বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার ॥ আমাদের করণীয়
ইমরান এইচ সরকার
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার সম্মিলিত নাগরিক শক্তি হিসেবেই এক ঐতিহাসিক বাস্তবতায় সম্মিলিত গণমানুষের প্লাটফর্ম হিসেবে গণজাগরণ মঞ্চ গঠিত হয়েছিল এবং তারপর থেকে আমরা প্রতিনিয়ত শত বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে বার বার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে এবং শাহবাগে দেয়া জনগণের ম্যান্ডেটের ৬ দফা বাস্তবায়নের আন্দোলনে সক্রিয় রয়েছি।
আর তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং এই বিচার সম্পন্ন করার সব বাধাকে সব সময় তীক্ষদৃষ্টিতে নজরে রেখে সেই অনুযায়ী সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে আমরা প্রতিনিয়ত কথা বলে থাকি। গণজাগরণ মঞ্চের এই সংগ্রামে শুধু তরুণ সমাজই জড়িত এমন নয় বরং দেশের সকল মানুষই এই সংগ্রামে গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যুদ্ধাপরাধীদের নির্মূলের এই দীর্ঘ যাত্রায় বার বারই আমাদেরকে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে হয় এবং সে অনুযায়ী আগামীর পথরেখা ঠিক করতে হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় আজকের আয়োজন। আজকের গোলটেবিলের শিরোনাম তাই-বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার, সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও আমাদের করণীয়।
এই গোলটেবিল বৈঠকে আমরা দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের প্রতিনিধিদের একসঙ্গে আমন্ত্রণ জানিয়েছি যাতে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একসঙ্গে পরিস্থিতির মূল্যায়ণ করা যায়। আগামীর লক্ষ্য যেমন নির্দিষ্ট, যাত্রাপথ তেমনই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, এই সময়ে সকলের সম্মিলিত অবস্থানের কোন বিকল্প নেই।
আজকের আলোচনার বিষয়বস্তুুতে বলা হয়েছে 'সাম্প্রতিক পরিস্থিতি।' এই সাম্প্রতিক পরিস্থিতির বিষয়টিতে আমি প্রথমেই নজর দিতে চাই। আপনারা দেখেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে যে সাম্প্রতিক খবরগুলো প্রকাশিত হচ্ছে, সেগুলো আমাদের কারও জন্যই স্বস্তিদায়ক নয়। এর মধ্যে সবচাইতে বড় যে খবরটি আমাদের উদ্বিগ্ন করছে সেটি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পরেও গত প্রায় ২ মাস ধরে দলটির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা যায়নি। এবং গত ১৯ মে একটি নোটিসের প্রেক্ষিতে এই গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক মামলা পরিচালনাকারী ৭ সদস্যের দল তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে।
এর চাইতে বড় উদ্বেগের বিষয় আর কী হতে পারে?
যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অবিলম্বে অভিযোগ দাখিল করা দরকার এবং সাফল্যের সঙ্গে এই মামলাটি পরিচালনা করা প্রয়োজন। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর যোগসাজশে, ষড়যন্ত্রে, প্ররোচণায়, দুরভিসন্ধিতে কিংবা অপচেষ্টায় যদি এই গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির অভিযোগ দাখিলে অনাবশ্যক কালক্ষেপণ করা হয় অথবা অভিযোগ দাখিল না করা হয় বা মামলা পরিচালনায় কোন শিথিলতা প্রদর্শন করা হয়, তাহলে এর পেছনে দায়ী প্রত্যেককেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের প্রতি যে কোন ধরনের শিথিলতা প্রকাশের অপচেষ্টাকে বাংলাদেশের মানুষ রুখে দেবে। আমরা সবসময়ই আশা করব যে, সকল শঙ্কা ও অপতৎপরতাকে রুখে দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা এই গুরুত্বপূর্ণ মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল ও মামলা পরিচালনায় তাদের পরীক্ষিত দক্ষতার ছাপ রাখবেন।
আমরা যেন ভুলে না যাই যে, এই বিচার প্রক্রিয়া কোন দৈনন্দিন ব্যাপার নয়। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, ২ লাখ মায়ের সম্ভ্রমের দায় মেটাতে ইতিহাস আমাদের কাঁধে এই বিচার করার মহান দায়িত্ব অর্পণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর ৪২ বছর লেগেছে এই বিচার প্রক্রিয়া শুরু" করতে, এখন যদি কোন কারণে এই বিচারটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে না পারা যায়, তাহলে শহীদদের অভিশাপ থেকে কেউই রেহাই পাবে না।
জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতিতে এই স্থবিরতা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে জেনেছি যে, ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলীদের মধ্যে কিছু অস্থিরতাও তৈরি হয়েছে। আমি সেগুলো এখানে উল্লেখ করা বিব্রতকর মনে করছি। কিন্তু বিষয়টির প্রতি নজর রাখার জন্য আমরা সকলের কাছে জোর আহ্বান জানাই। কোন ধরনের অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতির কারণে যাতে বিচার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সকলের।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতির আরেকটি বিষয়ে আমি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি যে, আরও অন্তত ৪টি মামলার রায় অপেক্ষমাণ।
ট্রাইব্যুনালে রাজাকার মতিউর রহমান নিজামীর রায়টি অপেক্ষমাণ আছে গত ২৪ মার্চ ২০১৪ থেকে প্রায় ২ মাস যাবত, জাহিদ হোসেন ওরফে খোকন রাজাকারের রায়টি অপেক্ষমাণ ১৭ এপ্রিল ২০১৪ থেকে এবং কুখ্যাত রাজাকার মীর কাশেমের মামলার রায় গত ৪ মে ২০১৪ থেকে অপেক্ষমাণ।
এছাড়া আপীল বিভাগে রাজাকার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায়ের আপীল নিষ্পত্তির রায়ও গত ১৬ এপ্রিল ২০১৪ থেকে গত দেড়মাস যাবত অপেক্ষমাণ । এই রায়গুলোর জন্য পুরো জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে । আগের রায়গুলোর চূড়ান্ত রায় ঘোষণায় যে সময় লেগেছিল, বর্তমানের এই ৪টি মামলার ক্ষেত্রে সেই তুলনায় অনেক বেশি সময় লাগছে যা অনাকাক্সিক্ষত। রায় ঘোষণার এই অপেক্ষার সময়ে ঘাতক জামায়াত-শিবির আর তাদের দোসররা কিন্তু চুপ করে বসে নেই । তারা যথেষ্ট সময় হাতে পাওয়ায় আগামীতে আবারও বড় ধরনের তাণ্ডব তৈরি করে এই দেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার চেষ্টা করতে পারে। আমরা আশঙ্কা করি জামায়াত-শিবির আগামীতে তাদের সর্বোচ্চ শক্তির প্রদর্শন করে, দেশী-বিদেশী চক্রের সঙ্গে মিলে এই দেশে যে অরাজকতার সৃষ্টি করবে সেটি অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় আরও ভয়াবহ হবে।
এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী অতীতে যেভাবে নিরীহ মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করেছে, থেঁতলে হত্যা করেছে, পুড়িয়ে মেরেছে; রাষ্ট্রীয় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস করেছে, এমনকি রাস্তার পাশের নিরীহ গাছগুলোও যাদের নৃশংস তাণ্ডব থেকে রেহাই পায়নি, এই চক্রকে সমূলে নিপাত করার এখনই সময়। অপেক্ষমাণ রায়গুলোর প্রেক্ষিতে আগামীতে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে প্রতিহত করার কোন ভরসা জাগানো দৃশ্যমান উদ্যোগ কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে না। আমরা বার বার বলছি যে, এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে এদের সন্ত্রাসী আস্তানাগুলো ধ্বংস করা দরকার, অবৈধ অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা প্রয়োজন এবং এদের বড় বড় সন্ত্রাসী পাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা জরুরী।
কিন্তু সে রকম কোন উদ্যোগ নেই। এর ফলে আগামীতে সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে তার দায় সকলকেই বহন করতে হবে।
আপনাদের আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম একটি দাবি ছিল-
অবিলম্বে সংগঠনগুলোর আর্থিক উৎস, যেসব উৎস থেকে সকল প্রকার জঙ্গীবাদী এবং দেশবিরোধী তৎপরতার আর্থিক যোগান দেয়া হয়, সেগুলো চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা।
আজকে যখন পত্রিকায় জামায়াতীদের পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে চাঁদা নেয়ার ছবি দেখতে পাই, তখন মনে হয় সাধারণ মানুষের সংগঠন নেই বলে, সাধারণ মানুষের টাকা নেই বলে, সাধারণ মানুষের আন্তর্জাতিক লবি নেই বলে সাধারণ মানুষের গণজাগরণের দাবিকে পাশ কাটিয়ে জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষকদের আর্থিক সহায়তা নেয়ার দুঃসাহস দেখানো যায়।
আমরা যখন জঙ্গীবাদের চিহ্নিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ে ওকালতি দেখি তখন নানা আশঙ্কায় শিউরে উঠি।
এ কিসের লক্ষণ, সেই প্রশ্ন বার বার আমাদের মনে ভেসে ওঠে।
আমি এখনও মনে করি, অবিলম্বে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা প্রয়োজন। আগামীতে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় একের পর এক কার্যকর হতে থাকবে, তখন সারাদেশে তাণ্ডব ছড়াতে এই প্রতিষ্ঠানগুলোই ব্যবহৃত হবে। এই প্রতিষ্ঠানের ছদ্মাবরণেই সারাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়, সারাদেশে তাদের নেটওয়ার্কিং শক্তিশালী করা হয় এবং সকল ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আর্থিক মদদ দেয়া হয়। আজ যদি এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মনীতি ও আইনসম্মত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হতে পারে। এই কূচক্রীরা ষড়যন্ত্র করে দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তুলবে না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে?
এই পরিস্থিতিতে যখন বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা দেখা যাচ্ছে, নানামুখী অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, রায় পরবর্তী তাণ্ডব মোকাবেলার কোন প্রস্তুুতি দেখা যাচ্ছে না, অন্যদিকে জঙ্গী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আমরা নানা মহলকে সক্রিয় দেখছি, তখন সত্যিই যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে ঘিরে ধীরে ধীরে একটি বড় আশঙ্কার জন্ম হচ্ছে।
আমি আগেও বার বার যে কথাটি বলেছি, সে কথাটিই আবার বলতে চাই যে দেশকে যুদ্ধাপরাধীমুক্ত করা একটি বিশাল ক্যানভাসের কাজ। দেশকে যুদ্ধাপরাধী মুক্ত করার জন্য জাতির মাঝে যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে উঠেছে, সেই ঐক্যের প্রতি সম্মান জানিয়ে যদি প্রতিটি মানুষ তাদের নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন না হন, সক্রিয় না হন, তাহলে প্রত্যেককেই একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
আর এখানেই সরকার, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত ও প্রসিকিউশন টিম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজনৈতিক মহল, গণমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষের প্রত্যেকেরই দায় ও দায়িত্ব রয়েছে। আজকের এই পরিস্থিতিতে প্রত্যেকটি সেক্টরের দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্যকে আবারও স্মরণ করা প্রয়োজন, পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন। আমি আমাদের সকলের কর্তব্য নির্ধারণের এই বিষয়টি আলোচনা করার জন্য সমবেত গুণীজনদের বিনীত আহ্বান জানাচ্ছি।
এতক্ষণ আশঙ্কার পরেও আমি উপসংহারে আমাদের নিজেদের মূল করণীয়টুকু পরিষ্কারভাবে সুকান্তের ভাষাতেই বলতে চাই, "বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ,/সুতীক্ষè করো চিত্ত /বাংলার মাটি, দুর্জয়/ ঘাঁটি চিনে নিক দুর্বৃত্ত।
লেখক : মুখপাত্র, গণজাগরণ মঞ্চ
(২৪ মে ২০১৪ জাতীয় প্রেস ক্লাব ভিআইপি লাউঞ্জে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকের স্বাগত বক্তব্য)
আর তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং এই বিচার সম্পন্ন করার সব বাধাকে সব সময় তীক্ষদৃষ্টিতে নজরে রেখে সেই অনুযায়ী সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে আমরা প্রতিনিয়ত কথা বলে থাকি। গণজাগরণ মঞ্চের এই সংগ্রামে শুধু তরুণ সমাজই জড়িত এমন নয় বরং দেশের সকল মানুষই এই সংগ্রামে গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যুদ্ধাপরাধীদের নির্মূলের এই দীর্ঘ যাত্রায় বার বারই আমাদেরকে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে হয় এবং সে অনুযায়ী আগামীর পথরেখা ঠিক করতে হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় আজকের আয়োজন। আজকের গোলটেবিলের শিরোনাম তাই-বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার, সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও আমাদের করণীয়।
এই গোলটেবিল বৈঠকে আমরা দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের প্রতিনিধিদের একসঙ্গে আমন্ত্রণ জানিয়েছি যাতে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একসঙ্গে পরিস্থিতির মূল্যায়ণ করা যায়। আগামীর লক্ষ্য যেমন নির্দিষ্ট, যাত্রাপথ তেমনই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, এই সময়ে সকলের সম্মিলিত অবস্থানের কোন বিকল্প নেই।
আজকের আলোচনার বিষয়বস্তুুতে বলা হয়েছে 'সাম্প্রতিক পরিস্থিতি।' এই সাম্প্রতিক পরিস্থিতির বিষয়টিতে আমি প্রথমেই নজর দিতে চাই। আপনারা দেখেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে যে সাম্প্রতিক খবরগুলো প্রকাশিত হচ্ছে, সেগুলো আমাদের কারও জন্যই স্বস্তিদায়ক নয়। এর মধ্যে সবচাইতে বড় যে খবরটি আমাদের উদ্বিগ্ন করছে সেটি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পরেও গত প্রায় ২ মাস ধরে দলটির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা যায়নি। এবং গত ১৯ মে একটি নোটিসের প্রেক্ষিতে এই গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক মামলা পরিচালনাকারী ৭ সদস্যের দল তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে।
এর চাইতে বড় উদ্বেগের বিষয় আর কী হতে পারে?
যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অবিলম্বে অভিযোগ দাখিল করা দরকার এবং সাফল্যের সঙ্গে এই মামলাটি পরিচালনা করা প্রয়োজন। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর যোগসাজশে, ষড়যন্ত্রে, প্ররোচণায়, দুরভিসন্ধিতে কিংবা অপচেষ্টায় যদি এই গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির অভিযোগ দাখিলে অনাবশ্যক কালক্ষেপণ করা হয় অথবা অভিযোগ দাখিল না করা হয় বা মামলা পরিচালনায় কোন শিথিলতা প্রদর্শন করা হয়, তাহলে এর পেছনে দায়ী প্রত্যেককেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের প্রতি যে কোন ধরনের শিথিলতা প্রকাশের অপচেষ্টাকে বাংলাদেশের মানুষ রুখে দেবে। আমরা সবসময়ই আশা করব যে, সকল শঙ্কা ও অপতৎপরতাকে রুখে দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা এই গুরুত্বপূর্ণ মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল ও মামলা পরিচালনায় তাদের পরীক্ষিত দক্ষতার ছাপ রাখবেন।
আমরা যেন ভুলে না যাই যে, এই বিচার প্রক্রিয়া কোন দৈনন্দিন ব্যাপার নয়। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, ২ লাখ মায়ের সম্ভ্রমের দায় মেটাতে ইতিহাস আমাদের কাঁধে এই বিচার করার মহান দায়িত্ব অর্পণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর ৪২ বছর লেগেছে এই বিচার প্রক্রিয়া শুরু" করতে, এখন যদি কোন কারণে এই বিচারটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে না পারা যায়, তাহলে শহীদদের অভিশাপ থেকে কেউই রেহাই পাবে না।
জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতিতে এই স্থবিরতা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে জেনেছি যে, ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলীদের মধ্যে কিছু অস্থিরতাও তৈরি হয়েছে। আমি সেগুলো এখানে উল্লেখ করা বিব্রতকর মনে করছি। কিন্তু বিষয়টির প্রতি নজর রাখার জন্য আমরা সকলের কাছে জোর আহ্বান জানাই। কোন ধরনের অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতির কারণে যাতে বিচার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সকলের।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতির আরেকটি বিষয়ে আমি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি যে, আরও অন্তত ৪টি মামলার রায় অপেক্ষমাণ।
ট্রাইব্যুনালে রাজাকার মতিউর রহমান নিজামীর রায়টি অপেক্ষমাণ আছে গত ২৪ মার্চ ২০১৪ থেকে প্রায় ২ মাস যাবত, জাহিদ হোসেন ওরফে খোকন রাজাকারের রায়টি অপেক্ষমাণ ১৭ এপ্রিল ২০১৪ থেকে এবং কুখ্যাত রাজাকার মীর কাশেমের মামলার রায় গত ৪ মে ২০১৪ থেকে অপেক্ষমাণ।
এছাড়া আপীল বিভাগে রাজাকার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায়ের আপীল নিষ্পত্তির রায়ও গত ১৬ এপ্রিল ২০১৪ থেকে গত দেড়মাস যাবত অপেক্ষমাণ । এই রায়গুলোর জন্য পুরো জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে । আগের রায়গুলোর চূড়ান্ত রায় ঘোষণায় যে সময় লেগেছিল, বর্তমানের এই ৪টি মামলার ক্ষেত্রে সেই তুলনায় অনেক বেশি সময় লাগছে যা অনাকাক্সিক্ষত। রায় ঘোষণার এই অপেক্ষার সময়ে ঘাতক জামায়াত-শিবির আর তাদের দোসররা কিন্তু চুপ করে বসে নেই । তারা যথেষ্ট সময় হাতে পাওয়ায় আগামীতে আবারও বড় ধরনের তাণ্ডব তৈরি করে এই দেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার চেষ্টা করতে পারে। আমরা আশঙ্কা করি জামায়াত-শিবির আগামীতে তাদের সর্বোচ্চ শক্তির প্রদর্শন করে, দেশী-বিদেশী চক্রের সঙ্গে মিলে এই দেশে যে অরাজকতার সৃষ্টি করবে সেটি অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় আরও ভয়াবহ হবে।
এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী অতীতে যেভাবে নিরীহ মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করেছে, থেঁতলে হত্যা করেছে, পুড়িয়ে মেরেছে; রাষ্ট্রীয় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস করেছে, এমনকি রাস্তার পাশের নিরীহ গাছগুলোও যাদের নৃশংস তাণ্ডব থেকে রেহাই পায়নি, এই চক্রকে সমূলে নিপাত করার এখনই সময়। অপেক্ষমাণ রায়গুলোর প্রেক্ষিতে আগামীতে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে প্রতিহত করার কোন ভরসা জাগানো দৃশ্যমান উদ্যোগ কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে না। আমরা বার বার বলছি যে, এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে এদের সন্ত্রাসী আস্তানাগুলো ধ্বংস করা দরকার, অবৈধ অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা প্রয়োজন এবং এদের বড় বড় সন্ত্রাসী পাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা জরুরী।
কিন্তু সে রকম কোন উদ্যোগ নেই। এর ফলে আগামীতে সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে তার দায় সকলকেই বহন করতে হবে।
আপনাদের আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম একটি দাবি ছিল-
অবিলম্বে সংগঠনগুলোর আর্থিক উৎস, যেসব উৎস থেকে সকল প্রকার জঙ্গীবাদী এবং দেশবিরোধী তৎপরতার আর্থিক যোগান দেয়া হয়, সেগুলো চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা।
আজকে যখন পত্রিকায় জামায়াতীদের পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে চাঁদা নেয়ার ছবি দেখতে পাই, তখন মনে হয় সাধারণ মানুষের সংগঠন নেই বলে, সাধারণ মানুষের টাকা নেই বলে, সাধারণ মানুষের আন্তর্জাতিক লবি নেই বলে সাধারণ মানুষের গণজাগরণের দাবিকে পাশ কাটিয়ে জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষকদের আর্থিক সহায়তা নেয়ার দুঃসাহস দেখানো যায়।
আমরা যখন জঙ্গীবাদের চিহ্নিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ে ওকালতি দেখি তখন নানা আশঙ্কায় শিউরে উঠি।
এ কিসের লক্ষণ, সেই প্রশ্ন বার বার আমাদের মনে ভেসে ওঠে।
আমি এখনও মনে করি, অবিলম্বে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা প্রয়োজন। আগামীতে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় একের পর এক কার্যকর হতে থাকবে, তখন সারাদেশে তাণ্ডব ছড়াতে এই প্রতিষ্ঠানগুলোই ব্যবহৃত হবে। এই প্রতিষ্ঠানের ছদ্মাবরণেই সারাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়, সারাদেশে তাদের নেটওয়ার্কিং শক্তিশালী করা হয় এবং সকল ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আর্থিক মদদ দেয়া হয়। আজ যদি এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মনীতি ও আইনসম্মত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হতে পারে। এই কূচক্রীরা ষড়যন্ত্র করে দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তুলবে না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে?
এই পরিস্থিতিতে যখন বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা দেখা যাচ্ছে, নানামুখী অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, রায় পরবর্তী তাণ্ডব মোকাবেলার কোন প্রস্তুুতি দেখা যাচ্ছে না, অন্যদিকে জঙ্গী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আমরা নানা মহলকে সক্রিয় দেখছি, তখন সত্যিই যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে ঘিরে ধীরে ধীরে একটি বড় আশঙ্কার জন্ম হচ্ছে।
আমি আগেও বার বার যে কথাটি বলেছি, সে কথাটিই আবার বলতে চাই যে দেশকে যুদ্ধাপরাধীমুক্ত করা একটি বিশাল ক্যানভাসের কাজ। দেশকে যুদ্ধাপরাধী মুক্ত করার জন্য জাতির মাঝে যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে উঠেছে, সেই ঐক্যের প্রতি সম্মান জানিয়ে যদি প্রতিটি মানুষ তাদের নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন না হন, সক্রিয় না হন, তাহলে প্রত্যেককেই একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
আর এখানেই সরকার, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত ও প্রসিকিউশন টিম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজনৈতিক মহল, গণমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষের প্রত্যেকেরই দায় ও দায়িত্ব রয়েছে। আজকের এই পরিস্থিতিতে প্রত্যেকটি সেক্টরের দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্যকে আবারও স্মরণ করা প্রয়োজন, পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন। আমি আমাদের সকলের কর্তব্য নির্ধারণের এই বিষয়টি আলোচনা করার জন্য সমবেত গুণীজনদের বিনীত আহ্বান জানাচ্ছি।
এতক্ষণ আশঙ্কার পরেও আমি উপসংহারে আমাদের নিজেদের মূল করণীয়টুকু পরিষ্কারভাবে সুকান্তের ভাষাতেই বলতে চাই, "বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ,/সুতীক্ষè করো চিত্ত /বাংলার মাটি, দুর্জয়/ ঘাঁটি চিনে নিক দুর্বৃত্ত।
লেখক : মুখপাত্র, গণজাগরণ মঞ্চ
(২৪ মে ২০১৪ জাতীয় প্রেস ক্লাব ভিআইপি লাউঞ্জে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকের স্বাগত বক্তব্য)
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০১৪, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২১
__._,_.___