১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভূমিকা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় গোলাম আযম রাজনৈতিক অবস্থান নেন ও পাকিস্তান বিভক্তির বিরোধীতা করেন[৩৫] এবং বারবার আওয়ামী লীগ ও মুক্তিবাহিনীকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করতে থাকেন।[৩৬] পরবর্তীতে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয় এবং ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। আযমের বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য ২৫ মার্চের পর থেকে জামায়াতের মুখপত্র বলে পরিচিত দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হত। ২৫ শে মার্চ রাতে সংঘটিত অপারেশন সার্চলাইট এর ছয় দিন পর গোলাম আযম ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে একটি ভাষণ দেন। এ ভাষণে তিনি ভারতের কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, "ভারত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী প্রেরণ করে কার্যত পূর্ব পাকিস্তানীদের দেশপ্রেমকে চ্যালেঞ্জ করেছে।...আমি বিশ্বাস করি যে, এই অনুপ্রবেশকারীরা পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমানদের নিকট হতে কোন প্রকার সাহায্য পাবে না।"[৩৭][৩৮] ২০ জুন, ১৯৭১ সালে করা একটি মন্তব্যে গোলাম আযম পাকিস্তানের প্রতি তার সমর্থন পুনরাব্যাক্ত করেন। মন্তব্যটি ছিল, "পাকিস্তনি বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় সকল সন্ত্রাসীদের হটিয়ে দিয়েছে।"[৩৬]
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়, ১১ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে গঠিত শান্তি কমিটিতে আযম গূরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ও তিনি এই আন্দলনকে ভারতের ষরযন্ত্র বলে উল্লেখ করেন।[৭][৩৯] আরো মনে করা হয়, আযম এই সংস্থার একজন প্রাতিষ্ঠাতা সদস্য।[৭] গোলম আযমের জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও বিহারিদের দ্বারা শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল।[৪০] এই শান্তি কমিটির সদস্যরা পাকিস্তনি সেনাবাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সহয়তা করত। তারা স্থানীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম যেমন হিন্দুদের সম্পদ ও জমি দখল করে সেগুলো পূণঃবিতরন করত। বিশেষ করে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরা শান্তি কমিটির হয়রানির শিকার হয়েছে বেশি। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ পাশের দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।[৮] শান্তি কমিটির সদস্যরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে রাজাকার সদস্য সংগ্রহ করত। রাজাকারের জন্য প্রথমিকভাবে আযমের জামায়াতে ইসলামী থেকে ৯৫ জন সদস্যকে সংগ্রহ করা হয় যাদেরকে খুলনার শাহজাহান আলী সড়কের আনসার ক্যাম্পে প্রশিক্ষন দেওয়া হয়।[৪১][৪২] এছাড়া যুদ্ধের সময় জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান আশরাফ হোসাইন জামালপুর জেলায় ২২ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে মিলিশিয়া বাহিনী আলবদর গঠন করেন।[৪৩] ১২ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে আযম ও মতিউর রহমান নিজামী এই স্বাধীনতা আন্দোলনকে ভারতের ষরযন্ত্র বলে উল্লেখ করে একটি বিক্ষোভের ডাক দেন ও তাতে নেতৃত্ব দেন।[৪৪]
মুক্তিযুদ্ধের সময় আযম প্রায়ই পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণ করতে, পাকিস্তানের নেতাদের সাথে যুদ্ধ সম্পর্কীত আলোচনা করতে।[৪৫] ৩০শে জুন লাহোরে সাংবাদিকদের কাছে গোলাম আযম বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের দুস্কৃতিকারী বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন যে তার দল এদের দমনে সর্বাত্ত্বক চেষ্ঠা করছে এবং এ কারণেই দুস্কৃতকারীদের হাতে বহু জামায়াত কর্মী নিহত হয়েছে।[৪৬] আযম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল টিক্কা খানসহ অন্যান্য সেনা অফিসারদের সাথে বৈঠক করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে কিভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যায় তার বিশদ আলোচনা করেন।[৪৫]
১২ আগস্ট, ১৯৭১ সালে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত একটি বক্তব্যে বলেন, "তথাকথিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকারীরা ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রু।"[৪৭] তিনি ভারতের বিরুদ্ধে আন্দোলনেরও ডাক দেন।[৪৮] গোলাম আযমকে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবেও অভিযুক্ত করা হয়। অভিযুগে বলা হয় সেপ্টেম্বরের প্রতম দিকে তিনি রাও ফরমান আলীর সাথে এক গোপন বৈঠক করে এই হত্যাকান্ডের নীলনকশা তৈরি করেন।[৪৯] উল্লেখ্য ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের অসংখ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রামে গোলাম আযমের পশ্চিম পাকিস্তান সফরকালের একটি সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ দুই কিস্তিতে ছাপা হয়। এই সাক্ষাৎকারে তিনি মুক্তিবাহিনীর সাথে তার দলের সদস্যদের সংঘর্ষের বিভিন্ন বিবরণ ও পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থতির ওপর মন্তব্য করেন। তিনি বলেন,
"বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জামায়াতকে মনে করতো পহেলা নম্বরের দুশমন। তারা তালিকা তৈরি করেছে এবং জামায়াতের লোকদের বেছে বেছে হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর লুট করছে জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। এতদসত্বেও জামায়াত কর্মীরা রাজাকারে ভর্তি হয়ে দেশের প্রতিরক্ষায় বাধ্য। কেননা তারা জানে 'বাংলাদেশ' ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কোন স্থান হতে পারে না। জামায়াত কর্মীরা শহীদ হতে পারে কিন্তু পরিবর্তিত হতে পারে না।" (দৈনিক সংগ্রাম, ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)
১৯৭১-এর পর বাংলাদেশ বিরোধী তদবির
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে একটি নতুন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের জন্ম হয়। গোলাম আযম ১৯৭১ সালের পরও তার তিনি বাংলাদেশ বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকেন। তিনি মধ্য-প্রাচ্য ও পাকিস্তানের অনেক নেতাকে এই নতুন জন্ম নেওয়া জাতিকে স্বীকৃতি না দিতে তদবির করেন। তার এই তদবির সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ বিবরণ ঢাকা বিশ্বব্যিালয়ের অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের লেখায় পাওয়া যায়।[১৪] অধ্যাপক আনিসুজ্জামান গোলাম আযমের বিরোদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ ১৯৯২ সালে গঠিত গণআদালতে উপস্থাপন করেন। এই গণআদালত জাহানারা ইমাম ও অন্যান্যদের দ্বারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গঠিত হয়েছিল। জাহানারা ইমাম এই অভিনব গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের দাবি তুলেছিলেন এবং হাজার হাজার জনতা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছিল।[৫৯]
দৈনিক প্রথম আলো অনুসারে, তিনজন বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা গোলাম আযমের বিরোদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। বাঙ্গালি সাংস্কৃতির বিরোদ্ধে গোলাম আযমের কর্মকান্ডের অভিযোগ উত্থাপন করেন সাইদ শামসুল হক, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উত্থাপন করেন বোরহান্নুদ্দিন খান জাহাঙ্গির ও মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ বিরোধী কর্মকান্ড সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।[১৪] আনিসুজ্জামানের উপত্থাপিত অভিযোগের কিছু বিশেষ অংশ হল,[১৪]
- ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হলে গোলাম আযম পাকিস্তানে বসে মাহমুদ আলী ও খাজা খয়েরউদ্দীনেরমত দেশদ্রোহীর সঙ্গে মিলিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি নামে একটি সংগঠনের সূচনা করেন এবং বিভিন্ন দেশে পূর্ব পাকিস্তান পূণঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলার আয়োজন করতে থাকেন। তিনি এই উদ্দেশ্যে দীর্ঘকাল পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমীর বলে পরিচয় দিতেন।
- ১৯৭২ সালে গোলাম আযম লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করেন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র উচ্ছেদ করে আবার এই ভূখন্ডকে পাকিস্তানের অংশে পরিনত করার ষড়যন্ত্র করেন। ১৯৭৩-এ ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত ফেডারেশন অফ স্টুডেন্টস ইসলামিক সোসাইটিজের বার্ষিক সম্মেলনে এবং লেসটারে অনুষ্ঠিত ইউকে ইসলামিক কমিশনের বার্ষিক সভায় তিনি বাংলাদেশ বিরোধী বক্তৃতা দেন। ১৯৭৪-এ মাহমুদ আলীসহ কয়েকজন পাকিস্তানিকে নিয়ে তিনি পূর্ব লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির একটি বৈঠক করেন। বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিনত করার প্রচেষ্ঠা ব্যার্থ হয়েছে দেখে এই সভায় স্থির করা হয় যে, তারা এখন থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নিয়ে একটি কনফেডারেশন গঠনের আন্দোলন করবেন। এই সভায় গোলাম আযম ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাংলাদেশে ফিরে অভন্ত্যর থেকে কাজ চালানোর প্রয়োজনীয়তা ব্যাক্ত করেন। ১৯৭৭-এ লন্ডনের হোলি ট্রিনিটি চার্চ কলেজে অনুষ্ঠিত একটি সভায় তিনি এ কথারই পুনরাবৃত্তি করেন এবং সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য পাকিস্তানি পাসপোর্ট ও বাংলাদেশি ভিসা নিয়ে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আগমন করেন।
- ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে গোলাম আযম রিয়াদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামি যুব সম্মেলনে যোগদান করেন ও পূর্ব পাকিস্তান পূণঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সকল মুসলিম রাষ্ট্রের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি সাতবার সৌদি বাদশার সঙ্গে সাক্ষাত করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে অনুরোধ করেন। ১৯৭৪ সালে রাবেতায়ে আলমে ইসলামির উদ্যোগে মক্কায় অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এবং ১৯৭৭ সালে কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত একটি সভায় বাংলাদেশের বিরোদ্ধে বক্তৃতা করেন।
- অনুরূপভাবে গোলাম আযম ১৯৭৩ সালে বেনগাজিতে অনুষ্ঠিত ইসলামি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য লবিং করেন। একই বছরে ত্রিপলিতে অনুষ্ঠিত ইসলামি যুব সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে হানিকর বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
- ১৯৭৩ সালে গোলাম আযম মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত মুসলিম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন অফ আমেরিকা এন্ড কানাডার বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানে পরিনত করতে সবাইকে কাজ করার আহ্বান জানান।
- ১৯৭৭ সালে গোলাম আযম ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ইসলামিক ফেডারেশন অফ স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশবিরোধী বক্তৃতা করেন।[১৪]
Mawdudi, Jamat-e-Islami & Deobandis had Opposed Pakistan's Creation.
__._,_.___