বুয়েট নিয়ে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার শিক্ষক সমিতির বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ করলেন শিক্ষামন্ত্রী স্টাফ রিপোর্টার ॥ সঙ্কট সমাধানে বুয়েট শিক্ষক সমিতির নেতাদের লাগাতার অসহযোগিতামূলক আচরণ ও আন্দোলনে মৌলবাদী গোষ্ঠীর জড়িয়ে পড়ার ঘটনাকে ভালভাবে নেয়নি সরকার। এবার কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার। কোন তথ্যপ্রমাণ ছাড়া শিক্ষক সমিতির নেতাদের একচেটিয়া ক্ষমতাকে পুঁজি করে যে কোন অন্যায় আব্দার তোলাকেও আর সহজভাবে নেয়া হচ্ছে না। নিত্যনতুন দাবির বিষয়ে এতদিন নমনীয় অবস্থানে থাকলেও মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষক সমিতির আচরণে তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, আন্দোলনরত শিক্ষকদের গণপদত্যাগের হুমকিসহ আন্দোলনের পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে। আমার তো এখন সন্দেহ হচ্ছে সমাধানের নানা উদ্যোগ ব্যাহত করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই চরম হুমকি দিচ্ছে শিক্ষক সমিতি। জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের নিয়ে সভা শেষ করার ৪০ মিনিটের মধ্যে শিক্ষক সমিতির নেতার হুমকি সঙ্কটের সমাধানকে বাধাগ্রস্ত করার কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। এদিকে সরকারের কঠোর অবস্থানে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন শিক্ষকরা। সরকারের আলোচনা ও বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে আপাতত আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। জানা গেছে, দাবি তোলার পর কোন অভিযোগ প্রমাণ ছাড়া বাস্তবায়ন করলেও যে সঙ্কটের সমাধান হয় না জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অবস্থা দেখেই সরকার বুয়েট নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে। কোন অপরাধের প্রমাণ ছাড়া দাবি উঠলেই উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে সরিয়ে দিলে তা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্কটের কারণ হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছে সরকার। দাবি বাস্তবায়নের পরেও একই শিক্ষকের অযৌক্তিক আন্দোলনে নেমে পড়ার ঘটনাকে ভালভাবে দেখছেন না অনেকেই। তাই অভিযোগ প্রমাণ ছাড়া কেবল একপক্ষ দাবি তুললেই নয়, বরং অভিযোগ তদন্ত করে প্রমাণের পরেই পদক্ষেপ নেয়ার কথা ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বুয়েটের আন্দোলনে শুরু থেকেই সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও গণমাধ্যমে সরকারবিরোধী জামায়াত ও হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঘটনা ফাঁস হওয়ায় বুয়েট নিয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন সরকার। তার পরেও উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সোমবার বুয়েটের সকল ডিন, বিভাগীয় প্রধান, সাবেক শিক্ষক ও উপাচার্যদের নিয়ে জরুরী সভায় বসেন শিক্ষামন্ত্রী। বৈঠক শেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী শান্তিপূর্ণ সমাধানের আশ্বাস দিয়ে বলেন, আন্দোলন, হাঙ্গার স্টাইকের প্রয়োজন হবে না। সিনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। দ্রুত আচার্য ও রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে শান্তিপূর্ণ সমাধান করা হবে। কিন্তু সরকারের অবস্থানে সাড়া না দিয়ে মাত্র ৪০ মিনিটের মাথায় শিক্ষক সমিতির নেতারা হুমকি দেন যে, আগামী রবিবারের মধ্যে দাবি বাস্তবায়ন না হলে গণপদত্যাগ করবেন তাঁরা। একই সঙ্গে ঘোষণা দেয়া হয়, প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে অবস্থান ধর্মঘট পালন করা হবে। সমিতির সভায় অনেকেই সরকারকে আলোচনার মধ্যে হুমকি দেয়ার বিষয়টি সমর্থন করেননি। অনেক শিক্ষক আপত্তি জানালেও নেতাদের হুমকিতে সমর্থন জানান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় মঙ্গলবার জরুরী সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষামন্ত্রী তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বার বার সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হলেও বুয়েটে আন্দোলনরত শিক্ষকরা কিছুতেই মেনে নিচ্ছেন না। মন্ত্রণালয়ে সাবেক উপাচার্য, প্রবীণ শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের পথে যখন এগোচ্ছিলাম, তার মাত্র ৪০ মিনিটের মাথায় চূড়ান্ত হুমকি দেয়া হলো আমাদের। এখন আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি বুয়েট সঙ্কট সমাধানের পথে বার বার বাধা সৃষ্টির পেছনে ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য আছে। শিক্ষক সমিতির এ আচরণে আমরা বিস্মিত। আমাদের সঙ্কট সমাধানের উদ্যোগকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার কৌশল নিয়েছে সমিতি। আমরা এটি ভাবতেও পারিনি। সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষা সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, অতিরিক্ত সচিব সালাউদ্দিন আকবার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে অপসারণ না করলে শিক্ষকদের একসঙ্গে পদত্যাগের হুমকির প্রেক্ষিতে এ ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমার সন্দেহ হচ্ছে সমাধানের নানা উদ্যোগ ব্যাহত করতেই তাদের হয়ত অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। মন্ত্রী আরও বলেন, আমরা যেখানে সঙ্কট সমাধানের পথে যাচ্ছি, আলোচনায় প্রবীণ শিক্ষকরা সকলকে অনশন ভঙ্গ করতে আহ্বান জানিয়েছেন, সেখানে পাল্টা হুমকি দিলে আমরা এখন কোন মুখ নিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাব। শিক্ষকদের আল্টিমেটামে বিস্ময় প্রকাশ করে নাহিদ বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি সমাধানে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের নিয়ে সভা শেষ করার ৪০ মিনিটের মধ্যে শিক্ষক সমিতি সভা ডেকে গণপদত্যাগের এই হুমকি দিয়েছে। দেশবাসী শিক্ষক সমিতির এ অবস্থানকে নিশ্চয়ই দেখবেন এবং বুঝবেন। শিক্ষক সমিতির দাবির প্রেক্ষিতেই তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট আসার পরেই তাঁরা আন্দোলন শুরু করেন। তবে এরপরও রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের পথ খোঁজা হবে। তিনি আরও বলেন, উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য পদে কে থাকবে আর কে থাকবে না তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকমতো চলা। উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি জানান। কেউ কিছু দাবি করলেই কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। আইন আছে, পদ্ধতি আছে। দেখতে হবে যে আইন ভঙ্গ করেছেন কিনা? অপরাধ করেছেন কিনা। শিক্ষক সমিতি যত বাধাই দিক আমরা সঙ্কট সমাধানের চেষ্টা করব। এদিকে সমিতির অবস্থানের বিরুদ্ধে বুয়েটে চলমান আন্দোলন আপাতত স্থগিত করেছে 'শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কার্মচারী ঐক্য ফোরাম। মঙ্গলবার বিকেলে বুয়েট আন্দোলনের 'পক্ষে-বিপক্ষে' তাদের অবস্থান এবং বিভিন্ন কর্মসূচী প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাফেটারিয়ার সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন ফোরামের আহ্বায়ক ও শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূর। তিনি বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর ডাকা বৈঠকের পর আমরা জানতে পেরেছি সুষ্ঠু সমাধানের জন্য আলোচনা চলছে। আমরা আলোচনায় বিশ্বাসী এবং আশা করি আলোচনার মাধ্যমেই এ সঙ্কটের সমাধান হবে। আগামী রবিবার শিক্ষক সমিতির সঙ্গে আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষকরা পদত্যাগ করবেন বলে যে কর্মসূচী দিয়েছেন, তার সঙ্গে ঐক্য ফোরামের শিক্ষকদের সংহতি রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে ঐক্য ফোরামের সঙ্গে যুক্ত কোন শিক্ষকই পদত্যাগ করবেন না। আমরা আলোচনায় বিশ্বাসী। শিক্ষক সমিতি দাবি করেছে, আগামী রবিবারের মধ্যে উপাচার্য পদত্যাগ না করলে আড়াই শ' থেকে তিন শ' শিক্ষক পদত্যাগ করবেন। তাহলে ঐক্য ফোরামের সঙ্গে কত জন শিক্ষক পদত্যাগ করবেন নাÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, রবিবারই দেখা যাবে কত সংখ্যক শিক্ষক আসলে পদত্যাগ করেন। অন্যদিকে আন্দোলনরত শিক্ষকরা পদত্যাগ করলে প্রয়োজনে 'বাইরে থেকে' শিক্ষক এনে ক্লাস নেয়ার কথা ভাবা হবে বলে মন্তব্য করেছেন বুয়েটের উপাচার্য এসএম নজরুল ইসলাম। তবে একই সঙ্গে বলেছেন পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হবে না। কেউ পদত্যাগ করছে বললেই বা পদত্যাগপত্র জমা দিলেই পদত্যাগ হয়ে যাবেÑ ব্যাপারটি তেমন নয়। সিন্ডিকেটই সিদ্ধান্ত নেবে, কার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হবে, কারটা হবে না। আর পদত্যাগপত্র যদি গ্রহণ করাই হয়, তখন সিন্ডিকেটই প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে। প্রয়োজনে বাইরে থেকে শিক্ষক আনা হবে কি না- তাও চিন্তাভাবনা করা হবে। |