প্রভাষ আমিন : উগ্রপন্থী জঙ্গিদের হাতে একটা তালিকা আছে। পত্র-পত্রিকায় পড়েছি সেই তালিকায় ৮৪ জনের নাম আছে। তাদের কাছে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা আছে, তাতে নাম আছে ১৬ জনের। জঙ্গিরা সেই তালিকা ধরে-ধরে একই স্টাইলে একের পর এক খুন করে যাচ্ছে। সরকার নির্বিকার। আমরা ফেসবুকে, ভার্চুয়াল জগতে প্রতিবাদের ঝড় তুলছি, শাহবাগে মিছিল-সমাবেশ করছি; কিন্তু নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছি না। এখন যেটা মনে হচ্ছে, তালিকায় যে ৮৪ জনের নাম আছে, তারা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের কাছ খেকে বিদায় নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। বাসার সামনে নয়, বইমেলার সামনে নয়, রাস্তায় নয়; এখন বাসার ড্রইংরুমেও আপনি নিরাপদ নন। হয় এই ৮৪ জনকে গ্রেফতার করে কারাগারে রাখা হোক, না হলে তাদের বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। এই যেমন নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করতে গিয়েছিলেন নিলয়। পুলিশ তাকে বিদেশে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। সেই পুলিশকে আমি দোষ দেই না। তিনি নিলয়কে শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবেই পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই পরামর্শেই ফুটে উঠেছে পুলিশের অসহায়ত্ব। পুলিশ জানে, তারা পারবে না, তাই তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন পালিয়ে যাওয়ার। সেই পুলিশের পরামর্শ শুনলে নিলয় জানে বেঁচে যেতে পারতো।
আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে খুব সক্রিয়। লেখালেখি করি বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, অনলাইনে। প্রচুর লিখি, নিশ্চয়ই তাতে অনেক লোক বিরক্ত হয়। কিন্তু ব্লগ সম্পর্কে আমার ধারণা হেফাজতের সেই কর্মীর মতো, যে বলেছিল- ইন্টারনেট দিয়া ব্লগ চালায়। রাজীব থেকে শুরু করে নিলয়- কাউকেই মৃত্যুর আগে আমি চিনতাম না। গ্লানিবোধ হয়, নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়, এত বড় জগতের কাউকেই চিনি না, এটা কেমন কথা। নিজেকে আমি সত্যিকারের মুক্তমনা লেখক মনে করি। তাই না চিনলেও ব্লগে যারা লেখালেখি করেন, তাদের অনুভূতির প্রতি, তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি আমার অনকে শ্রদ্ধা। মৃত্যুর আগে না চিনলেও মৃত্যুর পর তাদের বিভিন্ন লেখালেখি দেখেছি। তাদের অনেক লেখার সঙ্গেই আমি একমত নই। বিশেষ করে ধর্ম নিয়ে তাদের অনেকের অবস্থানের সঙ্গে আমার প্রবল দ্বিমত। বাংলাদেশে একটা প্রচলিত ফ্যাশন আছে, ইসলাম বিরোধিতাই এখানে মুক্তমনা, প্রগতিশীলতার সাইনবোর্ড যেন। কিন্তু ইসলাম বিরোধিতাকে আমি প্রগতিশীলতা মনে করি না। কিন্তু আমি সবসময় মতপ্রকাশের সর্বোচ্চ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। ব্লগারদের অনেক মতের সঙ্গে আমার ভিন্নমত থাকলেও তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত। মতপ্রকাশের অপরাধে মৌলবাদীরা রীতিমত তালিকা করে-করে মানুষকে খুন করে ফেলবে, এ কেমন কথা। বারবার একই স্টাইলে তালিকাভুক্ত মানুষদের খুন করে, খুনের পর দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়ে মৌলবাদীরা সরকারকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু সরকারের নির্লিপ্ততা দেখে মনে হচ্ছে, তারা সেই যুদ্ধে আগেই হেরে বসে আছে। তাহলে কি এখন তালিকার বাকি ব্লগাররা মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়ে বাসায় বসে অপেক্ষা করবে?
কাল যখন টেলিভিশনে ব্লগার নিলয় হত্যার খবর দেখাচ্ছিল, আতঙ্কিত প্রসূন এসে আমাকে বললো, বাবা তুমি ফুল-পাখি নিয়ে লেখো, কিন্তু কারও বিরুদ্ধে আর লেইখো না। প্রত্যেকবার ব্লগার খুন হলে প্রসূনের মধ্যে এই আতঙ্ক তৈরি হয়, বাবাকে বাঁচাতে কান্নাকাটি করে। আমি হেসে উড়িয়ে দেই বটে, কিন্তু লেখালেখির অপরাধে বাসায় ঢুকে খুন করে গেলে আতঙ্ক আমাকেও গ্রাস করে। আমি ভাবি, আমার লেখায়ও তো কেউ না কেউ ক্ষুব্ধ হন। মতে না মিললে কমেন্টে, ইনবক্সে অনেকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এতদিন পাত্তা দেইনি। এখন দেখছি মতপ্রকাশই এই দেশে সবচেয়ে বড় অপরাধ। হয় চুপ থাকতে হবে, নয় পালিয়ে যেতে হবে।
আমার সবচেয়ে খারাপ লাগে, যখন দেখি ব্লগারদের খুন করার জন্য খুনিরা ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। নিলয়কে খুন করার সময়ও 'নারায়ে তাকবির, আল্লাহ আকবর' বলেই চাপাতি চালানো হয়েছে। কিন্তু ইসলামের কোথায় ভিন্নমতের মানুষকে খুন করার কথা বলা বা লেখা আছে? এই খুনিরা, এই উগ্রপন্থীরা বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ইসলামকে সন্ত্রাসীদের ধর্ম বানিয়ে ফেলছে। এই প্রবণতা শুরু হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর। তারপর আল কায়েদা, তালেবান, সাম্প্রতিক আইএস'এর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে আসলে বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই যুদ্ধ জয়ের কৌশল হিসেবে বিশ্বের মোড়লরা ইসলামকে ভুলভাবে সন্ত্রাসের সমার্থক করে ফেলেছে। আপনার নামে আহমেদ, মোহাম্মদ থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনও বিমানবন্দরে আপনাকে নিরাপত্তা চৌকি পেরুতে হবে।
বৈশ্বিক এই প্রবণতা থেকে মুক্ত নয় বাংলাদেশও। গণজাগরণ মঞ্চ দিনের পর দিন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করলেও তাদের কাউন্টার হিসেবে যাদের মাঠে নামানো হলো, সেই হেফাজতে ইসলাম মাঠে নেমেই আগুন জ্বালিয়ে দিলো। ইসলামকে হেফাজত করতে নামলো তারা সহিংস কায়দায়। এখন যে তালিকা ধরে ধরে ব্লগারদের খুন করা হচ্ছে, সেও ইসলামের নামেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ব্লগাররা নয়, এই খুনিরাই ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু, ইসলামের ভাবমূর্তি তারাই ধ্বংস করছে। ইসলাম ধর্ম নিশ্চয়ই এত ঠুনকো নয় যে কোথায় কোন বাংলাদেশে, কোন ব্লগার, ব্লগে কী লিখলো তাতেই ইসলাম হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। আর এই উগ্রপন্থীদের কে দায়িত্ব দিয়েছে ইসলাম রক্ষার? ব্লগারদের লেখার জবাব আপনি পারলে লেখা দিয়ে দেন। কলমের জবাবে চাপাতি কেন?
ব্লগারসহ, সকল মানুষের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। সেই দায়িত্ব পালনে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তাহলে সেটা সরকার ঘোষণা দিয়ে দিক, যে তারা পারবে না। আমরা হয়, পালিয়ে যাবো, নয় খুন হবো। কিন্তু আমার খুব অবাক লাগে, ব্লগার হত্যার ব্যাপারে সরকার এমন নির্লিপ্ত, নির্বিকার কেন? কেন এখন পর্যন্ত কোনও ব্লগার হত্যার সুরাহা হলো না? ব্লগারদের যারা খুন করছে, তারা তো ভিনগ্রহ থেকে আসা নয়। এই দেশে, এই সমাজেই বাস করে এই ভয়ঙ্কর জঙ্গিরা। ক্রসফায়ারের ব্যাপারে কলঙ্ক থাকলেও এলিট ফোর্স র্যাবের তো অনেক সাফল্যও আছে। তারা দাবি করে জঙ্গিবাদের নেটওয়ার্ক তারা ভেঙ্গে দিয়েছে। তাহলে কারা এই তালিকা করছে, কারা এই খুন করছে? ক্লুলেস অনেক খুনের রহস্য উদঘাটন করে ফেলে র্যাব। আর দিনে-দুপুরে পাঁচতলা বাসায় ঢুকে খুন করে চলে যায় খুনিরা, যাওয়ার সময় চাপাতি ধুয়ে যায়, কাপড় বদলে যায়, গিয়ে আবার দায় স্বীকার করে বিবৃতি পাঠায় আর সরকার বসে বসে আঙ্গুল চুষে। এটা হতে পারে না।
আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই। জীবনের নিরাপত্তা চাই।
লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।
http://khabor.com/archives/63636
Also read:
- সব কলম নিভিয়ে দাও, খুনিদের উল্লাস চলুকAugust 8, 2015
http://khabor.com/archives/63639
- See more at: http://www.manobkantha.com/2015/08/08/56492.php#sthash.GE7blDMZ.dpuf
http://www.manobkantha.com/2015/08/08/56492.php
__._,_.___