ঈদের দিন জঙ্গি হামলায় গুলিতে নিহত ঝর্ণা রানী ভৌমিককে (৪০) শহীদ ঘোষণা করার জন্য স্বজনরা সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। ঝর্ণার স্বামী গৌরাঙ্গনাথ ভৌমিকের ফুফাত ভাই মুক্তিযোদ্ধা মাধব গোবিন্দ দাস জানান, জঙ্গিরা দেশের শত্রু, দেশদ্রোহী। তাদের হামলায় ঝর্ণা ভৌমিক যে নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন, তাকে শহীদ ঘোষণা করার জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই। শুক্রবার দুপুরে আলাপকালে তিনি এ প্রতিনিধিকে বলেন, 'ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার প্রথম দিনই মরদেহের সৎকারের জন্য নগদ ২০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছেন। শুক্রবার শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু, কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের এমপি রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের এমপি আফজাল হোসেন ও কিশোরগঞ্জ-২ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট সোহরাব উদ্দিন এসে আরও এক লাখ টাকা অনুদানের ঘোষণা দিয়ে গেছেন। শুধু টাকা দিয়েই কি দায়িত্ব শেষ। সরকারের কাছে আমার বৌদিকে শহীদ ঘোষণা করার দাবি জানাচ্ছি'।মুসলমানদের জন্য ঈদুল ফিতর বছরের সেরা উৎসবের উপলক্ষ হলেও শোলাকিয়া ঈদগার আশপাশের হিন্দু পরিবারগুলোও সেই আনন্দ ভাগ করে নেয়। ঈদগায় আসা দূর-দূরান্তের মুসলি্লদের জন্য তারা খাবার পানি নিয়ে রাস্তায় বসে থাকেন। সেদিন এসব পরিবারেও একটু ভালো খাবার, একটু সেমাই-লুচি তৈরির ব্যস্ততা পড়ে যায়। নিহত ঝর্ণা ভৌমিকের বড় ছেলে প্রভাষক বাসুদেব ভৌমিক বলেন, 'ঈদের ছুটিতে তিনি ঢাকা থেকে বাড়ি এসেছিলেন। প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদের দিন শোলাকিয়া ঈদগা সংলগ্ন তাদের বাসায় চলে সেমাই রান্না আর লুচি ভাজার প্রস্তুতি। সকালে মায়ের সেমাই রান্না শেষ। লুচি ভাজার জন্য চুলোয় কড়াইয়ের তেলও গরম হয়ে আছে। বাবা গৌরাঙ্গ নাথ ভৌমিক আর ছোটভাই শুভনাথসহ আমরা তিনজনই ঘরে অপেক্ষায় আছি কখন মা সেমাই আর লুচির থালা নিয়ে আমাদের মুখের কাছে তুলে ধরবেন। লুচি বানিয়ে সেগুলো কড়াইয়ে ছাড়ার প্রস্তুতি মা। এমন সময় শুরু হয়ে গেছে গোলাগুলি। ঘরের জানালা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মা আমাদের বললেন মেঝেতে শুয়ে পড়তে। মাও খাটে বসা ছিলেন। তিনিও দাঁড়িয়েছেন মেঝেতে এসে শুয়ে পড়বেন বলে। এমন সময় জানালার টিন ভেদ করে একটি গুলি এসে লাগল মায়ের মাথার পেছন দিকে। মা পড়ে গেলেন। গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে। চারিদিকে এত গুলি, মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাব সেই উপায়ও ছিল না। ঘরের মধ্যেই মারা গেলেন মা। ঢাকায় থাকলে আমার মা প্রতিদিন ফোন করতেন ভালো আছি কিনা, সাবধানে যেন থাকি। এখন কে ফোন করবে।' এসব কথা বলেই প্রভাষক বাসুদেব কাঁদতে থাকেন। ঘাতকরা কেড়ে নিল গোটা পরিবারের আনন্দ আর শান্তি। ঝর্ণার মৃত্যু একজনের মৃত্যু কেবল নয়, যেন গোটা পরিবারের বাঁধনকে তছনছ করে দিয়ে গেল।ঝর্ণার স্বামী গৌরাঙ্গনাথ ভৌমিক (৬০) শহরের সুবোধ বিড়ি ফ্যাক্টরির স্বল্প বেতনের কর্মচারী। তিনি আগে বিয়ে করেছিলেন টাঙ্গাইলের মেয়ে মিনু ভৌমিককে। তার প্রথম সন্তান বাসুদেবের পর ১৬ বছর আগে দ্বিতীয় সন্তান প্রীতিলতা ভৌমিকের জন্মের সময় সদর হাসপাতালে তিনি মারা যান। ছোট ছোট সন্তান কীভাবে সামলাবেন। সংসারই বা দেখবে কে। অবশেষে গৌরাঙ্গ ভৌমিক সদর উপজেলার নীলগঞ্জের মেয়ে ঝর্ণা ভৌমিককে বিয়ে করলেন। ঝর্ণা সৎমা হলেও প্রথম সংসারের ছেলে বাসুদেব ও মেয়ে প্রীতিলতাকে সবসময় বুকে আগলে রেখেছেন। কখনো তাদের বুঝতে দেননি যে, তাদের মা নেই। ঝর্ণাই তাদের গর্ভধারিণী মা হয়ে উঠলেন। বাসুদেব আর প্রীতিলতাও নিজেদের মায়ের অভাব ভুলে গিয়ে ঝর্ণাকেই তাদের সোহাগিনী মা হিসেবে গ্রহণ করলেন। তবে ঝর্ণা ভৌমিকের গর্ভেও জন্ম নিয়েছে শুভনাথ ভৌমিক নামে এক ছেলে। সে এখন আজিমউদ্দিন হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে।বাসুদেব ভৌমিক বর্তমানে ঢাকার তেজগাঁ মহিলা কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক। প্রীতিলতারও বিয়ে হয়ে গেছে। বাসুদেব কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমি থাকব ঢাকায়। বাবা থাকবেন কর্মস্থলে। ছোটভাই শুভ একা কীভাবে বাসায় থাকবে। ওকে প্রতিদিন মা স্কুলে যাবার জন্য প্রস্তুত করে দিতেন। এখন তাকে কে স্কুলে যেতে তাগিদ দেবেন, খাইয়ে দেবেন। আমাদের সংসারটা তছনছ হয়ে গেল, বললেন বাসুদেব। তবে শুভর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কিছু একটা করা উচিত বলে স্বজনরা দাবি জানান।ঝর্ণা ভৌমিকের ময়নাতদন্ত শুক্রবার সম্পন্ন করে ওইদিন রাতেই পার্শ্ববর্তী সাহাপাড়া শ্মশানে সৎকার করা হয়েছে বলে পরিবার জানিয়েছে।
http://www.thedailysangbad.com/first-page/2016/07/10/73450
ঢাকা, রোববার ২৬ আষাঢ় ১৪২৩, ৪ শাওয়াল ১৪৩৭ , ১০ জুলাই ২০১৬
তছনছ ঝরনা রানীর সুখের সংসার
শোলাকিয়া হামলায় যে ভাবে নিহত হন ঝর্ণা রানী ভৌমিক
আমার মাকে এভাবে মরতে হল কেন? | প্রথম পাতা | The Daily Ittefaq
__._,_.___