ভাষা আন্দোলনের মাস ও খলনায়কের প্রতিকৃতি
শুরু হয়েছে ভাষা আন্দোলনের মাস। আমাদের জাতীয় চেতনার মূল ভিত্তি ভাষা আন্দোলন। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথের 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি তেমনি ভাষা আন্দোলনের অমর সঙ্গীত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি'।
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে মনে পড়ে বঙ্গবিবেক আবুল ফজলের অমর একটি বইয়ের নাম 'একুশ মানে মাথা নত না করা'। অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান একুশের স্পর্ধাকে অত্যন্ত কৌশলে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকে তিলে তিলে দেশভিত্তিক আন্দোলনে রূপ দিয়েছিলেন। এটা খেয়াল করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তাই তিনি ভাষা আন্দোলনের স্পিরিট কনডেম করে জিন্নাহর দ্বি-জাতিতত্ত্বের স্পিরিট প্রয়োগ করতে থাকেন তার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে।
এ কথা অনেকেরই মনে আছে যে, জিয়ার রাজাকার প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ১৯৭৯ সালে সংসদে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষাকে 'বাংলাদেশি ভাষা' বলে বাংলা ভাষার নামকরণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই রাজাকার কি মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার পরামর্শ ছাড়া কথাটি বলেছিলেন? দেশ ভাগ হলেও ভাষা ভাগ হয় না, এ কথা জানা সত্ত্বেও শাহ আজিজ হিন্দু-বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ঘোষণাটি দিয়েছিলেন। রাজাকার প্রধানমন্ত্রীর ওই ঘোষণা একটি ধারাবাহিকতার ফলশ্রæতি। জিয়াউর রহমান সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে কতগুলো স্পর্শকাতর শব্দের পরিবর্তন করেন এবং নতুন শব্দের প্রবর্তন করেন। তিনি 'বাংলাদেশ বেতার' শব্দের পরিবর্তন করে চালু করেন 'রেডিও বাংলাদেশ' 'চালনা বন্দর' পরিবর্তন করে চালু করেন 'পোর্ট অব চালনা' 'জয় বাংলা' স্লোগানের পরিবর্তে চালু করে 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ'-এর পরিবর্তে চালু করেন 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ'। বাংলা ভাষার অভিধান থেকে তিনি 'নিমন্ত্রণ' শব্দটি প্রায় উঠিয়ে দিয়েছিলেন। এর প্রতিবাদ করেছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মালেক উকিল। এ জন্য তার মতো একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় জননেতাকে জিয়ার লোকজনেরা 'ভগবান দাশ' বলে বিদ্রƒপ করেছে।
এ কথা প্রমাণিত সত্য, জিয়া ভাষা আন্দোলনের আত্মদানের উৎসমূল থেকে গড়ে ওঠা মূল্যবোধের বিপরীত-সাম্প্রদায়িক, সংকীর্ণ মূল্যবোধ থেকে তার রাজনীতির ছক বিন্যাস করেছিলেন। যেখানে ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে লেখা আছে যে, বাংলা ও ইংরেজি শব্দের মধ্যে কোনো অর্থগত বিভ্রান্তি দেখা দিলে বাংলা শব্দেরই প্রাধান্য দেয়া হবে। জিয়াউর রহমান তার সামরিক ফরমানে বলেন, তার উল্টো কথা; বলেন ইংরেজি অর্থকে প্রাধ্যান্য দেয়ার কথা।
১৯৭৯ সালের সংসদে দাঁড়িয়ে শাহ আজিজ মহান একুশে ফেব্রুয়ারির পবিত্র দিনে ইংরেজিতে ভাষণ দিয়ে ভাষা শহীদদের অপমান করেছিলেন। একমাত্র ড. মযহারুল ইসলাম এই জঘন্য ধৃষ্টতার বিরোধিতা করেছিলেন। আর কোনো পণ্ডিত সেদিন টুঁ শব্দ করেননি। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা উচ্ছেদ করার পরিকল্পনাই এসেছে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক সেন্টিমেন্ট থেকে। ভাষা আন্দোলন ছিল সর্বতোভাবে ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন সবৈর্বভাবে বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছিল। জিয়াউর রহমান তার ফরমান জারি করে 'বাংলাদেশি' শব্দের আড়ালে ভাষা আন্দোলনের স্পর্ধাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৭২-এ প্রণীত সংবিধানকে তিনি ইসলামিকরণ করে ভাষা আন্দোলনেরই স্পিরিট কবর দিয়েছিলেন। আল্লাহর রাসূল স্ব স্ব মাতৃভাষার মর্যাদা দিয়েছিলেন, দেশপ্রেমের মর্যাদা দিয়েছিলেন। তিনি দশম হিজরির ৮ জিলহজ তার বিদায় হজের ভাষণটি দেন। মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ তার 'বিদায় হজ' প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন মহানবী কীভাবে তার ভাষণটি শুরু করেছিলেন। তিনি বলেছেন, 'নবী প্রথমে আকাশের দিকে চাহিয়া তাহার প্রভুর প্রশংসা ও শোকর গোযারি করিলেন এবং তারপর উদাত্ত কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন…।'
অর্থাৎ মহানবীও 'বিসমিল্লাহ' বলে ভাষণটি শুরু করেননি। মদিনা সনদের প্রারম্ভেও 'বিসমিল্লাহ' লেখা নেই। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ভণ্ডামি থেকে তিনি সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' সংযোজন করেছিলেন। তার কাজই ছিল পলিটিক্সকে ডিফিকাল্ট করা। জাতীয় সংবিধান একটি সর্বজনীন দলিল। সেই দলিলে একটি ধর্মের প্রাধান্যের ঘোষণা লিপিবদ্ধ করা হলে সেই সংবিধান সাম্প্রদায়িক দলিলে রূপান্তরিত হয়। জিয়া সেই কাজটি করেছেন। করেছিলেন ভাষা আন্দোলনের স্পিরিট ধ্বংস করার জন্য। ভাষা আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ বেতারে নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা দিয়ে সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। নানা আলামতেই এটা স্পষ্ট যে, তিনি পরিবেশের চাপে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি অত্যন্ত অল্প সময়ের জন্য সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি অনেক ক্যাম্পে মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়েছিলেন বলেও প্রমাণাদি আছে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু খবর পেয়েছিলেন পাকিস্তান থেকে 'সোয়াত' জাহাজে অস্ত্র আসছে। এই খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রধান মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে লোক মারফত খবর পাঠান যেন চট্টগ্রামে 'সোয়াত' থেকে অস্ত্র না নামানো হয়; জিয়া বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মান্য করেননি। বঙ্গবন্ধু আর জিয়ার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি। এ কথা লেখা আছে ড. রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত 'সম্মুখ সমরে বাঙালি' বইয়ে সংকলিত ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের প্রবন্ধে। আবদুল মতিনের বইতে লেখা আছে জেনারেল ওসমানী জিয়াকে ফায়ারিং স্কোয়াড দিতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের হস্তক্ষেপে তা সম্ভব হয়নি। অথচ ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জিয়ার জ্ঞাতসারেই খন্দকার মোশতাক ডালিম-ফারুকদের কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
'বঙ্গবন্ধুর সরকার অবিভক্ত বাংলার সিভিল সার্জেন্ট ও প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সচিব এ রবকে প্রধান করে জাতীয় পে-কমিশন গঠন করেন। কমিশনকে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বেতনের স্কেল নির্ধারণের পরামর্শ দেয়া হয়। কমিশন তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলকে বুলগেরিয়া, যুগোশ্লাভিয়া ও পূর্ব জার্মানিতে সে দেশের পে-পলিসি সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রেরণ করেন। সে দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন জিয়াউর রহমান। কমিশন পরামর্শ প্রদান করে এভাবে, "ইধহমষধফবংয ংযড়ঁষফ যধাব ঢ়ধু ঢ়ড়ষরপু রহাড়ষারহম ংযধৎরহম ড়ভ যধৎফংযরঢ় রহ ধহ বয়ঁর : ধনষব সধহহবৎ" অথচ এই পে-কমিশনের একজন প্রভাবশালী সদস্যরূপে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর জন্য যে গ্রেডের ও পে-স্কেলের সুপারিশ করেন তা সেনাবাহিনীর মনোভাব আরো বিরূপ হয়ে ওঠে। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর মাথা গরম করার জন্য এই কৌশল গ্রহণ করেছিলেন বলে সেনাবাহিনীর অফিসারদের কেউ কেউ মনে করেন। (অধ্যাপক আবু সাইয়িদ-বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ফ্যাক্টস্ এন্ড ডকুমেন্টস পৃ : ৯৮)
'বঙ্গবন্ধু সরকারের সামনে সেনাপ্রধান করার আরেকটি চয়েস ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর কমান্ডার মেজর (পরে জেনারেল) জিয়াউর রহমান। তার সম্পর্কে মন্ত্রিসভায় তীব্র মতবিরোধ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে নিজেকে হঠাৎ 'রাষ্ট্রপ্রধান' ঘোষণা, যুদ্ধের সময় জেনারেল ওসমানীকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে অপসারণের চক্রান্ত, সর্বোপরি যুুদ্ধের সময় তার অদক্ষতা ও ব্যর্থতার জন্য মুজিবনগর সরকার কর্তৃক কার্যত জেডফোর্স ভেঙে দেয়া ইত্যাদি কারণে সেনাপ্রধান পদে তার নিয়োগ ওসমানী এবং তাজউদ্দীন আহমদ দুজনেরই ঘোর অসম্মতি ছিল।' (আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী- বাংলাদেশ ও সেনাবাহিনী পৃ : ১৫)।
জিয়াউর রহমানের উচ্চাভিলাষ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ নেতারা সচেতন ছিলেন। জেনারেল ওসমানীও সন্দিহান ছিলেন। এ সময় জিয়াকে পূর্ব জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এই সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য জিয়া কর্নেল খুরশিদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কাছে সুপারিশ পাঠান। তাতে কাজ হয়নি। এর পর জিয়া কর্নেল হামিদকে ধরে, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েলকে ব্যবহার করে এই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে সক্ষম হন। (কর্নেল হামিদ- তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা)।
'বঙ্গবন্ধু হত্যার ১০ দিন পর উপ সেনাপ্রধান থেকে সেনাপ্রধান, আড়াই মাস পর সেনাপ্রধান এবং ডেপুটি সামরিক আইন প্রশাসক, দেড় বছর পর সেনাপ্রধান এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, স্বরাষ্ট্র, তথ্য ও অর্থমন্ত্রী, সোয়া এক বছর পর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সেনাপ্রধান এবং দুই রকম রাষ্ট্রপতি (হ্যাঁ-না এবং নির্বাচন) কোন মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়? বরং হুবহু মীর কাশিমের।' (মিনা ফারাহ- হিটলার থেকে জিয়া, পৃ : ৬৭)।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী প্রণীত 'পলাশি থেকে ধানমন্ডি' নাটকের ১ম দৃশ্যে, ২৩ পৃষ্ঠায় আছে : 'মুজিব : এই লোকটাকে চিনতে পেরেছেন জনাব?'
সিরাজ : আমি লোকটাকে চিনতে পেরেছি মুজিব, চিনতে পেরেছি। এ লোকটা মীর কাশিম। মীর জাফরের জামাই। আমাকে ভগবানগোলা থেকে অভুক্ত অবস্থায় সে ধরে নিয়ে এসেছিল মুর্শিদাবাদের কারাকক্ষে।'
মুজিব : জনাব, আমি কিন্তু অন্য লোককে দেখতে পাচ্ছি। এ তো মীর কাশিম নয়, আমারই এক সেনাপতি জিয়াউর রহমান।'
মাহমুদুল বাসার : প্রাবন্ধিক, গবেষক।
http://www.bhorerkagoj.net/print-edition/2016/02/03/73610.php
বিএনপির জন্ম যেভাবে সেনানিবাসে: ১
মার্কিন দূতাবাসকে গোপন বৈঠক সম্পর্কে জানাতেন যাদু মিয়া
মিজানুর রহমান খান | তারিখ: ১৯-০৯-২০১০
http://archive.prothom-alo.com/detail/date/2010-09-19/news/94638
বিএনপির জন্ম যেভাবে সেনানিবাসে: ২
জিয়া রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণে যাদু মিয়াকে ব্যবহার করেছিলেন
মিজানুর রহমান খান | তারিখ: ২০-০৯-২০১০
http://archive.prothom-alo.com/detail/date/2010-09-20/news/94920
সেনাছাউনিতে বিএনপির জন্মকে ষড়যন্ত্রমূলক বলেন আইজেনব্রাউন
মিজানুর রহমান খান | তারিখ: ২১-০৯-২০১০
__._,_.___