Banner Advertiser

Monday, November 16, 2015

[mukto-mona] ‘সবুজ’ ভাসানী, ‘লাল’ ভাসানী?




ফরহাদ মজহার

১৬ নভেম্বর ২০১৫,সোমবার, ১৮:১৫


সতেরো নভেম্বর ১৯৭৬ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি জন্মেছিলেন ১২ ডিসেম্বর ১৮৮০ তারিখে। তাঁর জন্মদিন বা মৃত্যুদিন নিয়ে বাংলাদেশে কখনই বড় কোন আয়োজন চোখে পড়ে নি। এমনকি অনেক সময় দেখেছি তার জন্মদিন ও মৃত্যুদিন খুবই নীরবে পার হয়ে গেছে।
বাঙালি বা বাংলাদেশীদের সম্পর্কে যে অভিযোগ সাধারণত শোনা যায়, সেটা সত্য বলেই মনে হয়। যেমন, এরা এমন এক জনগোষ্ঠি যারা প্রবৃত্তি ও আবেগের জগত ত্যাগ করে স্মৃতি, বুদ্ধি, বিচার ও কল্পনার জগতে প্রবেশ করে নি। এই জগতই আসলে ইতিহাসের জগত। নিজেদের ঐতিহাসিক ভাবে ভাবতে হলে এই চারটি গুণ আয়ত্তে আসা দরকার। সেটা হঠাৎ দৈবগুণে তৈরি হয়, সেটাও ঠিক নয়। একটা লড়াই সংগ্রামের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই একটি জনগোষ্ঠি সেটা আয়ত্ত করে। কিন্তু সেই লড়াই সংগ্রাম স্মৃতি হিসাবে জারি আছে কিনা সেটাও সন্দেহের। আমরা যেভাবে আমাদের নিয়ে কথা বলি তাতে মনে হয় বাংলাদেশের ইতিহাস মানে ভারতের সহায়তায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। এর আগে যেন আমাদের আর কোন ইতিহাস নাই। আমাদের ইতিহাসে জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াই নাই, জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে শ্রেণি সংগ্রাম নাই। আমাদের ইতিহাসে সিপাহি বিদ্রোহ নাই, তিতুমীর নাই, এমনকি সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ফজলুল হক নাই। সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে এই ইতিহাসে কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনের কোন চিহ্ন নাই। আমাদের ইতিহাস মানে আওয়ামী লীগের ইতিহাস কথাটার অর্থ এই অর্থে ইতিহাসের নিরাকরণ। বাংলাদেশকে ইতিহাসশূন্য করবার একটা প্রক্রিয়া। শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের 'জাতির জনক'। তিনি পয়দা না করলে বাংলাদেশের কোন জন্মই হোত না।
এই ইতিহাস থেকে মওলানা ভাসানীকে অশ্লীল ভাবে মুছে ফেলা হয়েছে। ন্যূনতম রাজনৈতিক সংবেদনশীলতাও আমরা হারিয়েছি যাতে আমরা এখন আর বুঝতে পারি না শেখ মুজিবুর রহমানের আগে মওলানা ভাসানীর নাম না নেওয়া রাজনৈতিক শ্লীলতার লঙ্ঘন। তবে, মওলানাকে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার প্রক্রিয়া আদৌ সফল হবে ভাববার কোন কারণ নাই। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠা এবং আমাদের ইতিহাসে তাঁর তাৎপর্য উপলব্ধি শেখ মুজিবুরের মতো অন্ধ আবেগ ও গায়ের জোর দিয়ে কায়েম করা যাবে না। ভাসানীর দিকে নজর দেওয়ার অর্থ হছে ভুয়া ইতিহাস বাদ দিয়ে মূলত এই উপমহাদেশ ও বিশেষ ভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে নতুন ভাবে নজর দেবার ক্ষমতা অর্জন করা। সেই প্রয়োজনের কথা মনে রেখে এখানে মওলানাকে নিয়ে দুই একটি কথা পেশ করবার চেষ্টা করব।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জীবন ও কাজ নিয়ে লেখালিখি হয় নি বলা অন্যায় হবে, কিন্তু মওলানার ওপর ভালো ও নির্ভরযোগ্য কোন জীবনীগ্রন্থ আমরা এখনও পাই নি। সেটা সম্ভবত বিপজ্জনক কিছু নয়। একই কথা সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ফজলুল হক এমনকি শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে বলা চলে। সাধারণ ভাবে নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা অসচেতন, সে কারণে আমরা কি ছিলাম, কি হয়েছি এবং কি হয়ে উঠতে পারি বা হয়ে উঠতে চাই এই সব প্রশ্ন আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়। ফলে বাংলাদেশের জনগণের সম্ভাব্য ঐতিহাসিক অভিমুখ কি হতে পারে তাকে প্রশ্ন আকারে তুলতেও আমরা অক্ষম। আমরা একদল নিজেদের 'বাঙালি' বলে ভাবি, সেটাও নাকি আবার 'আবহমান' অর্থাৎ বাঙালি হয়েই আমাদের নাকি আবির্ভাব, আর বাঙালি হয়েই আমাদের যুগযুগান্তরে বহমান হয়ে থাকা ইত্যাদি। আরেকদল এর প্রতিক্রিয়ায় নিজেদের 'বাংলাদেশী' বলেন। এই পরিচয়ের আড়ালে নিজেদের কখনো 'মুসলমান' কখনো 'বাঙালি' পরিচয়টাকে প্রধান ভাববার সুযোগ থেকে যায়, সেটা একটা সুবিধা। যাঁরা সেটা চান না, তাঁরা নিজেদের 'মুসলমান' ভাবতেই পছন্দ করেন। যেহেতু ধর্মের সঙ্গে ইতিহাসের জটিল সম্পর্ক বিচার করতে আমাদের প্রবল আলস্য রয়েছে, আলস্য রয়েছে ধর্মের সঙ্গে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সম্পর্ক বিচারের ক্ষেত্রেও, সে কারণে 'বাঙালি' বা 'বাংলাদেশী' পরিচয়ের বিপরীতে সমাজের একটা বড় অংশ নিজেদের 'মুসলমান' ভাবতেই অভ্যস্ত। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক ধারাগুলো শক্তিশালী হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার কারণে রাজনীতিতে ইসলামের প্রভাব, গ্রহণযোগ্যতা ও ন্যায্যতা হ্রাস পেয়েছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু পুরা সত্তর দশকব্যাপী বাংলাদেশে ও উপমহাদেশে ইসলাম প্রশ্নকে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের বিপরীতে স্থাপন করে যে পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে তাতে জনগণ বিভক্ত হয়েছে। বিভাজন ও বিদ্বেষ বেড়েছে। সর্বোপরি পরস্পরকে জানা বোঝার ক্ষেত্রগুলো সংকুচিত হয়ে গিয়েছে। জনগণের ইতিহাসের দিক থেকে ইসলাম ও উপমহাদেশের ইসলামের ইতিহাস মোকাবিলা, পর্যালোচনা ও ঐতিহাসিক তাগিদের নিরিখে আত্মস্থ করবার কোন চেষ্টাই হয় নি। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের দিক থেকে যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল, তাকে কাজে না লাগিয়ে এটাই নানানভাবে প্রমাণ করবার চেষ্টা হয়েছে যে ইসলাম 'বাঙালি' সংস্কৃতির আন্তরিক কোন উপাদান নয়। এটা বাইরের জিনিস। তেল আর জল যেমন মেশে না, ইসলাম ও বাঙালিও তেমনি পরস্পর বিরোধী একটি ব্যাপার। ইসলামের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ক্রমাগত বিদ্বেষমূলক রাজনৈতিক তৎপরতার কারণে রাজনীতিতে ইসলাম আরও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিশাবে হাজির হয়েছে, যার মীমাংসা এখন আর আগের মতো সহজ নয়। অনেক কঠিন বলেই এখন আমার মনে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি এবং সামগ্রিক ভাবে পাশ্চাত্যের ইসলাম বিদ্বেষ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ রাজনৈতিক ইসলাম অর্থাৎ যে রাজনৈতিক ধারা ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের ভীতি, বিদ্বেষ ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়ছে- তাকে নতুন ভাবে রাজনৈতিক বৈধতা দিয়েছে। এই ধারাকে 'মৌলবাদী', 'সন্ত্রাসী' ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করে এর ঐতিহাসিক আবির্ভাবের কার্যকারণকে যেমন এখন আর মুছে ফেলা যাবে না, একই ভাবে সাম্রাজ্যবাদ ও আন্তর্জাতিক পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিরোধী শ্রেণি-রাজনীতির দুর্বলতার কারণে এই ধারার রাজনৈতিক ন্যায্যতা ও বৈধতাকেও নাকচ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি একটি ভিন্ন বলয়ে প্রবেশ করেছে যাকে মোকাবিলার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি আমাদের নাই বললেই চলে।
ভাসানী প্রথাগত অর্থে বামপন্থি বা প্রগতিশীল রাজনীতি করতেন। বাংলাদেশের তথাকথিত প্রগতিশীল রাজনীতির ব্যর্থতাকে সহজ ভাবে বোঝার একটা পথ আছে। যারা এই রাজনীতি এখন করে তাদের অধিকাংশই যে শ্রেণি থেকে আসা সেই শ্রেণির সঙ্গে সাধারণ জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ। তাদের মাথার মধ্যে আগাম তৈয়ারি একটা রাজনৈতিক 'ছক' বাসা বেঁধে থাকে। বাস্তবতার সঙ্গে সেই ছক খাপ না খেলে তারা ছকটাকে বদলায় না; বদ্ধমূল ছককে না বদলিয়ে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের তৈয়ারি ছকের জগতে রাজা হয়ে থাকে। দাবি করতে থাকে বাস্তবতা মাথায় বাসা বেঁধে থাকা ছকের মতো হয়ে উঠুক। এই আহাম্মকি আমরা হরদম করছি। বাংলাদেশের শ্রেণি বা বিপ্লবী রাজনীতির এই দুর্দশা ভয়ানক। সেই দিক থেকে ইসলামকে বোঝা ও পর্যালোচনার কথা যখন ওঠে তখন আমরা মনে করি আমরা বুঝি বিপ্লবী রাজনীতির ধারা পরিত্যাগ করে ইসলামি রাজনীতির পক্ষে বয়ান খাড়া করছি, বয়ান দিচ্ছি। অথচ এই কালে প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রাজনৈতিক বয়ান, নীতি ও কৌশল নির্ণয়। এই ক্ষেত্রে প্রগতিশীল রাজনীতি যে খাদে পড়েছে তাকে ইসলাম বিদ্বেষী পাশ্চাত্যবাদী প্রতিক্রিয়ার অধিক কিছু বলা যায় না। এই রাজনীতির কোন ভবষ্যৎ নাই এটা স্পষ্ট।
মোটা দাগে রাজনৈতিক ইসলামকে আমরা দুটো ধারায় ভাগ করতে পারি। একটি পাশ্চাত্য উদারনৈতিক বা লিবারেল ধারা, যারা নির্বাচনী ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে ও প্রয়োজনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে 'ইসলাম' কায়েম করতে চায়। সাধারণত এরা দাবি করে ইসলাম ও গণতন্ত্রের মধ্যে কোন বিরোধ নাই। সেই দিক থেকে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গেও তার মৌলিক কোন বিরোধ নাই। বরং লড়াই নাস্তিক ও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে। এই দিক থেকে তারা গণতন্ত্র ও নির্বাচনকে সমার্থক গণ্য করে। পাশ্চাত্যের বাস্তবতায় রাষ্ট্রের বিশেষ একটি ধরন হিসাবে গণতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটেছে, কিন্তু পাশ্চাত্যের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় কিম্বা রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে গণতন্ত্রকে আলাদা করে তারা একে নিছকই শাসক নির্বাচনের একটি পন্থা বলে মনে করে। ইসলামের শরিয়া ও ইসলামি শাসনব্যবস্থার সঙ্গে গণতন্ত্র সাংঘর্ষিক কিনা এই তর্ক তাদের কাছে গৌণ। তাই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে শরিয়া আইন চাপিয়ে দেওয়াকে তারা গণতন্ত্রবিরোধী মনে করে না। যেহেতু তারা নির্বাচিত হয়েছে অতএব রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে দেওয়াকে তারা অন্যায্য গণ্য করে না। অন্য ধারা পুঁজি ও পাশ্চাত্য রাষ্টশক্তিগুলোর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও বলপ্রয়োগের বিপরীতে বলপ্রয়োগের নীতিতে বিশ্বাস করে। এদেরকেই মৌলবাদী, সন্ত্রাসী ইত্যাদি বলে ইসলামি মূল ধারার রাজনীতি সবসময়ই বিরোধিতা করে থাকে। কিন্তু কৃষক শ্রমিক নিপীড়িত শ্রেণির মধ্যে যতটা নয় তার চেয়েও অনেক বেশি মধ্যবিত্ত তরুণ সমাজের মধ্যে বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগের নীতিতে বিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়ছে বলেই আমার ধারণা। সেটাই স্বাভাবিক। এই ধারা সাধারণত মনে করে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক সাংঘর্ষিক। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বা গণতন্ত্র বলতে তারা কি বুঝে সেটা ভিন্ন তর্কের বিষয়, বলা বাহুল্য তারা সেটা মার্কস লেনিন বা মাওজে দংয়ের মতো নিশ্চয়ই বোঝে না, তারা এটাও মানে না যে পাশ্চাত্য এনলাইটমেন্টই বা পাশ্চাত্য সভ্যতার মানদণ্ড সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিচার করবার একমাত্র পদ্ধতি । সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার অর্থ এই পদ্ধতিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলা। গ্রিক-খ্রিষ্টীয় জগতই মানুষের একমাত্র জগত, তার বাইরে আর কোন জগত গড়া যায় না, এটা তারা মানতে রাজি নয়। বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপরীতে তারা ইসলাম সম্পর্কে নিজ নিজ ব্যাখ্যা অনুযায়ী এক ধরনের ইসলামি জীবনব্যবস্থা, খেলাফত, ইসলামি শাসনব্যবস্থা ইত্যাদি কায়েম করতে চায়। এই ভাগে বিভিন্ন ধারা রয়েছে। এসবের ফাঁকফোকরে আরও কিছু মানুষ অবশ্যই আছেন যারা বিভ্রান্ত, কিম্বা মনে করেন এইসব পরিচয় বিভ্রাট বা রাজনীতি পার্থিব জীবনে ইসলাম পালনের জন্য আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে অন্ধ হলে প্রলয় তো আর বন্ধ থাকে না।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে ভাবতে গেলে আমাদের সময়ের এই নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতি চোখ বন্ধ করে রাখলে চলবে না। প্রাচীন চিন্তা, বদ্ধমূল ধ্যানধারণা ও ফালতু আবেগ ও নীতিকথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ও বিশ্বব্যাপী নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সীমা ও সম্ভাবনা কোন কিছুরই বিচার করা যাবে না। কিছু মানুষ থাকবে যারা নেড়ি কুকুরের মতো মোড়ে মোড়ে চিৎকার করে যাবে। এদের সম্পর্কে একটি আরবি প্রবাদ আছে। সেটা হোল, কুকুর চিল্লায়, কিন্তু কাফেলা থামে না, কারণ তাকে চলতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে সামনে, সম্মুখের গন্তব্যে।

দুই.

অতএব আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে সামনে। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের গন্তব্য সম্পর্কে আমাদের আদৌ কোন ধারণা আছে কিনা। আসলেই। আমরা কোথায় যাচ্ছি? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যদি কঠিন হয় তাহলে ঘুরিয়ে বলি, কোথায় যেতে চাই আমরা? এই 'আমরা' মানে আসলে কারা? আর এ সব প্রশ্নের ওপর যখন হুমড়ি খেয়ে পড়ি, তখনই মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তার পাঞ্জাবি, লুঙ্গি ও তালের টুপি পরে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যান। তাঁর এই রূপের রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে যা তাঁর আদর্শ, জীবন ও ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সেই তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টার মধ্য দিয়ে এসব প্রশ্নের মানে অনুধাবন করা ও সমাধানের প্রণোদনা আমরা লাভ করতে পারি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা বিচারের কাজও সহজ হয়।
মওলানা ভাসানীকে দুই ভাবে আত্মস্থ করবার চেষ্টা চলে। একদল হচ্ছে প্রাচীন বামপন্থি, ষাট দশকের পর যাদের আর বয়স বাড়ে নি। তাঁরা মওলানার ইসলাম চায় না, কিন্তু মওলানার কমিউনিজম চায়। মওলানার সেকুলারিজম তাদের পছন্দের। তারা মওলানার 'লাল' দিকটা চায়। মওলানা তাদের কাছে 'লাল মওলানা', কিন্তু মওলানার যে লাল তাঁরা চায় সেই লালিমা প্রশান্ত, সেখানে জঙ্গি ভাব নাই। সেটা আরামের। অন্য ধারাও মওলানার বিপ্লবী ও জঙ্গি রূপ চায় না, তাঁর শান্তশিষ্ট পীররূপ ও মুরিদগিরিই তাদের পছন্দ। তাঁকে নির্জীব, নিবীর্য বানিয়ে তাঁর কবর পূজা ও ওরস করে কাটাতে চায় তাঁরা। লাল মওলানার বিপরীতে পিরালি সৌন্দর্যকে আমরা বলতে পারি 'সবুজ মওলানা'। সবুজ মওলানার মধ্যে কোন হানাহানি নাই, শ্রেণি সংগ্রাম নাই, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে 'খামোশ' হুঙ্কার নাই, কিম্বা জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের বল প্রয়োগ ন্যায্য এই সত্য ঘোষণা করবার হিম্মত নাই। মওলানাকে দুই ভাবে আত্মস্থ করবার এই ধারা মওলানা তাঁর বিপ্লবী তাৎপর্য থেকে জ্ঞানে কিম্বা অজ্ঞানে বিচ্যুত করে। কোন সন্দেহ নাই।


আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ইতিহাসকে গায়েব করে মওলানাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার চেষ্টা করে আর যারা মওলানাকে সবুজ কিম্বা লাল বানিয়ে কবরে শুইয়ে রাখার চেষ্টা করে তাঁদের ধারণা বর্তমানের রাজনীতিতে মওলানা ভাসানীর আর কোন তাৎপর্য নাই। বাংলাদেশের আগামী বৈপ্লবিক রাজনীতিতে তার আর কোন ভূমিকা থাকবে না। তিনি বড় জোর স্মৃতি মাত্র। তাঁর 'ইসলামি সমাজতন্ত্র' একটি স্ববিরোধী ধারণা, কিম্বা তাঁর 'রবুবিয়াত' বা 'হুকুমতে রব্বানি'-র ধারণা বুড়া বয়সে ভীমরতি মাত্র। তিনি এক সময়ে কমিউনিস্ট ছিলেন, কিন্তু বুড়া বয়সে ইসলামপন্থি হয়ে গিয়েছেন।
বলা বাহুল্য, মওলানা ভাসানী সম্পর্কে এই দুই ধরনের বিচার ও রাজনীতির লাল আর সবুজÑ আমি ঘোরতর বিরোধী। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির দিকনির্দেশহীনতার মধ্যে যদি আমরা কোন দিশা খুঁজে পেতে চাই তাহলে মওলানা ভাসানীকে ছাড়া আমাদের চলবে বলে আমি মনে করি না। এই জন্য নয় যে, তিনি একটা আদর্শ খাড়া করে দিয়ে গেছেন যা চিরায়ত বা এমন কর্মসূচি আমাদের দিয়ে গিয়েছেন যা বাস্তবায়ন করাই আমাদের কাজ। না, সেটা মোটেও নয়। দুর্ভাগ্যবশত তিনি খুব লেখালিখি করেন নি। বিচ্ছিন্ন কিছু প্রচার পুস্তিকা ছাড়া। সে কারণে তাঁর জীবনী ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডই আমাদের সম্বল। সেখানে তাঁর চিন্তাকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে আমাদের এবং একই সঙ্গে বর্তমানের জন্য তাঁর রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতাকেও অনুধাবন করতে হবে। তাকে মনে রেখে এই সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক কিছু অবস্থান আমরা দাঁড় করাতে পারি কিনা সেই চেষ্টার সাফল্যের মধ্যেই তার গুরুত্ব আমরা ধরতে পারব।
যেমন, ইসলাম বিশেষত ভাসানী যেভাবে 'ইসলাম' বুঝেছেন ও চর্চা করেছেন সেই ইসলামের সঙ্গে কমিউনিজমের যে বিরোধ আমরা অনুমান করি এবং স্নায়ুযুদ্ধের প্রচারণার কারণে যে বিরোধকে আমরা এখনও সত্য বলে ধরে রেখেছি তার আদৌ কোন ভিত্তি আছে কিনা সেটা নতুন করে আমাদের বিচার করতে ভাসানী আমাদের বাধ্য করেন। নিজের জীবন ও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তিনি ইসলাম ও কমিউনিজমের সম্পর্ক বিচারের নতুন একটি দিগন্ত উন্মোচন করেন যে জগতে আমরা এখনও প্রবেশ করবার বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি অর্জন করেছি দাবি করতে পারি না। কিন্তু তাঁর হাত ধরে সাহস করে কদমে কদমে এগিয়ে যাবার সংকল্প নিতে পারি। তবে এটা পরিষ্কার যে কমিউনিস্ট হওয়া আর নাস্তিক হওয়া যে সমার্থক নয়, সেটা এখনও ভাসানীর কাছ থেকে শিখতে আমাদের বাকি আছে।
দ্বিতীয়ত ধর্মতত্ত্ব হিশাবে ভাসানী ইসলামকে নাকচ করেছেন বলে প্রমাণ নাই, কিন্তু তাঁর রাজনীতির সঙ্গে ইসলামের একটি সঙ্গতিপূর্ণ ব্যাখ্যা তিনি খাড়া করবার চেষ্টা করেছেন। সেটাই তাঁর 'রবুবিয়াত'-এর রাজনীতি। তিনি বলছেন :
"আমরা বলিয়া থাকি, মানুষ হিসাবে গড়িয়া উঠিলে সকল সমস্যার সমাধান হইবে। কিন্তু মানুষ কি করিয়া মানুষ হিসাবে গড়িয়া উঠিবে তাহার পথ দেখাইয়া দিই না। খাইয়া পরিয়া স্বাস্থ্য ভাল হইতে পারে, কিন্তু আধ্যাত্মিক উন্নতি ব্যতীত চরিত্র গঠন হইবে না। সাময়িক ভাবোন্মাদনায় যে উন্নত চরিত্র ফুটিয়া উঠে তাহা জোয়ার-ভাটা মাত্র। যে জাতি কেবলি কল্যাণের দিকে গতিশীল, তাহাই আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ বাছিয়া লয়। যখন জাতীয় চরিত্র রাব্বুল আলামিনের রবুবিয়াত বা প্রতিপালনের বিধি-বিধানের সন্ধান লাভ করে, তখন হইতেই সুখ ও শান্তির পথে দেশ এবং জাতি গঠিত হইতে থাকে। তাই মানুষকে প্রথমে সব কিছুর মূলের দিকে এবং সামঞ্জস্যমণ্ডিত সকল বিধান প্রতিবিধানের প্রতি নজর দিতে হইবে।' ('হুকুমতে রব্বানী' প্রসংগে মওলানা ভাসানী (র.), ১৫ই এপ্রিল ১৯৭৪ নবাবপুর-ঢাকা)
যে রাষ্ট্রের কথা তিনি ভাবছেন তাকে তিনি তাঁর এই পরিভাষায় আর 'সমাজতন্ত্র' বলছেন না, বলছেন 'প্রতিপালনের বিধি-বিধান'। শুধু মানুষ নয় পশুপাখি জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ সব কিছুরই প্রতিপালন চাই। সবার 'হক' আছে। এ এক নতুন ধরনের 'সমাজতন্ত্র' যা মানুষকেন্দ্রিক নয়। 'প্রতিপালনের বিধি-বিধান' কায়েম। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের রাজনীতির সম্ভাবনা আমাদের সামনে হাজির করছেন ভাসানী। আমার বিনীত দাবি, ভাসানীকে নিয়ে নতুন ভাবে ভাববার এবং নতুন রাজনীতি আবির্ভাবের সম্ভাবনার চর্চা করবার কথা ভাবতে হবে আমাদের।
তাকে অর্ধেক লাল অথবা অর্ধেক সবুজে বোঝার চেষ্টা ভুল। তিনি যা তাঁকে তেমন করে বোঝাই আমাদের কাজ। তখন বাংলাদেশে বিপ্লবী রাজনীতি পুনর্গঠনের সঙ্গে কিভাবে ইসলাম প্রশ্ন জড়িত সেই দিকগুলো যেমন আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে তেমনি আগামী দিনে আমাদের গন্তব্য আসলে কোন্ দিকে তার নিশানা নির্দেশ করাও সহজ হবে।

- See more at: http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/70117#sthash.oL5HAhHn.dpuf

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/70117





__._,_.___

Posted by: "Jamal G. Khan" <M.JamalGhaus@gmail.com>


****************************************************
Mukto Mona plans for a Grand Darwin Day Celebration: 
Call For Articles:

http://mukto-mona.com/wordpress/?p=68

http://mukto-mona.com/banga_blog/?p=585

****************************************************

VISIT MUKTO-MONA WEB-SITE : http://www.mukto-mona.com/

****************************************************

"I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it".
               -Beatrice Hall [pseudonym: S.G. Tallentyre], 190





__,_._,___