'সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমাউন আহমদ ও ইমদাদুল হক মিলন-এর মিলন এই নিউইয়র্কেই ঘটেছিলো'
পাকিস্তান আমলের একবারে শেষের দিকে আমরা চাঁদপুর শহরের জোড়পুকুর পাড়ে 'পাকিস্তান লাইব্রেরী' নামে একটি পাঠাগারে বসতাম। আড্ডা মারতাম। বইপত্র পড়তাম। তখন মেইলে প্রায়শ: একটি পোস্টকার্ড আসতো, যাতে লেখা থাকতো, 'বই ব্যবসা লাভজনক নয় জেনেও যারা লাইব্রেরী ব্যবসা করেন তারা মহান।' লাইব্রেরী ব্যবসার সাথে জড়িতরা সবাই মহান এটা মানা হয়তো কঠিন, কিন্তু তারা নিজেদের অজান্তে অর্থ কমানোর মধ্য দিয়ে মানুষের কিছুটা হলেও কল্যাণ করছেন সেটা অনস্বীকার্য। অজান্তে বললাম এজন্যে যে, চিত্ত সাহা যখন ঢাকার বইমেলা শুরু করেছিলেন, তখন কি তিনি ভেবেছিলেন যে তার সেদিনের ছোট্ট বইমেলা আজ জাতীয় অনুষ্টানে পরিনত হবে? একই ভাবে নিউইয়র্কের মুক্তধারার বিশ্বজিত সাহা কি ভেবেছিলেন যে, ১৯৯২ সালে শুরু হওয়া বইমেলা ২৩ বছর পর আজ উত্তর আমেরিকা তথা সাগর পাড়ে বাঙালী ও বাংলার এক মহোত্সবে পরিনত হবে?বিশ্বজিত আমেরিকায় আসার পরপরই 'সাপ্তাহিক প্রবাসী' অফিসে পরিচয়। বাঁচার তাগিদেই মুক্তধারা গঠন, বই বিক্রী এবং পরবর্তিতে বইমেলা। উডসাইডের একবেড রুমের এপার্টমেন্ট থেকে বইমেলার যাত্রা শুরু, আজ এর পদচারণা সর্বত্র। মুক্তধারার অমর কীর্তি 'সাগর পাড়ে বইমেলা।' ঢাকার মত পুরো ফেব্রুয়ারী হয়তো নিউইয়র্কের বইমেলা হয়না; কিন্তু যে সপ্তাহান্তে তিনদিনের জন্যে বইমেলা হয়, ওই ক'দিন আমেজটা থাকে ঢাকার মতই। মানে আড্ডা, সবার সাথে দেখাশোনা, রাজ-উজির মারা, ঝগড়া-বিবাদ; প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা সবই চলে। দুই বাংলার লেখক, প্রকাশক, শিল্পী-কুশলীদের সমাগমে বইমেলা জমজমাট থাকে। এটাকে দুই বাংলার মিলনমেলা বলা চলে; যেটা ঢাকায় বাস্তব কারণেই হয়তো সম্ভব নয়। মুক্তধারা দুই বাংলার কত লেখক-শিল্পী-কুশলীদের বিশ্ব অঙ্গনে পরিচিত করিয়ে দিয়েছে এর খবর কে রাখে! এবারের বই মেলা সামনের মাসে, মানে জুনে। দুই বাংলা থেকে অনেকেই আসছেন। আমেরিকার অন্যান্য স্টেট বা কানাডা থেকেও অনেকে আসেন। ঢাকা-কলকাতার মানুষজন তো আছেনই। কবিগুরু ১৪০০সাল কবিতায় আশংকা প্রকাশ করেছিলেন যে, একশ বছর পরে কেউ তার কবিতা পড়বেন কিনা! বেঁচে থাকলে তিনি জেনে খুশি হতেন যে, শুধু বঙ্গে নয়, সাগর পাড়েও মানুষ আজ বাংলা পড়ছে, বাংলা বইয়ের মেলা হচ্ছে। সৈয়দ মুজতবা আলীর বাঙালীর বই না কেনা বা না পড়ার দেয়া বদনামটা সামান্য হলেও ঘোচাতে চেস্টা করছে।যতদুর জানি ঢাকা ও নিউইয়র্ক মুক্তধারা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান; দুই সংস্থার দুই কর্ণধার সাহা হলেও তারা অনাত্মীয়। প্রবাসে জীবন-জীবিকা-দেশ ও দশের জন্যে অনেকই অনেক কিছু করার চেষ্টা করেন, কিন্তু মুক্তধারা যা করেছে তা অনন্য। প্রবাসে বাঙালী মাত্রই সজ্জন, বইমেলায় তা টের পাওয়া যায়। দুই বাংলার চার লেখক সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং হুমাউন আহমদ ও ইমদাদুল হক মিলন-এর মিলনমেলা এই নিউইয়র্কেই ঘটেছিলো। এ পর্যন্ত কত প্রকাশক, লেখক, শিল্পীর বইমেলায় সমাগম ঘটেছে তার ইয়ত্তা নাই। ঢাকার বইমেলায় যা যা হয়, নিউইয়র্কের বইমেলায় কমবেশি তা হয়। ঢাকার বইমেলা নি:সন্দেহে বাংলাভাষা ও বাঙালী সংস্কৃতির প্রসার ঘটিয়ে থাকে এবং সেটা আমাদের ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। একইভাবে প্রবাসে মুক্তধারার বইমেলা সেই দায়িত্বটি যথাযথভাবে পালন করছে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যেদিন প্রাদেশিক পার্লামেন্টে বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবি তুলেছিলেন সেদিন যেমন তিনি ভাবেননি তিনি ইতিহাস হয়ে যাবেন, মুক্তধারাও তেমনি ভাবেনি বই ব্যবসা করে এবং তা থেকে ঐতিহাসিক বইমেলার প্রচলন করে তারা ইতিহাস হয়ে যাবেন। কিন্তু তারা ইতিহাস হয়ে গেছেন।বইমেলার যাত্রা অবশ্য কুসমাস্তীর্ণ ছিলো না। আজো এর পথযাত্রা ততটা মসৃন নয়; চড়াই-উতরাই নিয়ে তা চলছে। দেশেই হোক বা বিদেশেই হোক; আমাদের তো নিন্দুকের কোনো অভাব নেই। আমরা নিজেরা যা করতে পারিনা, তা অন্যকেও করতে দিতে চাইনা। মুক্তধারাকে ঠেকাবার বহু চেষ্টাই হয়েছে; কিন্তু কাজ হয়নি, মুক্তধারা এগিয়েই গেছে। সামনে হয়ত আরো এগিয়ে যাবে। তবে এটা ঠিক অনেকে ঢাকা-কলকাতা থেকে এসে হয়তো আশানুরূপ ব্যবসা পান না। অনেকে বলেন বই-এর চেয়ে শাড়ি বিক্রী বেশী। সবই হয়তো সত্য। অন্তত: গিন্নী শাড়ি কিনলে কর্তা তো একটি বই কেনেন। শাড়ি ও বই পাশাপাশি চললে মন্দ কি, দুটোই তো বাঙালী সংস্কৃতির অঙ্গ।মুক্তধারা ও বিস্বজিতকে অনেকে ঈর্ষা করেন, কারণ কোথাকার এক বিশ্বজিত ইতিহাস সৃষ্টি করে বসে আছেন, আমরা টেরও পাইনি। সম্ভবত: গত বছরই বইমেলা শেষে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত বিশ্বজিত আমায় জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, 'দাদা, আর পারিনা।' তার আকুতি বুঝতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু কীইবা করার আছে, পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়া ছাড়া। কারণ, আমি জানি বিশ্বজিতরা আছে বলেই বইমেলা হয়; ছাড়তে চাইলেও বইমেলা ছাড়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়। তবে, এখন সময় এসেছে মুক্তধারার পাশে দাড়ানোর। বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারে আমরা গদগদ হয়ে যাই। সরকারও অনেক কর্মকান্ড করেন। আমেরিকার সরকারী কর্মকর্তারা কি টের পান, বাংলা ও বাঙালীর জন্যে মুক্তধারা কি করছে? ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে বাংলাকে স্বীকৃতি দিলো, প্রায়ত হুমায়ুন আহমদের মতে তখনই মুক্তধারাকে সন্মানিত করা উচিত ছিলো। সেটা হয়নি, হওয়া উচিত। এ সময়ে দেশে এমন একটি সরকার ক্ষমতায় যার নেত্রী নিজেও লেখক; যার পিতা বাংলা ও বাঙালীর মহানায়ক। নিউইয়র্ক-এর মুক্তধারার স্বীকৃতির জন্যে তিনি এগিয়ে আসবেন তা বলা বাহুল্য।শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক২৪মে ২০১৪। নিউইয়র্ক।
__._,_.___