যানজটকে নিয়ে আর কত অবহেলা?
রাজধানীর মানুষ যে দুর্ভোগের শিকার প্রতিদিনই হচ্ছে সেটি হলো ভয়াবহ যানজট। যাতায়াত সমস্যা এখন নগরবাসীর জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্কুলগামী শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে চাকরিজীবী প্রতিটি মানুষকে প্রতিদিন চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এর উপর আর্থিক ক্ষতি তো আছেই। যানজট থেকে হাসপাতালের রোগী পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না।
দৈনিক খবরে বলা হয়, "যানজটে ক্ষতি প্রতিবছর ২০ হাজার কোটি টাকা"।
প্রায় ২ কোটি মানুষের শহর ঢাকাকে দিন দিন অচল করে দিচ্ছে যানজট। কেড়ে নিচ্ছে কর্মব্যস্ত নগরবাসীর অনেক সময়। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীতে যানজটের কারণে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে প্রায় ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা। রাজধানীতে ১২ কর্মঘণ্টার মধ্যে প্রায় ৭ ঘণ্টাই যানজটে আটকে থাকতে হয়।
অপর এক সমীক্ষা মতে, ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। আর সম্প্রতি হিসাব করেছে বিনিয়োগ বোর্ড (বিওআই)।
তারা দেখিয়েছে, রাজধানীতে যানজটের কারণে বছরে অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। এ ক্ষতির কারণে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ কম হচ্ছে। এভাবে আর্থিক ক্ষতি না হলে দেশের জিডিপি'র প্রবৃদ্ধি হতো ১৩ শতাংশ।
জানা গেছে, যদি ঢাকা শহর থেকে ট্র্যাফিক জ্যাম পুরোপুরি দূর করা সম্ভব হতো, তবে সরকারের শতকরা ৬ ভাগের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে টার্গেট, তা সহজেই অতিক্রম করা যেত। গবেষণায় বলা হয়, প্রতিবছর সারা দেশে ট্র্যাফিক জ্যামের কারণে ১২.৫৬ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়, যা জিডিপি'র শতকরা ৭ ভাগ। শুধুমাত্র রাজধানী থেকে যদি ট্র্যাফিক জ্যাম দূর করা যেত, তবে বর্তমান মাথাপিছু আয় ১৩১৪ ডলার থেকে বেড়ে ১৩৯২ ডলার হতো।
অপরদিকে এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, যানজটের দুর্ভোগ নগরবাসীর জীবনী শক্তিকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। এমনকী নাগরিকদের মানসিক সমস্যাকেও বাড়িয়ে তুলছে! মানুষের মধ্যে বাড়ছে হতাশা, কমছে ধৈর্য্য। প্রতিনিয়ত যানজটের কারণে নগরবাসীর সহনশীলতা কমছে। অল্পতেই রেগে গিয়ে দুর্ব্যবহার করছে সহ-যাত্রীর সঙ্গে। মানুষের সহনশীলতা কমে আসার ফলে পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হচ্ছে; এমনকি তালাকের মাত্রাও বেড়ে গেছে অনেকাংশে।
, কালবিলম্ব না করে রাজধানীকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। রাজধানী থেকে মানুষের চাপ কমাতে হবে। প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। কিন্তু "চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী" প্রবাদ বাক্যই প্রতিফলিত হচ্ছে। নির্দিষ্ট মেয়াদে রাজধানীকে ঢেলে সাজানোর মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হলেও মেয়াদ শেষে দেখা যায়, তার কিয়দংশও বাস্তবায়িত হয়নি। উল্টো মহাপরিকল্পনাকে থোড়াই কেয়ার করে অপরিকল্পিত কার্যক্রমই দ্রুত বাস্তবায়িত হচ্ছে। রাজধানীকে যেন কোনোভাবেই পরিকল্পনার ছকে বাঁধা এবং ভারমুক্ত করা যাচ্ছে না। সারাদেশের মানুষ প্রতিদিনই ঢাকামুখী হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষ প্রবেশ করছে। বছরে লাখ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করছে।
প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় তিন হাজার মানুষ বাস করে। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের চলাচলে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। তাদের চলাচলের ব্যবস্থা করতে গিয়ে অপরিকল্পিতভাবে যেমন যানবাহন নামাতে হচ্ছে, তেমনি তা যথেষ্টও হয়ে উঠছে না। ফলে রাজধানী এক হ্যাপহ্যাজার্ড অবস্থার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অসহনীয় ট্র্যাফিক জ্যাম সৃষ্টি হচ্ছে।
বলা হয়, একটি আদর্শ শহরে শতকরা ২৫ ভাগ রাস্তা থাকা প্রয়োজন। ঢাকা শহরে এর পরিমাণ মাত্র ৮ ভাগ। এই পরিমাণ রাস্তাও আবার বেদখল, অপরিকল্পিত পার্কিংসহ নানা অব্যবস্থাপনায় সঙ্কুচিত। তবে আমরা মনে করি, ৮ ভাগ রাস্তাকেও যদি পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে যানজট অধিকাংশই কমিয়ে ফেলা সম্ভব। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব কথা যে আমলে নেয় না, তা রাজধানীর চিত্র দেখেই বোঝা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থনীতিতে যানজট যে ক্ষত হয়ে রয়েছে এবং বিপুল ক্ষতি করে চলেছে, তা সারানোর উদ্যোগ কেন নেয়া হচ্ছে না? সরকারের উন্নয়নমুখী রাজনীতির স্বার্থেই তো জরুরীভিত্তিতে যানজট নিরসন করা উচিত। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সমস্যা চিহ্নিত হয়ে আছে, অথচ তা নিরসনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। এমন পরিস্থিতি বিশ্বের কোথাও আছে কিনা আমাদের জানা নেই।
পাশাপাশি উল্লেখ্য, বাস্তবতার তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে একথা এখন সর্বজনবিদিত, কেবল উড়ালসড়ক করে যানজটের সমাধান হওয়ার নয়; বরং তা যানজটকে আরো ঘনীভূত করেছে। অপরদিকে ঢাকার গণপরিবহনব্যবস্থা নেই বললেই চলে। ব্যক্তিগত পরিবহনই সর্বেসর্বা। গণপরিবহনের পাশাপাশি পাতাল নয়; মেট্রোরেল আনতে হবে, ঢাকার চারপাশে স্যাটেলাইট সিটি করে সহজ ট্রেন যোগাযোগ বাড়াতে হবে। সর্বোপরি ঢাকার জনসংখ্যা বিকেন্দ্রীকরণ করে ছড়িয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ বিকেন্দ্রীকরণ করে সারা দেশে সুষমভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা ছড়িয়ে দিতে হবে।
__._,_.___