সহিংস জামায়াতদেশজুড়ে পরিকল্পিত হামলা আগুন, ৭৩ পুলিশ আহত নিজস্ব প্রতিবেদক
গতকাল মতিঝিল বলাকা চত্বরে জাময়াতের তাণ্ডব। ছবি : শেখ হাসান
যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজ বিঘ্নিত করতে জামায়াত-শিবির পরিকল্পিত হামলা চালাতে পারে- এমন আশঙ্কার কথা আগাম জানিয়েছিলেন গোয়েন্দারা। সে অনুযায়ী গতকাল সোমবার রাজধানীর নিরাপত্তাব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছিল। দিনভর তল্লাশি ও কঠোর নজরদারির মধ্যেই বিকেলে পল্টন এলাকায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা সহিংস হয়ে ওঠে। পুলিশ বাধা দিতে গেলে তাদের ওপর চালানো হয় হামলা। এ ঘটনায় মতিঝিল থানার ওসিসহ ৩৩ জন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন। সংঘর্ষের সময় পাঁচটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক ভাঙচুর চালায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত নেতাদের মুক্তির দাবিতে গতকাল জামায়াত সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেয়। কর্মসূচি চলাকালে তারা সব স্থানেই ছিল মারমুখী। তাদের হামলায় ঢাকার বাইরে ৪০ পুলিশ সদস্য আহত হন।
হামলার শিকার হয়ে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ২০ জনকে আটক করেছে। বাকি হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের লক্ষ্য নিয়ে পুলিশের একাধিক দল আশপাশের এলাকায় তল্লাশি চালাচ্ছে।
রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও ডিএমপি কমিশনার বেনজির আহমেদ রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পুলিশ সদস্যদের দেখতে যান। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি পুলিশ সদস্যদের দেখতে যান। প্রতিমন্ত্রী বলেন, পুলিশের ওপর হামলা ও নাশকতায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু হয়েছে। তারা কোনোভাবেই রেহাই পাবে না।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা একত্রিত হয়ে নাশকতামূলক কাজ করতে পারে বলে আগেই তথ্য ছিল। সে অনুযায়ী রাজধানীর নিরাপত্তা জোরদার ছিল। এরই মধ্যে পল্টন এলাকায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ শুরু করলে পুলিশ বাধা দেয়। তাদের হামলায় অন্তত ৩৩ জন পুলিশ সদস্য মারাত্মক জখম হয়েছেন। সহিংসতা চলাকালে পুলিশ, জামায়াত-শিবিরের কর্মী ও পথচারীসহ অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি আহত হয়।
পুলিশের রমনা জোনের উপকমিশনার সৈয়দ নূরুল ইসলাম বলেন, জামায়াত ঘোষণা দিয়েছে শক্তি প্রদর্শনের। সেহেতু নিরাপত্তাব্যবস্থার ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান নিতে হয়। ট্রাইব্যুনালের প্রতিটি ফটকে সবাইকে ও গাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। এ ছাড়া সচিবালয়, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, শাহবাগ, মৎস্য ভবনসহ আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার রয়েছে। এরই মধ্যে পল্টন এলাকায় পরিকল্পিতভাবে পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে বিভিন্ন মহল থেকে তৎপরতা চলছে। বিশেষ করে জামায়াত-শিবির নানা অঘটন ঘটিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে চায়। তাদের বিভিন্ন বৈঠকসহ কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি চেষ্টা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে। আগাম তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা নজরদারি ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা কঠোর করা হয়েছে। সংঘর্ষ, হামলা ছাড়াও তারা আকস্মিক নাশকতা চালাতে পারে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল বিকেল পৌনে ৫টার দিকে সংঘর্ষ শুরু হয়। বায়তুল মোকাররমের উত্তর ফটক থেকে মতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত এলাকায় পুলিশের সঙ্গে প্রায় আধা ঘণ্টা ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলে। একপর্যায়ে জামায়াতের কর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ছুড়লে পুলিশও পাল্টা কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার নেতাদের মুক্তির দাবিতে মিছিলরত জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের এ সংঘর্ষের সময় পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অফিস শেষে ঘরমুখো মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হন। পল্টন থেকে মতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে প্রায় এক ঘণ্টা।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, হামলাকারীরা জামায়াতের মিছিল নিয়ে এলাকা প্রদক্ষিণের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। কিন্তু এর আগেই তারা রাস্তার ধারে থাকা অন্তত পাঁচটি মোটরসাইকেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। যানবাহন লক্ষ করে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। দৈনিক বাংলা মোড়, সিটি সেন্টারের সামনে ও জনতা ব্যাংকের সামনে পাঁচটি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়া হয়। জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা এ সময় পুলিশের একটি ভ্যানসহ ছয়টি গাড়ি ভাঙচুর করে এবং বিআরটিসির একটি বাস জ্বালিয়ে দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কমপক্ষে ৫০ রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। ঘটনাস্থল থেকে জামায়াতের ছয় নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে। তবে শিবিরের নেতারা দাবি করছেন, তাঁদের ২০ নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে।
প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলা সংঘর্ষে দৈনিক বাংলা মোড় থেকে মতিঝিল, পল্টন, বিজয়নগর এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দৈনিক বাংলা মোড় ও আশপাশের এলাকা কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। লোকজন দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। পুরো এলাকা এ সময় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষ ও পুলিশের লাঠিপেটায় আহত জামায়াতকর্মীদের অনেকে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফকিরাপুলের পানির ট্যাঙ্ক এলাকা থেকে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে প্রথমে মিছিল বের করে। তারা সরকার ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-বিরোধী স্লোগান দিতে থাকে। পুলিশ তাদের প্রধান সড়কে উঠতে বাধা দিলে তাদের লক্ষ করে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। তাদের অনেকে আশপাশের গলিতে অবস্থান নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে ইট-পাথর ছুড়তে থাকে। পুলিশের ধাওয়ার মধ্যে তারা ছোট ছোট জঙ্গি মিছিল নিয়ে পল্টন ও মতিঝিল এলাকায় তাণ্ডব শুরু করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুড়তে হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, পূর্বপরিকল্পিতভাবেই জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা এভাবে একত্রিত হয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। তারা প্রথমে বিভিন্ন দোকানের ক্রেতা ও পথচারীবেশে মার্কেটের সামনে একত্রিত হয়। তিনি জানান, সরকারি কাজে বাধাদান ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে আটক করা ২০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় তাদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।
সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনায় আহত মতিঝিল থানার ওসি হায়াতুজ্জামান, ইন্সপেক্টর (তদন্ত) ফরমান আলীসহ ২৬ জনকে ভর্তি করা হয়েছে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে। তাঁদের অধিকাংশের মাথা ও চোখে আঘাত লেগেছে। পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন নায়েক আবদুল লতিফ ও কনস্টেবল দোলন, সোহরাব, জালাল, নাজমুল, আহমেদুল ও তারেক।
জামায়াতের একটি সূত্র জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকৃত জামায়াত নেতাদের মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল। কিন্তু জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা গতকাল সারা দিন রাজধানীর কোথাও কোনো বিক্ষোভ কর্মসূচি না করলেও আসরের নামাজের পর মুহূর্তের মধ্যে বিভিন্ন গলি থেকে বের হয়ে শাপলা চত্বর এলাকা থেকে প্রায় এক হাজার কর্মী নিয়ে একটি মিছিল বের করে। এতে নেতৃত্ব দেন দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও ঢাকা মহানগর নায়েবে আমির হামিদুর রহমান আযাদ এমপি। আর এ কর্মসূচি পালনকালেই সংঘর্ষ হয়।
সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশকে দায়ী করেছেন জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর সহকারী সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশ বিনা উসকানিতেই জামায়াতের মিছিলে হামলা চালিয়েছে।
http://www.bhorerkagoj.net/new/blog/2012/11/07/83233.php
জামায়াত বেপরোয়া
সেলিম জাহিদ | তারিখ: ০৭-১১-২০১২
__._,_.___