মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবছর ৮ই নভেম্বর মঙ্গলবার। নিয়মটি হলো, নির্বাচনী বছরে নভেম্বর মাসের প্রথম সোমবারের পরের মঙ্গলবার এই নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়। সেই হিসাবে এবারের নির্বাচন পড়েছে ঐদিনে। আর ঐদিন শুধু যে প্রেসিডেন্ট-ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন তা নয় বরং ৩৪টি সিনেট পদ, ৪৩৫টি কংগ্রেস আসন বা কমপক্ষে এক ডজন গভর্নর পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাই এই নির্বাচনটি যে শুধু হোয়াইট হাউজ দখলের লড়াই তা নয়, এটি সিনেট ও কংগ্রেস কাদের নিয়ন্ত্রণে যাবে তাও নির্ধারিত হবে ঐ মাহেন্দ্রক্ষণে। সারা বিশ্বের দৃষ্টি যেমনি, তেমনি আমরাও এসময়ে 'সাদাবাড়ি' দখল নিয়েই কথা বলবো। কে হবেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট? আমেরিকানরা কালো প্রেসিডেন্ট পেয়েছেন, তারা কি একজন মহিলা প্রেসিডেন্টের জন্যে প্রস্তুত?
কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন হিলারি ক্লিন্টন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট! কথায় বলে, 'দিল্লী দূরস্থ' মানে দিল্লি অনেক দূর। হোয়াইট হাউজ-এর দুরুত্বও কম নয়! ৮ বছর আগে আজকের মত হিলারি বেশ হেসেখেলেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন, হটাত কোথা থেকে ওবামা এসে ডেমোক্রেটিক নমিনেশন ছিনিয়ে নেন। আবারো যে তা ঘটবে না এর গ্যারান্টি কোথায়? হিলারির নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী দ্বিতীয় বারের ভারমন্ট সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এগিয়ে আসছেন বেশ দ্রুত। ১লা ফেব্রূয়ারী আইওয়া ককাস, তারপর ৯ফেব্রূয়ারী নিউ-হ্যাম্পশায়ার প্রাইমারী; এদু'টো হয়ে গেলে কিছুটা আঁচ করা যাবে, তারআগে নয়। ডেমক্রেট পার্টিতে খুব বেশি ক্যান্ডিডেট নেই, তাই কে হবেন দলীয় প্রার্থী তা স্পস্ট হতে জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবেনা। ফেব্রূয়ারী থেকে জুন, এই পাঁচমাস বিভিন্ন স্টেট প্রাইমারী নির্বাচন শেষ হবে। জুলাইতে উভয় বড়দল আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের পার্টির নমিনি মনোনয়ন দেন। তখন থেকে শুরু হয় দুই দলের প্রতক্ষ্য লড়াই।
রিপাবলিকান দলে এগিয়ে বিলোনিয়ার ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার আশেপাশে কেউ নেই। তবে রিপাবলিকান শিবিরে এখনো অনেক ক্যান্ডিডেট, হিলারির মত ট্রাম্পকেও যথেস্ট চড়াই-উতরাই পার হতে হবে এবং সেটাও এই ফেব্রূয়ারী থেকে। মার্কিন নির্বাচনে এই প্রাইমারী পদ্ধতিটি বেশ জটিল এবং কষ্টসাধ্য। এই নির্বাচনটি পরোক্ষ। প্রাইমারীতে ভোটাররা নির্দিষ্ট সংখ্যক স্টেট ডেলিগেট নির্বাচন করেন, যারা পরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন। এটাকে বলা হয়, ইলেক্টোরাল কলেজ, এর মোট ভোটসংখ্যা ৫৩৮টি। যেই প্রার্থী ২৭০ টি ভোট পাবেন তিনি জয়ী হন। একজন প্রাথী যখন কোন স্টেট বিজয়ী হন, তখন ওই স্টেটের সবগুলো ভোট তার বাস্কে যায়, যদিও কোন কোন স্টেটে ভোটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ডেলিগেটও ভাগ হয়ে থাকে। এই ইলেক্টোরাল কলেজের কারণে কোন প্রেসিডেন্ট প্রাথী পপুলার ভোট বেশি পেয়েও প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না, যেমন আল-গোর; তিনি পপুলার ভোটে জিতেন, কিন্তু ইলেক্টোরাল ভোটে জিতে বুশ প্রেসিডেন্ট হন।
হোয়াইট হাউজ দখলের লড়াইয়ে বড় দুই দলের ফ্রন্টরানার হচ্ছেন হিলারী ক্লিন্টন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প। হিলারির এগিয়ে যাবেন তা আগেভাগে কিছুটা স্পস্ট থাকলেও ট্রাম্পের অগ্রযাত্রা অভাবিত। অনেকের ধারনাটা ছিলো ফাইট হবে জেব বুশ এবং হিলারির মধ্যে। কিন্তু বুশ এতটাই পেছনে যে তিনি আর কভার করতে পারবেন বলে মনে হয়না। একসময় নিউজার্সির গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টির সম্ভবনা শোনা গিয়েছিলো, কিন্তু তিনি ব্রিজ্গেট কেলেঙ্কারীতে ভেসে গেছেন। ব্রিজ্গেট কেলেঙ্কারী হলো, গভর্নর নির্বাচনের সময় ক্রিস্টি নাকি ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করে প্রতিপক্ষের নির্বাচনী প্রচরানয় বিঘ্ন সৃষ্টি করেছেন! ট্রাম্পের নিকটতম প্রতিদ্ধন্দী হলেন কৃষ্ণাঙ্গ বেন কারসন, যিনি একসময় জন হপকিন হাসপাতালের পরিচালক ছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গ হবার কারণে বোধকরি তিনি খুব একটা এগুতে পারবেন না, কেননা পরপর দু'জন কালো প্রেসিডেন্ট এমনটা ভাবা যায়না। রিপাবলিকান শিবিরে আরো ক্যান্ডিডেট হচ্ছেন, টেক্সাস সিনেটর টেড ক্রূজ; সাবেক হিউলেট প্যাকার্ড সিইও কার্লি ফায়ওরিনা; কেন্টাকি ও ফ্লোরিডার প্রথমবারের সিনেটর যথাক্রমে রান্ড পল ও মার্কো রুবিও। আরো আছেন, সাবেক সিনেটর সান্তরাম। ডেমক্রেট দলের ম্যারিল্যান্ডের সাবেক গভর্নর মার্টিন ওমালে হাটি পা পা করে এগুতে চেস্টা করছেন।
দু'দলে আরো কিছু প্রার্থী আছেন। নুতন করে যোগ দেয়ার সম্ভবনাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায়না। তদুপরি চূড়ান্তভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং গ্রীন পার্টি বা অন্য কোন দলীয় প্রার্থীও থাকতে পারেন। যদিও লড়াইটা হয় বড় দুই দলের মধ্যে। দুই দলের প্রার্থীদের মধ্যে এখন টিভি বিতর্ক হচ্ছে এবং তা সরাসরি সম্প্রচারও হচ্ছে। চূড়ান্ত মনোনয়নের পর দুই প্রধান প্রতিদ্ধন্ধীর মধ্যে সরাসরি টিভি বিতর্ক হয়। এবছর তিনটি বিতর্কের দিন ও স্থান ইতিমধ্যে স্থির হয়েছে, প্রথমটি হবে ২৬ সেপ্টেম্বর, তারপর অক্টোবর ৯ ও ১৯। এই বিতর্ক বেশ উপভোগ্য হয় এবং মাকিনীরা অনেকেই এসময় তাদের মনস্থির করেন কাকে ভোট দেবেন। ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের মধ্যেও একটি বিতর্ক হয়, সেটির তারিখ নির্ধারিত হয়েছে ৪ঠা অক্টোবর। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, প্রার্থীদের সুস্থতা একটি বিরাট বিষয়।
ধরা যাক, ট্রাম্প ও হিলারি শেষ পর্যন্ত দুই দলের চূড়ান্ত প্রার্থী হলেন, কে জিতবেন? বলা কঠিন। বাংলাদেশের মানুষ চায় হিলারী ক্লিন্টন জিতুক। আমেরিকার বা বহির্বিশ্বের মুসলমানরাও তাই চায়, কারণ তাদের ধারণা হিলারী লিবারেল এবং এতে তাদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে! কবে হিলারী সুহা আরাফাতকে চুমা খেয়েছিলো তাদের মনে ঐদৃশ্য আঁকা আছে, যদিও সুহা কবে আরাফাতের টাকাপয়সা নিয়ে কেটে পড়েছে সেই খবর তারা রাখেন না। ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ায় বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা খুশি হয়েছিলো, কারণ তার নামের মধ্যখানে 'হুসাইন' আছে! অথচ ওবামা মার্কিন স্বার্থে মুসলিম বিশ্বকে তছনছ করে দিতে এতটুকুও কার্পন্য করেনি। অর্থাৎ যিনিই মার্কিন প্রেসিডেন্ট হোন না কেন তাতে বাংলাদেশের খুশি বা বেজার হওয়ার কোন কারণ নেই। এমনকি হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে জননেত্রী শেখ হাসিনার অসুবিধা হবে বলে যারা ভাবেন, তারাও দু:খ পেতে পারেন।
আমেরিকা উদার দেশ। সবার অধিকার এখানে স্বীকৃত; ধর্মীয় স্বাধীনতা ব্যাপক। কিন্তু ইসলামী মৌলবাদীদের একের পর এক হামলা মার্কিনীদের ভাবিয়ে তুলছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই স্পর্শকাতর স্থানে আঘাত করেছেন। তিনি স্বল্প সময়ের জন্যে মুসলমানদের আমেরিকায় প্রবেশ নিষেধের প্রস্তাব করেছেন। ক'দিন আগে তার ক্যাম্প থেকে হিজাব পরিহিত একজন মহিলাকে বের করে দিয়েছেন। মাত্র গত সপ্তাহে টিভি বিতর্কে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো যে তিনি তার বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন কিনা, তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন তা তিনি করবেন না। করার কোন কারনই নেই, কেননা তিনি অনেকের মনের কথা বলেছেন। নির্বাচনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি 'ইসলামী জঙ্গী' কার্ড ব্যবহার করবেন। জয়ী হয়ে গেলে হয়তো ওটা ভুলে যাবেন। মনে রাখতে হবে, নরেন্দ্র মোদিও নির্বাচনের আগে অনেক কথা বলেছিলেন, এখন টু-শব্দ নেই। নির্বাচনে জিততে অনেকেই অনেক কথা বলেন, কিন্তু কোন গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষমতায় এসে রাতারাতি সব পাল্টে দেয়া যায়না।
আমার ধারণা দুই দলই তাদের ফ্রন্ট রানার নিয়ে ততটা খুশি নয়, কিন্তু উপায় নাই। লোকে বলে হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে পেছন থেকে বিল ক্লিন্টন দেশ চালাবেন। আর ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে কি খুব খারাপ প্রেসিডেন্ট হবেন? ট্রাম্প শিবির কিন্তু সবাইকে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন! প্রশ্ন হলো মার্কিনীরা ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট বা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কাকে শেষ পর্যন্ত বিজয়ের মালা পড়াবেন? তবে একথা বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে আর একটি ইসলামী হামলা হলে হোয়াইট হাউজ রিপাবলিকানদের হাতে চলে যাবে। তাছাড়া একনাগাড়ে বারো বছর সাদাবাড়ি ধরে রাখার ইতিহাস নিকট অতীতে ডেমক্রেটদের খুব একটা নেই।
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
নিউইয়র্ক। ১৭ জানুয়ারী ২০১৬।
__._,_.___