বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০১৩, ২৮ অগ্রহায়ন ১৪২০
"মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম এখনও চলছে" ॥ একাত্তরের বিজয়
সরদার সিরাজুল ইসলাম
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা করেন। কিন্তু পাকবাহিনী গণহত্যাসহ জবরদখল অব্যাহত রাখে যার বিরুদ্ধে বাঙালীর সশস্ত্রযুদ্ধ এবং পাকবাহিনীকে পরাভূত করে বিজয় অর্জন ১৬ ডিসেম্বর।
এই বিজয়ের ইতিহাস ২৬ মার্চ থেকে নয়, আরও পেছনে।
এই দিনটিতে পৌঁছতে বাঙালী জাতির কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ মুজিবকে পাড়ি দিতে হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে ১১ বছর জেল ও ২বার ফাঁসির মুখোমুখি দীর্ঘ ২৩ বছর ধারাবাহিক আপোসহীন সংগ্রামের পথ। ১৯৪৭ সালে অঙ্কুরিত ও ৪৮-৫২ তে বিস্ফোরিত মায়ের ভাষা বাংলাকে (যা পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ নাগরিকের ভাষা) অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম মূলত বাঙালী জাতীয়তাবাদের তথা স্বাধীনতার মাইলস্টোন হিসেবে বিবেচিত। এই দাবির পক্ষে গণরায় পাওয়া যায় ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বাংলাভাষা বিরোধী শাসকগোষ্ঠী মুসলিম লীগকে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্টকে ৯৯ শতাংশ আসনে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে কিন্তু তা নস্যাত করে দেয়া হয়। জেনারেল আইয়ুব ক্ষমতা দখল করেন ১৯৫৮ সাল। কিন্তু বাঙালীরা রাজপথ ছাড়েনি। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ঐতিহাসিক ৬ দফার 'আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসন' দাবি বাঙালীর প্রাণের দাবিকে নস্যাত করার জন্য তৎকালীন পাকিস্তানের স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করে বঙ্গবন্ধুকে তাৎক্ষণিক (১৯৬৬) শুধু আটক করেই ক্ষান্ত হয়নি, ফাঁসি দেয়ার লক্ষ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করে বিচারের প্রহসন শুরু করেছিলেন ১৯৬৮ সালের জানুয়ারির দিকে। আইয়ুব খান ভেবেছিল যে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ভারতের সহযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার অভিযোগ আনলে মুজিবের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ক্ষেপে যাবে এবং সহজেই তাঁকে ফাঁসি দেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু ফল হলো উল্টো। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা রুখে দাঁড়াল বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে। ছাত্র সমাজের মুখপাত্র তৎকালীন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে গড়ে উঠল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও তৈরি হলো ৬ দফার পুরোটা নিয়ে ছাত্রদের দাবিসহ ১১ দফা কর্মসূচী। গড়ে উঠল ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, শরিক হলো বাংলার আপামর জনসাধারণ। মওলানা ভাসানী যিনি আইয়ুব দশকের পুরো অংশটিতে 'ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব' ৬ দফা 'সাম্রাজ্যবাদের দলিল' এমনকি ৭ জানুয়ারি '৬৯ তারিখে ১১ দফাকেও প্রথমে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ ও খালেদ মোহাম্মদ আলীর কাছে (অবশ্য সমর্থন জানান। ২৪/১/৬৯ তারিখে সেদিন কার্ফু ছিল) এবং তাঁকেও আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন পল্টনে বলতে হয়েছিল, 'জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।' আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে ছাত্রনেতা আসাদ (শহীদ ২০/১/৬৯), আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ও সার্জেন্ট ফজলুল হককে ২৫/২/৬৯ তারিখে বন্দী অবস্থায় গুলি করা (জহুর সঙ্গে সঙ্গে শহীদ হন এবং ফজলুল হক গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান), ২৮/২/৬৯ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা পুলিশের গুলিতে শহীদ এবং মহিলাসহ অগণিত বাঙালীর আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে জেনারেল আইয়ুব খান ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেন এবং বেতার /টিভিতে নিজে আগামীতে আর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না বলে ঘোষণা দেন। এর ফলে বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা মামলার অন্য আসামিরা (মোট ৩৪ জন) মুক্তিলাভ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি (৬৯) রেসকোর্স ময়দানে নাগরিক সংবর্ধনার সভাপতি ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দানের প্রস্তাব করেন এবং সমবেত জনসমুদ্র বিপুল করতালিতে তা সমর্থন করে।
যে আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিতে চেয়েছিল তাকেই অবশেষে পদত্যাগ করে (২৪ মার্চ '৬৯) ক্ষমতা দিতে হয় সেনাপতি জেনারেল ইয়াহিয়াকে। ইয়াহিয়া খান সর্বজনীন ভোটাধিকার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য পাকিস্তানের গণ ও জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের দিন ধার্য করেন যথাক্রমে ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭০ ও ১৭ জানুয়ারি, ১৯৭১। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু ইতোপূর্বে গৃহীত 'প্যারিটি' (জনসংখ্যার ভিত্তিতে নয়-পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সমানসংখ্যক প্রতিনিধিত্ব) প্রত্যাখ্যান করে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব আদায় করে নিয়েছিলেন। ফলে জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের (মহিলাদের জন্য আলাদা ১৩টি আসন) মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ দাঁড়ায় ১৬২+৭=১৬৯ ও পশ্চিম পাকিস্তান ১৩৮+৬=১৪৪টি আসন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ১৬২টির মধ্যে ১৬০টি এবং মহিলা আসন ৭টিসহ মোট ১৬৯টি আসন পেয়ে জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের ২৮৮ এবং মহিলা ১০টি আসনসহ ২৯৮টি আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ। অপরদিকে ভুট্টোর পিপলস্ পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৪৪টি আসনের মধ্যে ৫টি মহিলা আসনসহ লাভ করে ৮৮টি আসন। যে বিধান (এলএফও) বলে নির্বাচন হয়েছিল তাতে একথা নির্দিষ্ট ছিল না যে সংবিধানে প্রণয়নে ২/৩ শতাংশ সদস্যের সম্মতি প্রয়োজন হবে। উক্ত বিধানে বলা হয় যে সংসদ বিষয়টি নির্ধারণ করবে। তাই একথাই স্পষ্ট যে বঙ্গবন্ধু যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেছেন সেহেতু তিনি সংবিধান প্রণয়নে সক্ষম।
সত্তরের নির্বাচনের পরে বঙ্গবন্ধু ছ'দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করেন। কিন্তু ভুট্টো প্রকাশ্যে 'বিরোধী দলের আসনে বসার জন্য তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ভোট দেয়নি, ছয় দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র গ্রহণযোগ্য নয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা তার কাছে ও পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা শেখ মুজিবের কাছে হস্তাস্তরের মতো উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখতে শুরু করেন, যার ফলে সংসদ অধিবেশন বসতে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি '৭১ এক ঘোষণায় জেনারেল ইয়াহিয়া ঢাকায় সংসদের অধিবেশন আহ্বান করেন ৩ মার্চ (৭১)। ভুট্টো তাতে যোগদান করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। ভুট্টো ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য সদস্যরা সংসদ অধিবেশনে যোগদানের জন্য ঢাকায় আসা শুরু করেন কিন্তু হঠাৎ করে ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ দুপুরে বেতারে প্রচারিত এক ঘোষণায় অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় ছাত্র জনতা রাজপথে নেমে পড়ে বিক্ষোভে। বঙ্গবন্ধু হোটেল পূর্বাণীতে জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় সদস্যদের বলেন, 'আজ যে কথা আপনাদের বলব তা স্ত্রীকেও বলবেন না। ইয়াহিয়া সৈন্য আনছে, আমিও আমার পথে যাব। এলাকায় চলে যান। জনগণকে সংগঠিত করে প্রস্তুত রাখুন যে কোন ত্যাগের জন্য।' জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, 'উই কান্ট এলাউ ইট টু গো আন চ্যালেঞ্জড' এখান থেকে অসহযোগ শুরু। মার্চ মাসের সে নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম সপ্তাহে গোটা দেশব্যাপী হরতাল, মিটিং, মিছিল এবং অফিস, স্কুল-কলেজ বন্ধ। প্রথম সপ্তাহের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর মধ্যে ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শাহাজান সিরাজ কর্তৃক ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন- ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ।
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি পুনরায় উল্লেখ করে সুস্পষ্ট ৪টি দাবিসহ উচ্চারণ করেন, 'এবারে সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারে সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,' আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। বস্তুত ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা নিজ হাতে গ্রহণ করেন। জনসাধারণের ও সরকারী দফতর জন্য ৭ মার্চ ১১টি, ব্যাংক ও সরকারী সংস্থার জন্য ১০ মার্চ সুস্পষ্ট ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন যা সরকারী কর্মকর্তারা যথারীতি পালন করে। উল্লেখ্য, ৬ মার্চ টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর নিয়োগ করা হলেও পূর্ব পাকিস্তানের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি.এ, সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শপথ পড়াননি। ৭ মার্চের ভাষণ সরাসরি বেতার/টিভিতে প্রচারের জন্য বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা পালনে বাধা দিলে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা কর্মবিরতি ঘোষণা করে যার ফলে ৭ মার্চের ভাষণ সেদিন রাতে বেতার/টিভিতে প্রচারে বাধ্য হয়। (চলবে)
এই বিজয়ের ইতিহাস ২৬ মার্চ থেকে নয়, আরও পেছনে।
এই দিনটিতে পৌঁছতে বাঙালী জাতির কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ মুজিবকে পাড়ি দিতে হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে ১১ বছর জেল ও ২বার ফাঁসির মুখোমুখি দীর্ঘ ২৩ বছর ধারাবাহিক আপোসহীন সংগ্রামের পথ। ১৯৪৭ সালে অঙ্কুরিত ও ৪৮-৫২ তে বিস্ফোরিত মায়ের ভাষা বাংলাকে (যা পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ নাগরিকের ভাষা) অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম মূলত বাঙালী জাতীয়তাবাদের তথা স্বাধীনতার মাইলস্টোন হিসেবে বিবেচিত। এই দাবির পক্ষে গণরায় পাওয়া যায় ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বাংলাভাষা বিরোধী শাসকগোষ্ঠী মুসলিম লীগকে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্টকে ৯৯ শতাংশ আসনে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে কিন্তু তা নস্যাত করে দেয়া হয়। জেনারেল আইয়ুব ক্ষমতা দখল করেন ১৯৫৮ সাল। কিন্তু বাঙালীরা রাজপথ ছাড়েনি। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ঐতিহাসিক ৬ দফার 'আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসন' দাবি বাঙালীর প্রাণের দাবিকে নস্যাত করার জন্য তৎকালীন পাকিস্তানের স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করে বঙ্গবন্ধুকে তাৎক্ষণিক (১৯৬৬) শুধু আটক করেই ক্ষান্ত হয়নি, ফাঁসি দেয়ার লক্ষ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করে বিচারের প্রহসন শুরু করেছিলেন ১৯৬৮ সালের জানুয়ারির দিকে। আইয়ুব খান ভেবেছিল যে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ভারতের সহযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার অভিযোগ আনলে মুজিবের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ক্ষেপে যাবে এবং সহজেই তাঁকে ফাঁসি দেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু ফল হলো উল্টো। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা রুখে দাঁড়াল বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে। ছাত্র সমাজের মুখপাত্র তৎকালীন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে গড়ে উঠল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও তৈরি হলো ৬ দফার পুরোটা নিয়ে ছাত্রদের দাবিসহ ১১ দফা কর্মসূচী। গড়ে উঠল ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, শরিক হলো বাংলার আপামর জনসাধারণ। মওলানা ভাসানী যিনি আইয়ুব দশকের পুরো অংশটিতে 'ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব' ৬ দফা 'সাম্রাজ্যবাদের দলিল' এমনকি ৭ জানুয়ারি '৬৯ তারিখে ১১ দফাকেও প্রথমে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ ও খালেদ মোহাম্মদ আলীর কাছে (অবশ্য সমর্থন জানান। ২৪/১/৬৯ তারিখে সেদিন কার্ফু ছিল) এবং তাঁকেও আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন পল্টনে বলতে হয়েছিল, 'জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।' আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে ছাত্রনেতা আসাদ (শহীদ ২০/১/৬৯), আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ও সার্জেন্ট ফজলুল হককে ২৫/২/৬৯ তারিখে বন্দী অবস্থায় গুলি করা (জহুর সঙ্গে সঙ্গে শহীদ হন এবং ফজলুল হক গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান), ২৮/২/৬৯ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা পুলিশের গুলিতে শহীদ এবং মহিলাসহ অগণিত বাঙালীর আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে জেনারেল আইয়ুব খান ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেন এবং বেতার /টিভিতে নিজে আগামীতে আর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না বলে ঘোষণা দেন। এর ফলে বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা মামলার অন্য আসামিরা (মোট ৩৪ জন) মুক্তিলাভ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি (৬৯) রেসকোর্স ময়দানে নাগরিক সংবর্ধনার সভাপতি ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দানের প্রস্তাব করেন এবং সমবেত জনসমুদ্র বিপুল করতালিতে তা সমর্থন করে।
যে আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিতে চেয়েছিল তাকেই অবশেষে পদত্যাগ করে (২৪ মার্চ '৬৯) ক্ষমতা দিতে হয় সেনাপতি জেনারেল ইয়াহিয়াকে। ইয়াহিয়া খান সর্বজনীন ভোটাধিকার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য পাকিস্তানের গণ ও জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের দিন ধার্য করেন যথাক্রমে ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭০ ও ১৭ জানুয়ারি, ১৯৭১। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু ইতোপূর্বে গৃহীত 'প্যারিটি' (জনসংখ্যার ভিত্তিতে নয়-পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সমানসংখ্যক প্রতিনিধিত্ব) প্রত্যাখ্যান করে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব আদায় করে নিয়েছিলেন। ফলে জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের (মহিলাদের জন্য আলাদা ১৩টি আসন) মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ দাঁড়ায় ১৬২+৭=১৬৯ ও পশ্চিম পাকিস্তান ১৩৮+৬=১৪৪টি আসন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ১৬২টির মধ্যে ১৬০টি এবং মহিলা আসন ৭টিসহ মোট ১৬৯টি আসন পেয়ে জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের ২৮৮ এবং মহিলা ১০টি আসনসহ ২৯৮টি আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ। অপরদিকে ভুট্টোর পিপলস্ পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৪৪টি আসনের মধ্যে ৫টি মহিলা আসনসহ লাভ করে ৮৮টি আসন। যে বিধান (এলএফও) বলে নির্বাচন হয়েছিল তাতে একথা নির্দিষ্ট ছিল না যে সংবিধানে প্রণয়নে ২/৩ শতাংশ সদস্যের সম্মতি প্রয়োজন হবে। উক্ত বিধানে বলা হয় যে সংসদ বিষয়টি নির্ধারণ করবে। তাই একথাই স্পষ্ট যে বঙ্গবন্ধু যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেছেন সেহেতু তিনি সংবিধান প্রণয়নে সক্ষম।
সত্তরের নির্বাচনের পরে বঙ্গবন্ধু ছ'দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করেন। কিন্তু ভুট্টো প্রকাশ্যে 'বিরোধী দলের আসনে বসার জন্য তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ভোট দেয়নি, ছয় দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র গ্রহণযোগ্য নয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা তার কাছে ও পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা শেখ মুজিবের কাছে হস্তাস্তরের মতো উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখতে শুরু করেন, যার ফলে সংসদ অধিবেশন বসতে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি '৭১ এক ঘোষণায় জেনারেল ইয়াহিয়া ঢাকায় সংসদের অধিবেশন আহ্বান করেন ৩ মার্চ (৭১)। ভুট্টো তাতে যোগদান করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। ভুট্টো ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য সদস্যরা সংসদ অধিবেশনে যোগদানের জন্য ঢাকায় আসা শুরু করেন কিন্তু হঠাৎ করে ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ দুপুরে বেতারে প্রচারিত এক ঘোষণায় অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় ছাত্র জনতা রাজপথে নেমে পড়ে বিক্ষোভে। বঙ্গবন্ধু হোটেল পূর্বাণীতে জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় সদস্যদের বলেন, 'আজ যে কথা আপনাদের বলব তা স্ত্রীকেও বলবেন না। ইয়াহিয়া সৈন্য আনছে, আমিও আমার পথে যাব। এলাকায় চলে যান। জনগণকে সংগঠিত করে প্রস্তুত রাখুন যে কোন ত্যাগের জন্য।' জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, 'উই কান্ট এলাউ ইট টু গো আন চ্যালেঞ্জড' এখান থেকে অসহযোগ শুরু। মার্চ মাসের সে নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম সপ্তাহে গোটা দেশব্যাপী হরতাল, মিটিং, মিছিল এবং অফিস, স্কুল-কলেজ বন্ধ। প্রথম সপ্তাহের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর মধ্যে ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শাহাজান সিরাজ কর্তৃক ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন- ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ।
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি পুনরায় উল্লেখ করে সুস্পষ্ট ৪টি দাবিসহ উচ্চারণ করেন, 'এবারে সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারে সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,' আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। বস্তুত ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা নিজ হাতে গ্রহণ করেন। জনসাধারণের ও সরকারী দফতর জন্য ৭ মার্চ ১১টি, ব্যাংক ও সরকারী সংস্থার জন্য ১০ মার্চ সুস্পষ্ট ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন যা সরকারী কর্মকর্তারা যথারীতি পালন করে। উল্লেখ্য, ৬ মার্চ টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর নিয়োগ করা হলেও পূর্ব পাকিস্তানের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি.এ, সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শপথ পড়াননি। ৭ মার্চের ভাষণ সরাসরি বেতার/টিভিতে প্রচারের জন্য বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা পালনে বাধা দিলে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা কর্মবিরতি ঘোষণা করে যার ফলে ৭ মার্চের ভাষণ সেদিন রাতে বেতার/টিভিতে প্রচারে বাধ্য হয়। (চলবে)
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০১৩, ২৮ অগ্রহায়ন ১৪২০
শেষ হাসি স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তিই হাসবে তবে সরকারকে কঠোর হতে হবে
স্বদেশ রায়
এই লেখা যখন ওয়েবে পাঠক পাবেন বা সকালে পত্রিকায় পড়বেন তখনও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা থাকবে। তাঁদের মতো আমিও উৎকণ্ঠিত। তবে হতাশ নই। বরং স্থির বিশ্বাস থেকে বলতে চাই, ১৬ ডিসেম্বরের আগে কসাই কাদেরের ফাঁসি বাংলাদেশের মাটিতে হবেই। হয়ত বলা হতে পারে এতটা দুর্গম পথ কেন স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তিকে পাড়ি দিতে হচ্ছে। এর প্রথম উত্তর রবীন্দ্রনাথ থেকে দেয়া যায়, শ্রেয়কে দিতে হয় দুর্মূল্য। পাশাপাশি এটাও বলতে হয়, সত্যের পথ অনেক কঠিন ও কঠোর। মঙ্গলবার রাত সাড়ে এগারোটার দিকে যখন টেলিভিশনের পর্দায় . . .
আমাদের জাতীয় পতাকা
বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল রক্তস্নাত। ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে এবং হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয় আমাদের লাল-সবুজ পতাকাশোভিত বাংলাদেশের। চিরসবুজ আমাদের এই বাংলাদেশ। দেশের তরুণরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে। পতাকার সবুজ ও লাল রং ব্যবহারের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সবুজ রং বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি ও তারুণ্যের প্রতীক, বৃত্তের লাল রং উদীয়মান সূর্য, স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারীদের রক্তের প্রতীক। বাংলাদেশ জাতীয় পতাকার এই রূপটি ১৯৭২ সালের ১৭ . . .
__._,_.___