আপনিই বলুন কতজনকে হত্যা করা হয়েছিল
খালেদা জিয়া স্বাধীনতাযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ৩০ লাখ শহীদ হয়েছিলেন এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে। এই সংখ্যা যদি তিনি বিশ্বাস না করেন তবে তিনিই বলুন কতজন নিহত হয়েছিলেন। সংখ্যা যখন তিনি অবিশ্বাস করেন তবে বলুন এই অবিশ্বাসের কারণ কী? বলুন তার বিশ্বাসের ভিত্তি কী? আমাদের মতো সাধারণ মানুষ মনে করবে যে, শহীদের সংখ্যা কম এই কথা উহ্য রয়েছে তার বক্তব্যে। আমরা মনে করব তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধের বিশাল ত্যাগকে ছোট করার চেষ্টা করছেন। তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধের মাহাত্ম্যকে ছোট করার চেষ্টা করছেন। যে বিশাল ত্যাগের মধ্য দিয়ে একটি জাতি বিশাল বিজয় অর্জন করেছে সেই বিশাল অর্জনকে তিনি খাটো করার চেষ্টা করছেন। এই কাজের মধ্য দিয়ে তিনি বিশাল ঐতিহ্যময় একটি জাতিকে কলঙ্কমণ্ডিত করতে চাচ্ছেন। তবে সঠিক সংখ্যা বলে তিনি যা মনে করেন সেটা প্রমাণ করার মতো কিছু তার হাতে যদি থেকে থাকে সেটা তিনি বলুন। সঠিক হলে জনগণ তা মেনে নেবে।
মনে প্রশ্ন জাগে, এখন এই সময় তিনি এসব কথা বললেন কেন? তিনি তো একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তখন তিনি কিছু বলেননি কেন? ১৯৭১ সালে দেশে কী হচ্ছিল সেটা কি তিনি দেখেছিলেন? তিনি ছিলেন ক্যান্টনমেন্টে পাক সেনাদের মাঝখানে। পত্রিকায় পড়েছি, অবস্থাটা তিনি নিজে বেছে নিয়েছিলেন। আরো পড়েছি, তার স্বামী নাকি লোক পাঠিয়েছিলেন তাকে কাছে নিয়ে যেতে। তিনি নাকি যাননি। তিনি নাকি সব প্রটোকল অগ্রাহ্য করে একজন পাকিস্তানি জেনারেলের জন্য শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন। কথায় কথায় নানা কথা উঠে আসে। একটি জাতির গৌরবকে ধুলায় মিশিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে অনেকে দুঃখ পাবে- এটা স্বাভাবিক। তার সন্তান জাতির পিতা সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছেন; যা অনেককেই রুষ্ট করেছে।
তিনি প্রকাশ্য জনসভায় যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্তদের নির্দোষ বলে ঘোষণা করেছিলেন। বিচারে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুজনের সম্বন্ধে বলতে যেয়ে তিনি বলেছিলেন যে, এটা 'বিচারিক হত্যাকাণ্ড'। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সব মিলিয়ে কেমন দেখাচ্ছে? তার এবং ছেলের কাজে ও কথায় কি মনে হচ্ছে না যে তারা স্বাধীনতার আদর্শের বিরোধী? মনে কি হচ্ছে না যে তার বক্তব্য পাকিস্তানের বক্তব্যের সঙ্গে একই সূত্রে গাঁথা। এত দিন তিনি যা বলেননি তা এখন বলছেন কেন? পাকিস্তান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বলেছে। তাদের সমর্থন করার জন্যই কি তিনি এসব কথা বলছেন? আমরা জানি স্বাধীনতাযুদ্ধ সমর্থন করেননি- এমন সব দলের লোক বিএনপিতে রয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতার আদর্শে বিশ্বাসী মানুষ বিএনপিতে রয়েছেন বলে দাবি করা হয়। জানতে ইচ্ছা করে তারা কী ভাবছেন তাদের নেত্রীর বক্তব্য শুনে। নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে তারা কী ভাবেন? জনগণ তাদের সম্বন্ধে কী ভাববেন এ কথা কি তারা ভাবেন?
মাত্র সেদিন বিজয় দিবস পালিত হলো। টেলিভিশনের মাধ্যমে আমরা অনেক কিছু শুনলাম। অনেক কিছুই দেখলাম। দেখলাম অসংখ্য শহীদদের মৃতদেহ। অনেক মৃতদেহেই আছে নির্যাতনের চিহ্ন। বর্বরতার কী নিদর্শন। চক্ষুবিশারদের চোখ তুলে নেয়া হয়েছে। হৃৎপিণ্ড বিশেষজ্ঞের হৃৎপিণ্ড বের করে নেয়া হয়েছে। রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জে গণকবর। এসব আর এখন শোনা কথা নয়। টিভির মাধ্যমে চোখে দেখা। কেউ কি বলতে পারে এসব নিষ্ঠুর দৃশ্য সত্য নয়! এসব দৃশ্য দেখে কার চোখ পানিতে ভরে ওঠে না। হত্যাকারীদের সম্বন্ধে কী ধারণা হয় মানুষের?
টিভির মাধ্যমে শহীদদের আপনজনদের কথা শুনলাম। কি মর্মান্তিক। তারা নিজের চোখে দেখেছেন, কারা তাদের আপনজনদের নিয়ে যাচ্ছে। ওই নরপশুদের সঙ্গে কথাও বলেছেন কেউ কেউ। এসব দেখার পরে যারা যুদ্ধাপরাধীদের নির্দোষ বলে তাদের সম্বন্ধে কী ভাবতে ইচ্ছা করে? যুদ্ধাপরাধের জন্য শাস্তিকে যারা 'বিচারিক হত্যাকাণ্ড' বলে তাদের সম্বন্ধে কী ভাবতে ইচ্ছা করে? স্বজনহারাদের শোক শুধু নয়। তাদের একাকীত্ব শুধু নয়। তাদের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের কথা মনে পড়ে। এ সংগ্রাম বাস্তব সংগ্রাম। আর্থিক সংগ্রাম। প্রতিদিনের সংগ্রাম। একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষকে হারিয়ে পরিবারের কি দুঃসহ অবস্থা! সবার মনে দুঃখময় স্মৃতি। আর নেত্রী বলছেন সংখ্যার কথা। সাধারণ মানুষের মন কেমন করে উঠবে? শোকাহত পরিবারদের জন্য সহানুভূতি নয়। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন নয়। কী করে শহীদ পরিবারদের সাহায্য করা যায়- সে কথা নয়। তিনি বলছেন সংখ্যার কথা।
অনেকে বলেন, দুটি বড় দলের মধ্যে আলোচনা হওয়া উচিত। আদর্শ জগতে কথাটি সত্যি। আলোচনার মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। অনেক উত্তেজনা প্রশমিত হতে পারে আলোচনার মাধ্যমে। গণতন্ত্রের অগ্রগতি হতে পারে আলোচনার মাধ্যমে। তবে এটা ঠিক যে, কিছু ব্যাপারে আপস সম্ভব নয়। শহীদদের আত্মার প্রতি অবমাননা সহ্য করার মতো কিছু নয়। এ ক্ষেত্রে আলোচনা শুরু হতে পারে একটি মাত্র শর্তে আর তা হচ্ছে যারা শহীদ আত্মাকে অবমাননা করেছে তাদের ক্ষমা প্রার্থনা। শহীদদের আপনজনদের মনে যারা কষ্ট দিয়েছে তাদের কথা দিতে হবে যে, ভবিষ্যতে তারা এমন কাজ করবে না। জাতির মূল আদর্শগুলোকে যারা অবজ্ঞা করে। জাতির মূল আদর্শগুলোকে যারা অবমাননা করে তারা গণতান্ত্রিক আদর্শ কতটা মেনে চলবে তা দেখার বিষয়। জাতির মূল আদর্শগুলোকে যারা বদলে দেয়ার চেষ্টা করে তারা গণতান্ত্রিক পথে কতটা চলবে সময়ই তা বলে দেবে। জনগণ সব দেখে। জনগণ সব বোঝে। তবে জনগণ সব সময় কিছু বলে না।
ওয়াহিদ নবী : চিকিৎসক, লেখক। রয়াল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের একজন ফেলো
http://www.bhorerkagoj.net/print-edition/2015/12/30/68056.php
__._,_.___