সীমিত সংখ্যায় রোহিঙ্গা নিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র
অব্যাহত রাজনৈতিক নির্যাতনের মুখে শত শত রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমানোর কারণে যে মানবিক দুর্যোগের সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ বাড়ছে। এ প্রেক্ষাপটে মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ ককাসের চেয়ারম্যান কংগ্রেসম্যান জোসেফ ক্রাউলি প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসনের মার্কিন উদ্যোগকে তিনি স্বাগত জানান।
অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর নিজস্ব মুখপাত্রের বরাতে এক লিখিত বক্তব্যে প্রথম আলোকে জানিয়েছে, সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত, এমন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সীমিত সংখ্যায় গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত। তবে এ কাজে নেতৃত্ব দিতে হবে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারকে।
পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে দুর্যোগের মুখে পড়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানের ব্যাপারে মার্কিন কংগ্রেসে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান উভয় দলেরই সমর্থন রয়েছে। চলতি সপ্তাহে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির কাছে লেখা এক চিঠিতে দুই দলের মোট ২৩ জন কংগ্রেস সদস্য সমুদ্রে আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে অতিরিক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সংকটের অন্তর্নিহিত কারণের প্রতি নজর দিতে মার্কিন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
চিঠিতে কংগ্রেস সদস্যরা বলেন, সমুদ্রে বিপদের সম্মুখীন এমন হাজার হাজার (রোহিঙ্গা) উদ্বাস্তুকে খোঁজা ও তাদের মানবিক সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এবং সমমনা দেশগুলোর সুনির্দিষ্ট ও প্রকাশ্য ব্যবস্থা গ্রহণের এখনই সময়।
এই পত্রটির বিবরণ-সংবলিত একটি তথ্য বিবরণী কংগ্রেসম্যান জোসেফ ক্রাউলির কার্যালয় থেকে প্রথম আলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ ককাসের সভাপতি নিউইয়র্কের এই ডেমোক্রেটিক কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাবের জন্য সুপরিচিত। রোহিঙ্গা প্রশ্নে মতামতের জন্য ক্রাউলির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁর গণসংযোগ পরিচালক কোর্টনি গিডনার প্রথম আলোকে জানান, সীমিতসংখ্যক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে মার্কিন সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি তাঁর সমর্থন রয়েছে।
কসোভা কায়দায় আলাদা ভূখণ্ড: বাংলাদেশের কোনো কোনো মহলে ভাবা হচ্ছে দক্ষিণ ইউরোপের কসোভা কায়দায় রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য আলাদা একটি ভূখণ্ড চিহ্নিত করে এ সমস্যার অর্থপূর্ণ সমাধান সম্ভব। এ রকম কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারে তাঁর সমর্থন আছে কি না, জানতে চাওয়া হলে কংগ্রেসম্যান ক্রাউলি সরাসরি কোনো জবাব দেননি। পররাষ্ট্র দপ্তরের কাছে একই প্রশ্ন করা হলে তারা পুরো ব্যাপারটি 'গুঞ্জন' বলে বাতিল করে দেন।
প্রথম আলোকে এক লিখিত বক্তব্যে পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র জানান, গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার উদ্বাস্তুকে পুনর্বাসিত করেছে। শুধু চলতি অর্থবছরেই তারা এক হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে।
রিফিউজি কাউন্সিল: বেশি করে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে জোর সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বাস্তু পরিষদ (রিফিউজি কাউন্সিল, ইউএসএ)। এই পরিষদের পরিচালক নেওমি স্টাইনবার্গ প্রথম আলোকে জানান, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের অধিক সংখ্যায় যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসনের ব্যাপারে তাদের তাগাদা অব্যাহত রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে বিশ্বের অন্যান্য দেশকেও এগিয়ে আসতে হবে। স্টাইনবার্গ অভিযোগ করেন, আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার অনীহ।
যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসনের সুযোগ আছে, তা জানা গেলে আরও বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করবে বলে অনেকেরই আশঙ্কা।
উদ্বাস্তু হাইকমিশনারের বক্তব্য: রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের অনেকে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে রওনা হলেও সে দেশের সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা নৌকাযোগে যাওয়া রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেবে না। মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকেও নেতিবাচক ইঙ্গিত মিলেছে। এদিকে আফ্রিকার ক্ষুদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশ গাম্বিয়া জানিয়েছে, মুসলমানদের প্রতি সংহতিস্বরূপ তারা রোহিঙ্গা 'বোট পিপলদের' আশ্রয় দিতে প্রস্তুত।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের আঞ্চলিক মুখপাত্র ভিভিয়েন ট্যান প্রথম আলোকে বলেন, আফ্রিকায় উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের যে অভিজ্ঞতা, তা থেকে স্পষ্ট যে সেখানে স্থায়ী বসতি স্থাপন, বিশেষত তাদের সমাজে একীকরণ (ইন্ট্রিগ্রেশন) সহজ নয়। নৌকায় করে পালানো উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন সমস্যার আংশিক সমাধান মাত্র।
কসোভোর মতো কোনো ভূখণ্ডে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসিত করা সম্ভব কি না, এমন এক প্রশ্নের জবাবে শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের বাংলাদেশ মুখপাত্র অঞ্চিতা শাদমান প্রথম আলোকে জানান, এমন কোনো পরিকল্পনার ব্যাপারে তাঁরা অবহিত নন। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে অন্যত্র পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে, পত্রিকায় প্রকাশিত এমন খবরের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে মুখপাত্র জানান, এ ব্যাপারে কোনো চূড়ান্ত পরিকল্পনার কথা তাঁরা জানেন না।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যাটি দীর্ঘদিনের পুরোনো হলেও সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন আকারের নৌকায় করে দেশত্যাগের চেষ্টায় দুর্ঘটনায় পড়লে তা সবার নজর কাড়ে। মিয়ানমার সে দেশের প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে আসছে। অব্যাহত নির্যাতন-বঞ্চনার মুখে তিন থেকে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
__._,_.___