মসজিদের টাকায় সুদের ব্যবসা করতেন মুয়াজ্জিন শফিকুল বারী পুরান ঢাকার ইসলামপুরের ঝব্বু খানম জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন বেলাল হোসেনকে (৫৭) মসজিদের নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক লেনদেন, ভাগবাটোয়ারা ও মুয়াজ্জিনের পদ পাওয়ার জন্যই হত্যা করা হয়েছে। আর এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বেলাল হোসেনের সহকর্মী ও বন্ধুরা বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ঘটনায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা অভিযান চালিয়ে ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা হলেন- মূল আসামি খাদেম মো. হাবিবুর রহমান (২০), সহকারী মুয়াজ্জিন মো. মোশারফ হোসেন (১৯), হাফেজ তফাজ্জল হোসেন (২৩) ও বেলালের বন্ধু সারোয়ার হালিম (৩৮)। তবে এ ঘটনায় আরো একজন জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। গ্রেফতারকৃত আসামিদেরকে গতকাল আদালতে পাঠিয়ে তিনদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) পারভেজ হোসেন মানবকণ্ঠকে বলেন, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, মূলত মুয়াজ্জিনের পদ পাওয়া ও মসজিদের আয়ের টাকা লেন-দেন ও ভাগবাটোয়ারার কারণেই মুয়াজ্জিন বেলাল হোসেনকে হত্যা করা হয়। এর আগেও তাকে দু'বার হত্যার চেষ্টা হয় তবে ভাগ্যগুণে বেচে যান তিনি। হত্যাকাণ্ডের পরপরই সন্দেহভাজন হিসেবে সরোয়ারকে আটক করা হয়। জড়িতদের গ্রেফতারে ১৭ এপ্রিল থেকে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হয়। গত সোমবার রাতে নেত্রকোনার গ্রামের বাড়ি থেকে দ্বিতীয় মুয়াজ্জিন মোশারফ হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্যে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে তোফাজ্জাল ও মঙ্গলবার রাতে নড়াইল থেকে হাবিবকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি আরো জানান, মসজিদের নিয়ন্ত্রণ ও টাকার ভাগ পাওয়ার লোভে খাদেম হাবিবের প্ররোচনা ও পরিকল্পনায় বেলালকে হত্যা করা হয়। খাদেম হাবিব ও দ্বিতীয় মুয়াজ্জিন মোশাররফ মসজিদে বেলালের একক আধিপত্য মেনে নিতে পারছিলেন না। এ কারণেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের দু'মাস আগে হাবিব, মোশারফ ও তোফাজ্জল দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের একটি মসজিদে বসে বেলালকে হত্যার প্রাথমিক পরিকল্পনা করেন। জিজ্ঞাসাবাদে মোশারফ ঘটনাস্থলে ছিলেন না দাবি করলেও তার কাছ থেকেই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে। জিজ্ঞাসাবাদে মোশারফ জানায়, ছয় হাজার টাকা মাসিক বেতনে তিনি ৬ মাস আগে ওই মসজিদে চাকরি নেন। ঘটনার সময় তিনি মসজিদের ৩ তলায় নিজের কক্ষে ছিলেন। তবে তিনি বেলালের আর্তচিত্কার শুনেছিলেন। আর ৫ হাজার টাকা বেতনে তিন বছর যাবত হাবিব খাদেম হিসেবে কাজ করছেন। হাবিব খাদেমের কাজ করলেও হবিব, বেলাল ও মোশারফকে স্থানীয় লোকজন মুয়াজ্জিন হিসেবে চিনতো। তবে পড়া-লেখা শেষ না করায় হাবিব কখনও প্রধান মুয়াজ্জিন হতে পারবেন না বলে তার মধ্যে হতাশা ছিল। তদন্ত কর্মকর্তা পারভেজ জানান, মোশারফ ও হাবিবের সঙ্গে বেলালের ধর্মীয় মতাদর্শেরও বিরোধ ছিল। তবে অর্থ ও ক্ষমতার লোভই এ হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ। বেলালকে হত্যা করতে পারলে মোশারফকে মুয়াজ্জিন বানানো হবে। আর মসজিদের আয়ের টাকা তারা ভাগ করে নেবেন। এমন লোভ দেখানোর পরই মোশারফ ওই পরিকল্পনায় রাজি হন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। অপরদিকে মসজিদের ৩৩টি দোকান থেকে ভাড়া বাবদ প্রতিমাসে ৪২ হাজার টাকা ও দানবাক্সের টাকা থেকে মসজিদের কর্মীদের বেতন দিতেন বেলাল। বাকি টাকা তিনি নিজের একাউন্টে জামা রাখতেন ও কিছু টাকা সুদে ব্যবসায় খাটাতেন। বেলাল এমনভাবেই ৬ লাখ ৭ হাজার টাকা বন্ধু সরোয়ারকে দেয় বলে বেলালের ব্যক্তিগত একটি খাতার হিসবে পাওয়া গেছে বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তা। আর বেলালকে হত্যা করা হলে এই টাকা আর দিতে হবে না বলে সরোয়ারও এ হত্যা পরিকল্পনায় যোগ দেয়। এই ৪ জন ছাড়াও এই হত্যা পরিকল্পনায় আরো একজন জড়িত বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তা। তবে তদন্তের স্বার্থে ও গ্রেফতারের আগে তার পরিচয় জানাতে রাজি হননি তিনি। এদিকে মহানগর পুলিশের লালবাগ জোনের উপকমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ এই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে জানান, হত্যাকাণ্ডের দু'মাস আগে আসামিদের পরিকল্পনা মতে খাদেম হাবিব চকবাজার থেকে ধারালো চাকু কিনে আনেন। পরিচয় গোপন রাখার জন্য মুখোশও কিনে আনেন। হত্যাকাণ্ডের দু'দিন আগে হাবিব ছুটি নিয়ে নিজ গ্রামের বাড়ি নড়াইলের নাড়াগাতিতে চলে যান। কিন্তু হত্যার পরিকল্পনা অনুযায়ী একদিন পরই তিনি ঢাকায় ফিরে এসে কেরানীগঞ্জে অবস্থান নেন। ঘটনার রাতে হাবিব গোপনে ঝব্বু মসজিদে এসে দেখেন বেলাল বাইরে আছেন। তিনি বেলালের অপেক্ষায় থাকেন। রাত ১১টার দিকে বেলাল ফিরে আসেন। হাবিব তার সঙ্গে সিড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠেন। দোতলায় ওজু শেষে তিন তলায় যাওয়ার সময় সিঁড়ির মধ্যে বেলালকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে হবিব। বেলালকে খুনের পর হাবিব তার পকেট থেকে ৬ হাজার টাকা, মোবাইল ফোন ও ঘরের চাবি নিয়ে নেন। এরপর তিন তলায় ওঠে মোশরফকে ২ হাজার টাকা দিয়ে পালিয়ে যান তিনি। যাওয়ার সময় বাবুবাজারের একটি ড্রেনে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা ছুরিটি তিনি ফেলে দেন। প্রসঙ্গত, গত ২৮ বছর ধরে বেলাল পুরান ঢাকার ইসলামপুরের ঝব্বু খানম জামে মসজিদে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। গত ৪ এপ্রিল মসজিদের সিঁড়িতে তার রক্তাক্ত লাশ পাওয়া যায়। ওই সময় তার বুকে তিনটি এবং পিঠে ও হাতে আরো দু'টি ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। তবে মসজিদের তিন তলায় তিনি যে কক্ষে থাকতেন সেটি তালাবন্ধ ছিল। মানবকণ্ঠ/এসবি/জেডএইচ |
__._,_.___