দুই দিনের কোটিপতি
চট্টগ্রাম সরকারি সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ জামে মসজিদের তিন মুয়াজ্জিনের মধ্যে দ্বিতীয় বশিরুল আলম। বেতন আট হাজার টাকা। লাখ টাকার স্বপ্ন দেখতেও ভয় থাকাটাই স্বাভাবিক। অথচ তিনিই হঠাৎ করে হয়ে গেলেন কোটিপতি। তবে মাত্র দুই দিনের জন্য। ১২ অক্টোবর গ্রুপ ফোরের ভল্ট থেকে তিন কোটি টাকা চুরি করে প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তারক্ষী শহিদুল নিরাপদ ভেবেই নিয়ে এসেছিলেন পূর্ব পরিচিত বশিরুল আলমের শয়ন কক্ষে। দুটি লাগেজে ভরে সেই টাকা একদিন ছিল বশিরের কক্ষেই। গতকাল নগরজুড়ে ঝড় তুলেছিল দু'দিনের কোটিপতি মুয়াজ্জিনের কথাই।
হায় রে বিধি, কে জানতো সেই টাকাটাই তাকে কোটিপতি করার পরিবর্তে নিয়ে যাবে কারাগারে? মঙ্গলবার ভোরেই পুলিশ তার কক্ষ থেকে উদ্ধার করে চুরি যাওয়া টাকার প্রায় পুরোটাই। আর চোরাই টাকা নিজ হেফাজতে রাখার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয় মুয়াজ্জিন বশিরুল আলমকে।
চুরি কাহিনী
দিনের পর দিন শোষিত হতে হতে বিক্ষুদ্ধ মন বিদ্রোহ করে বসে। প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় ঘটায় তিন কোটি টাকা চুরির মতো দুর্ধর্ষ ঘটনা। এ যেন কোন এ্যাকশন থ্রিলার ছবির কাহিনী। গতকাল র্যাব সদর দপ্তরে গ্রেপ্তারকৃত শহিদুল যখন গ্রুপ ফোর সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানে চুরির ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করছিলেন, উপস্থিত সাংবাদিকদের অনেকের মনে ভিড় করছিল তখন এমন কোন ছবির জমজমাট কাহিনী। তবে র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিশতাক উদ্দিন আহমেদ জানালেন, তার জবানবন্দির সত্যতা যাচাই করার আগে নিশ্চিত করে কিছু বলার সুযোগ নেই।
বঞ্চনার ক্ষোভ থেকে চুরির পরিকল্পনা : শহিদুল হক বলেন, গ্রুপ ফোরের কর্মকর্তারা শাসক। গ্রুপ ফোর প্রতিষ্ঠানে ১২শ কর্মচারী আছে। তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। ৮ ঘণ্টা খাটিয়ে একজন কর্মচারীকে মাস শেষে তারা মাত্র ৪ হাজার টাকা দেয়। অথচ এই আট ঘন্টার জন্য তারা অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে নেয় আট হাজার টাকা। আমাকে মাসিক মাত্র ৪ হাজার টাকা বেতন দিত। ওভারটাইম করে আরও দু'তিন হাজার টাকা পেতাম। কর্মচারীদের রক্ত চুষে মালিকরা টাকার পাহাড় গড়ার কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে এই চুরি করেছি। কোন খারাপ উদ্দেশ্যে নয়। শহিদুল আরো বলেন, রোজার ঈদের আগে বোনাস দূরের কথা, বেতনটাও দেয় নি তারা। ভেবেছিলাম কোরবানির ঈদে পাবো। কিন্তু ঈদের আগের দিন ৫ অক্টোবরেও যখন বেতন দেওয়া হলো না, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম চুরি করার।
শহিদুল বলেন, আমার সহকর্মীদের অনেকেই অফিসে কান্না করতো। চাকরি করে, কিন্তু বেতন পায় না, বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারে না। ঈদের আগে অনেকে মোবাইল ফোন বন্ধ রাখতো, বাড়ির লোকজনকে কী জবাব দেবে ভেবে না পেয়ে।
শহীদুল ইসলামের দাবি, দুই ঈদে বেতন না পেয়ে ক্ষোভে, দু:খে তিনি ভল্ট থেকে টাকা চুরির সিদ্ধান্ত নেন। চুরির সিদ্ধান্ত এবং পরিকল্পনা সব তার একার। এসময় র্যাব কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন গ্রুপ ফোরের দুই কর্মকর্তা। সংবাদ সম্মেলন শেষে তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা তড়িঘড়ি করে গাড়িতে চেপে চলে যান। উল্লেখ্য আগের দিন সিএমপি কমিশনার কার্যালয়েও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তারা নিরুত্তর ছিলেন এবং সংবাদ সম্মেলন শেষে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।
একক প্রচেষ্টায় এ দুর্ধর্ষ চুরি : র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে শহিদুল চুরির ঘটনা সবিস্তারে বর্ণণা দেন। তিনি জানান, ১২ অক্টোবর শনিবার রাতে গ্রুপ ফোরের অফিসে দায়িত্ব পালন করছিলেন,নিরাপত্তা কর্মী শহীদুল ইসলাম, ভল্টের গার্ড রফিক এবং ফ্রন্ট ডেস্ক অপারেটর রবিউল। রফিক ও রবিউল ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন। আগে থেকেই শহিদুল জানতেন যে কার্যালয়ের প্রথম দুই রুমের চাবি থাকে ফ্রন্ট ডেস্কে। প্রথমে কার্যালয়ের এক পাশের ছাদ দিয়ে ভেতরে ঢুকে শহিদুল অতি সন্তর্পণে এগিয়ে যান ফ্রন্ট ডেস্কের দিকে। ডেস্ক থেকে চাবি নিয়ে প্রথমে গার্ড রুমের দরজা খুলেন। সেখানে রক্ষিত আরও তিনটি চাবি নিয়ে পরপর দু'টি দরজা খুলে ভল্ট রুমে ঢুকেন। তার আগে মুখোশ পড়ে নেন। ভল্ট রুমে অ্যালার্মিং সুইচ ছিল। ঢোকার আগে শহীদুল তার ছিঁড়ে সেটা নষ্ট করে দেন। সে কক্ষের একটি ড্রয়ার থেকে ভল্টের চাবি নিয়ে দীর্ঘ তিন ঘণ্টা সময় নিয়ে চুরি করেন তিন কোটি টাকা । র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিশতাক উদ্দিন আহমেদ জানান প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা কর্মী হওয়ার সুবাদেই কার্যালয়ের কোথায় টাকা থাকে,ভল্টের চাবি কোথায় তা জানা ছিল শহিদুলের।১২ অক্টোবর রাত ৩টা ৫৭ মিনিট থেকে ভোর ৬টা ৪৯ মিনিট পর্যন্ত সময়ে চুরি সংঘটিত হয়।
টাকা যেভাবে মুয়াজ্জিনের ঘরে :- র্যাব সূত্রে জানা যায়, টাকা চুরির পর শহিদুল হক প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে টাকাগুলো রিক্সায় তুলেন। সোজা চলে যান পূর্ব পরিচিত সিটি কলেজ জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন বশিরুলের কাছে। তার শয়ন কক্ষে রেখে আসেন এ টাকা। তবে বশিরুল টাকা চুরি সম্পর্কে কিছুই জানেনা বলেও জানান তিনি। সেখানে টাকা রেখে আবারও বেরিয়ে যান। সেদিন শহরেই অবস্থান করেন তিনি। পরদিন রাঙামাটি চলে যান। চাকরির পাশাপাশি রাঙামাটি কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়াশোনা করতেন তিনি। সিদ্ধান্ত নেন চুরির ঘটনাটি ধামাচাপা পড়া পর্যন্ত রাঙ্গামাটিতে অবস্থান করবেন। আর এরই মধ্যে কলেজ থেকে কাগজপত্র তুলে অন্য কোনও জায়গায় গিয়ে চাকরির চেষ্টা করবেন।
মুয়াজ্জিনের সাথে পরিচয় :- শহিদুল হক জানান, ২০১২ সালে এইচএসসি প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার জন্য সিটি কলেজের আবেদনপত্র তুলতে গিয়ে পরিচয় মুয়াজ্জিন বশিরুল আলমের সাথে। কিন্তু জমা দিতে দেরি হওয়ায় সেই সময় তিনি ভর্তি হতে পারেন নি। তবে বশিরের সাথে তার সখ্যতা রয়ে যায়। দিনে দিনে আরো গাঢ় হয়। মঙ্গলবার সিএমপির গোয়েন্দা শাখায় আটককৃত মুয়াজ্জিন বশিরুল আজাদীকে জানিয়েছিলেন, মাঝে মধ্যেই শহিদুল তার ঘরে আসতো। বই পত্র, ব্যাগ রেখে যেত, আবার নিয়েও যেত। কিন্তু কখনো রাত্রি যাপন করে নি।
একই ভাবে শহিদুলও গতকাল জানান, চুরির পর এতগুলো টাকা নিয়ে কোথায় যাবেন, তা ভাবতে পারছিলেন না। তাই মুয়াজ্জিনের ওখানেই যেতে মনস্থির করেন। তাছাড়া মুয়াজ্জিনের ঘরে টাকা রাখলে কেউ সন্দেহ করবে না- এটিও একটি কারণ ছিল।
মহৎ উদ্দেশ্যে চুরি:- শহিদুল হক দাবি করেন, গরীব ও নির্যাতিতদের মাঝে বিলিয়ে দিতেই টাকা চুরি করেছিলেন তিনি। তিনি বলেন, চাইলে বিলাসিতা করতে পারতাম। কিন্তু চুরির টাকায় হাত দিই নি। স্টেশন রোডের একটি হোটেলে ৪০ টাকা ভাড়ায় আর পাঁচজনের সাথে মাদুর পেতে রাত কাটিয়েছি। সবজি দিয়ে ভাত খেয়েছি।
গরীবদের কীভাবে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন জানতে চাইলে শহিদুল বলেন,নির্যাতিত নারী, গরীব মানুষকে ১০০ / ২০০ টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চাই নি আমি। চেয়েছিলাম গরীব লোকদের ঋণ দেবো। আমার দেয়া পুঁজিতে তারা ব্যবসা করবে, পরে স্বাবলম্বী হলে ফেরত দেবে। সেই টাকা অন্যজনকে দেবো। এভাবেই তাদের মুখে হাসি ফুটাবো।
কিছু প্রশ্নের উত্তর মিলছে না : তিন কোটি টাকা চুরির মূল আসামি শহিদুল কাল র্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর এ ঘটনার রহস্য পুরোপুরি উন্মোচিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ছোট ছোট কিছু প্রশ্নের উত্তর এখনো জানা যায় নি, যা তদন্তে বেরিয়ে আসবে বলে ধারণা করছে সংশ্লিষ্ট সকলে।
পুলিশের অভিযান টিম বলছে, তারা মুয়াজ্জিনের ঘর থেকে উদ্ধার করেছে ২ কোটি ৯৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অন্যদিকে বাদী দাবি করছে টাকা ছিল ৩ কোটি। প্রথম অবস্থায় ধারণা করা হচ্ছিল বাকি ৫০ হাজার টাকা শহিদুল নিয়ে গেছে। কিন্তু তার দাবি চুরি করা টাকার কানা কড়িও ধরেননি তিনি। র্যাব- ৭ অধিনায়ক জানান, আটকের সময় শহিদুলের পকেটে ছিল মাত্র ২৫৭ টাকা। তাহলে এই ৫০ হাজার টাকা কোথায় গেল?
দ্বিতীয়ত: শহিদুল বলছেন, চুরির ঘটনায় একমাত্র তিনিই দায়ি। মুয়াজ্জিন বা অন্য কেউ তাতে জড়িত নন। কিন্তু চুরির পর এতগুলো টাকা একাকী বহন করে খুলশী থেকে আইসফ্যাক্টরী রোডস্থ সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও রহস্যময়। তাছাড়া মুয়াজ্জিনের ঘরে পাওয়া ঐ ট্রলি ব্যাগ দুটি কে এনেছিল এবং বস্তা থেকে টাকাগুলো কে ব্যাগে রেখেছিল?
তৃতীয়ত: শহিদুল দাবি করছেন, বঞ্চনার ক্ষোভ থেকেই ৫ অক্টোবর তিনি চুরির সিদ্ধান্ত নেন। তাই যদি হবে, তবে চাকরিতে যোগ দেয়ার সময় কেন নিজের ঠিকানা ভুল দিয়েছিলেন তিনি? শুধু তাই নয়, তার ব্যাগ তল্লাশি করে এটিএম বুথ কিংবা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে চুরির বেশ কিছু কৌশল লেখা কাগজ পাওয়া গেছে। সেটা প্রতিষ্ঠানে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলে কী করে মুখ লুকোতে হয়,তাও উল্লেখ আছে তাতে। যা ইন্টারনেট ঘেঁটে সংগ্রহ করা বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কখন তিনি সংগ্রহ করেন এগুলো?
- মুয়াজ্জিনের ঘরে মিলল গ্রুপ ফোরের ৩ কোটি টাকা
- http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article866318.bdnews
মুয়াজ্জিনের কক্ষে মিলল গ্রুপ ফোরের ৩ কোটি টাকা | | Samakal ...
চট্টগ্রামে জিফোর এসের চুরি যাওয়া তিন কোটি টাকার মধ্যে দুই কোটি ৯৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা মিলেছে মসজিদের এক মুয়াজ্জিনের কক্ষে! দুই ব্রিফকেস ভর্তি এসব টাকা উদ্ধার করা হয় সোমবার গভীর রাতে। মুয়াজ্জিনের কক্ষে মিলল গ্রুপ ফোরের ৩ কোটি টাকা. উদ্ধার হওয়া প্রায় ৩ কোটি টাকা- সমকাল. চট্টগ্রামের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ...
__._,_.___