নাস্তিক আখ্যা দিয়ে হত্যা
আমাদের সময়.কম
দীপক চৌধুরী : নাস্তিক আখ্যা দিয়ে হত্যার ঘটনায় নানামুখী চাপে পড়েছে পুলিশ ও র্যাব। প্রশিক্ষিত জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিলেও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর দৃশ্যমান তৎপরতা চোখে পড়ছে না। একের পর এক টার্গেট কিলিং বাস্তবায়ন করে প্রকৃত খুনিরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। দেশের এ বিষয়গুলো এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোচিত হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, গত তিন বছরে চাপাতি ও অস্ত্র ব্যবহার করে বেশ কয়েকটি হামলা-খুনের ঘটনা ঘটেছে। উগ্রপন্থিদের চাপাতিতে প্রাণ গেছে ১৪ জনের। ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে এ সহিংসতা শুরু হয়। এগুলোর মধ্যে শুধু একটির ক্ষেত্রে ঘটনাস্থল থেকে হাতেনাতে এক উগ্রপন্থিকে আটক করা হয়। ২০১৫ সালে তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যার ঘটনায় হিজড়ারা ঘাতক দলের একজনকে ধরে ফেলেন। অন্য ঘটনাগুলোয় হামলাকারীরা নির্বিঘেœ পালিয়ে যায়।
এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত ঘটনা জুলহাজ মান্নান, মাহবুব তনয় হত্যা। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর অন্যরবম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এই জোড়াখুনের ঘটনায় কিছু ক্লু পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি এও বলেছেন, আশা করি অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হবে। গত বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৪ মিনিটে টেলিফোন করে জন কেরি ওই হত্যাকা-ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কুশল বিনিময়ের পরে জন কেরি বলেন, জুলহাস মান্নান ছিলেন তাদের সহকর্মী। অবশ্য কলাবাগানের হত্যাকা-ের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে উদ্বেগ প্রকাশ করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওরায়দুল কাদের।
গতকাল গাজীপুরে এক অনুষ্ঠানে সেতুমন্ত্রী আরো বলেন, তার দেশেও হত্যাকা- হচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় ঘরে ঢুকে বাংলাদেশী এক দম্পতিকে হত্যা করলেও এ ব্যাপারে তার মাথা ব্যাথা নেই। অথচ বাংলাদেশের কলাবাগানে একটি হত্যাকা- নিয়ে স্টেটমেন্ট দিচ্ছেন, (আমাদের) প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করছেন।
টেলিফোনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বলেছেন, তারা আমাদের সহযোগিতার কথা বলেছেন। আমাদের কাজ আমরা করবো। সরকার কোনো চাপ অনুভব করছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আওয়ামী লীগ নেতা ও সরকারের মন্ত্রী বলেছেন, নাস্তিক আখ্যা দিয়ে একের পর এক হত্যা করে চলেছে ঘাতকরাÑ এটি ভয়ঙ্কর বিষয়। এ ক্ষেত্রে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের তৎপরতায় সরকার অসন্তুষ্ট। এসব হত্যাকা-ের ব্যাপারে 'আমরা' কঠোর তা প্রমাণ করতে পারছি কোথায়? আর এ কারণেই অনেকে তাদের স্বার্থে সুযোগ নেবে।
গত সোমবার কলাবাগানের উত্তর ধানমন্ডির ৩৫ নম্বর বাসায় ঢুকে জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুবকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। জুলহাজ যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডিতে চাকরি করতেন। আর তার বন্ধু মাহবুব একজন নাট্যকর্মী। নৃশংস এই ঘটনায় শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র খবর রাখছে এবং নানারকম পরামর্শ দিচ্ছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বের হয়ে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ সরকার ও পুলিশের পক্ষে সাম্প্রতিক হত্যাকা-গুলো রোধ করা সম্ভব নয়। এসব হত্যাকা- তদন্তে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) সম্প্রতি লিখিতভাবে ঢাকা মহানগর পুলিশকে প্রস্তাব করেছে, জুলহাজ মান্নান ও নাট্যকর্মী মাহবুব তনয় হত্যা মামলার তদন্তে সহায়তা করতে আগ্রহী তারা। কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সংশিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ নিয়ে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও করেছেন তাদের প্রতিনিধিরা। এ বৈঠকে তথ্যবিনিময়ও করেছেন তারা। পুলিশের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র এ কথা জানায়। এদিকে পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানাচ্ছেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জোড়া খুনে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা যাবে। এরই মধ্যে সম্ভাব্য কিছু জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা আলামতের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে।
এই জোড়া খুনের ঘটনায় জড়িতদের দুজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ দাবি করেন এবং শিগগিরই এদের গ্রেফতার করা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। তবে এই দুজনের নাম-পরিচয় এবং তারা কোনো সাংগঠনের সদস্য কি না, সে বিষয়ে পুলিশ কিছু বলেনি।
গত বুধবার সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াও এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেন, জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয়কে হত্যার ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও আলামত পাওয়া গেছে।
গুরুত্বপূর্ণ কোনো মামলায়ই কোনোরকম তদন্তে অগ্রগতি নেই। বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক অভিজিৎ রায় ও প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলার তদন্তে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এ দুই ঘটনায় খুনিরা এখনো ধরা পড়েনি। এমনকি ফয়সল হত্যাকা-ে জড়িত কাউকে শনাক্তও করতে পারেনি পুলিশ।
মামলা দুটির এ অবস্থায় বুধবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, অভিজিৎ ও ফয়সলের হত্যাকারীদের 'দু-একজন' দেশের বাইরে চলে গেছে। সকালে ডিএমপি সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, 'অভিজিৎ হত্যা মামলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। কারা খুন করেছে সেই নাম-ঠিকানা আমরা পেয়েছি। কেউ কেউ হয়তো গ্রেফতার হয়েছে। অনেককে হয়তো গ্রেফতার করতে পারিনি। ইতিমধ্যে আবার দু-একজন বাংলাদেশের বাইরে চলে গেছে।
ডিএমপির কমিশনারের এমন বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অভিজিৎ রায়ের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায়। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, হত্যাকারীরা দেশের বাইরে চলে গেছে, আর উনি পুলিশ (ডিএমপি) প্রধান হয়ে বসে আছেন। আসামিরা দশের বাইরে কী করে গেল? জানলেন কী করে, কোন সূত্র ধরে?
সম্পাদনা : সুমন ইসলাম
http://www.amadershomoys.com/unicode/2016/04/30/103133.htm#.Vyju8NQrJrE
__._,_.___