বেগম খালেদা জিয়ার বুড়ো বয়সের ভীমরতি
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ভাদ্র মাস এলে বাংলাদেশে কৈ মাছ উজায়। তারা জলাশয় ছেড়ে ডাঙ্গায় কানে হাঁটতে শুরু করে। বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির ব্যাপারেও দেখা যায়, নির্বাচনে রাজনীতির স্বাভাবিক নিয়মে একটু সুবিধা করতে পারলেই তারা মনে করে দেশটা তাদের হয়ে গেছে। জলে স্থলে তারা কৈ মাছের মতো কানে হাঁটতে শুরু করে। দেশের মানুষকে ডাক দেয় এখনই সরকার হটাও, আমাদের ক্ষমতায় বসাও। বার বার হোঁচট খেয়েও বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কোন হুশ হয়েছে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক ও পারিবারিক হতাশা, না বুড়ো বয়সের ভীমরতি কোন্টা থেকে তিনি এখনও আবোলতাবোল বলে চলেছেন, তা শুধু তিনিই জানেন।
বর্তমান উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপি কিছুটা ভাল করেছে তা সত্য। তাতে দেশের রাজনীতি উল্টে যায়নি। এমনটা পৃথিবীর সব দেশেই হয়। ক্ষমতাসীন দল স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর নির্বাচনে অনেক সময় ভাল করে না। ব্রিটেনেও অনেক সময় করে না, এবারেও করছে না। ব্রিটেনে আসন্ন বায়া কাউন্সিল ও কাউন্টি কাউন্সিলের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন টোরিলিব দলের ভরাডুবি হতে যাচ্ছে বলে সকলের ধারণা। তাতে কি টোরিলিব দল ক্ষমতা ছাড়বে, না তাদের ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য বিরোধী লেবার দল আন্দোলনে নামাবে? না, তারা তা করবেন না। লেবার-নেতৃত্ব তরুণ। তাদের বৃদ্ধ বয়সের ভীমরতিতে ধরেনি। তারা আগামী সাধারণ নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করবেন এবং আশা করবেন নির্বাচনের মাধ্যমে টোরিলিব কোয়ালিশনকে ক্ষমতা থেকে বিদায় দেবেন।
কিন্তু বাংলাদেশে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার আর তর সইছে না। সম্ভবত তাঁকে বয়সকালের ভীমরতিতে ধরেছে। তাই দশকের পর দশক একটা রাজনৈতিক দলের সর্বময় কর্তৃত্বে থেকেও তিনি রাজনীতি শেখেননি। তাঁর প্রমাণ পাওয়া গেছে গত ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনেও। তার আগের পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিশেষ পরিস্থিতিতে (হেফাজতী অভ্যুত্থানের সময়ের অসত্য প্রোপাগান্ডার সুযোগ নিয়ে) আচমকা জিতে তাঁর মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। এর পর একটু অপেক্ষা করে যে কোন ব্যবস্থার অধীনে সাধারণ নির্বাচনে যোগ দিলে তাঁর দলের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। তিনি পাকিস্তানের আইএসআই, জামায়াত এবং তাঁর 'লায়েক পুত্র' তারেক রহমানের পরামর্শে সে পথে হাঁটলেন না। কারণটা কী?
কারণ হলো, তাঁকে বোঝানো হলো এখন ধাক্কা দিলেই হাসিনা সরকারকে ফেলে দেয়া যাবে। এই ফেলে দেয়ার জন্য অপেক্ষা করলে '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের আর ফাঁসির দণ্ড থেকে বাঁচানো যাবে না। হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকতে থাকতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড দানের কাজটি সেরে যাবেন। একই সঙ্গে ইউনূস শিবির এবং তাঁর অনুসারী সুশীল সমাজটিও বিএনপি-নেতৃত্বকে নির্বাচনের আগেই হাসিনা সরকারকে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস চালিয়ে হলেও ক্ষমতা থেকে হটানোর কাজে উৎসাহ যুগিয়েছেন।
অর্ধ নোবেলজয়ী ড. ইউনূস হয়ত ভেবেছিলেন, সাধারণ নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে, তাহলে তো গ্রামীণ ব্যাংক ফিরে পাওয়া তাঁর হবে না। সুতরাং আগেই ধাক্কা মেরে এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক পুনর্দখল করতে হবে। বিএনপি তো তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংক ফিরিয়ে দেয়ার প্রকাশ্য অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেই। নির্বাচনের পর যদি আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসে যায়, তাহলে তো আরও পাঁচ বছর তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংক পুনর্দখলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তাঁর বয়স হয়ে গেছে। অবসর গ্রহণের বয়স পেরিয়ে গেছে বহু বছর আগে। আরও পাঁচ বছর অপেক্ষা করার সময় ও বয়স কি তিনি পাবেন? ফলে ড. ইউনূসও সিন্ধবাদের দৈত্যের মতো বিএনপি-নেত্রীর কাঁধে সওয়ার হয়েছিলেন।
চারদিক থেকে এত উৎসাহ-উদ্দীপনা পেয়ে বিএনপি নেত্রী আর সাধারণ নির্বাচনে যাননি। বরং হেফাজতীদের কাছে উৎসাহ পেয়ে হাসিনা সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিলেন ক্ষমতা ত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার। বুড়ো বয়সের ভীমরতি আর কাকে বলে? আর এই ভীমরতির দরুন তাঁর দল জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ছয় মাসের বেশি সময় সন্ত্রাস চালিয়ে দেশের অর্থনীতির যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে; আগুনে পুড়িয়ে যে কয়েক শ' নিরীহ নরনারী হত্যা করেছে, সেই বর্বরতার কি কোন তুলনা আছে?
হাসিনা সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি যোগ দেয়ায় মনে হয়েছিল, দলের নেতানেত্রীর সুমতি বুঝি ফিরে এসেছে। তারা এবার সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে হাঁটা শুরু করবেন। এই সরকারকে একটি মধ্যবর্তী সাধারণ নির্বাচন দিতে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় চাপ সৃষ্টি করবেন এবং সেই নির্বাচনে জেতার জন্য দলটিকে সংগঠিত করবেন। কিন্তু দেশের মানুষের এই আশা পূর্ণ হয়নি। টিকটিকি মারা গেলেও তার লেজ কেমন লাফায়, তেমনি বিএনপি-হেফাজতী অভ্যুত্থান থেকে সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত নিজেদের বুদ্ধির দোষে একটার পর একটা বিপর্যয় বরণের পরও এখন উপজেলা নির্বাচনে কিছুটা ভাল করার সঙ্গে সঙ্গেই আবার টিকটিকির লেজের মতো লাফাতে শুরু করেছে। আবার আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসের পথে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে।
সম্প্রতি জনসভায় দেয়া বেগম খালেদা জিয়ার দুটি বক্তব্য বিএনপির বর্তমান মনোভাব ও অভিসন্ধির প্রকাশ বলে সম্ভবত ধরে নেয়া যেতে পারে। খালেদা জিয়া বলেছেনÑ এক. 'সরকারকে আর সময় দেয়া হবে না। আমরা এখনই আন্দোলনের কর্মসূচী দেব।' দুই. 'আওয়ামী লীগ যে কী জিনিস, তা নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। এটা একটা ভয়ঙ্কর দল। এরা ক্ষমতায় এলেই হত্যা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি শুরু হয়।'
প্রথমে তাঁর দ্বিতীয় বক্তব্যটি নিয়ে আলোচনা করি। আওয়ামী লীগ যে কী ধরনের দল তা নতুন প্রজন্মের কাছে গোপন রাখার, ইতিহাস বিকৃত করার শত অপচেষ্টা করেও বিএনপি কি সফল হয়েছে? তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় ৪০ বছর পর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চে তরুণ প্রজন্মের জয়বাংলা সেøাগান কণ্ঠে ধারণ করে অভ্যুদয় ঘটে কি? একাত্তরের যে যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতায় বসিয়ে খালেদা জিয়া বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করেছেন, সেই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সারা তরুণ প্রজন্ম এত উত্তাল হয়ে ওঠে কী করে? এই লাখ লাখ তরুণকে জামায়াতের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে কাফের, নাস্তিক আখ্যা দিয়ে, তাদের ব্লগারদের হত্যা করে, হেফাজতী মাদ্রাসাছাত্র ভাড়া করে শাপলা চত্বরে এনে খালেদা জিয়া সরকারকে হটাতে পেরেছেন কি? তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁর দল কি ইমেজ তুলে ধরতে পেরেছে? কি আবেদন রাখতে পেরেছে?
খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ সম্পর্কে কী জানাবেন তরুণ প্রজন্মকে? তারা নিজেদের রক্ত দিয়ে, অভিজ্ঞতা দিয়ে জেনেছে আওয়ামী লীগ কী জিনিস? তারা আওয়ামী লীগের দোষত্রুটি ও ব্যর্থতা সম্পর্কে সচেতন। আবার তার সাফল্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে দলটির ভূমিকা সম্পর্কেও অবহিত। তারা জানে, আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক দোষত্রুটি। কিন্তু এই দলটিই এখন পর্যন্ত একমাত্র গণভিত্তিক বড় রাজনৈতিক দল, যে দল অসাম্প্রদায়িক ও আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে। এই দলের বিকল্প কোন দল এখনও গড়ে ওঠেনি। এই দলের শাসনামলে দেশে কিছু রাজনৈতিক হত্যাকা- হয়েছে, কিন্তু তা দলের শীর্ষ নেতাদের অনুমোদন ও সহায়তায় নয়। প্রতিপক্ষ দলের কোন বড় নেতা ও নেতাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যার কোন নজির আওয়ামী লীগে নেই। দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দমনে হাসিনা সরকারের ব্যর্থতা সত্ত্বেও এই সরকারের আমলেই দেশের সর্বাধিক উন্নতি ঘটেছে।
গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য শেখ হাসিনা যে সংগ্রাম করেছেন, তার কাছে খালেদা জিয়ার রেকর্ড সমুদ্রে গোষ্পদ। গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে শেখ হাসিনা গ্রেনেড হামলার মুখোমুখি হয়ে বিস্ময়করভাবে বেঁচে গেছেন। তাঁর জীবনের ওপর ছোটবড় হামলা হয়েছে নয়-দশ বার। তাঁকে সাবজেলে বন্দী করে রেখে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। চিকিৎসার জন্য জামিন নিয়ে বিদেশে গেলে তাঁকে দেশে আসতে না দিয়ে ফেরারী আসামি হিসেবে হুলিয়া জারি করা হয়েছে।
অন্যদিকে, খালেদা জিয়াকেও এক-এগারোর সময় একই সাবজেলে রাখা হয়েছিল, তবে মহারানীর মতো। মাঝে মাঝে তাঁকে সৌদি আরবে পাঠানো হবে এই গুজব ছাড়া তাঁকে নিয়ে তেমন টানাহ্যাঁচড়া করা হয়নি। তিনি মহারানীর মতো হিন্দিগানের রেকর্ড শুনে এবং কেশচর্চায় দিন কাটিয়েছেন বলে জানা যায়। তাঁর 'সুযোগ্য পুত্র' দেশে থাকাকালে তাঁর সব দুর্নীতি ও অপকর্মের জন্য দেশবাসীর কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে চিকিৎসার নামে বিদেশে চলে যান। অসংখ্য সন্ত্রাস ও দুর্নীতির মামলা মাথার ওপরে ঝুলে থাকলেও এখন পর্যন্ত দেশে ফেরেননি। তাঁর চিকিৎসা নাকি আর শেষই হচ্ছে না।
বেগম খালেদা জিয়া কোন্ মুখে বলেন, নতুন প্রজন্মের কাছে আওয়ামী লীগের চেহারা তিনি তুলে ধরবেন? আয়নায় নিজেদের চেহারাটা তিনি দেখেছেন? রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কি কোন তুলনা চলে? আওয়ামী লীগের জন্ম গণআন্দোলনে। বিএনপির জন্ম এক সেনাপতির ক্ষমতার লালসায় সেনা শিবিরে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে একটি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে। বিএনপি প্রথমে সামরিক শাসনের ছদ্মবেশে ক্ষমতায় এসেছে জাতির পিতা ও জাতীয় নেতাদের হত্যায় ইন্ধনদাতা ও বেনিফিসিয়ারী হিসেবে; দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে রাতে কারফিউ এবং দিনে ১৪৪ ধারা ছিল একটি নিত্যদিনের ঘটনা।
জেলে বিচার প্রহসনের নামে কর্নেল তাহেরসহ দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার ও জওয়ান হত্যা করা হয়েছে জিয়াউর রহমানের নির্দেশে। ৩৫টি সেনা অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছে, যার অধিকাংশই জিয়াউর রহমানের নিজের পরিকল্পিত। সেনাবাহিনীতে তাঁর অপছন্দের লোকদের হত্যা করাই ছিল এই নকল অভ্যুত্থান ঘটানোর আসল উদ্দেশ্য। তাঁর স্ত্রীর শাসনামলে বেছে বেছে কিবরিয়া, আহসানউল্লা মাস্টারের মতো আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করা হয়েছে। হুমায়ুন আজাদসহ বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক নিহত হয়েছেন কয়েক ডজন। দশ ট্রাকভর্তি অবৈধ অস্ত্র আমদানি, বাংলা ভাই, শায়খ আব্দুর রহমানের মতো সন্ত্রাসীদের অভ্যুত্থান ঘটেছে খালেদা জিয়ার আমলেই।
তিনি দেশের স্বাধীনতার শত্রু ও যুদ্ধাপরাধীদের এনে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। হাওয়া ভবনের মতো বিশাল দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের দুর্গ তৈরি হয়েছে তাঁর পুত্রের মালিকানায়। বিদেশে অবৈধ পথে বিশাল অঙ্কের টাকা পাচারের দায়ে বিদেশের আদালতে দ-িত হয়েছে বেগম জিয়ারই এক পুত্র। সর্বোপরি শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। এখন জানা যায়, এই হামলা সম্পর্কেও বেগম জিয়া আগে অবহিত ছিলেন। তাঁর পুত্র তারেকের বিরুদ্ধে তো এই হামলায় যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছেই।
এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপির কোন শীর্ষ নেতা নিহত হয়েছেন, তার নজির দেখানো যাবে কি? বেগম জিয়ার গায়ে একবার একটি ফুলের টোকাও পড়েছে কি? বরং তাঁর শাসনামলের দুর্নীতি, সন্ত্রাস, সংখ্যালঘু নিধন, নারী নির্যাতন, কৃষক হত্যা, দেশময় অরাজকতা সৃষ্টির ইতিহাস লেখা হলে তো মহাভারত হয়ে যাবে। বেগম জিয়ার মুখে ভারত-বিরোধিতায় অনবরত খই ফোটে। কিন্তু জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বক্তৃতা দিতে গিয়ে গঙ্গা নদীর পানির হিস্যা নিয়ে কথা বলেননি। পরে বলেছেন, কথাটি বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। অথচ ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রণব মুখার্জী বাংলাদেশ সফরে এলে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতে অশালীনভাবে অসম্মতি জানিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে চিড় ধরাবার চেষ্টা করেছেন।
তিনি শেখ হাসিনার সরকারকে ভারতের তাঁবেদার সরকার বলেন। অথচ তিনি নিজে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা চক্র বাংলাদেশ-বিরোধী আইএসআইয়ের নির্দেশে ওঠাবসা করেন। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে আওয়ামী লীগ সরকার গঙ্গার পানির হিস্যা আদায় করেছে, পার্বত্য শান্তিচুক্তি করেছে, বিপুল অর্থ সাহায্য আদায় করেছে এবং বহুমুখী উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য অর্থনৈতিক চুক্তি করতে পেরেছে। আশা করা যায়, সীমান্ত সমস্যা, তিস্তা, টিপাইমুখ বাঁধ সমস্যা ইত্যাদিও শীঘ্রই এবং হাসিনা সরকারের আমলেই মীমাংসিত হবে।
এর পাশাপাশি পাকিস্তানের স্বৈরাচারী ও সামরিক শাসকদের উস্কানিতে এবং স্বার্থে, এমনকি তাদের স্বার্থে ভারতের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা দিতে গিয়ে খালেদা জিয়া কেবল ভারত-বিদ্বেষ প্রচার দ্বারা কোন্ দাবিটা আদায় করতে পেরেছেন? বরং ভারতের অসন্তোষ ও অসহযোগিতার ফলে বাংলাদেশে বন্যা ও খরা নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত হয়েছে; সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা অব্যাহত রয়েছে এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। আমার সন্দেহ নেই, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার শাসনামল সম্পর্কে কোন গবেষক যদি কোন বই লেখেন, তাহলে এই আমলকে তিনি বাংলাদেশের জন্য এক অভিশপ্ত যুগ বলে উল্লেখ করতে বাধ্য হবেন।
খালেদা জিয়া উপজেলা নির্বাচনে সামান্য সাফল্যে ফুলে গিয়ে দেশে আবার সরকার-বিরোধী আন্দোলন শুরু করার হুমকি দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি আবার সন্ত্রাস শুরু করবেন। অবশ্যই সঙ্গে দোসর থাকবে জামায়াত। আন্দোলনের শক্তি বিএনপির নেই। জনসমর্থন তাঁরা আগে পাননি, ভবিষ্যতেও পাবেন না। জামায়াতের সহযোগিতায় আবার সন্ত্রাস চালাতে গেলে বেগম জিয়া নিজেই তাঁর দলের জন্য কবর তৈরি করে যাবেন। এ জন্য তাঁর উপদেষ্টা এককালের কবর-খোদক মোসাদ্দেক আলী ফালুর সাহায্য নিতে হবে না।
বিএনপির উচিত হাসিনা সরকারের সমালোচনা করা, নিয়মতান্ত্রিক বিরোধিতায় যাওয়া। রাজনৈতিক হঠকারিতা দ্বারা পুরনো ভুলের পুনরাবৃত্তি করা আত্মঘাতী হবে। বেগম জিয়া যেভাবে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন, তা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে তাঁর নিজের বা তাঁর পুত্রের বাংলার সিংহাসনে বসার কোন সম্ভাবনা (আশঙ্কা) আমি দেখি না।
[লন্ডন মঙ্গলবার, ৪ মার্চ ২০১৪]
বর্তমান উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপি কিছুটা ভাল করেছে তা সত্য। তাতে দেশের রাজনীতি উল্টে যায়নি। এমনটা পৃথিবীর সব দেশেই হয়। ক্ষমতাসীন দল স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর নির্বাচনে অনেক সময় ভাল করে না। ব্রিটেনেও অনেক সময় করে না, এবারেও করছে না। ব্রিটেনে আসন্ন বায়া কাউন্সিল ও কাউন্টি কাউন্সিলের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন টোরিলিব দলের ভরাডুবি হতে যাচ্ছে বলে সকলের ধারণা। তাতে কি টোরিলিব দল ক্ষমতা ছাড়বে, না তাদের ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য বিরোধী লেবার দল আন্দোলনে নামাবে? না, তারা তা করবেন না। লেবার-নেতৃত্ব তরুণ। তাদের বৃদ্ধ বয়সের ভীমরতিতে ধরেনি। তারা আগামী সাধারণ নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করবেন এবং আশা করবেন নির্বাচনের মাধ্যমে টোরিলিব কোয়ালিশনকে ক্ষমতা থেকে বিদায় দেবেন।
কিন্তু বাংলাদেশে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার আর তর সইছে না। সম্ভবত তাঁকে বয়সকালের ভীমরতিতে ধরেছে। তাই দশকের পর দশক একটা রাজনৈতিক দলের সর্বময় কর্তৃত্বে থেকেও তিনি রাজনীতি শেখেননি। তাঁর প্রমাণ পাওয়া গেছে গত ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনেও। তার আগের পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিশেষ পরিস্থিতিতে (হেফাজতী অভ্যুত্থানের সময়ের অসত্য প্রোপাগান্ডার সুযোগ নিয়ে) আচমকা জিতে তাঁর মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। এর পর একটু অপেক্ষা করে যে কোন ব্যবস্থার অধীনে সাধারণ নির্বাচনে যোগ দিলে তাঁর দলের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। তিনি পাকিস্তানের আইএসআই, জামায়াত এবং তাঁর 'লায়েক পুত্র' তারেক রহমানের পরামর্শে সে পথে হাঁটলেন না। কারণটা কী?
কারণ হলো, তাঁকে বোঝানো হলো এখন ধাক্কা দিলেই হাসিনা সরকারকে ফেলে দেয়া যাবে। এই ফেলে দেয়ার জন্য অপেক্ষা করলে '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের আর ফাঁসির দণ্ড থেকে বাঁচানো যাবে না। হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকতে থাকতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড দানের কাজটি সেরে যাবেন। একই সঙ্গে ইউনূস শিবির এবং তাঁর অনুসারী সুশীল সমাজটিও বিএনপি-নেতৃত্বকে নির্বাচনের আগেই হাসিনা সরকারকে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস চালিয়ে হলেও ক্ষমতা থেকে হটানোর কাজে উৎসাহ যুগিয়েছেন।
অর্ধ নোবেলজয়ী ড. ইউনূস হয়ত ভেবেছিলেন, সাধারণ নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে, তাহলে তো গ্রামীণ ব্যাংক ফিরে পাওয়া তাঁর হবে না। সুতরাং আগেই ধাক্কা মেরে এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক পুনর্দখল করতে হবে। বিএনপি তো তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংক ফিরিয়ে দেয়ার প্রকাশ্য অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেই। নির্বাচনের পর যদি আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসে যায়, তাহলে তো আরও পাঁচ বছর তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংক পুনর্দখলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তাঁর বয়স হয়ে গেছে। অবসর গ্রহণের বয়স পেরিয়ে গেছে বহু বছর আগে। আরও পাঁচ বছর অপেক্ষা করার সময় ও বয়স কি তিনি পাবেন? ফলে ড. ইউনূসও সিন্ধবাদের দৈত্যের মতো বিএনপি-নেত্রীর কাঁধে সওয়ার হয়েছিলেন।
চারদিক থেকে এত উৎসাহ-উদ্দীপনা পেয়ে বিএনপি নেত্রী আর সাধারণ নির্বাচনে যাননি। বরং হেফাজতীদের কাছে উৎসাহ পেয়ে হাসিনা সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিলেন ক্ষমতা ত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার। বুড়ো বয়সের ভীমরতি আর কাকে বলে? আর এই ভীমরতির দরুন তাঁর দল জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ছয় মাসের বেশি সময় সন্ত্রাস চালিয়ে দেশের অর্থনীতির যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে; আগুনে পুড়িয়ে যে কয়েক শ' নিরীহ নরনারী হত্যা করেছে, সেই বর্বরতার কি কোন তুলনা আছে?
হাসিনা সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি যোগ দেয়ায় মনে হয়েছিল, দলের নেতানেত্রীর সুমতি বুঝি ফিরে এসেছে। তারা এবার সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে হাঁটা শুরু করবেন। এই সরকারকে একটি মধ্যবর্তী সাধারণ নির্বাচন দিতে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় চাপ সৃষ্টি করবেন এবং সেই নির্বাচনে জেতার জন্য দলটিকে সংগঠিত করবেন। কিন্তু দেশের মানুষের এই আশা পূর্ণ হয়নি। টিকটিকি মারা গেলেও তার লেজ কেমন লাফায়, তেমনি বিএনপি-হেফাজতী অভ্যুত্থান থেকে সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত নিজেদের বুদ্ধির দোষে একটার পর একটা বিপর্যয় বরণের পরও এখন উপজেলা নির্বাচনে কিছুটা ভাল করার সঙ্গে সঙ্গেই আবার টিকটিকির লেজের মতো লাফাতে শুরু করেছে। আবার আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসের পথে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে।
সম্প্রতি জনসভায় দেয়া বেগম খালেদা জিয়ার দুটি বক্তব্য বিএনপির বর্তমান মনোভাব ও অভিসন্ধির প্রকাশ বলে সম্ভবত ধরে নেয়া যেতে পারে। খালেদা জিয়া বলেছেনÑ এক. 'সরকারকে আর সময় দেয়া হবে না। আমরা এখনই আন্দোলনের কর্মসূচী দেব।' দুই. 'আওয়ামী লীগ যে কী জিনিস, তা নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। এটা একটা ভয়ঙ্কর দল। এরা ক্ষমতায় এলেই হত্যা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি শুরু হয়।'
প্রথমে তাঁর দ্বিতীয় বক্তব্যটি নিয়ে আলোচনা করি। আওয়ামী লীগ যে কী ধরনের দল তা নতুন প্রজন্মের কাছে গোপন রাখার, ইতিহাস বিকৃত করার শত অপচেষ্টা করেও বিএনপি কি সফল হয়েছে? তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় ৪০ বছর পর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চে তরুণ প্রজন্মের জয়বাংলা সেøাগান কণ্ঠে ধারণ করে অভ্যুদয় ঘটে কি? একাত্তরের যে যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতায় বসিয়ে খালেদা জিয়া বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করেছেন, সেই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সারা তরুণ প্রজন্ম এত উত্তাল হয়ে ওঠে কী করে? এই লাখ লাখ তরুণকে জামায়াতের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে কাফের, নাস্তিক আখ্যা দিয়ে, তাদের ব্লগারদের হত্যা করে, হেফাজতী মাদ্রাসাছাত্র ভাড়া করে শাপলা চত্বরে এনে খালেদা জিয়া সরকারকে হটাতে পেরেছেন কি? তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁর দল কি ইমেজ তুলে ধরতে পেরেছে? কি আবেদন রাখতে পেরেছে?
খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ সম্পর্কে কী জানাবেন তরুণ প্রজন্মকে? তারা নিজেদের রক্ত দিয়ে, অভিজ্ঞতা দিয়ে জেনেছে আওয়ামী লীগ কী জিনিস? তারা আওয়ামী লীগের দোষত্রুটি ও ব্যর্থতা সম্পর্কে সচেতন। আবার তার সাফল্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে দলটির ভূমিকা সম্পর্কেও অবহিত। তারা জানে, আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক দোষত্রুটি। কিন্তু এই দলটিই এখন পর্যন্ত একমাত্র গণভিত্তিক বড় রাজনৈতিক দল, যে দল অসাম্প্রদায়িক ও আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে। এই দলের বিকল্প কোন দল এখনও গড়ে ওঠেনি। এই দলের শাসনামলে দেশে কিছু রাজনৈতিক হত্যাকা- হয়েছে, কিন্তু তা দলের শীর্ষ নেতাদের অনুমোদন ও সহায়তায় নয়। প্রতিপক্ষ দলের কোন বড় নেতা ও নেতাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যার কোন নজির আওয়ামী লীগে নেই। দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দমনে হাসিনা সরকারের ব্যর্থতা সত্ত্বেও এই সরকারের আমলেই দেশের সর্বাধিক উন্নতি ঘটেছে।
গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য শেখ হাসিনা যে সংগ্রাম করেছেন, তার কাছে খালেদা জিয়ার রেকর্ড সমুদ্রে গোষ্পদ। গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে শেখ হাসিনা গ্রেনেড হামলার মুখোমুখি হয়ে বিস্ময়করভাবে বেঁচে গেছেন। তাঁর জীবনের ওপর ছোটবড় হামলা হয়েছে নয়-দশ বার। তাঁকে সাবজেলে বন্দী করে রেখে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। চিকিৎসার জন্য জামিন নিয়ে বিদেশে গেলে তাঁকে দেশে আসতে না দিয়ে ফেরারী আসামি হিসেবে হুলিয়া জারি করা হয়েছে।
অন্যদিকে, খালেদা জিয়াকেও এক-এগারোর সময় একই সাবজেলে রাখা হয়েছিল, তবে মহারানীর মতো। মাঝে মাঝে তাঁকে সৌদি আরবে পাঠানো হবে এই গুজব ছাড়া তাঁকে নিয়ে তেমন টানাহ্যাঁচড়া করা হয়নি। তিনি মহারানীর মতো হিন্দিগানের রেকর্ড শুনে এবং কেশচর্চায় দিন কাটিয়েছেন বলে জানা যায়। তাঁর 'সুযোগ্য পুত্র' দেশে থাকাকালে তাঁর সব দুর্নীতি ও অপকর্মের জন্য দেশবাসীর কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে চিকিৎসার নামে বিদেশে চলে যান। অসংখ্য সন্ত্রাস ও দুর্নীতির মামলা মাথার ওপরে ঝুলে থাকলেও এখন পর্যন্ত দেশে ফেরেননি। তাঁর চিকিৎসা নাকি আর শেষই হচ্ছে না।
বেগম খালেদা জিয়া কোন্ মুখে বলেন, নতুন প্রজন্মের কাছে আওয়ামী লীগের চেহারা তিনি তুলে ধরবেন? আয়নায় নিজেদের চেহারাটা তিনি দেখেছেন? রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কি কোন তুলনা চলে? আওয়ামী লীগের জন্ম গণআন্দোলনে। বিএনপির জন্ম এক সেনাপতির ক্ষমতার লালসায় সেনা শিবিরে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে একটি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে। বিএনপি প্রথমে সামরিক শাসনের ছদ্মবেশে ক্ষমতায় এসেছে জাতির পিতা ও জাতীয় নেতাদের হত্যায় ইন্ধনদাতা ও বেনিফিসিয়ারী হিসেবে; দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে রাতে কারফিউ এবং দিনে ১৪৪ ধারা ছিল একটি নিত্যদিনের ঘটনা।
জেলে বিচার প্রহসনের নামে কর্নেল তাহেরসহ দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার ও জওয়ান হত্যা করা হয়েছে জিয়াউর রহমানের নির্দেশে। ৩৫টি সেনা অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছে, যার অধিকাংশই জিয়াউর রহমানের নিজের পরিকল্পিত। সেনাবাহিনীতে তাঁর অপছন্দের লোকদের হত্যা করাই ছিল এই নকল অভ্যুত্থান ঘটানোর আসল উদ্দেশ্য। তাঁর স্ত্রীর শাসনামলে বেছে বেছে কিবরিয়া, আহসানউল্লা মাস্টারের মতো আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করা হয়েছে। হুমায়ুন আজাদসহ বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক নিহত হয়েছেন কয়েক ডজন। দশ ট্রাকভর্তি অবৈধ অস্ত্র আমদানি, বাংলা ভাই, শায়খ আব্দুর রহমানের মতো সন্ত্রাসীদের অভ্যুত্থান ঘটেছে খালেদা জিয়ার আমলেই।
তিনি দেশের স্বাধীনতার শত্রু ও যুদ্ধাপরাধীদের এনে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। হাওয়া ভবনের মতো বিশাল দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের দুর্গ তৈরি হয়েছে তাঁর পুত্রের মালিকানায়। বিদেশে অবৈধ পথে বিশাল অঙ্কের টাকা পাচারের দায়ে বিদেশের আদালতে দ-িত হয়েছে বেগম জিয়ারই এক পুত্র। সর্বোপরি শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। এখন জানা যায়, এই হামলা সম্পর্কেও বেগম জিয়া আগে অবহিত ছিলেন। তাঁর পুত্র তারেকের বিরুদ্ধে তো এই হামলায় যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছেই।
এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপির কোন শীর্ষ নেতা নিহত হয়েছেন, তার নজির দেখানো যাবে কি? বেগম জিয়ার গায়ে একবার একটি ফুলের টোকাও পড়েছে কি? বরং তাঁর শাসনামলের দুর্নীতি, সন্ত্রাস, সংখ্যালঘু নিধন, নারী নির্যাতন, কৃষক হত্যা, দেশময় অরাজকতা সৃষ্টির ইতিহাস লেখা হলে তো মহাভারত হয়ে যাবে। বেগম জিয়ার মুখে ভারত-বিরোধিতায় অনবরত খই ফোটে। কিন্তু জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বক্তৃতা দিতে গিয়ে গঙ্গা নদীর পানির হিস্যা নিয়ে কথা বলেননি। পরে বলেছেন, কথাটি বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। অথচ ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রণব মুখার্জী বাংলাদেশ সফরে এলে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতে অশালীনভাবে অসম্মতি জানিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে চিড় ধরাবার চেষ্টা করেছেন।
তিনি শেখ হাসিনার সরকারকে ভারতের তাঁবেদার সরকার বলেন। অথচ তিনি নিজে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা চক্র বাংলাদেশ-বিরোধী আইএসআইয়ের নির্দেশে ওঠাবসা করেন। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে আওয়ামী লীগ সরকার গঙ্গার পানির হিস্যা আদায় করেছে, পার্বত্য শান্তিচুক্তি করেছে, বিপুল অর্থ সাহায্য আদায় করেছে এবং বহুমুখী উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য অর্থনৈতিক চুক্তি করতে পেরেছে। আশা করা যায়, সীমান্ত সমস্যা, তিস্তা, টিপাইমুখ বাঁধ সমস্যা ইত্যাদিও শীঘ্রই এবং হাসিনা সরকারের আমলেই মীমাংসিত হবে।
এর পাশাপাশি পাকিস্তানের স্বৈরাচারী ও সামরিক শাসকদের উস্কানিতে এবং স্বার্থে, এমনকি তাদের স্বার্থে ভারতের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা দিতে গিয়ে খালেদা জিয়া কেবল ভারত-বিদ্বেষ প্রচার দ্বারা কোন্ দাবিটা আদায় করতে পেরেছেন? বরং ভারতের অসন্তোষ ও অসহযোগিতার ফলে বাংলাদেশে বন্যা ও খরা নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত হয়েছে; সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা অব্যাহত রয়েছে এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। আমার সন্দেহ নেই, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার শাসনামল সম্পর্কে কোন গবেষক যদি কোন বই লেখেন, তাহলে এই আমলকে তিনি বাংলাদেশের জন্য এক অভিশপ্ত যুগ বলে উল্লেখ করতে বাধ্য হবেন।
খালেদা জিয়া উপজেলা নির্বাচনে সামান্য সাফল্যে ফুলে গিয়ে দেশে আবার সরকার-বিরোধী আন্দোলন শুরু করার হুমকি দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি আবার সন্ত্রাস শুরু করবেন। অবশ্যই সঙ্গে দোসর থাকবে জামায়াত। আন্দোলনের শক্তি বিএনপির নেই। জনসমর্থন তাঁরা আগে পাননি, ভবিষ্যতেও পাবেন না। জামায়াতের সহযোগিতায় আবার সন্ত্রাস চালাতে গেলে বেগম জিয়া নিজেই তাঁর দলের জন্য কবর তৈরি করে যাবেন। এ জন্য তাঁর উপদেষ্টা এককালের কবর-খোদক মোসাদ্দেক আলী ফালুর সাহায্য নিতে হবে না।
বিএনপির উচিত হাসিনা সরকারের সমালোচনা করা, নিয়মতান্ত্রিক বিরোধিতায় যাওয়া। রাজনৈতিক হঠকারিতা দ্বারা পুরনো ভুলের পুনরাবৃত্তি করা আত্মঘাতী হবে। বেগম জিয়া যেভাবে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন, তা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে তাঁর নিজের বা তাঁর পুত্রের বাংলার সিংহাসনে বসার কোন সম্ভাবনা (আশঙ্কা) আমি দেখি না।
[লন্ডন মঙ্গলবার, ৪ মার্চ ২০১৪]
প্রকাশ : বুধবার, ৫ মার্চ ২০১৪, ২১ ফাল্গুন ১৪২০
__._,_.___