সব পথ গিয়ে যেন মিশেছে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে। কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে রাতের আঁধারে ঠিকরে বেরোচ্ছে জনতার ক্ষোভের আগুন। কণ্ঠে দৃঢ় উচ্চারণ, 'ফাঁসির রায় না নিয়ে ঘরে ফিরব না।' ছবি তুলেছেন নাভিদ ইশতিয়াক তরু।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরের আন্দোলনই এখন বেশি জোরদার হতে দেখা যাচ্ছে। কারণ সরকার বা বিরোধী দল কারোর ওপরই আর জনগণের কোনো আস্থা অবশিষ্ট নেই। ফলে ক্ষোভ উগরে দিতে মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। গেল ২৪ ঘণ্টায় তারই প্রতিফলন এ বাংলায়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লাসহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে এ অভূতপূর্ব জনজাগরণ রূপ নিয়েছে প্রতিবাদী মানুষের গণবিস্ফোরণে, যার সূচনা শাহবাগ চত্বর থেকে। যত দিন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি না হচ্ছে, তত দিন গণ-আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃপ্ত শপথ আমজনতার।
মঙ্গলবার বিকেলেই শাহবাগে জড়ো হতে থাকে তরুণ প্রজন্ম। রাতভর প্রতিবাদী গান, কবিতা, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে এবং কাদের মোল্লাকে ছয়বার প্রতীকী ফাঁসিতে ঝুলিয়ে একাত্তরের শহীদদের রক্তের ঋণ শোধের শপথ নেয় তারা। গতকাল বুধবার সূর্য মুখ দেখাতেই আন্দোলন পায় নতুন মাত্রা। জামায়াতের হরতাল চলার মধ্যেও বিভিন্ন সংগঠন ও নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ বাঁধভাঙা স্রোতের মতো শাহবাগের সমাবেশে যোগ দিয়ে স্লোগান তোলে, 'একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার', 'ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই'।
আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড়ের চার পাশের চারটি সিগন্যাল পোস্টে যুদ্ধাপরাধীদের চারটি কুশপুত্তলিকা ঝুলিয়ে দেয়। মাঝখানে কাদের মোল্লার। এ ছাড়া সাপের আকৃতিতে বানানো হয়েছে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের আরেকটি কুশপুত্তলিকা। এরই মধ্যে চলছে প্রতিবাদী গান, কবিতা আবৃত্তি ও ফাঁসির দাবিতে আগুনে স্লোগান।
সকাল ৯টা থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ-স্কুলপড়ুয়ারা জড়ো হতে থাকে শাহবাগ মোড়ে। সেখানে একে একে এসে সংহতি জানায় বিভিন্ন সংগঠন। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্রফ্রন্টসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা এসে আন্দোলনকারীদের উজ্জীবিত করেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলও এ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে।
সকাল থেকেই আসতে থাকেন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। প্রতিবাদ জানাতে আসেন রাজনীতিবিদরাও। আসেন পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন, নাট্য ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কুদ্দুস, নৃত্যশিল্পী দীপা খন্দকারসহ অনেকে।
পরিবেশ ও বনমন্ত্রী বলেন, কাদের মোল্লা যে অপরাধ করেছেন তাতে তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। আদালত যে রায় দিয়েছেন তাতে সরকার ও আওয়ামী লীগও হতাশ।
আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, 'জামায়াত-শিবিরের আন্দোলন রাজাকারদের রক্ষা করার জন্য, যারা একাত্তরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। অন্যদিকে শাহবাগের এ আন্দোলন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে, স্বাধীনতার চেতনার পক্ষে। আমরা একাত্তরে রাজাকারদের পরাজিত করেছি, এবারও পরাজিত করে ঘরে ফিরব।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী জাকারিয়া শুভ বলেন, 'আমার কাছে এ আন্দোলন আগুনের মতো। আমরা যারা আন্দোলনের সঙ্গে আছি, তারা আগুনের এ উত্তাপে ওম পোহাচ্ছি। কেউ যদি এ আগুন নেভাতে আসে, তাহলে সে নিজেই পুড়ে যাবে। আমরা স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্ম। আমরাই এ আগুন।' তিনি আরো বলেন, 'অসমাপ্ত এ বিপ্লবকে সমাপ্ত করে তবেই আমরা ঘরে ফিরব।'
ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুম বলেন, কাদের মোল্লার ফাঁসি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলবে।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হওয়ার পরও কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিরা তীব্র ক্রুদ্ধ। তাঁদের প্রশ্ন- কতগুলো খুন করলে, কতগুলো ধর্ষণ করলে ফাঁসির সমান অপরাধ হয়?
গানে ও কবিতায় প্রতিবাদ : গতকাল দুপুরের পর থেকে বাড়তে থাকে জনস্রোত। বিকেলের মধ্যে শাহবাগ চত্বর থেকে চারুকলা ইনস্টিটিউট, বিপরীত দিকে রূপসী বাংলা হোটেল, অন্যদিকে আজিজ সুপার মার্কেট, শিশুপার্ক পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য। প্রতিবাদের ঢেউয়ে প্রকম্পিত গোটা প্রাঙ্গণ। এ সময় সমাবেশ থেকে তরুণ শিল্পীরা গেয়ে শোনান গণসংগীত, আবৃত্তিকাররা শোনান প্রতিবাদী কবিতা। গণসংগীত শিল্পী কফিল আহমেদ সমাবেশে সংহতি জানিয়ে কণ্ঠে তোলেন প্রতিবাদী সুর। তিনি একে একে গেয়ে শোনান, 'অগ্নি চেতনায় শাণ দাও', 'আগুন খাই, আগুন ঘুমাই', 'বুকটান বুক টান টান করে দাঁড়াও' ইত্যাদি। ভরাট কণ্ঠের সুরে, কথার শাণিত স্পর্ধায় জেগে ওঠে, নেচে ওঠে প্রতিবাদী জনতা। হাজারো মানুষ কফিল আহমেদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলায়, সুর তোলে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি জানায়। শিল্পী ফকির আলমগীরও এসেছিলেন সংহতি জানাতে। তিনিও গান গেয়ে উজ্জীবিত করেন প্রতিবাদীদের।
এর আগে কয়েক শ তরুণ-তরুণী স্লোগান-গান-আবৃত্তি করে রাত কাটিয়ে দেয়। দুটি বড় পর্দায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। রাত আড়াইটার দিকে মুক্তির গান চলচ্চিত্র শেষ হয়ার পর বিজিবির দুটি গাড়ি শাহবাগের অবরোধস্থলের পাশ দিয়ে এগিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এ সময় সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তারা নিশ্চুপ থাকে। ভোর পৌনে ৫টার দিকে হঠাৎ একদল পুলিশ এসে বারডেমের পাশের সড়কে অবস্থান নেয়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা পুলিশের সামনে গিয়ে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে।
প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে জনসমুদ্রে : নেই কোনো নৈরাজ্যের চেষ্টা। ককটেল বিস্ফোরণ বা বোমাবাজিও নিখোঁজ। সাধারণ মানুষের গাড়ি ভাঙচুর তো দূরের কথা, পুলিশের ওপর হামলার কোনো চেষ্টাই ছিল না। তবে মানুষের মনে আছে প্রচণ্ড ক্ষোভ। আছে তুমুল প্রতিবাদ। কয়েক মাস ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে জামায়াত-শিবিরের সহিংস আন্দোলনে যখন দেশ অস্থির, তখনই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগের আন্দোলনে নেই কোনো সহিংসতা। এখানকার আন্দোলনের ভাষা গান-কবিতা-ব্যঙ্গচিত্রসহ নানা সৃষ্টিশীল ও নান্দনিক উপাদান। সঙ্গে রাজাকারবিরোধী মজার মজার স্লোগান।
আন্দোলনকারীরা কেই কাউকে চেনে না। তার পরও তাদের মধ্যে কত নিবিড় সম্পর্ক, সৌহার্দ্য। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা দাঁড়িয়ে গেছে প্রতিবাদী মানববন্ধনে। আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনে গতকাল সকাল থেকে তীব্র রোদ উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ কণ্ঠ মিলিয়েছে একই দাবিতে- 'যুদ্ধাপরাধী কসাই কাদেরের ফাঁসি চাই'। তাদের মতে, যাবজ্জীবনের মতো লঘু শাস্তি একাত্তরের শহীদদের সঙ্গে প্রহসন।
দলে দলে তারা গাইছে প্রতিবাদী গান। চারুকলার সামনের রাস্তায় অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মিলিত হয়ে আঁকছেন যুদ্ধাপরাধবিরোধী ব্যঙ্গচিত্র। রাজপথের কালো পিচে ফুটে উঠছে কাদের মোল্লা, সাঈদী, নিজামী, গোলাম আযম, সাকাসহ চিহ্নিত সব যুদ্ধাপারাধীর ভয়ংকর চেহারা। রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা সাধারণ মানুষ রাজাকারদের এসব ব্যঙ্গচিত্রে থুথু ছুড়ছেন।
আন্দোলনস্থলে একদল তরুণ লুডু খেলারও আয়োজন করেছে। লুডুর সাপের মাথায় রয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের ছবি। একটানা চড়া রোদের মধ্যে থেকে আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা ও স্যালাইনের ব্যবস্থা করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিকেন্দ্রিক সংগঠন 'স্লোগান ৭১'। এভাবে পারস্পরিক সহমর্মিতায় পুরো আন্দোলনস্থল পরিণত হয়েছে এক ঐক্যের মেলবন্ধনে।http://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&type=gold&data=news&pub_no=1146&cat_id=1&menu_id=13&news_type_id=1&index=0#.URMC_h2S8vw
সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে কালের কণ্ঠ ডেস্কhttp://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&type=gold&data=news&pub_no=1146&cat_id=1&menu_id=13&news_type_id=1&index=4
SHARING "SHAHBAG SLOGANS" WITH YOU ALL :
__._,_.___