রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অর্থ চুরি: জনগণ সঠিক তথ্য জানতে চায়
বিদায় ডা: আতিয়ার রহমান। বাংলাদেশে তো পদত্যাগের রেওয়াজ নেই, তবু আপনি দাযিত্ব নিয়ে সরে দাড়িয়েছেন, এজন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। কেন জানি আজ রবি ঠাকুরের দু'টি কবিতার ক'টি পংতি বা লাইন মনে পড়ছে, তা হলো: 'তুমি মহারাজ, সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে'। অথবা, 'রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি'। আক্ষরিক অর্থে কবিতার ওই লাইনগুলোর সাথে ডা: আতিয়ার বা অন্য কারো তেমন কোন সম্পর্ক নেই, বা ডা: আতিয়ার আমার লেখার সাবজেক্ট ন
ন,
তবু ক'টি কথা এসে যায়: ডা: আতিয়ার বলির পাঠা হলেন না তো? বঙ্গবনধু-কে হত্যার আগে যেমন তার হিতাকাংক্ষীদের একে একে তার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিলো, তেমনি করে জননেত্রীর কাছ থেকে তার শুভানুধ্যায়ীদের সরিয়ে দেয়া হচ্ছে কি?
বাংলাদেশের বিশাল রিজার্ভে কারা ভাগ বসাতে সক্ষম? বা, সরকারকে বেকায়দায় ফেলা কারো
উদ্দেশ্য? কোন এক অখ্যাত কবির ভাষায় বলতে হয়, 'মাথায় কত প্রশ্ন আসে দিচ্ছেনা কেউ জবাব তার!' জনগণ সঠিক তথ্য জানতে চায়।
বাংলাদেশে ক'দিন বাদে বাদে গণপিটুনীতে চোরের মৃত্যু সংবাদ আমরা
মিডিয়ায়
দেখি, আমাদের দেশে এ ধরনের সংবাদ বিরল ঘটনা নয়। সব সম্ভবের এক অদ্ভ ুত দেশ বাংলাদেশ, সেখানে সামান্য চুরির জন্যে চোরের প্রাণ গেলেও রাঘব বোয়ালরা ধরা-ছোয়ার বাইরে থাকে। এর কারণ হয়তো, বড় চোররা লুটের মাল শেয়ার করতে জানেন, ছিচকে চোররা সেটা শেখেনি। ছোটবেলায় আমরা 'চোর' রচনা পড়েছিলাম। চোর সেখানে বলছিলো, বেদম মার খাওয়ার পরও তার চোখে একফোটা জল আসেনি, কিন্তু পিতার সাথে ছোট্ট একটি মেয়ে চোর দেখতে এসে যখন বললো, 'বাবা, চোর কোথায়, ও তো মানুষ'! চোরের চোখে তখন জল এসেছিলো। এতকাল পরে এখন মনে হয়, ছোট ছোট চোররা হয়তো অভাবের টানে চুরি করে, তারা হয়তো মানুষই বটে, কিন্তু বড় বড় চোরেরা? তারা কি মানুষ, না অ-মানুষ; তাদের কি সামান্য দেশপ্রেম নাই বা তাদের দেশপ্রেম কি 'দেশী মুরগী'-কে ভালবাসার মত! গল্পটা তাহলে বলেই ফেলি: আমাদের দেশের মানুষ মদ খাবে বিলাতি, শাড়ি কিনবে ভারতীয়, পারফিউম ফ্রান্সের, জিন্স-কেটস পড়বে আমেরিকার কিন্তু মুরগি কিনতে গেলে চাইবে, 'দেশী মুরগী' অর্থাৎ মুরগীর বেলায় তাদের দেশপ্রেমের কোন ঘাটতি থাকেনা! সদ্য শমসের বিন মুসা সুইস ব্যাঙ্কে টাকা রাখা নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। আরে বাবা, উন্নত দেশগুলোতে 'শেয়ারিং ইজ কেয়ারিং' বলে একটি কথা আছে, সম্পদের কিছুটা ভাগ অন্যদের দিলেই তো সব ল্যাটা চুকে যায়! কিন্তু সুরন্জিত সেনগুপ্ত 'সন্দেহের তীর অর্থমন্ত্রীর দিকে' কথাটা বলে ভালো করেননি, শত হলেও নিজ দলের লোক, তাছাড়া ওনার আমলেই আরো কত ব্যাঙ্ক লুট হয়েছে, হাজার কোটি টাকা কোন টাকাই নয় একথাও আমরা শুনেছি, শেয়ার মার্কেট, হলমার্ক-এর কথা না-ই বা তুললাম, তখন তো দাদা আপনি কিছু বলেননি, এখন কেন বলছেন, এখন তো মাত্র ৮০০ কোটি টাকা!
যাকগে, বিষয়টির সুষ্টু তদন্তের মাধ্যমে সুরাহা হওয়া দরকার। অপরাধী ধরা পড়ুক সেটা সবার কাম্য। এ সপ্তাহে ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল বাংলাদেশের অর্থ কেলেঙ্কারী নিয়ে একটি রিপোর্ট ছেপেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইন যেহেতু এঘটনায় পার্টি তারাও সহজে ছাড়বে না। এবার এঘটনা ধামাচাপা দেয়া যাবে বলে মনে হয়না, কারণ ঘটনাটি আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিস্ট। ডিজিটাল পদ্বতির এচুরি যে অন্য দেশে হবেনা তার গ্যারান্টি কোথায়, তাই বাংলাদেশ না চাইলেও এ রহস্যের সমাধা হবে। অবশ্য এবার এ তদন্তে বাংলাদেশ যে আন্তরিক এর কিছু কিছু আলামত দেখা যাচ্ছে। এটাকে যারা অযথা রাজনীতিকরনের চেস্টা করছেন, সেটা বন্ধ হওয়া দরকার। নুতন গভর্নরের নাম অর্থমন্ত্রী এত ত্বরিত ঘোষণা করতে পারলেন কিভাবে সেটাও ভাবার বিষয়, কারণ জনশ্রুতি আছে অর্থমন্ত্রী সাবেক গভর্নরকে ততটা পছন্দ করতেন না! তাছাড়া অর্থমন্ত্রী কি দায় এড়াতে পারেন!
ডা: আতিয়ার-এর বিদায়ে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চোখে জল দেখেছি, যদিও কেন মাস দেড়েক এই ঘটনা ধামাচাপা দেয়া ছিলো এর কোন ব্যাখ্যা আমরা এখনো দেখিনি। উন্নত দেশগুলোতে যেকোন বড় বড় ঘটনার প্রায় সাথে সাথে 'ইনফরমেশন সেল' খোলা হয় এবং সেখান থেকে সঠিক তথ্য জনগণ জানতে পায়। আমাদের দেশে এখনো ঐরকম ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, তাই যে যারমত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, বিশেষত: সোস্যাল মিডিয়ায় একশ্রেনীর অ-মানুষের প্রচরণা দেখলে মনে হবে ভারত ওই টাকাটা ইতিমধ্যে খেয়ে ফেলেছে অথবা এই ঘটনার জন্যে সরকার দায়ী! তবে এ ঘটনায় সংশ্লিস্ট আরো মানুষের কথাবার্তা জানা বা শোনা দরকার। আরো অনেককেই হয়তো মাহফুজ আনামের মত ভুল বা গাফিলতি স্বীকার করতে হবে অথবা ডা: আতিয়ারের মত পদত্যাগ বা গ্রেফতার হতে হবে। তবে অর্থমন্ত্রীর প্রলাপ নয়, সরকারী তরফ থেকে প্রতিদিন এ বিষয়ে বক্তব্য থাকা উচিত, যাতে জনগণ বিভ্রান্ত না হয়।
মাহফুজ আনামের প্রসঙ্গ যখন এলো তখন একটি গল্প বলি: বনের রাস্তার মাঝে এক সিংহ শুয়ে আছে। এক শিয়াল তা দেখে কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করলো, 'হুজুর, রাস্তার মাঝে শুয়ে আছেন যে, শরীর খারাপ'? সিংহ বললো, 'গুলি লেগেছে, উঠতে পারছিনা।' শিয়াল সুযোগ বুঝে তখন লাফ দিয়ে উঠে বলে, 'রাস্তা কি তোর বাপের যে মধ্যখানে শুয়ে থাকবি, উঠ, ভাগ।' গল্পটি পার্থ প্রতীম মজুমদারের থেকে ধার নেয়া, তবে সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে অগুনতি মামলা দেখে আমার কেন জানি এগল্প মনে এলো। কোন এক মনীষী বলেছিলেন যে, জীবনে পরাজয়কে যেমন মেনে নিতে হয়, ভুলকেও তেমনি সাহসের সাথে স্বীকার করতে হয়। জীবনের পথে ভুলগুলো স্বীকারে সৎ সাহস চাই। ডা: আতিয়ার রহমান ও মাহফুজ আনাম তা দেখিয়েছেন। তাদের ভুলের খেসারত হয়তো দেশ বা বরেন্য ব্যক্তিবর্গকে দিতে হয়েছে, কিন্তু তারাও তো এর প্রায়:শ্চিত করছেন। আমাদের দেশের রাজনীতিকরা কি অসংখ্য ভুল করেননি? তারা কি তাদের ভুলগুলো স্বীকার করবেন? একজন ব্যাঙ্কার বা সাংবাদিক সেই সৎসাহস দেখালেও কোন রাজনীতিক এখনো তা দেখাতে পারেননি। মন্ত্রীদের তো আমরা পদত্যাগ করতে দেখিনা, যদিও কেটে পরার মত ঘটনার তো অভাব কখনই ছিলোনা, বা এখনো নেই!
আমাদের দেশে রাজনীতিকরা দাযিত্ব নেন না, মন্ত্রীরা সব দায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর দিয়ে বসে থাকেন! অথচ প্রতিটি বড় ঘটনার সাথে রাজনীতিকরা জড়িত থাকেন, সেটা প্রকাশ্যে বা পেছন থেকে। ১/১১-তে যেমন রাজনীতিকরা জড়িত, বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক, হলমার্ক, শেয়ার মার্কেট ও অন্যান্য কেলেঙ্কারীতেও নিশ্চিতভাবে রাজনীতিকরা সংশ্লিষ্ট। একজন গৃহকর্তার ভুলে একটি পরিবার গোল্লায় যায়, কিন্তু একজন
নেতার
ভুলে একটি দেশ ও সমাজ ডুবে যায়। দেশে আজকে যে অর্থ লোপাট বা মৌলবাদী তান্ডব এজন্যে অনেকাংশে রাজনীতিকরা দায়ী, তারা এই দাযিত্ব নেবেন না? পাঠক, আমি ১০০% রাজনীতিকদের পক্ষে। রাজনীতিকরাই একটি দেশকে এগিয়ে নেয় বা ডুবিয়ে দেয়। অন্য কেউ বা কোন বাহিনী নয়। জাতির জনক বঙ্গবনধু শেখ মুজিব একজন রাজনীতিক, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছিলেন। ১৭ই মার্চ জাতির জনকের জন্মদিন সদ্য পালিত হলো, তাকে মরণোত্তর জন্মদিনের শুভেচ্ছা। আবার খুনী মুশতাক বা জিয়া দু'জনেই রাজনীতিক, দু'জনই মীরজাফর। ১/১১ যারা ঘটিয়েছেন, তারা রাজনীতিক ছিলেন না, তারা ভুল করেছেন। আজকাল অনেকেই ১/১১-এর কুশলিবদের বিচারের কথা বলেন, এমনটা হলে কি লোম বাছতে কম্বল উজার হয়ে যাবেনা? আসলে আমাদের দেশে রাজনীতি নেই বা একটি রাজনৈতিক সিস্টেম গড়ে ওঠেনি বলেই ১/১১ বা অলিক তত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গ বারবার আসে। মার্কিন মুলুকে এটা নির্বাচনী বছর, ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন অনেক উল্টাপাল্টা বলছেন, তিনি নির্বাচিত হলে ওসব ভুলে যেতে হবে, কারণ তাকেও একটি শক্ত সিস্টেমের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে, যেমনটা যেতে হচ্ছে নরেন্দ্র মোদীকে, ভুলে যেতে হচ্ছে তার অনেক নির্বাচনী ওয়াদা! কাজেই, সবকিছু হবে যদি সিস্টেম থাকে, তাই সিস্টেম চাই। সিস্টেম থাকলে ব্যাংক লুট করে যেমন কেউ পার পাবেন না, তেমনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের টাকা
মেরে দেয়ার
কথা কেউ চিন্তাও করবেন
না। শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
নিউইয়র্ক। ১৯শে মার্চ ২০১৬।
__._,_.___