পাওয়ার কাহিনীর পর রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন তাঁর এপিএসের কাছে যে ৭০ লাখ টাকা পাওয়া গেছে তা সরকারী টাকা কিনা? রেলমন্ত্রী উত্তর দিয়েছিলেন, প্রশ্নই ওঠে না। সোমবার রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, টাকা যে এপিএস ওমর ফারুক তালকুদারের তা সে নিজেই স্বীকার করেছেন। রেলমন্ত্রীর বাসভবনে যাওয়ার সময় গাড়িতে টাকা ছিল তাও তাঁর জানা ছিল না। রেলমন্ত্রী এও বলেছেন, তিনি রাত ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। গাড়িতে পাওয়া ৭০ লাখ টাকা যে রেলমন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের সে বিষয়টি নিশ্চিত ও মীমাংসিত। কিন্তু এই টাকা কোথা থেকে এসেছে? টাকা কার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেই প্রশ্নে তদন্ত হচ্ছে।
রেলমন্ত্রী গত ৮ এপ্রিল রাতে ৭০ লাখ টাকাসহ আটক ও ছাড়া পাওয়ার কাহিনীর পরদিন বলেছিলেন তিনি শুনেছেন, তাঁর এপিএস ওমর ফারুক তালুকাদারকে ব্ল্যাক মেইল ও হাইজ্যাক করার জন্য ড্রাইভার গাড়ি বিজিবি সদর দফতরে ঢুকিয়ে দেয়। সদ্যপদত্যাগী রেলমন্ত্রীর এই অভিযোগ তদন্তের সামনে আসছে। প্রশ্ন উঠেছে, গত ৮ এপ্রিল গভীররাতে রেলমন্ত্রীর এপিএস, পূর্বাঞ্চলের জিএম, রেলের কমান্ড্যান্ট ও ড্রাইভার আলী আজম আটক হওয়ার পর সবাইকে ছেড়ে দেয়ার কথা জানানো হয়। কিন্তু যে ড্রাইভার গাড়িটি বিজিবির সদর দফতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে সেই ড্রাইভার আলী আজমের কোন হদিস নেই। দীর্ঘ ৮ দিন ধরে ড্রাইভার আলী আজম কোথায় আছে কেউ জানাতে পারছে না। তার পরিবারের পক্ষ থেকেও তার খোঁজসহ নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে। বিজিবির সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট থানা ও পুলিশ কর্মকর্তারাও ড্রাইভারের হদিস দিতে পারছেন না। তাহলে ড্রাইভার আলী আজম কোথায়? ড্রাইভার আলী আজমকে জনসমক্ষে এনে ঘটনার বর্ণনা ও জবানবন্দী নেয়া হলে গোটা ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে সহায়ক হবে।
সদ্য পদত্যাগী রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অভিযোগ করে আসছেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত। রেলমন্ত্রীর অভিযোগ অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, রেলের দুর্নীতিবাজ গ্রুপ, রাজনৈতিক শত্রুরা কি তাহলে ষড়যন্ত্র করে ড্রাইভারকে দিয়ে ৭০ লাখ টাকা দিয়ে বিজিবির সদর দফতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে? ড্রাইভারকে জনসমক্ষে হাজির করে এ ব্যাপারে তার জবানবন্দী নেয়া গেলে সেই গভীররাতের নেপথ্য কাহিনী বের হয়ে আসবে। সদ্য পদত্যাগী রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সোমবার সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিয়েছেন, তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে আবার রাজনীতিতে ফিরে আসবেন। রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করে তদন্তকে প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষভাবে চলতে দেয়ার ঘোষণা অনুযায়ী তদন্তকারীরা এখন তদন্ত শুরু করেছে।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, বিজিবি সদর দফতরে গভীর রাতে ৭০ লাখ টাকাসহ আটকের ঘটনাটি কোন স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না। এভাবে কোন মন্ত্রীকে কেউ ঘুষ দেয়ও না, আবার কোন মন্ত্রীও এভাবে ঘুষ নেন না। আর গাড়ির ড্রাইভারইবা কোন সাহসে এভাবে তার বসদের বিজিবি সদর দফতরে ঢুকিয়ে দিবে? এসব প্রশ্ন কোনভাবে মিলানো যাচ্ছে না। তবে রেলমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী ষড়যন্ত্রের গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। সঠিক তদন্তই এ বিষয়ে সত্য বের হয়ে আসবে। সেই গভীর রাতে বিজিবি সদর দফতরে ৭০ লাখ টাকাসহ আটকের নেপথ্যে সরকারকে বিব্রতকর ও বেকায়দায় ফেলতে পরিকল্পিত ষড়যন্তের নীলনকশার কোন কাহিনী লুকিয়ে আছে কিনা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। বর্ষীয়ান ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে ধ্বংস করার জন্য তাঁকে দাবার ঘুঁটি বা বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে কিনা তাও তদন্তের সামনে আসছে।