Banner Advertiser

Wednesday, October 21, 2015

[mukto-mona] ইতিহাসের পাঠ: বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের অবিসংবাদিতা



মুহাম্মদ শামসুল হক

ইতিহাসের পাঠ: বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের অবিসংবাদিতা

এপ্রিল ২০, ২০১৪

Shamsul Haqueপ্রথম পর্ব

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা নিয়ে বহু বই-পুস্তক-সাময়িকী ইতোমধ্যে বেরিয়েছে, যেগুলো পড়লে এদেশের জনগণের পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির প্রতি কীভাবে মোহমুক্তি ঘটেছে, তেইশ বছরের শাসনামলে কী অকথ্য নির্যাতন, অবর্ণনীয় শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন চলেছে এদেশের মুক্তিকামী নেতা-কর্মীদের ওপর, সে ব্যাপারে সম্যক ধারণা অর্জন করা যায়।

তাই সেদিকে বিস্তারিত না গিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের অবিসংবাদিতা, স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনৈতিক ও সশস্ত্র প্রস্তুতি এবং ঘোষক প্রসঙ্গে আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।

বাংলাদশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও শেখ মুজিব প্রসঙ্গটি ইতিহাসে অনন্য ও ব্যতিক্রম এ জন্য যে, পাকিস্তান নামক একটি ধর্মীয় জাতিসত্তাবিশিষ্ট রাষ্ট্রের আওতায় শাসিত হবার প্রাথমিক অবস্থাতেই তিনি বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় দিন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করেন। পাকিস্তানি কাঠামোর ভেতরে থেকে যতই দিন যায় ততই জাতির বিভিন্ন স্তরেও এ উপলব্ধিবোধ ছড়িয়ে পড়ে। সবার উপলব্ধিবোধ নিজের চেতনায় মিশিয়ে স্বাধীনতার সোপান রচনা করেন শেখ মুজিব একাত্তরে। যা সমসাময়িক অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ নেতার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা চাওয়া নিয়ে কিংবা তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে নানা রকম ভিত্তিহীন মন্তব্য করেন। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি লাগামহীন মন্তব্যসহ যুক্ত হয়েছেন লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির নেতা (প্রশাসনের খাতায় পলাতক) তারেক রহমান, যার বাবা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে 'জাতির পিতা' সম্বোধন করতেন এবং ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে মুক্তিসংগ্রামের 'গ্রিন সিগন্যাল' বলে মনে করতেন।

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে 'জাতির পিতা' সম্বোধন করতেন এবং ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে মুক্তিসংগ্রামের 'গ্রিন সিগন্যাল' বলে মনে করতেন

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে 'জাতির পিতা' সম্বোধন করতেন এবং ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে মুক্তিসংগ্রামের 'গ্রিন সিগন্যাল' বলে মনে করতেন

ছেলের কথায় সুর মিলিয়েছেন তার মা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও সশস্ত্র উভয় প্রক্রিয়াতেই এগিয়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণকে অধিকার সচেতন এবং স্বাধীনতার জন্য উজ্জীবীত করা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত মুক্তি এসেছে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে।

পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতার প্রয়োজনের কথা অনেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভেবেছেন; আকারে-ইঙ্গিতে বিভিন্ন সময় বলেছেনও। কিন্তু এই লক্ষ্য সামনে রেখে শেখ মুজিব যেভাবে জেল-জুলুম সহ্য করেছেন এবং নানামুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে ধাপে ধাপে বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে গেছেন তা আর কারও সাহসে কুলোয়নি।

সে রকম দূরদর্শিতাও আর কারও মধ্যে দেখা যায়নি। পূর্ব বাংলায় ব্রিটিশ আমলে মাস্টারদা সূর্যসেন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুসহ অনেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করলেও তা অসময়োচিত, অপরিকল্পিত হওয়ায় এবং এতে সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারায়, ওইসব সংগ্রাম চূড়ান্তভাবে সফল হয়নি।

পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা-বিবৃতি, রাজনৈতিক কর্মসূচি, অসহযোগ আন্দোলন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে তাঁর লক্ষ্য এবং তা অর্জনে তাঁর যে ব্যতিক্রমী ভূমিকা তার সঙ্গে অন্য কারও তুলনা করা যায় না।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলের প্রদেশটির নাম ছিল পূর্ব বাংলা। এ নাম পরিবর্তন করে 'পূর্ব পাকিস্তান' করার উদ্যোগ নেয় পাকিস্তান সরকার। কিন্তু সে প্রস্তাব শেখ মুজিব মেনে নিতে পারেননি। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার 'পূর্ব পাকিস্তান' নামকরণ করতে চাইলে, তৎকালীন গণপরিষদে দেওয়া বক্তৃতায় শেখ মুজিব এর বিরোধিতা করেন।

বাঙালিদের ওপর জুলুম ও শোষণের ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ জানিয়ে তিনি প্রয়োজনে 'অনিয়মতান্ত্রিক' পথে এগোনোর ইঙ্গিত দেন তখনই। তিনি বলেন–


…মাননীয় স্পীকার, আপনি দেখতেই পাচ্ছেন যে, ওরা 'পূর্ব বাংলা' নামটা পাল্টিয়ে 'পূর্ব পাকিস্তান' করতে চাচ্ছে। অথচ আমরা বার বার এই দাবি করছি যে, এখন এর নাম শুধু 'বেঙ্গল' (বাংলা) করা হোক। 'বেঙ্গল' (বাংলা) শব্দের একটা ইতিহাস রয়েছে, এর নিজস্ব ঐতিহ্য বিদ্যমান। আপনারা নাম বদলাতে চান, তাহলে আমাদের বাংলায় ফিরে যেয়ে জনগণকে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা এ ধরনের পরিবর্তন মেনে নেবে কিনা।

['পাকিস্তানের চব্বিশ বছর: ভাসানী-মুজিবের রাজনীতি: প্রথম খণ্ড', এম আর আখতার মুকুল, পৃষ্ঠা-১৫৬]

শাসকগোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন–

জুলুম মত্ করো ভাই (অত্যাচার কর না ভাই), যদি এ সবকিছু আপনারা আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চান, তাহলে আমাদের বাধ্য হয়েই সংবিধানবিরোধী পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। সংবিধানের বিধি মোতাবেক আপনাদের এগোতে হবে। আপনারা যদি জনসাধারণকে শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেন, তাহলে তারা অনিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি গ্রহণে বাধ্য হবে। এটাই বিশ্বের সর্বত্র ঘটে থাকে এবং তা বিশ্বের ইতিহাস থেকে অনুধাবন করা সম্ভব।

[প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-১৫৭-১৫৮]

আগরতলা মামলার ৩০ নম্বর আসামি মুহাম্মদ মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী (১৯৫৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নন কমিশন রিক্রুট) জানিয়েছেন, শেখ মুজিব তাদের কাছে ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে দেশকে (বাংলাদেশ) আলাদা করার পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন।

২০০৭ সালের ১৫ মার্চ ঢাকার শ্যামলীর ২ নম্বর সড়কের বাড়িতে (বাড়ি নং ১৩/১১ গ) এ লেখককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন–


১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার মাত্র চার মাস পর জুলাই মাসেই চাকরি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়, যাতে দেখা যায়, নোটিশ প্রাপ্তদের ৮০ ভাগই বাঙালি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বাঙালিদের মধ্য থেকে নিয়োগের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এটা পাকিস্তানি আমলাদের পছন্দ না হওয়ায় তারা এমনভাবে নিয়োগ প্রত্যাহার করেন যাতে বাঙালিরা চাকরি থেকে বাদ পড়েন।

এ ব্যাপারে প্রতিবাদ জানানোর জন্য সঙ্গীদের নিয়ে আমি পূর্ব পাকিস্তানের এমপিদের হোস্টেল সামাকো হাউসে যাই। সেখানে বাঙালি এমপি যাদের পেয়েছি তাদের হাতে আমাদের অভিযোগের বিবরণসহ একটি করে কপি তুলে দিই। সেখানে পেলাম শেখ সাহেবকেও। আমাদের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রথম মন্তব্য ছিল, 'এদের সঙ্গে আর থাকা চলবে না। ঢাকায় গিয়ে আলাদা হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে নেব।'

'এদের সঙ্গে আর থাকা চলবে না, ঢাকায় গিয়ে আলাদা হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে নেব'

'এদের সঙ্গে আর থাকা চলবে না, ঢাকায় গিয়ে আলাদা হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে নেব'

যতদূর মনে পড়ে সেদিন এমপি হোস্টেলে অনেকের মধ্যে ফরিদ আহমদ, কুমিল্লার রমিজ উদ্দিন আহমদ, ময়মনসিংহের সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন হোসেন, ইউসুফ আলী প্রমুখ ছিলেন। কিন্তু আমাদের কথায় তারা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি।

কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার (রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য) আসামিদের মধ্যে ১২ জন এবং সংশ্লিষ্ট অন্য কয়েকজন সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তির কাছ থেকে আমি বিভিন্ন সময় সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তাদের কথায় নিশ্চিত হওয়া গেছে, ষাটের দশকের গোড়ার দিকে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত নৌবাহিনীর বিক্ষুব্ধ বাঙালি সৈনিকদের নেতা লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরোক্ষ যোগাযোগ শুরু হয়।

'৬২ সালের শেষের দিকে করাচিতে নৌবাহিনীর কামাল উদ্দিনের টিচার্স হাউজিং সোসাইটির বাসায় এক গোপন বৈঠকে নৌবাহিনীর সদস্যেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যা এবং স্বাধীনতার ব্যাপারে তাদের মনোভাবের কথা শেখ মুজিবকে খুলে বলেন এবং তাঁর নেতৃত্ব ও পরামর্শসহ সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা চান।

ওই বৈঠকে বিক্ষুব্ধ সৈনিকদের পক্ষে তাদের গ্রুপ নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন, মোজাম্মেল হোসেন, সুলতান উদ্দিন, স্টুয়ার্ড মুজিব, নূর মোহাম্মদ বাবুল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। শেখ মুজিব তাদের মনোভাব জেনে নিজেরও একই মনোভাব ও পরিকল্পনার কথা জানান। তিনি বলেন–

স্বাধীনতার জন্য আমি আমার শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দিতে রাজি আছি। আপনাদের যখন যে রকম সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন তা আমি দেব।

এছাড়া স্বাধীনতার আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয় করার ব্যাপারে ছাত্রদের দায়িত্ব দেওয়া হবে বলে তিনি তাদের আশ্বস্ত করেন। একই সঙ্গে তিনি দেশপ্রেমিক সৈনিকদের সুসংগঠিত হওয়ার পরামর্শ দেন।

এর আগে অর্থাৎ কমান্ডার মোয়াজ্জেমের পরোক্ষ প্রস্তাব পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তৎকালীন সিএসপি অফিসার রুহুল কুদ্দুসসহ কয়েকজন অতিবিশ্বস্ত লোক নিয়ে বিষয়টি পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। এ বিষয়ে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর থেকে নৌ, বিমান ও সেনা সদস্যরা তাদের বিশ্বস্ত লোকজন নিয়ে ধীরে ধীরে পৃথক পৃথক গ্রুপ সৃষ্টির মাধ্যমে সংগঠিত হতে থাকেন। এই মামলায় শেখ মুজিবসহ অন্যরা জেল খেটেছেন। এই মামলার কারণেই ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের ভিত্তি তৈরি হয়।

পূর্ব বাংলার মেহনতি জনগণের মজলুম জননেতা হিসেবে খ্যাত মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে 'আসসালামু আলাইকুম' বলেছিলেন। অনেকে একে স্বায়ত্তশাসনের দাবি হিসেবে দেখেন। কেউ কেউ একে পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলাকে পৃথক করার হুঁশিয়ারি হিসেবেও ভাবেন। কিন্তু সর্বস্তরের জনগণের কাছে তা বোধগম্য হয়নি।

বামপন্থী সংগ্রামী সংগঠন কম্যুনিস্ট পার্টি পূর্ব বাংলার জনগণের শোষণমুক্তি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি হাতে নিলেও স্বাধীনতার কথাটি তখনও স্পষ্ট করেনি, যেমনটি ষাটের দশকের শুরুতে কম্যুনিস্ট পার্টির সভায় করেছিলেন শেখ মুজিব।

বিশিষ্ট কম্যুনিস্ট নেতা ও লেখক খোকা রায়ের মতে, ১৯৬১ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছেন। খোকা রায় লিখেছেন–

পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও অন্যান্য জাতীয় অধিকার লাভের আকাঙ্ক্ষা জনগণের মনে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছিল। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মহলের কোনো কোনো অংশে 'স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান' দাবি গুঞ্জরিত হচ্ছিল। ১৯৬০-৬১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ভিতর 'স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান' দাবি নিয়ে একটি সাধারণ আলোচনা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সব সভ্যই 'স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান' দাবিকে ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করেছিলেন। এই বিষয়ে অভিমত পার্টি একটি সার্কুলারে সে সময় প্রচারও করেছিল। হামদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজ বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজের ভিতর গভীর অসন্তোষ জেগে উঠেছিল।

…….. কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি এটাও উপলব্ধি করেছিল যে, বাস্তব অবস্থা আন্দোলনের অনুকূলে হলেও পার্টির একার প্রচেষ্টায় কোনো আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য কমিউনিস্ট পার্টিসহ পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের ঐক্য অন্তত আওয়ামী লীগ ও কম্যুনিস্ট পার্টির ভিতর ঐক্য বা সমঝোতা একান্ত প্রয়োজন ছিল।

…..আওয়ামী লীগ ও কম্যুনিস্ট পার্টির মধ্যে সেই বৈঠক হয়েছিল ১৯৬১ সনের শেষ দিকে। সেসব বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন শেখ মুজিবর রহমান ও মানিক মিয়া। কম্যুনিস্ট পার্টির পক্ষে উপস্থিত ছিলাম মণি সিংহ ও আমি। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আমাদের প্রথম বৈঠক হয়েছিল পার্টির এক ঘনিষ্ঠ সমর্থকের বাড়িতে।

………. প্রতিক্রিয়াশীল আইউবশাহীর বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন গড়ে তোলা একান্ত দরকার সে বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা এবং আমরা প্রথম বৈঠকেই একমত হয়েছিলাম।

……..আন্দোলনের দাবি নিয়ে আলোচনার সময় শেখ মুজিবর রহমান বারবার বলছিলেন যে, 'পাঞ্জাবের বিগ বিজনেস যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করছিল ও দাবিয়ে রাখছিল তাতে ওদের সঙ্গে আমাদের থাকা চলবে না। তাই এখন থেকেই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আন্দোলনের প্রোগ্রামে ওই দাবি রাখতে হবে, ইত্যাদি।'

তখন আমরা (আমি ও মণিদা) শেখ মুজিবকে বুঝিয়েছিলাম যে, কমিউনিস্ট পার্টি নীতিগতভাবে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি সমর্থন করে, কিন্তু সে দাবি নিয়ে প্রত্যক্ষ আন্দোলনের পরিস্থিতি তখনও ছিল না। 'স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান' দাবি নিয়ে ওইসব আলোচনার পরের বৈঠকে শেখ মুজিব আমাদের জানিয়েছিলেন, 'ভাই এবার আপনাদের কথা মেনে নিলাম। আমাদের নেতাও (সোহরাওয়ার্দী সাহেব) আপনাদের বক্তব্য সমর্থন করেন। তাই এখনকার মতো সেটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমার কথাটা থাকল' ইত্যাদি।

['সংগ্রামের তিন দশক', পৃষ্ঠা ১৮১, ১৮২, ১৮৩]

'পাঞ্জাবের বিগ বিজনেস যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করছিল ও দাবিয়ে রাখছিল তাতে ওদের সঙ্গে আমাদের থাকা চলবে না'

'পাঞ্জাবের বিগ বিজনেস যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করছিল ও দাবিয়ে রাখছিল তাতে ওদের সঙ্গে আমাদের থাকা চলবে না'

৯৪ সালের ১০ আগস্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক নিবন্ধে শেখ হাসিনা লিখেছেন–

তখন রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগের সব নেতা 'এবডো' ছিলেন অর্থাৎ সক্রিয় রাজনীতিতে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তাই ছাত্রদের সংগঠিত করে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু করা হয়। আব্বা অবশ্য আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি বেড়াতে যেতেন বিভিন্ন জেলায়। সেখানে দলকে সংগঠিত করার কাজ ও আইয়ুববিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য প্রতি জেলা, মহকুমা, থানায় গোপন সেল গঠন করেন। দেশকে স্বাধীন করার জন্য দলকে সুসংগঠিত করার কাজ গোপনে চলতে থাকে। ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। বাষট্টিতে বহু ছাত্র গ্রেপ্তার হয়। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের বহু নেতা এ বাড়িতে এসেছেন গোপনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ নিতে ও আলোচনা করতে।

অন্যদিকে শুরু থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের প্রতি যে অমানবিক শাসন-শোষণের প্রক্রিয়া চালাতে থাকে তা থেকে জাতির মুক্তির লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল ঐতিহাসিক ছয় দফা। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে যে, ছয় দফা ছিল পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন রচনার প্রদান সোপান। শেখ মুজিব জানতেন ৬ দফা দাবি কিছুতেই পাকিস্তান সরকার মেনে নেবে না। আর জনগণ ছয় দফা গ্রহণ করলে এর ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতার অধিষ্ঠিত হতে পারবে।

এভাবে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিকভাবে গড়ে উঠবে একটি ভিত্তি। বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইউব খান। '৬৭ সালের ২৯ মার্চ মোমেনশাহী সার্কিট হাউসে দেওয়া এক ভাষণে তিনি বলেন–

এদেশের কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে যে একটিমাত্র ক্ষমতা রয়েছে তা হচ্ছে প্রাদেশিক গভর্নরের নিযুক্তি। এই ক্ষমতা যদি কেন্দ্রীয় সরকারের হাত থেকে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে দেশের দুটি অংশ পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।….. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিদাররা প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের দুই অংশের বিচ্ছিন্নতা কামনা করে, কিন্তু প্রকাশ্যে এই কুমতলব স্বীকার করার মতো সৎসাহস তাদের না থাকায় জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।

['ভাসানী মুজিবের রাজনীতি: দ্বিতীয় খণ্ড', পৃষ্ঠা-১২৫]

২.

এদিকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যখন ছয় দফা ও ১১ দফার আন্দোলন স্বাধিকার আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ লাভ করছিল তখন (ফেব্রুয়ারি '৭১) দেশের রাজনৈতিক অস্থির পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে পূর্ব বাংলার অন্যান্য রাজনৈতিক দল, উপদল ও গ্রুপগুলো স্বাধীনতার দাবি তুলতে থাকে ক্ষীণ স্বরে। কেউ 'পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর', কেউ 'পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন কর,' আর কেউ 'স্বাধীন সার্বভৌম গণবাংলা কায়েম কর' ইত্যাদি ভাসা ভাসা দাবি উত্থাপন করতে থাকে বিভিন্ন প্রচারপত্রের মাধ্যমে। আশ্বর্য যে, ওই সব রাজনৈতিক সংগঠন '৭১ সালের মার্চের প্রাক্কালেও 'স্বাধীন বাংলাদেশ' উচ্চারণ করতে পারছিলেন না।

['বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম', রফিকুল ইসলাম, পৃষ্ঠা-৯৬]

এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনেক এগিয়ে, তার প্রমাণ আমরা পাই '৬৯ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের নাম 'বাংলাদেশ' ঘোষণার মধ্য দিয়ে।

১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু দিবসের এক আলোচনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন–


এক সময় এদেশের বুক হইতে মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে 'বাংলা' কথাটির শেষ চিহ্নটুকুও মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে– একমাত্র 'বঙ্গোপসাগর' ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে বাংলা কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। আমি ঘোষণা করিতেছি– আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হইতে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র 'বাংলাদেশ'।

['বং বঙ্গ বাঙ্গালা বাংলাদেশ,' মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ভোরের কাগজ, ২৬ মার্চ '৯৮]

পাকিস্তানিরা ধরে নেয় যে, পূর্ব বাংলাকে এই সময় ছলে-বলে-কৌশলে এবং প্রয়োজনে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে দমিয়ে ক্ষমতার বাইরে রাখতে না পারলে 'পাকিস্তান' টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। বিদেশিরাও বলতে থাকেন, এই নির্বাচনী ফলাফল পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার আলামত। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিতা অর্থাৎ একক নেতৃত্বের বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক।

লণ্ডনের অবজারভার পত্রিকার রিপোর্টার গেভিন ইয়ং তার এক রিপোর্টে উল্লেখ করেন–

বাংলার এই জয়জয়কার হঠাৎ একটা নাটকীয় সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে। আজ না হলেও কাল পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে যেতে পারে। …. পূর্ব পাকিস্তানে মুজিব কোন পীর-পয়গম্বরের মতোই জনপ্রিয়। … পূর্ব পাকিস্তানের দরিদ্র অবহেলিত কোটি কোটি জনগণ এ সপ্তাহে '৭০ সালের নভেম্বরে) তাদের ভয়ানক প্রাকৃতিক (ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস) বিপর্যয়ের ছায়াকে তাড়িয়ে দিয়েছে এবং পুনরায় রাজনীতিতে ভয়াবহ মূর্তিতে দেখা দিয়েছে।

মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের অগ্নিক্ষরা মূর্তিকে সামনে রেখে আধ্যাত্মিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে তারা একটি রোমাঞ্চকর রাজনৈতিক জয় ('৭০ সালের নির্বাচনে) লাভ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের যার থেকেই হোক, বিশেষ বাধা বরদাস্ত অথবা যার সঙ্গেই হোক নিষ্পত্তি করার জন্যে, মুজিব অথবা তাঁর জনগণ আর দাঁড়িয়ে থাকবে বলে মনে হয় না।

['বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত: প্রথম খণ্ড', পৃ: ১৩৭-১৪০]

এই বিজয়ের পেছনে শেখ মুজিবের অসামান্য কর্মসাধনার বিবরণ দিয়েছেন সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী মাহবুব উল আলম। তিনি লিখেছেন–

আরও এক ব্যাপারে অন্যসব নেতার উপর টেক্কা দিয়েছেন মুজিব। আমরা দেখেছি নির্বাচনের পূর্বে দেশকে তাঁর মতে আনবার জন্যে মুজিব কী অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। তিনি দেশের সর্বত্র চষে বেড়িয়েছেন, তাঁর অনুগামীদের সংঘবদ্ধ করেছেন। বিরাট বিরাট জনসভায় ভাষণ দিয়ে তিনি দেশকে জাগিয়ে তুলেছেন। তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠ সর্বত্র শ্রুত হয়েছে। তাঁর দেহ এই অমানুষিক পরিশ্রমে কখনও ভেঙে পড়েনি। যে অকুতোভয়তা এবং চরম আত্মবিশ্বাস মুজিব চরিত্রের প্রধান গুণ তিনি সেটা জনগণের মধ্যে সঞ্চারিত করে দেন। দেশে তিনি যে শক্তি পয়দা করে দিলেন আমাদের ইতিহাসে তার কোনো তুলনা হয় না। তাঁর অনুপস্থিতিতেও এই শক্তি সমান কাজ করে গিয়েছে। ধন্য মুজিব।

['বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত: প্রথম খণ্ড', পৃষ্ঠা ১৪২]

অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যথাসময়ে স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতা ও প্রস্তুতিমূলক উদ্যোগের প্রমাণ মেলে ড. কামাল হোসেনের দেওয়া তথ্যে। '১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক বৈঠকে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার সম্ভাব্যতা নিয়ে সক্রিয়ভাবে আলোচনা করেন।

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে বিলম্ব আওয়ামী লীগকে তার নিজস্ব বিকল্পগুলো বিবেচনায় অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রণোদিত করে। একটি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রস্তুত করে রাখার সিদ্ধান্ত হল। ওই ঘোষণা দেওয়া হলে তার বিরুদ্ধে সামরিক আঘাত কতটা জোরালোভাবে আসতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে ওই আক্রমণ মোকাবিলা করে বিজয়ী হওয়ার জন্যে জনগণের শক্তি কতটুকু সবকিছুই সতর্কভাবে বিবেচনার প্রয়োজন ছিল।

বিদ্যমান সামরিক শক্তি সম্পর্কে কিছুটা হিসেব করে দেখা হল। ভারতের ওপর দিয়ে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং এর ফলে সৈন্য ও রসদ সরবরাহে সৃষ্ট অসুবিধার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হল।

আমাকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের একটা খসড়া তৈরি করতে বলা হয়। এই খসড়া তৈরিতে নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত হল মার্কিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভাষ্য, যেখানে ওই ঘোষণাকে যুক্তিসঙ্গত করতে ব্রিটিশ-শাসনের অন্যায় অবিচারকে তুলে ধরা হয়েছে।

খসড়াটি প্রস্তুত হলে ১০ জানুয়ারি আমি সেটি শেখ মুজিবের হাতে দিলাম এবং তিনি সেটি নিজের কাছে রাখলেন। তাজউদ্দিন আহমদ ওই খসড়াটি প্রণয়নের কাজে যুক্ত ছিলেন। যদি স্বাধীনতা ঘোষণার কর্মপন্থা গৃহীত হয়, সে ক্ষেত্রে ওই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনার রূপরেখা প্রণয়নের দায়িত্বও ছিল তাজউদ্দিন আহমদেরই।

যদি স্বাধীনতা ঘোষণার কর্মপন্থা গৃহীত হয়, সে ক্ষেত্রে ওই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনার রূপরেখা প্রণয়নের দায়িত্ব ছিল তাজউদ্দিন আহমদের হাতেই

যদি স্বাধীনতা ঘোষণার কর্মপন্থা গৃহীত হয়, সে ক্ষেত্রে ওই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনার রূপরেখা প্রণয়নের দায়িত্ব ছিল তাজউদ্দিন আহমদের হাতেই

ওই পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো ছিল রাজপথে লাখ লাখ মানুষ নামিয়ে দিয়ে প্রধান প্রধান শহরগুলোতে ব্যাপক গণবিক্ষোভ শুরু; এভাবে সামরিক বাহিনীকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ফেলে বেতার কেন্দ্র, সচিবালয় ও গভর্ণরস হাউস দখল এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে গভর্নরের কাছ থেকে ঘোষণা আদায় ইত্যাদি।

….ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সকল আওয়ামী লীগ সদস্য ও দলের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের এক যৌথ সভা আহ্বান করা হয়। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হতে থাকে যে, স্বাধীনতা-ঘোষণার সিদ্ধান্ত বিবেচনার উদ্দেশ্যেই ১৩ ফেব্রুয়ারির ওই সভা আহ্বান করা হয়েছে। আমার মনে পড়ে, সভার প্রাক্কালে এক বিদেশি কূটনীতিক শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করেছিলেন, 'এই বৈঠকে কি আপনারা একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন?

['মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল', ড. কামাল হোসেন, পৃষ্ঠা ৫০/৫১]

১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের এক যৌথ সভায় বঙ্গবন্ধুকে 'জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অধিকার আদায়ের জন্য যে কোনো পন্থা গ্রহণের পূর্ণ অধিকার' দিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়।

পূর্ব বাংলার জনগণের স্বাধিকারের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর প্রবল আগ্রহের কথা তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যেও ছিল স্পষ্ট। ৭১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এক সাংবাদিক সম্মেলনে তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভুট্টো ও পিপলস পার্টির ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন–

আমরা আজ প্রয়োজন হলে আমাদের জীবন বিসর্জন করারও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের একটি কলোনিতে বাস করতে না হয়, যাতে তারা একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে সম্মানের সঙ্গে মুক্ত জীবনযাপন করতে পারে, সে প্রচেষ্টাই আমরা চালাব।

[দৈনিক পাকিস্তান; ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১]

৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে এক ছাত্রগণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এ সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বক্তৃতা করেন। সভায় তৎকালীন ডাকসু সহসভাপতি আসম আবদুর রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদদুস মাখন, ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে গঠিত, 'স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' এর পক্ষ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহার পাঠ করেন শাহজাহান সিরাজ।

ওই ঘোষণায় বিভিন্ন ধারার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ধারা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা। এ ছাড়া নিচের স্লোগান ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় উক্ত ইস্তেহারে–

১. স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হউক;

২. স্বাধীন কর, স্বাধীন কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর;

৩. স্বাধীন বাংলার মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব;

৪. গ্রামে-গঞ্জে দুর্গ গড়, মুক্তিবাহিনী গঠন কর;

৫. বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর;

৬. মুক্তি যদি পেতে চাও, বাঙালিরা এক হও।

এই ইশতেহারেই 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসবে গ্রহণ করা হয়।

['বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম', রফিকুল ইসলাম, পৃষ্ঠা-১০৩]

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৬ বছর পর ইতিহাসের অমোঘ ধারায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর 'বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হউক' শ্লোগানটি রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর আগে একাত্তরে মুজিবনগর সরকার এবং স্বাধীনতার পরপরই নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করে।

বয়স এবং অভিজ্ঞতা রাজনৈতিক পরিপক্কতার জন্য একটি অতি জরুরি বিবেচ্য বিষয়। ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়ের বয়সের কারণে এবং অভিজ্ঞতার ঘাটতির জন্য তারা কিছুটা বাড়তি আবেগতাড়িত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো জাতীয় নেতাকে পদক্ষেপ নিতে হয় সময়, সুযোগ, সামর্থ্য, অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি, দেশের সার্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায়। সর্বোপরি বিদ্যমান আইনগত দিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিযার বিষয়টিও গভীরভাবে বিবেচনায় রাখতে হয় একজন প্রাজ্ঞ, দূরদর্শী, কৌশলী রাজনৈতিক নেতাকে, যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে।

পাকিস্তানিদের দীর্ঘদিনের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' সমসাময়িক আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অপরিহর্যতা তুলে ধরাসহ সামগ্রিক বিষয়টি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সব দিক বুঝেশুনেই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি দিয়েছিলেন তিনি।

সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলেছেন, মুক্তির কথা বলছেন। যুদ্ধ শব্দটি সরাসরি না বলে লড়াই এর জন্য জনগণকে প্রস্তুত থাকার কথা বলেছেন। সামরিক-বেসামরিক পর্যায়ে চাকরিজীবী ও সাধারণ মানুষের অনেকেই এই ভাষণ শুনে শিহরিত হয়েছেন। সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের গণ্ডিবদ্ধ নেই। আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতাপ্রাপ্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র।

সব দিক বুঝেশুনেই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি দিয়েছিলেন তিনি

সব দিক বুঝেশুনেই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি দিয়েছিলেন তিনি

এই ভাষণ শোনার পর থেকে যে রক্ত আগুন জ্বলে উঠে বাঙালির শিরায় শিরায় সেই থেকে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালিরা অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে। চূড়ান্ত নির্দেশের অপেক্ষার পর এল ২৫ মার্চের রাতের ঘোষণা।

বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর আসতে লাগল ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর সৈয়দপুরসহ বিভিন্ন স্থানে পাক সেনারা বাঙালিদের ওপর আক্রমণ শুরু করেছে। এরই মধ্যে তিনি তৈরি করে রাখেন স্বাধীনতার যুদ্ধের চূড়ান্ত ঘোষণা। বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞের সংবাদ পেয়েই তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের গোপন স্থানে চলে যাবার নির্দেশ দেন এবং বিশেষ ব্যবস্থায় টেলিফোন ও একান্ত বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে অয়্যারলেস স্টেশনে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন স্বাধীনতার সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা। যা রাতের মধ্যেই পৌঁছে যায় চট্টগ্রামে।

পরদিন ২৬ মার্চের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশের আনাচে-কানাচেসহ বহির্বিশ্বে। ঘোষণাটি প্রচারের অল্পক্ষণের মধ্যে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ। রাত প্রায় একটা ২০ মিনিটে গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু।

সেই ঘোষণার থেকে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময় পর্যন্ত বাঙালি তরুণ-যুবক-দামাল ছেলেসহ আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা ও বাঙালি ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, আনসার বাহিনীর সদস্যরা এই ভাষণকে মন্ত্রজ্ঞান করে লড়াই করে গেছেন মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য।

চট্টগ্রাম

১৯ এপ্রিল, ২০১৪

[দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য]

http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/16884




__._,_.___

Posted by: SyedAslam <Syed.Aslam3@gmail.com>


****************************************************
Mukto Mona plans for a Grand Darwin Day Celebration: 
Call For Articles:

http://mukto-mona.com/wordpress/?p=68

http://mukto-mona.com/banga_blog/?p=585

****************************************************

VISIT MUKTO-MONA WEB-SITE : http://www.mukto-mona.com/

****************************************************

"I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it".
               -Beatrice Hall [pseudonym: S.G. Tallentyre], 190





__,_._,___