মানব পাচারকারীদের চক্রান্তের জালে অসহায় বেকার,দরীদ্র যুবক।
সারাদেশে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারকারী চক্র এখনো বিশেষভাবে সক্রিয়। গত ইয়াওমুল খামীস বা বৃহস্পতিবার (১২ ফেব্রুয়ারি-২০১৫) সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর হাতে ১৫ জন আটক হয়েছে। রাত সাড়ে ৩টায় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরের ১নং বয়া এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। এসময় উদ্ধারকৃত ব্যক্তিদের বহনকারী একটি ইঞ্জিনচালিত সাম্পান জব্দ করা হয়। তবে সাম্পানের মাঝি-মাল্লারা সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে পালিয়ে যায় বলে পুলিশ জানায়।
উল্লেখ্য, দৈনিক পত্রিকাগুলোতে নিয়মিতই প্রকাশ করা হচ্ছে জীবন বদলে দেয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে মালয়েশিয়া পাচার করার খবর। স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ার পথে সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে শতশত লোক প্রাণ হারাচ্ছে। অনেককেই চরম প্রতিকূল ও বৈরী অবস্থা কাটিয়ে মালয়েশিয়া নামক ভূখ-ে পৌঁছালেও তাদের দুর্বিষহ অনিশ্চিত জীবনযাপন করতে হচ্ছে। সমুদ্র পথে রওয়ানা হয়ে অনেকেই পথিমধ্যে ডুবে মরছে। অনেককে মেরে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হচ্ছে। আবার অনেকে থাইল্যান্ডের গহিন অরণ্যে আটকা পড়ে নির্মম পরিস্থিতি শিকার হচ্ছে। আবার অনেকে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার কারাগারগুলোতে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে।
মানবপাচারকারীদের বিশাল সিন্ডিকেট মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএস) পদ্ধতিতে অসহায়, অসচ্ছল ও বেকার যুবকদের মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সংগ্রহ করে থাকে। এর মাধ্যমে মাঠ পর্যায় থেকে সমুদ্র উপকূলের নির্দিষ্ট পয়েন্ট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে মাথাপিছু ২/৩ হাজার টাকা করে দেয়া হয়। আবার উপকূল থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট বোটে করে গভীর সমুদ্রে বা বহির্নোঙরে বড় বোট বা জাহাজে পৌঁছাতে পারলে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেয়া হয়। মানবপাচারের প্রতিটি ধাপে সহায়তাকারীদের নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেয়া হয়। মানবপাচারকারীদের এ বিরাট নেটওয়ার্কের সাথে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশ ছাড়াও এদেশের শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত; কিন্তু প্রশাসন এখন পর্যন্ত মূল হোতাদের কাউকে আটক করার সংবাদ দিতে পারেনি।
বিভিন্ন পর্যায়ের সুবিধাভোগী দালালদের আটকের পর মানবপাচার আইনে মামলা করা পর্যন্ত এর কার্যক্রম অধিকাংশ ক্ষেত্রে শেষ করা হয়। মালয়েশিয়ায় যেসব প্রবাসী বাঙালি রয়েছে তাদেরকেও মানবপাচারকারীরা মানবপাচারে ব্যবহার করে থাকে। মালয়েশিয়ায় কর্মরত শ্রমিক তার স্ত্রী কিংবা আত্মীয়-স্বজনকে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। প্রথম পর্যায়ে ২০ হাজার টাকা দিয়ে কিংবা কোনো প্রকার টাকা না দিয়েও মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে প্রলোভন দেখানো হয়। দালালদের এই প্রলোভনে পড়ে গ্রামের নিরীহ, বেকার ও অসচ্ছল যুবকরা উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে।
সমুদ্র পথে পাড়ি দেয়ার পথিমধ্যে সমুদ্রের মাঝপথে কিংবা থাইল্যান্ড এলাকায় তাদের পরিবারকে টাকা দেয়ার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে। গ্রামের নিরীহ ওই যুবককে জিম্মিদশা থেকে উদ্ধারে অনেক অসহায় পরিবার সহায়-সম্পদ এমনকি ভিটে-মাটি পর্যন্ত বিক্রি করে পাচারকারী চক্রের হাতে টাকা তুলে দেয়। যেসব পরিবার টাকা দিতে পারে তাদের ছেলেদের মালয়েশিয়া উপকূলে গহীন অরণ্যে ছেড়ে দেয়া হয়। যাদের পরিবার টাকা দিতে পারে না, তাদেরকে বোট বা জাহাজ থেকে ফেলে দেয়া হয় কিংবা নির্যাতন চালানো হয়। অনেককে থাইল্যান্ডের সমুদ্র উপকূলে নামিয়ে দেয়া হয়। তাদের কাছ থেকে দালালরা দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, অনুসন্ধানে জানা গেছে- সাগরপথে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডে অবৈধভাবে মানুষ পাচার করা হচ্ছে গবাদি পশুর চালানের মতো করেই। সীমান্ত এলাকার গরু বেপারীর মতো করে কক্সবাজারের মানবপাচারকারীরাও মানুষের হাতে-কানে-গায়ে মেহেদীর রং লাগিয়ে বিশেষ চিহ্ন দিয়ে পাচার করছে। আবার কার্গো বোটে ঠাসাঠাসি করে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে মিয়ানমার থেকে যেভাবে গবাদি পশু পাচার করা হয় অনুরূপ কক্সবাজার উপকূল থেকেও বোটে গাদাগাদি করে মানুষের চালান পাচার করা হয় থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায়। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের উপকূলের মানবপাচারকারী সিন্ডিকেট সদস্যরা কক্সবাজার থেকে পাচার হওয়া লোকজনের চালান গ্রহণের পর সেই মেহেদী রংয়ের বিশেষ চিহ্নের সাহায্যেই পাচারকারীদের সাথে লেনদেন নির্ধারণ করে থাকে।
এ সিন্ডিকেটের গডফাদারদের অধীনে কাজ করছে অজস্র দালাল। দেশজুড়ে এ দালালের সংখ্যা সহস্রাধিক বলে পুলিশের ধারণায় এসেছে। কিন্তু ধরা পড়েছে একেবারে নগণ্য। পাশাপাশি ধৃতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও দৃশ্যমান নয়। এ কারণে মানবপাচার দুর্দমনীয় অবস্থানে পৌঁছে গেছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে মানবপাচার প্রধান রুট বঙ্গোপসাগর। ছোট বড় ইঞ্জিন বোট ও ট্রলার চালকদের একটি অংশ এ কাজে জড়িত হয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এদেশ থেকে অল্প টাকায় মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রলোভন দেখালেও থাইল্যান্ডে দালালদের আস্তানায় বন্দি করে রেখে এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে দেশে থাকা স্বজনদের কাছ থেকে দুই আড়াই লক্ষাধিক টাকা করে আদায় করে পরবর্তীতে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন উপকূলে পৌঁছে দেয়।
উল্লেখ্য, মানবপাচারে অভিযুক্ত ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান রয়েছে। এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে স্থানীয় প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে গণবিজ্ঞপ্তি দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত আমরা মনে করি যে, শুধু আইনের বল প্রয়োগেই মানবপাচার রোধ করা যাবে না। কারণ মানুষের তৈরি আইনের গোলকধাঁধায় মানুষ সহজেই পার পেয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় হলো- মানুষের সৃষ্টিকর্তা খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি অনুগত হওয়া ও উনার প্রতি অন্তরে ভয় লালন করা এবং এ সম্পর্কিত মূল্যবোধ ও চেতনা জাগ্রত করা।
মূলত, আজকের যুগে ধর্মব্যবসায়ী তথা উলামায়ে 'সূ'দের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব থাকায় বাঞ্ছিতভাবে সম্মানিত ইসলামী চেতনা কারো মাঝে নেই বললেই চলে। বরং উলামায়ে 'সূ'রাও যেভাবে অসততায় আর দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়েছে তা দেখেই মানবপাচারকারীরা আরো সাহসী ও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
__._,_.___