জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ হেফাজতে ইসলামকে একটি জঙ্গীবাদী জামায়াতী সংগঠন অভিহিত করে একে প্রতিহত করার হুঁশিয়ারি দিয়েছে বাংলাদেশ ইমাম-ওলামা সমন্বয় ঐক্য পরিষদ। সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের নেতারা ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ৫ মে হেফাজতে ইসলাম নামক জঙ্গী সংগঠনের নেতাকর্মীদের যেখানে পাওয়া যাবে, সেখানেই সুন্নতি লাঠি দিয়ে উচিত শিক্ষা ও শায়েস্তা করা হবে। এদিকে ইসলামের নামে উগ্রবাদী কর্মকা- চালানোর জন্য জামায়াত-শিবির ও হেফাজতের সঙ্গে শান্তিপ্রিয় ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠগুলোর মধ্যে বিরোধ ক্রমশই বাড়ছে। বিএনপি-জামায়াতের আশীর্বাদে ১৩ দফা বাস্তবায়নে হেফাজতের গোঁড়ামিতে সাধারণ ধর্মভিক্তিক দল বা সংগঠন ও ইসলামী চিন্তাবিদরা চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুরু থেকে জামায়াতের আশীর্বাদপুষ্ট উগ্রবাদী হেফাজত কর্মকা-কে প্রশ্রয় দেয়ার কারণে এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। দেশের প্রতিটি স্থানে জামায়াতসহ উগ্রবাদী সকল সংগঠনের নেতাকর্মীর সমন্বয়ে রাতারাতি গড়ে উঠেছে হেফাজতে ইসলাম, যাদের উগ্রবাদী আচরণে শান্তিপ্রিয় ইসলাম আজ প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করছেন ইসলামী চিন্তাবিদরা। এ পরিস্থিতিতে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদরাও জামায়াত-শিবিরের নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ বিষয়ে তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব ও বিশিষ্ট ইসলামী গবেষক লায়ন এমএ আউয়াল বলেন, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি নিরসন, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ ও ইসলামসহ সকল ধর্মের অবমাননাকারীদের শাস্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে আগামী ১১ মে মতিঝিল শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। তিনি বলেন, মওদুদীবাদী জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ ও হেফাজতে ইসলামের বিভ্রান্তিমূলক কর্মকাণ্ডের জবাব দিতে হবে। হেফাজতের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনেছে বিভিন্ন ইসলামী দল ও সংগঠনের ঐক্য ফোরাম বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোট। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবিতে আন্দোলনরত গণজাগরণ মঞ্চবিরোধী হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীকে 'রক্ষার' অভিযোগ আসার পর একাত্তরে সংগঠনটির আমিরের ভূমিকা তুলে আবারও অভিযোগ এনেছেন জোটের সভাপতি হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান। তিনি বলেন, একাত্তরে যখন পাকিস্তানী সেনা আর তাদের দোসররা এ দেশে হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালিয়েছিল, তখন হেফাজতের নেতারা কোথায় ছিলেন? হেফাজতের নেতা আহমদ শফী একাত্তরে পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানী সেনা আর রাজাকারদের সব কাজে সহযোগিতা করেন। আহমদ শফী এখন পাকিস্তানের দোসরদের রক্ষার 'এজেন্ডা' বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছেন। ইসলামী জোটের সভাপতি বলেন, জামায়াত নেতা গোলাম আযম, নিজামী, সাঈদী, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান এবং বিএনপি নেতা সাকা চৌধুরী ও আব্দুল আলিম গং মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পক্ষ নিয়েছিল। ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা যে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল তাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠরাই মুসলমান ছিল। একাত্তরের ওই গণহত্যাকারীরা বাঙালী জাতির ও ইসলামের চিরদুশমন। পবিত্র রকারানে গণহত্যার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ-ের কথা বলা হয়েছে উল্লেখ করে মাওলানা জিয়াউল হাসান বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের নামাজ-রোজা যেভাবে ফরজ করে দিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই দল-মত নির্বিশেষে সকল যুদ্ধাপরাধী ঘাতকের বিচার করাও পবিত্র কোরানের বিধান অনুযায়ী আমাদের জন্য ফরজ করা হয়েছে। 'ধর্ম অবমাননার' অভিযোগে ব্লগারদের গ্রেফতার করায় সরকারকে সাধুবাদ জানালেও যারা যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় বিভিন্নভাবে ধর্মীয় উস্কানি ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন সম্মিলিত ইসলামী জোটের নেতা। বলেন, জামায়াত-শিবিরের ব্লগ ও ব্লগাররা এখনও বহাল তবিয়তে আছে, যদিও এরাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালে অন্যের নামে ভুয়া এ্যাকাউন্ট খুলে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, পবিত্র কোরান ও ইসলামকে আল্লাহ নিজেই হেফাজত করার ঘোষণা দিয়ে ১৫ নং সূরা হিজরের ৯নং আয়াতে চিরস্থায়ীভাবে দিয়ে আল্লাহ'তাআলা বলেন, "ইন্না নাহনু নাযযালনাজ যিকরা ওয়া ইন্না লাহু লা-হা-ফিজুন" অর্থাৎ "আমিই কোরান অবতীর্ণ করিয়াছি এবং অবশ্য আমিই উহার সংরক্ষক'।" সেখানে আল্লাহর দায়িত্ব পালনের কথা শয়তান ছাড়া কেউ বলতে পারে না। বাংলাদেশ ফেৎনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও জাগ্রত নাগরিক কাউন্সিলের চেয়ারপার্সন আলহাজ মুফতি মাসুম বিল্লাহ বলেছেন, '৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে শফী সাহেবের অনুভূতি ও অবস্থান কি ছিল? তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে গোটা জাতির কাছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধর্মীয় অনুভূতিকে মুখোমুখি করার ষড়যন্ত্রের নীলনক্সাই তার প্রমাণ বহন করছে। ধর্মীয় অনুভূতিকে ইস্যু বানিয়ে বাংলাদেশে ৯৫ শতাংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় চেতনাকে পুঁজি করে চিহ্নিত একটি দলকে ক্ষমতায় যাওয়ার দরজা করে দেয়া ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের মাধ্যমে তাদের বাঁচাবার চক্রান্তের জন্যই হেফাজতে ইসলামের নানা কর্মসূচী। দৈনিক আল ইহসান ও মাসিক আল বাইয়্যিনাতের সম্পাদক আল্লামা মুহম্মদ মাহবুব আলম বলেছেন, ইসলাম হেফাজতের মালিক কোন মানুষ নয়, বরং স্বয়ং আল্লাহ পাক তিনি। তিনি বলেন, আরও অভিযোগ উঠেছে হেফাজতে ইসলাম নামধারীরা মূলত জামায়াতের দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত হয়ে হেফাজতে জামায়াত হিসেবে কাজ করছে।
এদিকে সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামকে একটি জঙ্গিবাদী জামায়াতী সংগঠন অভিহিত করে একে প্রতিহত করার হুঁশিয়ারি দিয়েছে বাংলাদেশ ইমাম-ওলামা সমন্বয় ঐক্য পরিষদ। সংগঠনের চেয়ারম্যান মাওলানা মোঃ ইসমাইল হোসাইন এ ঘোষণা দিয়ে বলেন, হেফাজতে ইসলাম আগামী ৫ মে সারাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাতে পারে। সেজন্য তারা কওমী মাদ্রাসায় বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এ বিষয়ে দেশের গোয়েন্দা বাহিনীকে খেয়াল রাখতে হবে। বর্তমান হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াতের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তারা দেশটাকে আফগানিস্তান বানাতে চায়। তিনি আরও বলেন, আমাদের অনেক লোক গোয়েন্দাদের মতো করে কওমী মাদ্রাসায় ঢুকে দেখেছেন, তারা কিভাবে বোমা তৈরি করছে। তাদের সবাইকে গ্রেফতার করতে হবে। তারা ৫ মে সরকার পরিবর্তন করতে চায় এবং আহমদ শফীকে দিয়ে দেশ চালাতে চায়। নেতাকর্মীদের ৫ মে রাজপথে থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, হেফাজতে ইসলামের ষড়যন্ত্র রুখতে হলে আপনারা ছোট ছোট সুন্নতি লাঠি তৈরি করে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেবেন। কারণ, এদের হাত থেকে নিজেকে এবং দেশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন পরিষদের সংগঠনের মহাসচিব মাওলানা শাহ মোহাম্মদ ওমর ফারুক, নড়াইলের পীর সাহেব অধ্যক্ষ মাওলানা ডা. আল ইমরান ও ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের পীর সাহেব মাওলানা কাজী মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম। এদিকে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনাসভায় দেশের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদসহ বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেছেন, উগ্রবাদী কর্মকা- নয় বরং ধর্মের সত্যিকারের মর্মবাণীকে উপলব্ধি করতে হবে। আন্তর্জাতিক সূফী ঐক্য সংহতি আয়োজিত 'সামাজিক স্থিতিশিলতা রক্ষায় ধর্ম-প্রেক্ষিত বাংলাদেশ' শীর্ষক আলোচনাসভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভা-ারী। পরিচালনা করেন অধ্যাপক ড.আ ন ম রইস উদ্দিন। বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম জমিয়াতুল ফালাহ্্ জাতীয় মসজিদের খতিব ও আহলে সুন্নাত ওয়াত জামআতের মহাসচিব আল¬ামা জালাল উদ্দিন আল কাদেরী, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল (অব) সৈয়দ মোঃ ইব্রাহিম, ঢাকা বিশ্বকিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান, অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া, ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা, এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, গণতন্ত্রী পাটির সাধারণ সম্পাদক নুরুর রহমান সেলিম, মাওলানা রহুল আমিন ভুঁইয়া চাঁদপুরী ও শাহ্ এস.এম. মাইজভা-ারী। তাঁরা বলেন, ধর্ম কোন পক্ষ বা গোষ্ঠীর নয়। ধর্ম সকলেরই জন্য। ধর্মের নামে সমাজে বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, মারামারি, ধর্মকে অস্বীকার করার নামান্তর। ধর্মের শিক্ষাই হলো ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতি এবং সকলেই একই স্রষ্টার সৃষ্টি এই সত্যকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করলেই সমাজে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব।