মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় প্রসঙ্গে
দেশের সর্বোচ্চ আদালত একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আলবদর নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি বহাল রেখেছেন। এতে দেশবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। এমন একজন জল্লাদও খালেদা জিয়ার মন্ত্রী ছিলেন। সেই খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপ চান। শুনতে ভালো লাগলেও মন থেকে মানতে পারি না খালেদা জিয়ার প্রস্তাব।
আজ যদি জিয়ার প্রধানমন্ত্রী রাজাকার শাহ আজিজ বেঁচে থাকত তাহলে তারও বিচার হতো, ফাঁসিও হতো। রেহাই পেত না সে। সবুর খানরা বেঁচে থাকলে তাদেরও বিচার হতো। এরা প্রত্যেকে বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। এসব দাগি রাজাকাররা পরবর্তীকালে জিয়ার হাত শক্তিশালী করেছে, বিএনপি গঠনে ভূমিকা রেখেছে। জিয়ার কল্যাণে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে বসেছিল। স্বাধীনতার শত্রুরা যদি ক্ষমতা দখল করতে পারে তাহলে দেশটির কী অবস্থা হতে পারে, তা আমরা দেখেছি ২১ বছর ধরে।
যে বদর নেতার ফাঁসির রায় বহাল রইল, সে ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিল। তার নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে আলবদর বাহিনী গঠিত হয়েছিল। তখন আলবদর বাহিনী ছিল সবচেয়ে দুর্ধর্ষ। এরা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাক হানাদারদের সঙ্গে যৌথ অভিযানে অংশ নিয়েছে। এরা বুদ্ধিজীবী হত্যারও নীলনকশা প্রণয়নকারী ছিল। আলবদরের সহযোগিতা ছাড়া পাকি সেনারা বাংলাদেশের এত মানুষ হত্যা করতে পারত না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৬৫ সালের পাক-ভারতের মতো যুদ্ধ ছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলাযুদ্ধে পাক হানাদারদের পর্যুদস্ত করেছিল। একমাত্র আলবদর বাহিনী বাংলাদেশের নদী-নালা-খালবিল, বাড়িঘর, মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানা, ঠিকানা চিনিয়ে দিয়েছে। আলবদর বাহিনীর জল্লাদরা শহীদ রুমীকে জাহানারা ইমামের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কবি, সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরীসহ অগনিত বুদ্ধিজীবীকে নিজামীর নেতৃত্বে উঠিয়ে নিয়ে রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে হত্যা করে। যিনি ছিলেন চোখের ডাক্তার তার চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল, যিনি ছিলেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ তার হৃৎপিণ্ড উপড়ে ফেলা হয়েছিল, যিনি ছিলেন দাঁতের ডাক্তার তার দাঁত তুলে ফেলা হয়েছিল। আর কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষকদের নির্দয়ভাবে হাতের পাঞ্জা কেটে ফেলা হয়েছিল। এরা নাকি ইসলামের ধ্বজাধারী, এই ধ্বজাধারীরা মিথ্যা কথা বলে বুদ্ধিজীবীদের ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রচনাবলি পড়ার সময় আমি বিস্মিত, স্তম্ভিত হয়েছি, কী সাংঘাতিক মেধাবী ছিলেন তারা। অনেকে বিশ্ব স্বীকৃত পণ্ডিত ছিলেন। এই দেশবরেণ্যদের হত্যা করা হয়েছে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করে দেয়ার জন্য। এ জন্যই তো এখন দেশে মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন জমে ওঠে না। আলবদরের ঘাতকরা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চট করে অদৃশ্য হয়ে যায়, কেউ তাদের ধরতে পারেনি; এতই ধূর্ত জামায়াত-শিবিরের ঘাতকরা! আড়ালে আডালে থেকে এরা বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে প্রখর ধর্মীয় অপপ্রচার চালিয়েছে। তারপর জিয়ার আমলে তারা বুক টান করে তাদের খাস তালুকে ফিরে আসে। ২১ বছর পর্যন্ত এরা নির্বিচারে বাংলাদেশের ছাত্র-বুদ্ধিজীবী-শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধাদের পায়ের রগ কেটেছে, হাতের কব্জি কেটেছে, মাথার খুলি চূর্ণ করেছে। এরা চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে পাকিস্তান আমলের মতো উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। চট্টগ্রামের শহীদ মিনারে কেউ ফুল দিতে পারত না শিবিরের অত্যাচারে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফিরে না এলে এত দিনে আলবদরের ঘাতক-নিজামীরা এ দেশকে পাক ওয়াতান বানিয়ে ফেলত। এত দিনে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে 'পাকসার জমিন সাদবাদ' গাওয়া শুরু হয়ে যেত। বদর প্রধান, ঘাতক নিজামীর ফাঁসির রায় বহালের খবর পেয়ে সারা জাতি উল্লাসে ফেটে পড়েছে। তবে দুঃখ পেয়েছেন বেগম জিয়া ও তার সুজন-কুজন মার্কা সুশীল মজুমদাররা।
নিজামীর অপরাধের ফিরিস্তি প্রকাশ পেয়েছে বাংলাদেশের বিশেষ বিশেষ জাতীয় পত্রিকায়। সেটা নিয়ে চর্বিত চর্বন করতে চাই না। নিজামী যখন খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভার শিল্পমন্ত্রী ছিল, তখন অলৌকিকভাবে ১০ ট্রাক অস্ত্র এসে পৌঁছেছিল চট্টগ্রাম বন্দরে। এই ঘটনা নিয়ে তখন তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। বাঙালির চক্ষু চড়কগাছ হয়েছিল, ১০ ট্রাক অস্ত্র, এটা কি মুখের কথা নাকি? কোন উদ্দেশ্যে ১০ ট্রাক অস্ত্র আনা হয়েছিল? বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিনাশ করার জন্য? নিয়াজী রাও ফরমান আলীদের পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য? নাকি আরেকটি ১৫ আগস্টের জন্ম দেয়ার জন্য? এ ব্যাপারে এখনো সঠিক তদন্তের পরিসংখ্যান আমরা পাইনি। এর মোটিভ জানা দরকার। এই দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার হওয়া দরকার।
এ পর্যন্ত যে কজন শীর্ষস্থানীয় ঘাতকের ফাঁসি হয়েছে তাদের মধ্যে নিজামী পয়লা নম্বরের। কারণ সে জামায়াতের আমির। ১৯৭১ সালে নিজামী বলেছিল, 'আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা। যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী সেখানেই আলবদর। যেখানে দুষ্কৃতকারী সেখানেই আলবদর। ভারতীয় চরদের কাছে আলবদর সাক্ষাৎ আজরাইল।' এই একটি মাত্র বিবৃতির জন্য নিজামীর ফাঁসি হতে পারত। মুক্তিযোদ্ধাদের সে 'তথাকথিত; 'ভারতীয় চর' এবং 'দুষ্কৃতকারী' বলেছে। এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কী হতে পারে? শেখ হাসিনা আজ ক্ষমতায় আছেন বলেই এতবড় জল্লাদের বিচার হলো, না হলে এরা জিয়া ও তদীয় পতœী খালেদা জিয়ার ঘাড়ে চড়ে এ দেশকে ইমরান খানদের কাছে বিক্রি করে ফেলত।
বাংলাদেশের রাজনীতিকে নিজামীর মিথ্যাচারের পাপ কলুষিত করে ফেলেছে। ধর্মের আচকান গায়ে দিয়ে, জোব্বা পরে, পরস্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে ফটো তুলতে এদের ধর্মীয় বিধানে আটকায় না। প্রতি মিনিটে এরা যত মিথ্যা কথা বলেছে, সমগ্র ইউরোপ এক বছরেও এত মিথ্যা কথা বলে না। এরা পাক দস্যুদের দস্যুবৃত্তি, নারী ধর্ষণ দেখেও ওদের পক্ষে হাদিস খাড়া করেছে। জামায়াত-শিবিরের পাণ্ডারা আজ ইসলামের মতো মানবতাবাদী, শান্তির ধর্মকে জঙ্গিবাদের ইশতেহারে পরিণত করেছে। ভাবখানা এমন যে, ইসলাম ওদের পৈতৃক সম্পত্তি।
রাজশাহীর বাগমারায় যখন বাংলা ভাইরা মুক্তিযোদ্ধাদের গাছের ডালে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে তখন নিজামী বলেছিল, 'বাংলাভাই বলে কেউ নেই। এসব মিডিয়ার সৃষ্টি।' এটা জ্বলজ্যান্ত মিথ্যা কথা না? পরে দেখা গেল বাংলা ভাইয়ের ফাঁসি হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। একটা মিথ্যা প্রমাণিত হলেই তো যথেষ্ট। বিষ এক বালতি খাওয়ার প্রয়োজন হয় না, এক ফোঁটা খেলেই মানুষের মৃত্যু হয়।
নিজামী বলেছিল বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী বলে কেউ নেই। এ কথা বলা আর দেশদ্রোহিতা করা সমান কথা। নিজামী-মুজাহিদের এই একটি ধৃষ্টতামূলক উক্তির জন্য আরো কয়েক বার ফাঁসি হওয়া দরকার।
বরাবরের মতো বেগম জিয়ার উকিলরা জল্লাদ নিজামীর পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য আদালতে দাঁড়িয়েছেন। খন্দকার মাহবুব হোসেন কী বলেছেন শোনেন, 'আমার ক্লায়েন্ট নিজামী সাহেব যেভাবে নির্দেশ দেবেন সেভাবেই ব্যবস্থা নেব। আদালতে যে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে তা সাজানো সাক্ষ্য। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর যারা এ অপরাধে জড়িত ছিল তাদের বিচার না করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তাদের সহযোগী হিসেবে আসামির মৃত্যুদণ্ড হতে পারে না।'
নিজামী সাহেব? আহারে! কত সম্মান, কত মধুর কণ্ঠে 'সাহেব' বলা হয়েছে। এরাও আবার মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ ডাকে। আদালত পাড়ায় বিএনপির উকিলদের অভব্যতা দেখে বাঙালি জাতি স্তম্ভিত হয়েছে। বিএনপিও একটি যুদ্ধাপরাধী দল। এই দলের সঙ্গে ৩০ লাখ শহীদের স্বজনদের কোনো আপস হবে না।
মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক।
http://www.bhorerkagoj.net/print-edition/2016/01/13/70190.php
__._,_.___