প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০:০০আপডেট : ১৮ নভেম্বর, ২০১৪ ২২:২৪:৫৮ |
ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রাম সূচনাকারীদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব তিতুমীর। প্রথম পর্যায়ে তার আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার। মুসলিম সমাজে শিরক ও বেদাতের অনুশীলন নির্মূল করা এবং মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের অনুশাসন অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করাই ছিল তার আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য। পরবর্তী সময়ে তা বৃহত্তর পরিসরে ব্রিটিশ ও তার তাঁবেদারদের বিরুদ্ধে গণসংগ্রামে রূপ নেয়। অসীম সাহস ও সেকেল স্থানীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিনি প্রতিরোধ সংগ্রাম পরিচালনা করেন। এ আন্দোলনে তার বিখ্যাত বাঁশের কেল্লা আজও জনশ্রুতিতে দেদীপ্যমান। ব্রিটিশ সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় এ বাঁশের কেল্লাতেই তার মৃত্যু হয়। সেদিনটি ছিল ১৯ নভেম্বর, ১৮৩১ সাল।
তিতুমীরের পুরো নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী। তিনি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চবি্বশ পরগনা জেলার বারাসাতের অন্তর্গত চাঁদপুর গ্রামে ১৭৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মীর হাসান আলী আর মা আবেদা রোকাইয়া খাতুন। তিতুমীরের প্রাথমিক শিক্ষা হয় তার গ্রামের বিদ্যালয়ে। পরবর্তীকালে তিনি স্থানীয় একটি মাদরাসায় লেখাপড়া করেন। তিনি ছিলেন কোরআনে হাফেজ, বাংলা, আরবি ও ফার্সি ভাষায় দক্ষ এবং আরবি ও ফার্সি সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগী। তিনি ইসলামী ধর্ম শাস্ত্র, আইন শাস্ত্র, দর্শন, তাসাউফ ও মানতিক বিষয়ে সুপ-িত ছিলেন। শৈশবকালে শারীরিক কৌশল, কুস্তিগির, দক্ষ সংগঠক ও অসাধারণ বীরত্বের জন্য বিশেষ সুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি অসাধারণ দৈহিক শক্তির অধিকারী ছিলেন।
১৮২২ সালে তিতুমীর মক্কায় হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে যান। তিনি সেখানে স্বাধীনতার অন্যতম পথপ্রদর্শক সৈয়দ আহমেদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ও ওয়াহাবি মতবাদে অনুপ্রাণিত হন। ১৮২৭ সালে দেশে ফিরে গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তিতুমীর হিন্দু জমিদার কর্তৃক মুসলমানদের ওপর বৈষম্যমূলকভাবে আরোপিত 'দাড়ির খাজনা' এবং মসজিদের করের তীব্র বিরোধিতা করেন। একইসঙ্গে কৃষককুলের ওপর জমিদারদের অত্যাচার প্রতিরোধ করতে গিয়ে অপরাপর জমিদারদের সঙ্গেও তিতুমীর সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এসব অত্যাচারী জমিদার ছিলেন গোবরডাঙার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, তারাগোনিয়ার রাজনারায়ণ, নাগপুরের গৌরীপ্রসাদ চৌধুরী এবং গোবরা-গোবিন্দপুরের দেবনাথ রায়। ক্রমেই তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে, তিনি তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হন। ১৮৩১ সালের ২৩ অক্টোবর বারাসাতের কাছে নারিকেলবাড়িয়ায় তারা বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন। বাঁশ এবং কাদা দিয়ে দ্বিস্তরবিশিষ্ট এ কেল্লা নির্মিত হয়।
প্রতিরোধের এক পর্যায়ে তিতুমীর বর্তমান চবি্বশ পরগনা, নদীয়া এবং ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকার নিয়ে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী এবং ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের হাতে বেশ কয়েকবার পরাজয় বরণ করে। তন্মধ্যে বারাসতের বিদ্রোহ অন্যতম। ঐতিহাসিক উইলিয়াম হান্টার বলেন, ওই বিদ্রোহে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষক সেনা তিতুমীরের পক্ষে যুদ্ধ করেন। অবশেষে ১৮৩১ সালের ১৩ নভেম্বর ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। ১৪ নভেম্বর কর্নেল হার্ডিংয়ের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা ভারি অস্ত্রশস্ত্র ও কামান নিয়ে আক্রমণ চালায়। সেকেলে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তীব্র যুদ্ধ করেই তিতুমীর ও তার সহচরদের অনেকে শহীদ হন। তার বাহিনীর প্রধান গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেয়া হয়। বাঁশের কেল্লা ধ্বংস করা হয়। কিন্তু এ যুদ্ধ মুক্তির যে চেতনা জাগ্রত করে, সেটা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার পথ রচনায় তাৎপর্যময় ভূমিকা রাখে। তাই তিতুমীর চিরস্মরণীয়, মুক্তি সংগ্রামের অনুপ্রেরণাদাতা।
আনিসুর রহমান, সংস্কৃতি কর্মী।
ডাকটিকিটে তিতুমীর ও তাঁর বাঁশের কেল্লা |
Titumir
__._,_.___