একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই এই প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার জন্য জামায়াত-শিবির যেমন উঠে পড়ে লেগেছে তেমনি পাকিস্তানে এমন কিছু তথাকথিত লেখক গজিয়েছে যারা কিনা এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে তৎপর। আকিলা ইসমাইল নাম্নী এক মহিলা 'অব মারটাইরস এ্যান্ড মেরীগোল্ডস' নামে একটি বই লিখেছিল। '৭১-এ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসের সুবাদে স্বীয় অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে বইটিতে তিনি এমন সব দাবি করেছেনÑযা যুক্তির নয় আবেগ ও উত্তেজনার কথা। তিনি বলছেন যে, যুদ্ধে রাজাকার, বিহারী বা পাকিস্তানী হত্যার অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধাদেরও একইভাবে অভিযুক্ত করা উচিৎ। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এই পুস্তকটিকে ঘিরে পাকিস্তানের মিডিয়ায় বেশ আলোড়ন তোলার চেষ্টাও কম হচ্ছে না। লেখিকার বড় বড় সাক্ষাতকার এবং পুস্তকটিতে বর্ণিত বিষয়াদি ওই মিডিয়ায় তুলে ধরা হচ্ছে। এই উপায়ে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের হীন উদ্দেশ্য যে চালানো হচ্ছে এতে কোনই সন্দেহ নেই। এই বইটি হাতে পেয়ে ভারত ও বাংলাদেশবিরোধী পাকিস্তানী মিডিয়া যেন আহ্লাদে আটখানা। এই বইয়ের বক্তব্যকে ইনিয়ে-বিনিয়ে তুলে ধরে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপপ্রয়াস চলছে। শুধু যে এই বইটির মাধ্যমে এ হেন অপচেষ্টা করা হচ্ছে তা কিন্তু নয়, প্রকৃত প্রস্তাবে জামায়াত-শিবিরের ছত্রছায়ায় ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির মাধ্যমেও চলছে এই জাতীয় নানাবিধ অপকর্ম। তাছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে অর্থকড়ি দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা এবং যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রক্রিয়া বিরোধী প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশেরও ব্যবস্থা করছে তারা হরহামেশাই।
আকিলা ইসমাইলের বইকে সামনে রেখে পাকিস্তানের মিডিয়া, এস্টাবলিশমেন্টও সংশ্লিষ্ট মহল এই বিচার বিষয়ে অপব্যাখ্যা প্রদানের খানিক সুযোগ পেয়েছে বলেই মনে হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালীদের দ্বারা বিহারী হত্যার ঘটনাকে বড় করে তুলে ধরে বিহারী হত্যার জন্য যারা দায়ী তাদেরকেও বিচার করার দাবি তোলা হচ্ছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধকালে বিহারীদের অবস্থান এবং কর্মতৎপরতা কি ছিল সেটি কিন্তু বেমালুম চেপে যাওয়া হয়েছে এতে। লেখিকা মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশে ছিলেন এবং তিনি সে সময়কার যে বিবরণ দিয়েছেন তা একেবারেই তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং পাকিস্তানের প্রতি দরদ থেকে উৎসারিত। সুতরাং তার ভাষ্যে বা বিবরণীতে মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং যুদ্ধাপরাধীদেরকে দোষী কিংবা নিষ্ঠুর হিসেবে প্রতিপন্ন করার প্রয়াস থাকবেই এবং বইটিতে তা-ই আছে। বইটিতে উল্লেখ আছে যে, মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শেষের দিকে লেখিকা ও তার পরিবার করাচীতে ফিরে যান। মুক্তিযুদ্ধে তার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি এক সাক্ষাতকারে বলেছেন যে, তার পরিবারকে জোরপূর্বক ঢাকার বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। আর ঠিক সেইদিন থেকেই তারা বুঝতে পারেন যে, তাদের 'কেউ নেই কিছু নেই, এমনকি দেশটাও তাদের আর নেই।' যে রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছেন সেই রাস্তা দিয়েই বাসে করে সেদিনও যেতে হয়েছে তাদের, কিন্তু সেই দিনটি বড্ড অপরিচিত ঠেকেছিল তার চোখে। এ ধরনের আবেগপূর্ণ বর্ণনায় পাঠকের মন গলানো সম্ভব হলেও যে সত্যটি লেখিকার চোখে কখনই পড়েনি তা হচ্ছে বিহারীরা সেই '৪৭ থেকে '৭১ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকালীন বাঙালীদের ওপর সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় কি সব জঘন্য কা-কীর্তি করেছে সে সব কথা। বিহারীদের প্রতি বাঙালীদের ক্ষোভ-রোষের যথেষ্ট কারণ যে তারা নিজেরাই সৃষ্টি করেছিল এ কথা তার মতো অনেকেরই খেয়াল নেই দেখা যায়। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের ফ্রেমে বন্দী করে বিহারী-বাঙালী সম্পর্ককে এভাবে বিশ্লেষণ করাটা যে মতলবী স্বার্থ থেকে উদ্ভূত তাতো বলাই বাহুল্য। পাকিস্তানের সুশীল সমাজ এবং সেনাবহিনীর কোন কোন মহলেও এমন অনেকে আছেন যারা '৪৭-'৭১ সময়কালে পূর্ব পাকিস্তানে বিহারীদের দৌরাত্ম্যের বিষয়টি মেনে নিতে নারাজ। অর্থাৎ ওই সময়কালে তারা যে নানান অপকর্মে যুক্ত ছিল এ সত্যটি এরা সব সময় এড়িয়ে যায়। একাত্তরে বিহারীরা বাঙালীদের হত্যা, লুট, ধর্ষণ বেশুমার চালিয়েছে। শুধু কি তাই? পাকিস্তানী বাহিনীকে পথঘাট দেখিয়ে দিয়ে বাঙালী নিধনে ও অন্যান্য অপরাধ করতে সহযোগিতা করেছে। বিহারীদের এ সব অপকর্মের কথা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং এ সবের প্রামাণ্য দলিলও আছে।
সে যাই হোক, বিহারীদের এ সব দুষ্কর্মের কথা বাংলাদেশের সরকার এমনকি মানুষও খুব বেশি দিন মনে রাখেনি। তাই এদেরকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানেও কুণ্ঠিত হয়নি তারা। হাইকোর্টের নির্দেশ মোতাবেক এদের অনেককেই নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে, অথচ পাকিস্তানী মিডিয়ার যেন এ সব তথ্য জানাই নেই! তাই এ বিষয়ে তাদেরকে সবসময়েই একপেশে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণই করতে দেখা যায়। পাকিস্তানের ডন পত্রিকার ব্রাসেলস প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত একজন কলামনিস্ট আলোচ্য বইটির সমালোচনা করতে গিয়ে '৭১ সালে ঢাকায় বসবাসকালীন তার নিজের স্মৃতিকথাও খানিক লিখেছেন। তার সে স্মৃতিকথায় বাঙালী-বিহারী সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে। ঢাকায় ছাত্র থাকাকালীন বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সখ্য তার জীবনে মধুর স্মৃতি হয়ে আছে। একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর নৃশংসতার ব্যাপারে এই কলামিস্ট সমালোচনামুখর থেকেছেন এবং পাকিস্তানের একজন সুনাগরিক হিসেবে পাকিস্তানী বাহিনীর এই অত্যাচার বা নির্মমতার জন্য তিনি নিজেকেও অপরাধী ভেবেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তারই বন্ধু আকিলা ইসমাইল রচিত বইটির মাধ্যমে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বিহারীদের ওপর বাঙালীদের নির্মমতার কথা জানতে পেরে ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েন বলে জানিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তার কাছে অর্থহীন মনে হয় তখন, তিনি এই বই পাঠান্তে জানতে পারেন, 'রাতারাতি সেখানে বন্ধু ঘোরতর শত্রুতে রূপান্তরিত হয়েছে।' অথচ এই বইটি পড়ার আগ পর্যন্ত কিন্তু পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কৃত কোন কর্মই তার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। মজার ব্যাপার এই যে, তিনি নিজে তখন পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন অথচ বিহারীদের ওপর বাঙালীরা বা বাঙালীদের ওপর বিহারীরা অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে এমন কোন কিছুই তার জানা নেই। এ সব বিষয়ে তিনি জানতে পারছেন তখন যখন কিনা তার বন্ধু এতকাল পরে এই বইটি লিখেছেন! ডন পত্রিকায় বইটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এই সব কথা বলেছেন এই কলামিস্ট। সবচেয়ে বড় কথা, একাত্তরের মোহনায় এসে বাঙালীরা তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধ দ্বারা এমনই উজ্জীবিত ছিল যে, উর্দুভাষী পাকিস্তানী কর্তৃত্ব থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তখন তারা যারপরনাই প্রস্তুত। এই বিভাজন কোন ধর্মভিত্তিক বিভাজন ছিল না, ছিল ভাষা ও জাতীয়তাবাদভিত্তিক। ফলে বিহারীরা যে তখন বাঙালীদের রোষানলে পড়েছিল তা এ কারণে নয় যে তারা বিহারী, বরং তাদের কর্মকা- সর্বতোভাবে পাঞ্জাবী কোটেরী বা উর্দুভাষীদের পক্ষে থাকায় বাঙালীদের ক্ষিপ্ত হবার কারণ ঘটেছিল বৈ-কী! তাছাড়া, বাঙালী-বিহারী হানাহানি কোন এক তরফা বিষয়ও ছিল না। মনে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে উৎসারিত। তাই হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টানরাও সে মুক্তিযুদ্ধে অকাতরে প্রাণ দিতে এগিয়ে গেছে সেদিন। আসলে তখনকার পাকিস্তানী রাজনীতিতে ধর্মের নামে বিষ প্রথম ঢোকায় জামায়াতে ইসলামী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই উগ্র ডানপন্থী দলটি পাক সামরিক কর্তৃপক্ষের পূর্ণ মদদে ইসলাম রক্ষার নামে বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ ধর্ষণ লুণ্ঠনে শামিল হয় এবং পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীকে এ সব দুষ্কর্মে সহায়তা জোগায়। উল্লেখ্য, এ সব বিষয়ে একটি পুস্তক রচনার দায়ে দৈনিক ডন পত্রিকার একজন সাংবাদিক শেষতক্ আর দেশেই থাকতে পারেননি। জান নিয়ে তাকে ব্রিটেনে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। ওই পুস্তকে তিনি সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনীকে সেদিন নৃশংসতা চালাবার কাজে সর্ব প্রকার সহযোগিতা প্রদান করেছিল পূর্ব পাকিস্তানেরই একটি অংশ যারা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে 'বিশ্বাসঘাতক' আর মুক্তিযুদ্ধকে 'ভারতীয় হিন্দুদের চক্রান্ত' বলে অভিহিত করে একে নস্যাতের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল।
পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে বাঙালীদের ওপর সকল ধরনের নির্যাতন চালাবার পূর্ণ কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছিল '৭১-এ। পূর্ব পাকিস্তানের গণজাগরণ প্রতিহত করতে নির্মম-নৃশংস পথই বেছে নেয় তারা আর বাঙালীরা ওই পাঞ্জাবী ও পাঠান সেনাদের বিরুদ্ধেই গর্জে ওঠে এ কারণে। এ রকম এক পরিস্থিতিতে কিছু উর্দুভাষী বিহারীর ওপর বাঙলীদের ক্ষোভ বা রোষাগ্নি জ্বলে ওঠা অস্বাভাবিক ছিল না নিশ্চয়ই! তবে এটি কোন ব্যাপকভিত্তিক এ্যাকশন ছিল না, ছিল দু'চারটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। আজ এই ধরনের দু'পাঁচটা ঘটনাকে সামনে এনে একাত্তরে বাঙালীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নজিরবিহীন গণহত্যার ব্যাপকতাকে লঘু করার অপকৌশল চালানো হচ্ছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই ধর্মীয় বিদ্বেষ আর অসহিষ্ণুতারই পরিচর্যা করেছেন এর শাসকরা।
১৯৭১-এর ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত বিচ্ছিন্ন দু'চারটা ঘটনায় হতাহত অজ্ঞাত ব্যক্তিদের প্রতি কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ কি কারণে আজ করা হচ্ছে তা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্স জানার দরকার নেই নিশ্চয়ই! তবে যারা এ জাতীয় মায়াকান্না জুড়ে দিয়ে একাত্তরের গণহত্যাকে খাটো করার চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা আসলে তাদের অজ্ঞাতেই তিক্ততা এবং বৈরিতাকে নতুনভাবে ডেকে আনছেন যার নতিজা ভাল হতে পারে না। তাছাড়া এর মাধ্যমে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বানচাল করা কিংবা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের প্রতি কোন প্রকার সহানুভূতি সৃষ্টি যে করা যাবে না সে কথা হলফ করেই বলা চলে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট