ইউনিসেফের প্রতিবেদন
দক্ষিণ এশিয়ায় কিশোরী নির্যাতনের শীর্ষে বাংলাদেশ
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বলেছে, বিশ্বে প্রতি ১০ জনে একজন মেয়ে ১৯ বছর বয়স পেরোনোর আগেই ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। আর দক্ষিণ এশিয়ায় কিশোরী নির্যাতনের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। এখানে প্রায় প্রতি দুজনের একজন (৪৭ শতাংশ) বিবাহিত কিশোরী (১৫ থেকে ১৯ বছর) স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়।
গতকাল শুক্রবার প্রকাশিত 'হিডেন ইন প্লেইন সাইট' (দৃষ্টির মধ্যেই সুপ্ত) শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে শিশুদের ওপর সহিংসতার মাত্রা ও ধরন জানতে ১৯০টি দেশ থেকে তথ্য-উপাত্ত ব্যবহৃত হয়েছে।
প্রতিবেদন প্রসঙ্গে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ হচ্ছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাল্যবিবাহের শিকার যারা হচ্ছে, তাদের বিয়ের পরে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। কেননা, বিয়ে ও অন্য পরিবারের সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা থাকে না। তবে সরকার বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ব্যাপকভাবে কাজ করছে। নতুন আইন করতে যাচ্ছে সরকার। সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের ফলে বাল্যবিবাহের শিকার এই কিশোরীদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
বেসরকারি সংগঠন ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা বলেন, পরিবারের নিকটজনদের হাতে এ ধরনের নির্যাতন বেশি হয়। এ ধরনের ঘটনা বন্ধু বা সমবয়সীদের মাঝে বেশি প্রকাশিত হয়।
স্বামী বা সঙ্গীর নিপীড়ন: প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে বিবাহিত কিশোরীদের (১৫ থেকে ১৯ বছর) মধ্যে শারীরিক, যৌন বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় প্রতি তিনজনে একজন। এই হার সবচেয়ে বেশি ইকুয়েটোরিয়াল গিনিতে, ৭৩ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম ইউক্রেনে, ২ শতাংশ।
এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থা নাজুক বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এখানে কোনো না কোনো সময় বিবাহিত বা সঙ্গী ছিল—এমন প্রতি পাঁচজন নারীর একজন তাঁদের স্বামী বা সঙ্গীর কাছ থেকে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এই হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে, ৪৭ শতাংশ। ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এ ক্ষেত্রে ৭ নম্বরে। এরপর ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে এই হার যথাক্রমে ৩৪, ২৮ ও ২৩ শতাংশ।
১৫ থেকে ১৯ বছরের কিশোরীদের সঙ্গীর কাছ থেকে শুধু শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার চিত্রও বিশ্বব্যাপী প্রায় একই। এখানেও সবার ওপরে ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, ৭১ শতাংশ। আর দক্ষিণ এশিয়ার যে চারটি দেশের তথ্য পাওয়া গেছে সেখানে, সবার ওপরে বাংলাদেশ, ৪০ শতাংশ। এরপর ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল যথাক্রমে ২৫, ২৩ ও ১৭ শতাংশ।
কিশোরীদের মানসিক নির্যাতনের ক্ষেত্রেও ওপরে আছে ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, ৫৭ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে এই হার যথাক্রমে ২৫, ১৩ ও ১০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তথ্য পাওয়া যায়নি।
বিয়ের পর নির্যাতন: প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৮ বছরের নিচে বিয়ে মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী। অনেক দেশে সেটা আইনেরও লঙ্ঘন। এর পরও এমনটা প্রায়ই ঘটে। গবেষণায় দেখা গেছে, কম বয়সে বিবাহিত মেয়েরা পরিবারের মধ্যে স্বামী বা অন্য সদস্যদের দ্বারা বেশি নির্যাতনের শিকার হন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, এখানে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে যেসব মেয়েদের বিয়ে হয়, তারা অন্যদের তুলনায় বেশি শারীরিক নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। একই প্রবণতা আছে ভারত ও নেপালেও।
নিপীড়নের পর সাহায্য প্রার্থনা: বেশির ভাগ দেশেই যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার পর অন্যের থেকে সহযোগিতা নেওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েশিশুরা (১৫-১৯ বছর) নারীদের (২০-৪৯ বছর) চেয়ে পিছিয়ে থাকে। অবশ্য বাংলাদেশে সাহায্য প্রার্থনার দিক দিয়ে বাংলাদেশের মেয়ে ও নারীদের অবস্থান প্রায় সমান সমান, ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। অন্য দেশের তুলনায় এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে। সবচেয়ে পিছিয়ে আছে কলম্বিয়া, কিরগিজস্তান ও তানজানিয়ার মতো দেশগুলো।
হত্যাকাণ্ড: প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা বিশ্বে হত্যার শিকার মোট মানুষের পাঁচ ভাগের এক ভাগই অনূর্ধ্ব ১৯ বছর বয়সী। ২০১২ সালে সারা বিশ্বে মোট ৯৫ হাজার শিশু-কিশোরকে হত্যা করা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১২ সালে বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ শিশু-কিশোরের (১৯ পর্যন্ত) মধ্যে একজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় এই হার সবচেয়ে বেশি আফগানিস্তানে, আটজন এবং এরপর পাকিস্তানে, চারজন। আর বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিশু-কিশোর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় লাতিন আমেরিকার এল সালভাদরে। প্রতি লাখে ২৭ জন। এ ক্ষেত্রে ওপরের দিক থেকে পরের দুটি দেশও একই অঞ্চলের। গুয়াতেমালা ২২ ও ভেনেজুয়েলা ২০।
প্রতিবেদন প্রকাশের সময় ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক অ্যান্থনি লেক বলেছেন, 'এসব অস্বস্তিকর তথ্য—কোনো সরকার বা মা-বাবার কাছেই এ তথ্য প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু প্রতিটি অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতার পরিসংখ্যান প্রত্যক্ষভাবে মোকাবিলা না করলে শিশুর প্রতি সহিংসতার ব্যাপারে মানসিকতার পরিবর্তন কখনোই হবে না। আর শিশুরাও স্বাভাবিক জীবন পাবে না। কিন্তু প্রত্যেকেরই একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত শৈশব পাওয়ার অধিকার আছে।'
সুপারিশ: প্রতিবেদনে শিশুদের ওপর নির্যাতন প্রতিরোধে ছয়টি কৌশল অবলম্বনের সুপারিশ করা হয়েছে। যেগুলোর মধ্যে আছে, পিতা-মাতার বন্ধুসুলভ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও শিশুদের জীবন-যাপনের কৌশল শেখানো, আচরণগত পরিবর্তন; শিশুদের ওপর সংঘটিত অপরাধের বিচার নিশ্চিত করা, অপরাধ মোকাবিলা ও সামাজিক পদ্ধতির সংস্কার এবং অপরাধের শিকার শিশুদের সেবার ব্যবস্থা জোরদার করা; সহিংসতা ও এর আর্থসামাজিক ক্ষতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং সামাজিক রীতিনীতিতে পরিবর্তন আনা।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/311719/
__._,_.___