দারিদ্র্য কত প্রকট, কর্মসংস্থানের কী দুরবস্থা-ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে ধনবৈষম্য।সমাজের বিরাট এক অংশ এখনো ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে ঘুমাতে যায় ।
অর্থনৈতিক আয় বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করা যায় যে 'গিনি সহগ' (এটি অর্থনৈতিক শাস্ত্রের একটি টুল) দ্বারা, তা যদি বাড়তে বাড়তে শূন্য দশমিক পাঁচ-এর কাছাকাছি পৌঁছায় বা অতিক্রম করে, তবে তা অর্থনীতির জন্য মারাত্মক সংকেত। এখন বাংলাদেশে 'গিনি সহগ' এই সীমান্তরেখা প্রায় ছুঁতে চলেছে। অথচ বাংলাদেশে জন্মলগ্ন্নকালে অর্থাৎ ১৯৭২ সালে তা ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৩২। তার মানে মোট জাতীয় আয় এবং মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেলেও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে ধনবৈষম্য। সমাজে ধনী-গরিবের মধ্যে আয় বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। যার একটি ফ্ল্যাট ছিল তার ১০টি ফ্ল্যাট হচ্ছে। অথচ গরিবরা ক্রমেই গরিব হচ্ছে। আয়কর ফাঁকি, প্রাকৃতিক সম্পদ দখল, ঋণ পরিশোধ না করা ইত্যাদি অবৈধ কাজের মাধ্যমে বিত্তশালীরা সম্পদের পাহাড় গড়ছে। দারিদ্র্য নিয়ে ভাবতে হলে বৈষম্য কমার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
মাথাপিছু আয়ের মধ্যে অনেক ফাঁক থাকে। দেশের মোট জাতীয় আয় এবং সে সঙ্গে মাথাপিছু আয় বাড়লেই সব মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ে না। দেশে একজন কোটিপতি তৈরি হলে, তার জন্য এক হাজার মানুষকে গরিব হতে হয়। অর্থনীতির এটাই নিয়ম। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সাগরে ভাসমান অভিবাসন-প্রত্যাশী মানুষের আহাজারি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে দারিদ্র্য কত প্রকট, কর্মসংস্থানের কী দুরবস্থা- মানুষ কতটা বেপরোয়া হলে এ রকম ঝুঁকি নেয়। দেশজ উৎপাদন এবং জাতীয় আয়ের হিসাবে নানা রকম ফাঁকফোকর আছে। যে আয় দেখানো হয়, তা ভাগ করে দিলেই সবার পকেটে তা পৌঁছায় না। জাতীয় আয়ের হিসাবটা হয় অন্যভাবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্বাস্থ্য দিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের অবস্থা বোঝা যায় না। একদিকে দেশজ উৎপাদন বাড়ছে, অন্যদিকে বাড়ছে বৈষম্য। শহরে বড় বড় শপিংমল গড়ে উঠেছে। আবার জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি নেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ানো লোকের সংখ্যাও বাড়ছে। তাই বাংলাদেশের নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে উল্লম্ফনের খবর শুনে আহ্লাদিত হওয়ার অবকাশ নেই।
জানা গেছে, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের ৪০ শতাংশের বেশি এখন কোটিপতিদের দখলে। ৫০ ভাগ লাখপতি আর ১০ ভাগ আমানত রয়েছে লাখ টাকার নিচের অ্যাকাউন্টগুলোয়। অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের কাছে ৪০ শতাংশের বেশি সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ায় দেশে আয় বৈষম্য বেড়েছে। এতে ধনী- গরিবের বৈষম্যও বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৯ সালের মার্চে দেশে ব্যক্তিপর্যায়ে কোটিপতি অ্যাকাউন্ট ছিল ১২ হাজার ৯১৭টি। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৬৮৭টিতে। সে হিসাবে গেল ৬ বছরে দেশে ব্যক্তিপর্যায়েই কোটিপতি অ্যাকাউন্ট বেড়েছে প্রায় ২৭ হাজার ৭৭০টি। প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ২১৫ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০০৯ সালের মার্চে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক মিলে ব্যাংকে কোটি টাকার ঊর্ধ্বে অ্যাকাউন্ট ছিল ১৯ হাজার ৬৩৬টি। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৭২৭টি। সে হিসাবে ৬ বছরে দেশে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় মিলে কোটিপতি অ্যাকাউন্ট বেড়েছে প্রায় ৩৫ হাজার। প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১৭৮ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি অ্যাকাউন্টধারী ছিলো মাত্র পাঁচজন। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর শেষে এ সংখ্যা ৪৭-এ পৌঁছে, যা ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৯৮ জন। তখন তাদের আমানতের পরিমাণ ছিল সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ১০ শতাংশ। এরপর ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪৩-এ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালের জুনে কোটিপতির মোট সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৯৪ এবং ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে কোটিপতির মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ১৬২। এরপর অক্টোবর ২০০১ থেকে ডিসেম্বর ২০০৬ পর্যন্ত কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছিল ৮ হাজার ৮৮৭ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২ বছরে বেড়েছিল ৫ হাজার ১১৪।
বাহাত্তরে সাহস আর উচ্চাশা নিয়েই যাত্রা হয়েছিল স্বাধীনতা-উত্তর উন্নয়ন পরিকল্পনার। তবে উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে সাম্প্রতিক দশকগুলোয় সামাজিক অসমতা ও বৈষম্য যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে পাকিস্তান আমলের অর্থনীতিরই যেন পুনরুজ্জীবন ঘটছে। সমাজের বিরাট এক অংশ এখনো ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে ঘুমাতে যায়। মানসম্মত শিক্ষা, চিকিৎসা ও পরিবেশসম্মত আবাসনসুবিধা এখনো সাধারণের আয়ত্তেরই বাইরে। সমাজের ৭৫ শতাংশ মানুষের জীবনে অসচ্ছলতা ও অস্বাচ্ছন্দ্যের অন্ত নেই। জীবনমুখী ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উন্নয়নতত্ত্ব দেখার প্রয়োজন অনেকটাই হারিয়ে গেছে অর্থনীতির পারভারশনে।
মূলত, দেশের উন্নয়নতত্ত্বের প্রধান ত্রুটি হচ্ছে, এখানে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জাতীয় আয় বৃদ্ধির উপর, বণ্টনব্যবস্থা নিয়ে ভাবা হয়নি মোটেও। ফলে জাতীয় আয় বাড়ার প্রধান সুবিধাভোগী সীমিত কিছু মানুষ, আর বিরাট অংশের সম্ভাবনা ক্রমেই মিইয়ে যাচ্ছে।
আমাদের উন্নয়ন সাফল্যে দারিদ্র্যের হার কমার কথা বলা হলেও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বেড়েই চলেছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সমাজের একটি অংশ বড় অঙ্কের কালো টাকার মালিক বনে যাচ্ছে। কিছু লোক হঠাৎ করে কোটিপতি হয়ে যাওয়ায় সমাজে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, যা এসময়কার অস্থিতিশীলতার অন্যতম কারণ। বিষয়টির দিকে নজর দেয়ার সময় এসেছে এখন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ওয়েলফেয়ার মনিটরিং সার্ভে অনুযায়ী, মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশের হাতেই সম্পদের সবচেয়ে বড় অংশ। মধ্যবিত্ত শ্রেণী মোট জনসংখ্যার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। এর বাইরে ৭৫ শতাংশ মানুষই উন্নয়নের বড় ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কোনোভাবে আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলিয়ে দিন পার করছে ৫ কোটি ৪৫ লাখ ৬০ হাজার মানুষ। আর দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী এমন মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিতের সংখ্যা দেড় কোটি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ খাদ্যচাহিদা মেটাতে হয়ে পড়ছে ঋণগ্রস্ত। সমাজের এ অংশটি ক্রমেই ঋণভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে।
অথচ বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন ছিল এদেশের গণমানুষের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এক গভীর মানবিক সংগ্রামী দর্শন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনদর্শনের ভিত্তি-শক্তি ছিল গণমানুষ।
বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনটি তারই উদ্ভাবিত ও ধারণকৃত 'দেশের মাটি উত্থিত অথবা স্বদেশজাত উন্নয়ন দর্শন' যে দর্শন অনুযায়ী প্রকৃত উন্নয়ন হলো, এমন এক প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ায় নির্মিত হবে সুস্থ-সবল-চেতনাসমৃদ্ধ-ভেদ-বৈষম্যহীন-আলোকিত মানুষের সংঘবদ্ধ-সংহতিপূর্ণ সমাজ ও অর্থনীতি ব্যবস্থা।
অর্থনীতির প্রধান মানদ-গুলোর নিরিখে 'বঙ্গবন্ধুসহ' আজকের বাংলাদেশের অর্থনীতি আজকের মালয়েশিয়ার অর্থনীতিকে অনেকগুণ ছাড়িয়ে যেত এবং সেইসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনের বৈশিষ্ট্যের কারণেই আর্থ-সামাজিক শ্রেণী কাঠামোর আমূল পরিবর্তন ঘটে শ্রেণী-বৈষম্য হ্রাস পেয়ে সমাজ সমতাভিমুখী হতো যা মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় এবং একইসঙ্গে 'বঙ্গবন্ধুহীন' আজকের বাংলাদেশে যা চরম বৈষম্যমূলক। যে লড়াই-সংগ্রাম-মুক্তিযুদ্ধ করা হলো আবারও সেই বৈষম্যপূর্ণ দুই অর্থনীতির ফাঁদে পড়েছে আজকের বাংলাদেশ।
'বঙ্গবন্ধুসহ' আজকের বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) হতো ৪২ হাজার ১৫৮ কোটি ডলার যা একই সময়ের মালয়েশিয়ায় ১৫ হাজার ৪২৬ কোটি ডলার অর্থাৎ মালয়েশিয়ার তুলনায় ২.৭৩ গুণ বেশি এবং একই সময়ের 'বঙ্গবন্ধুহীন' আজকের বাংলাদেশের তুলনায় ৪.৭৬ গুণ বেশি। 'বঙ্গবন্ধুসহ' আজকের বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপি মালয়েশিয়াকে অতিক্রম করত আমাদের মাথাপিছু জিডিপি হতো ৬ হাজার ৬১ ডলার যা মালয়েশিয়ায় ৫ হাজার ৩৪৫ ডলার। মোট জাতীয় আয়ের (জিএনআই) ক্ষেত্রেও 'বঙ্গবন্ধুসহ' আজকের বাংলাদেশ মালয়েশিয়াকে ২.৮গুণ অতিক্রম করতো। 'বঙ্গবন্ধুসহ' বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয় হতো ৪২ হাজার ৫১৪ কোটি ডলার বিপরীতে এখন মালয়েশিয়ার মোট জাতীয় আয় ১৫ হাজার ৫ কোটি ডলার। এক্ষেত্রে 'বঙ্গবন্ধুসহ' বাংলাদেশে মাথাপিছু জাতীয় আয় হতো ৫ হাজার ৫৯৮ ডলার যা মালয়েশিয়ায় একই সময়ে ৫ হাজার ১৯৯ ডলার।
উল্লেখ্য, প্রকৃত অর্থে তুলনীয় পিপিপি ডলারে মাথাপিছু প্রকৃত জাতীয় আয়কে অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিমাপনের অপেক্ষাকৃত শ্রেয় মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করা হয়। 'বঙ্গবন্ধুসহ' বাংলাদেশে মাথাপিছু প্রকৃত জাতীয় আয় (পিপিপি ডলারে) এখন হতো ১৪ হাজার ১০০ ডলার যা মালয়েশিয়ায় ১৩ হাজার ৮২২ ডলার, আর 'বঙ্গবন্ধুহীন' আজকের বাংলাদেশে মাথাপিছু প্রকৃত জাতীয় আয় মাত্র ১ হাজার ৮৯০ ডলার (অর্থাৎ 'বঙ্গবন্ধুসহ' বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় ৭.৫গুণ কম)। অর্থনীতির মূল চলকগুলোর নিরিখে 'বঙ্গবন্ধুসহ' আজকের বাংলাদেশ আজকের মালয়েশিয়াকে শুধু অতিক্রমই করতো না; বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনের সমতাভিমুখী বৈশিষ্ট্যের কারণে তা হতো প্রকৃত বৈষম্য হ্রাসকারী মাথাপিছু উৎপাদন অথবা বৈষম্য হ্রাসকারী মাথাপিছু প্রকৃত আয়।
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক উদ্ভাবিত ও ধারণ-লালনকৃত দেশের মাটি উত্থিত উন্নয়ন দর্শনের ভিত্তিতেই তিনি চেয়েছিলেন এমন এক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে- যে বাংলাদেশে জন্মসূত্রে কেউ দরিদ্র থাকবে না, যে বাংলাদেশে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি হবে চিরস্থায়ী, যে বাংলাদেশ হবে চিরতরে ক্ষুধামুক্ত-শোষণমুক্ত, যে বাংলাদেশ হবে বঞ্চনামুক্ত-সমতাভিত্তিক-ইসলামিক বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশে মানবমুক্তি নিশ্চিত হবে, হবে তা সুসংহত ও সুদৃঢ়; যে বাংলাদেশে দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতা দূর করে নিশ্চিত হবে সব মানুষের সুযোগের সমতা, যে বাংলাদেশ পরনির্ভরশীল হবে না, হবে স্বনির্ভর-স্বয়ংসম্পূর্ণ; এক কথায় যে বাংলাদেশ হবে 'সোনার বাংলা'।
মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, "মহান আল্লাহ পাক তিনি ওই জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না; যে জাতি তার নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করে না।"
__._,_.___