সিনেমা যেখানে নিষিদ্ধ
রবিবার, ৮ মার্চ ২০১৫
কাগজ অনলাইন ডেস্ক: গাড়ির ভেতর থেকে ওয়াকি টকির সাহায্যে কথা বলছেন এক নারী, গাড়ির বাইরে চলছে সিনেমার শুটিং। নির্মাতা তিনিই, কিন্তু গাড়ির বাইরে বের হয়ে পুরুষ কলাকুশলীদের নির্দেশনা দিতে গেলে সমাজ তা মেনে নেবে না। আর এভাবেই আড়াল খুঁজে নিয়ে চলছে স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা।
যেখানে আপাদমস্তক কালো বোরখার নিচে চাপা পড়ে নারীর সব স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষা, যেখানে জন্ম থেকেই নারী বন্দি – সেখানেই জন্মেছিলেন হাইফা আল-মনসুর। কিন্তু তার জন্ম হয়েছিল ইতিহাস সৃষ্টির জন্য।
সৌদি আরবের চলচ্চিত্রের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত এবং নতুন। আর এই ইতিহাস লেখা শুরু হয় হাইফার হাত ধরেই। ধর্মীয় রীতিনীতি এবং কট্টর সমাজব্যবস্থার বিপরীতে গিয়ে এই ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এই নারী।
হাইফার জন্ম ১৯৭৪ সালের ১০ আগস্ট সৌদি আরবের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। বারো ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। তার বাবা ছিলেন একজন কবি। নিজের দেশে কোনো সিনেমাহল না থাকলেও বাবার আগ্রহে ভিডিওর মাধ্যমে প্রথম সিনেমার সঙ্গে পরিচয়।
বাবার অনুপ্রেরণাতেই মিশরের কায়রোতে সাহিত্য বিষয়ে পড়তে যান। কায়রো থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আসার পর হাইফা একটি তেল কোম্পানিতে ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘদিন সেখানে কাজ করার পরও কোনো পদোন্নতি হয়নি তার। ধীরে ধীরে তিনি আবিষ্কার করলেন, নারী হিসেবে তার জীবন অনেকটাই কঠিন তার নিজের দেশে। মানসিক প্রশান্তি খুঁজে ফেরেন সেলুলয়েডে, বুঝতে পারেন একমাত্র সিনেমা নির্মাণই জাগিয়ে তুলতে পারে তার অস্তিত্বকে।
আবার পা রাখলেন দেশের বাইরে, এবার গন্তব্য অস্ট্রেলিয়ার সিডনি। পড়বেন চলচ্চিত্র বিষয়ে।
সিডনি থেকে ফিরলেন দেশে, উদ্দেশ্য সিনেমা নির্মাণ। কিন্তু তখনও সৌদিতে নির্মিত হয়নি কোনো পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা, হাতে গোনা কয়েকজন নির্মাতা তথ্যচিত্র আর স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের গণ্ডি পেরুনেরা সাহস করে উঠতে পারেন না।
সিনেমা শব্দটিই যেখানে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ, সেখানে সিনেমা নির্মাণের সাহস করা কি এতোটাই সহজ? তাও যদি সেই নির্মাতা হন একজন নারী? না, মোটেও সহজ ছিল না স্বপ্নের পথে হাইফার এই যাত্রা।
সৌদি আরবে কোন প্রেক্ষাগৃহ নেই। শত বছরের ইতিহাসে দেশটিতে কখনও নির্মিত হয়নি কোনো পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা। নিজস্ব চলচ্চিত্রশিল্পের কোনো অস্তিত্বই নেই দেশটিতে। এমন এক দেশে বসে সিনেমা নির্মাণ করেছেন হাইফা আল-মনসুর। সৌদি আরবের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য এই সিনেমার পুরো শুটিং হয়েছে তার নিজ দেশেই, কলাকুশলীরাও ছিলেন সৌদি।
হাইফার রিয়ার শুরু হয় শর্টফিল্মের মাধ্যমে। পরপর তিনটি শর্টফিল্ম নির্মাণের পর একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেন তিনি। 'উইমেন উইদাউট শ্যাডোস' নামের এই ডকুমেন্টারিতে উঠে আসে সৌদি নারীদের মনের কথা, যা এর আগে কখনও এভাবে তুলে ধরা হয়নি।
'উইমেন উইদাউট শ্যাডোস' প্রদর্শিত হয় ১৭টি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। ওমানের মাস্কাট চলচ্চিত্র উৎসবে এটিকে সেরা প্রামান্যচিত্রের স্বীকৃতিও দেওয়া হয়। এরপর হাইফা শুরু করেন তার ক্যারিয়ারের এবং তার দেশের প্রথম ফিচার ফিল্মের কাজ।
'ওয়াজেদা' ১০ বছর বয়সী এক সৌদি কিশোরীর কাহিনী। রিয়াদে বেড়ে ওঠা ওয়াজেদার খুব শখ, একটি বাইসাইকেল কিনবে সে। নারী হিসেবে তার সীমাবদ্ধতার কথা জেনেও টাকা জমিয়ে সাইকেল কেনার স্বপ্ন দেখে ছোট্ট মেয়েটি। স্বপ্ন পূরণের এই পথে তাকে পেরুতে হয় নানা চড়াই-উতরাই।
'ওয়াজেদা' সিনেমার শুটিং করতে গিয়ে নানা অভিনব পন্থার আশ্রয় নিতে হয়েছে হাইফাকে। ঘরের বাইরে বের হয়ে শুটিং করতে গিয়েও পর্দার আড়ালেই থাকতে হয়েছে তাকে। আবার পুরুষ কলাকুশলীদের নির্দেশনা দিয়ে সমাজের তোপের মুখে যাতে না পড়তে হয়, তাই গাড়ির ভেতর থেকে সারতে হয়েছে পরিচালনার কাজ।
রক্ষণশীল সৌদি সরকারের অনুমতি নিয়েই সিনেমার কাজ করেছেন হাইফা। নানা ধরনের নিয়ম ও রীতির কথা খেয়াল রাখতে হয়েছে বিশেষভাবে। এরপর যখন বিশ্বব্যাপী মুক্তি পেল 'ওয়াজেদা', তখন এই সৌদি সরকারের কাছ থেকেই মিলেছে প্রশংসা। এমনকি ২০১৩ সালের অস্কারে প্রথম সৌদি সিনেমা হিসেবে সেরা বিদেশি সিনেমা বিভাগে জমা পড়েছিল 'ওয়াজেদা'। হাইফার পথ অনুসরণ করে এখন পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছেন আরও অনেক সৌদি পরিচালক এবং কলাকুশলী।
তবে কোনো নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন কিংবা স্রোতের বিপরীতে চলার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেন না, বলেই জানান হাইফা। তার ভাষ্যে, "আমি এমন কিছু করতে চেয়েছি যা আমাকে খুশি করবে। আমি কখনও চাইনি সৌদি আরবের প্রথম নারী নির্মাতার রেকর্ড গড়তে কিংবা কোন ধরনের নিয়ম ভাঙতে। আমি শুধু নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।"
নারীরা যেখানে গাড়ি চালাতে পারে না, পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারে না, পরিবারের কোনো পুরুষ সঙ্গী ছাড়া ঘর থেকে বের হতে পারে না – এমন এক দেশের শত বছরের রক্ষণশীলতার বেড়াজাল ভেঙ্গেছেন হাইফা। তার এই অবদান সৌদি আরবের ইতিহাসে চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবে।
'ওয়াজেদা'র পর আরও একবার 'গাড়ির ভেতরে' গিয়ে বসার পরিকল্পনায় আছেন হাইফা। চলছে নতুন এক সিনেমা নির্মাণের কাজ। জানিয়েছেন, এবারের সিনেমাটিরও শুটিং হবে সৌদি আরবে।
__._,_.___