ঈদের চিঠি
ড. মুকিদ চৌধুরী
দশ-এগারো বছরের আবদে তিনমাস ধরে ঢাকার একটি বাড়িতে আছে। ঈদের আগের দিন বাড়ির কথা মনে করে খুব অস্থির লাগছে তার। ঠাকুর'দার কাছে চিঠি লেখার জন্যে সুযোগ খুঁজছিল। মালিক, মালিকের বউ এবং বাচ্চাটির পাত্তা নেই; তারা ঈদের বাজার করার জন্য চলে যেতেই আবদে তার মালিকের আলমারি থেকে কালির দোয়াত, মরচে ধরা কলম আর দোমড়ানো মোচড়ানো একটি কাগজ নিয়ে লিখতে বসল। লেখা শুরু করার আগে বেশ কয়েকবার ভীত-চকিত দৃষ্টিতে জানালা, দরজা এবং চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। দরজা বন্ধ। জানালাও বন্ধ, তবে একপাট আধখোলা। তার সতর্ক দৃষ্টি। শ্মশানের নীরবতায় ভয়াল শেয়ালের জ্বলজ্বল দৃষ্টি যেন। হঠাৎ বাড়ির বাইরের সিঁড়ি দিয়ে একটি লোক ওপরে উঠে আসার শব্দ তার কানে ভেসে এল। ছলাৎ করে ওঠে তার ভেতরটা, গায়ে কাঁটা দিল, দেহ-কাঁপন উঠল। তার ভেতরে দুরুদুরু ছিল হঠাৎ এই শব্দটি ধাক্কা দিয়ে দপদপ বেড়ে গেছিল, আবার শব্দটি তলিয়ে যেতে থাকলে দুরুদরু অবস্থায় এল। চোখ চিলের মতো সজাগ। আড়চোখে দেখে নিল এদিক-ওদিক আরেকবার। ছোটো একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সামনে রাখা সোফার টেবিলের ওপর কাগজটা বিছিয়ে হাঁটু গেড়ে ঝুঁকে লিখতে শুরু করল আবদে।
'প্রিয় ঠাকুর'দা, ঈদের সালাম নেবেন। এই আনন্দের দিনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন আপনাকে দীর্ঘায়ু করেন। আপনি ছাড়া আমার তো আর কেউ নেই, আল্লাহ আমার মা-বাবা দু-জনকেই কেড়ে নিয়েছেন, আমার সবকিছুই তো আপনি।'
এ পর্যন্ত লিখে আবদে থেমে গেল। উঠে গিয়ে আধখোলা জানালা দিয়ে বাইরের জগৎটাকে একবার দেখে নিল। গলির সামনে চায়ের দোকান। দোকানের সামনে লোকজনের জট। দোকানের ঝাঁপ খোলা। ভেতরের লোকজনের কথা ভেসে আসছে। আবেদ দেখে দোকানের বাইরে কয়েকজন ফিশফিশ করে কথা বলছে। মানুষের কাছে মানুষই ভীষণজীব। তার ভেতরটা আবারও কেঁপে উঠল, কী হয় কী হয় আতঙ্ক। বাঘ, সিংহ, হায়না থেকেও মানুষ ভয়াল। তবুও সে মনে মনে আওড়াল, তবুও ঠাকুর'দার ওপর থেকে বিশ্বাস হারাতে পারি না। ঠাকুর'দার কথা বড্ড বেশি মনে পড়ছে তার। জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে বুকটা হু হু করে উঠল তার। মানসপটে স্পষ্ট দেখতে পেল, তার ঠাকুর'দাকে।
ঠাকুর'দা এক বাড়িতে নৈশপ্রহরী হিসেবে কাজ করেন। ষাট-বছর বয়সি, ম্লান-দৃষ্টির অধিকারী ঠাকুর'দা হালকা-পাতলা শরীরের একজন শক্তসমর্থ ও সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষ।
পাশের বাড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পেল, ছাদের ওপর একজন বই নিয়ে পাইচারী করছে। আর নীচ থেকে একজন ডাকাডাকি করছে। বইওয়ালা লোকটি নিচে নামছে না, লোকটিকে ওপরেও ডাকছে না। বরং বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে একজন মহিলা বলতে লাগলেন, 'কে রে? ও! তুমি। রাস্তায় কেন? বাড়ি যাও, কী দরকার ঘোরাঘুরি করা।' নীচের লোকটি জোর করেই বলল, 'গেট খুলুন কাকিমা, এককাপ চা খাবো!' কাকিমা বললেন, 'চা খাবে? দাঁড়াও, গেট খুলি।' সে সাইকেলে তালা না লাগিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে ওপরে উঠে গেল। আবদের মন জুড়ে আবারও ঠাকুর'দার স্মৃতি ভেসে উঠল। দিনের বেলা তিনি রান্নাঘরে ঘুমোন অথবা বাবুর্চির সঙ্গে গল্পগুজব করে সময় কাটান। রাতের বেলা একটি চাদর গায়ে জড়িয়ে বাড়ির চারপাশে টহল দিয়ে বেড়ান, আর কাঠের ছোটো লাঠিটি হাতের তালুতে পিটিয়ে মৃদুশব্দ সৃষ্টি করেন, যাতে বাড়ির মালিক বুঝতে পারেন যে, তিনি কাজে ফাঁকি দিচ্ছেন না, আর চোর-ছ্যাঁচোড়েরা কেউ একজন পাহারায় আছে ভেবে বাড়ির কাছে ঘেঁষার সাহস পাবে না। এইসময় তার পোষা জামকালো কুকুরটি তাকে অনুসরণ করে। অতিশয় বিনয়ী এবং আদুরে স্বভাবের এই কুকুরটি কাউকে খারাপ চোখে দেখে না, নিজের মুনিবের মতোই ভদ্র ব্যবহার করে আগন্তুকদের সঙ্গেও। কিন্তু তার এই আপাত ভদ্রতার আড়ালে যে এক বদমাশ লুকিয়ে আছে সেটা আশপাশের লোকজনই শুধু জানে। কারও ভাঁড়ারে ঢুকে খাবার চুরি করা কিংবা কৃষকের বাড়ি থেকে মুরগি চুরি করতে তার জুড়ি নেই। আর এই কারণে তাকে কতবার যে পিটিয়ে আধমরা করা হয় তার কোনও হিসেব নেই। তারপরও তার স্বভাবের কোনও পরিবর্তন হয়নি। এই মুহূর্তে কোনও সন্দেহ নেই যে, ঠাকুর'দা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মসজিদের গুমবুজ দেখছেন। ভারী পায়ে আওয়াজ তুলে কুকুরটির সঙ্গে মজা করছেন, ছোট্ট লাঠিটি তার কোমরে গামছায় ঝুলিয়ে রেখে। হাতে হাত ঘষে, ফাঁকে ফাঁকে বাবুর্চির সঙ্গে দুষ্টুমি করছেন।
'গাঁজা চলবে?' বাবুর্চির উদ্দেশে তার জিজ্ঞাসা। বাবুর্চি হাত বাড়িয়ে গাঁজার চিলিমটি মুখে নিয়ে টেনে চিৎকার করে উঠল। খুশিতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন ঠাকুর'দা, বললেন, 'খাসা জিনিস কিন্তু।' তারা মজা করার জন্যে কুকুরটির নাকেও শুঁকালেন, শ্বাস টেনেই চমকে উঠল সে। অস্থিরভাবে মাথা দোলাতে দোলাতে বাইরে চলে গেল কুকুরটি। কিন্তু তার লোকদেখানো বিনয়ী স্বভাবের কারণে লেজ নাড়াতে শুরু করল, মাথা নিচু করে। চমৎকার আবহাওয়া। পরিষ্কার তাজা বাতাস বইছে চারদিকে। দৃষ্টিগ্রাহ্য অন্ধকারে ছেয়ে আছে পুরো গ্রামটি। বিদ্যুচ্চকের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের বাড়িগুলোর টিনের চাল জ্বলজ্বল করছে অন্ধকারেও; আর গাঁজার চিলিমটি থেকে বেরিয়ে আসা কুণ্ডলি পাকানো ধোঁয়া সহজেই নজর-কাড়ে। গাছগুলো ঢেকে আছে বৃষ্টির কুয়াশায়। আকাশে ঝিলমিল করছে বিদ্যুৎ। সারা আকাশ যেন কিসের আগমনী বার্তা ঘোষণা করছে। পুরো ব্রহ্মাণ্ড মনে হয় স্নন করে নিজেকে পুত-পবিত্র করে নিয়েছে ঈদের খুশিতে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আবদের। দোয়াতে কলম ডুবিয়ে নিয়ে লিখতে শুরু করল আবার।
'মালিক আমাকে খুব গালাগালি ও মারধোর করে। চুলের মুঠি ধরে বারান্দায় বের করে দরজা বন্ধ করে দেয়। ভীষণভাবে মাঝেমধ্যে মারে ঝাড়ু দিয়ে, বিশেষ করে তখন তার বাচ্চাটাকে দোলনায় দোল দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়ি তখন। কয়েকদিন আগে, মালিকের বউ আমাকে ইলিশ মাছ পরিষ্কার করতে বলেছিল, আমি মাছের লেজের দিক থেকে শুরু করেছিলাম বলে সে মাছটি দিয়ে আমাকে মারধোর করে। মালিকও তার বউয়ের তামাশা নীরবে দেখতে দেখতে সহ্য করতে না পেরে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে থাকে। তারপর ন্যাকড়া পুড়িয়ে কাটা জায়গা বেঁধে দেয়। এখন মাথায় সেলাই। পায়ে তাদের মারে গোদাফোলা, চুন-হলুদ দিয়ে বেড়াচ্ছি। হাসি পায় যখন মালিক বাড়িতে না থাকে তখন তার বউ আমাকে তাড়ি আনতে পাঠায় শুঁড়িখানায়। ফিরে এলে প্রায়ই দেখতে পাই, বড়লোকের ঘরের বেটি, বড়লোকের ঘরের বউ অন্য পুরুষের সঙ্গে আমোদে ব্যস্ত। তাড়ি গিলে গিলে একসময় তারা হুঁশনাশা। ওদের কোনও সমাজ নেই। নিয়ম নেই। ওরা সমাজ মানে না।
'প্রিয় ঠাকুর'দা, আল্লাহর দোহাই, আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। নতমস্তকে আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি ঠাকুর'দা, আমাকে নিয়ে যান, না হলে আমি মরে যাব।'
বিড়বিড় করে বাক্যগুলো পড়তে থাকে আবদে। দু'চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। শীর্ণকায় দুই হাত দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে লিখে যাচ্ছে।
'শাক-শুটকি খাওয়া আমি বেশি কষ্ট পাই খাবার নিয়ে, একদিনও পেট ভরে খেতে পারিনি এখানে, ঠাকুর'দা। সকালে সামান্য শুকনো রুটি, দুপুরে রাতে রাঁধা ভিজে ভাত আর রাতে বাসি রুটি। চা কখনও আমার কপালে জোটে না। রাতের বেলা শুতে দেয় করিডোরে। তাদের বাচ্চাটা যখন কেঁদে ওঠে তখন আমার ঘুম হারাম হয়ে যায়। কারণ, বাচ্চাটাকে দোলনা দিয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে অনেক সময় লেগে যায়।'
পড়ন্ত বিকালে নেই নেই করেও অনেক লোক বাড়ির সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করছে, প্রাণবন্ত। আবদে কলম থামিয়ে সেদিকে কান পাতে। দু-একজনের রাজনৈতিক কটুক্তিও শোনা যাচ্ছে। এই গলিরে ধমনিতে রক্ত প্রবাহের রূপ নেয় চায়ের দোকানে। আতঙ্ক জড়িত মুখে আবারও আবদে লিখে যায়।
'আমি আপনার তামাক সাজিয়ে দেব, ঠাকুর'দা। আল্লাহর কাছে আপনার জন্যে প্রার্থনা করব। যদি কোনও ভুল করি আপনার যেভাবে খুশি আমাকে শাস্তি দেবেন ঠাকুর'দা। রোজগারের জন্যে আপনি কোনও চিন্তা করবেন না, দরকার হলে আমি আপনার মালিকের জুতো পরিষ্কার করব, নয়তো-বা রাখালের চাকরি নেব।
'প্রিয় ঠাকুর'দা, আমি আর সহ্য করতে পারছি না, এরা আমাকে মেরে ফেলছে। আপনি আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করুন। নয়তো-বা আমি এখান থেকে একদিন পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব। তাতে কেবল অন্তর জ্বলবে। আপনারও জ্বলবে, আমারও জ্বলবে। অন্তর জ্বলবে, অন্তর।'
তখনই আবদের চোখে ভেসে ওঠে. পদ্মার পাড়-ভাঙা মানুষের হাহাকার। পাড়ের মানুষ সরে গিয়ে ঘর বাঁধে, নদী ছাড়ে না। পদ্মা-পাড়ের মানুষ পদ্মার পাড় ছাড়া থাকতে পারে না, যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। পদ্মা-পাড়েই তাদের ঘর-সংসার, জন্ম, বেড়ে ওঠা, সুখ-দুঃখ, ভাব-ভালোবাসা, মৃত্যু। বর্ষার সময় জলে জলাকার হলেও উঁচু ঢিপিতে বাড়ি-ঘর-বস্তি। এক সময় তাও ভেসে যায়। খাও তো জলই খাও, পেট ব্যথা হয় তো ডাইরিয়াই হোক। অবশ্য কিশোরদের মহা ফুর্তি, কলাগাছের ভেলায় এপাড়-ওপাড় এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরে বেড়ানো যায়। আবেদও যেন এরকমই এক ভেলায় ঘুরছে। একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সে আবার চিঠি লিখতে থাকে।
'প্রিয় ঠাকুর'দা, আমি যখন বড়ো হব তখন আপনার দেখাশোনা করব। স্নান করার সময় তেল মালিশ করে দেব। আপনার যাতে কোনও অসুবিধা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখব। আর আপনি যদি কখনও মারা যান আমি আপনার আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করব, যেভাবে আমি আমার মায়ের জন্যে সবসময় করি।'
আবেদের কলম থেমে যায়। বর্ষা শেষে পদ্মার জল কমে আসে। নদী ছোট হয়। চর জাগে। পলি পড়ে। ফসল লাগানোর ধূম পড়ে। এর ছিঁনানো জমিতে সেও বীজ ছড়ায়। মার-দাঙ্গার মতোও অবস্থা সৃষ্টি হয়। তবে মিলেমিশে থাকার জন্য নিজেরাই আপসে বসে। সীমানার মীমাংসাও হয়। তখন সবাই ভাই ভাই। কেউ-বা চাচা, কেউ-বা কাকা, কেউ-বা খালা, কেউ-বা মাসি। বীজ পড়ার পরেই শাদা জমিনে সবুজের বুঁটি; বুঁটি বুঁটি সবুজ। গরু ঘাস পায়, জলে মাছ খেলে বেড়ায়। ঢাঁকি ঢাঁকি শাক-শবজি, চকচকে রুপোর মতো মাছ পদ্মা পেরিয়ে হাট-গঞ্জ-শহরে যায়। আবদে তখনই লিখতে শুরু করে।
'আমাদের শাক, শবজি, মাছ ঢাকায় আসে। ঢাকা খুব বড়ো শহর। অনেক লোকের বসবাস এখানে। প্রচুর গাড়ি আছে এই শহরে। আর এই শহরের কুকুরগুলো মোটেও হিংস্র নয়। কসাইয়ের দোকানগুলোতেও বিভিন্ন রকমের মাংস কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু দোকানিরা ভুলেও কখনও বলে না কোথায় থেকে তারা এগুলো এনেছে।
'আপনি শুনে আশ্চর্য হবেন যে, এই শহরে একটি চক্র বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, যারা শিশুদের দিয়ে ভিক্ষে করায়। এদের ভিক্ষা করার পদ্ধতিও নানা রকমের। অনেক সময় গণ-সমাবেশে দুই আঙুলের ফাঁকে দুটো পাতা গুঁজে চরম বেসুরো গলায় কোনও এক জনপ্রিয় গানের দু'কলি গেয়ে শোনায়। গান শেষ হলে জনতার কাছে টাকা-পয়সা চায়। কেউ আবার কোনও খাবারের দোকান বা ভিড়ে-ঠাঁসা বাজারের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। ক্রেতা এলে তাদের জামা বা শাড়ি ধরে হালকা টান দেয়। এরপর হাতখানা মুখের কাছে ঠেকিয়ে ইশারায় খেতে চায়। সারাদিন ভিক্ষে করে এরা যে পয়সা রোজগার করে দিনের শেষে পাষণ্ডরা এদের থেকে সব কেড়ে নেয়। মনে করতে পারেন যে, তারা বাবা-মাকে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করার পরিশ্রম থেকে রেহাই দিতেই এভাবে ভিক্ষা করে, কিন্তু বাস্তবটা একেবারেই ভিন্ন।'
হঠাৎ আবদে যেন শুনতে পায়, স্বচ্ছ জলের ঝিরঝির করে বয়ে যাওয়া স্রোতের শব্দ। চমকে ওঠে সে। চোখ বন্ধ করতেই দেখতে পায়, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মহলা-মাচের বড় বড় ঝাক, শাদা বালু থেকে শাদা, চলে ফিরে ঘুরে বেড়ায়। পাতাভরা জলে স্রোত তার হাঁটু ছোঁয়, মায়া-মাছ দৌড়ে পালিয়ে যায়। সে চোখ খুলে আবার লিখতে শুরু করে।
'প্রিয় দাদু, আপনার মালিকের বাড়িতে ঈদ উপলক্ষ্যে যখন বিভিন্ন রকমের খাবার তৈরি হবে, আমার জন্যে কিছু আলাদা করে ট্রাঙ্কে রেখে দেবেন। বাবুর্চিকে আমার কথা বললেই তিনি দেবেন।'
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আবদে। জানালা পথে আবারও তার দৃষ্টি চলে গেল বাইরে। তার মনে পড়ছে কী ভাবে তার ঠাকুর'দা তাকে নিয়ে জঙ্গলে যেতেন গাছের কাঠ সংগ্রহ করার জন্যে। কত আনন্দেরই না ছিল সেসব দিন। জঙ্গলে ঢুকে ঠাকুর'দা জোরে গলা খাঁকারি দেন, আর অমনি হুড়মুড় করে উড়ে যায় গাছের আগডালে বসা পাখিগুলো। সেটা দেখে খুশিতে হেসে উঠত আবদে।
গাছ কাটার আগে ঠাকুর'দা গাঁজা টানেন, অল্প একটু তামাকও সেবন করেন, আর আবদের দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠেন। এমন সময় হঠাৎ একটি লেজকাটা শেয়াল মুক্ত তীরের মতো লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসে গাছের পেছন থেকে। কর্কশ চিৎকার দিয়ে ওঠেন ঠাকুর'দা, 'ধর ধর লেজকাটা শয়তানটা পালিয়ে যাচ্ছে।' যখন গাছটা কেটে নামানো হয় তখন ঠাকুর'দা সেটা টেনে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে তোলেন। তারপর লেগে যান কাঠ কাটার কাজে। আবদের যে সবচেয়ে বেশি পছন্দের, সে হচ্ছে ঠাকুর'দার মালিক-বাড়ির বাবুর্চি। যখন আবদের মা বেঁচে ছিলেন তিনিও কাজ করতেন সেই বাড়িতে। আর বাবুর্চির তাকে আদর করত ভীষণ ভাবে। তাকে লিখতে পড়তে শিখিয়েছে সে-ই। একশো পর্যন্ত গুনতে পারে সে। এমনকি তাকে নাচতে-গাইতে পর্যন্ত শিখিয়েছে। কিন্তু আবদের মা যখন মারা গেলেন, আবদের স্থান হল তার সঙ্গে রান্নাঘরে। আর সেই রান্নাঘর থেকে এখন ঢাকার এই বাড়িতে। আবদে আবার লিখতে শুরু করল।
'আপনি দয়া করে আসুন, ঠাকুর'দা, আল্লাহর দোহাই, আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান। এই অমানুষগুলোর আচরণ আমাকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় আমি অনাথ-অসহায়। 'আমাকে ওরা ঠিকমতো খেতে দেয় না। ক্ষুধার কষ্ট কী সেটা আমি আপনাকে বোঝাতে পারব না। আরেকদিন মালিক আমাকে লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করেছে, যার ফলে আমি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলাম। কুকুরের চেয়েও অধম এখানে আমার জীবন। সকলকে আমার প্রণাম দেবেন। আপনিও নিবেন।
ইতি,
আপনার একমাত্র নাতি।'
চিঠিটা শেষ করে আবদে কাগজটি ভাঁজ করে খামের ভেতর ঢোকাল। কয়েকদিন আগে খামটি সে কিনে এনেছিল বাজার থেকে। সামান্য একটু ভেবে নিয়ে খামের ওপর ঠিকানা লিখল। প্রাপক, ঠাকুর'দা'। তারপর হাতে মাথা আঁকড়ে ধরে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল সে। তারপর যোগ করল নাম ও ঠিকানা। কাজ শেষ করে উল্লাসিত হয়ে উঠল আবদে, কারণ চিঠিটি লেখার সময় কেউ তাকে দেখতে পায়নি। তাড়াতাড়ি খামটি পকেটে নিয়ে দৌড়ে বাইরে চলে এল। কসাইখানার লোকটাকে একদিন জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছিল কোথায় চিঠি ফেলতে হবে, সে বলেছিল, ঐ-যে দেখছ, সেই লাল রঙের ডাক-বাক্সে ফেললেই চিঠি নিখিল বিশ্বে ছড়িয়ে যায়। আবদে দৌড়ে সেই ডাক-বাক্সটির কাছে এল। তারই পাশে একটি বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছাড়বো, ছাড়বো করেও ছাড়ছে না। যাত্রীতে ভরা বাসটি, তবুও যেতে নারাজ। উৎকণ্ঠা নিয়ে যাত্রীদের অপেক্ষা। এদিক-ওদিক বাস, ট্রাক, রিকশা, ভ্যানের জট।
ছোটো ফাঁক দিয়ে চিঠিটা লাল রঙের ডাক-বাক্সের ভেতর ফেলে দিল।
ঘণ্টাখানেক পরে খুশি মনে আবদে ঘুমিয়ে পড়ল এই ভেবে যে, খুব শীঘ্রই তার ঠাকুর'দা তাকে নিতে আসবে, এই নরক থেকে উদ্ধার করতে। ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখল তার ঠাকুর'দা রান্নাঘরের দাওয়ায় বারান্দায় বসে পা নাড়াতে নাড়াতে চিঠিটা পড়ে শোনাচ্ছেন বাবুর্চিকে। আর ঠাকুর'দার পাশে লেজ নাড়াতে নাড়াতে চক্কর দিচ্ছে তার প্রিয় কুকুরটি।
চিঠি পড়া শেষ হলে বাবুর্চি বলল, 'আচ্ছা, বেশ। আবেদকে আনতে আমি এখনই যাচ্ছি।'
__._,_.___