http://www.bhorerkagoj.net/
print-edition/2016/11/19/ 117011.php নাসিরনগরের আগুন আমেরিকায় লাগলে কি ট্রাম্পকে খুব বেশি দায়ী করা যাবে?
বুধবার নাসিরনগরে আবার হিন্দুর বাড়িতে আগুন লেগেছে। এতে এক বৃদ্ধা মারা গেছেন। আসলে আগুন এখন শুধু ঘরে লাগেনা, লাগে হিন্দুর বুকে। বারবার নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, ভিকটিম বিচার পাচ্ছেনা, অপরাধী বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হিন্দুর বুকের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। এবার তাই নাসিরনগর অভিমুখে লংমার্চের ডাক এসেছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, সংখ্যালঘুর ওপর হামলার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দাদা যথার্থ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত দরকার। তিনি ব্যর্থ হলে, উন্নয়ন,সম্প্রীতি ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। সাম্প্রদায়িকতা রুখতে না পারলে জঙ্গীবাদ প্রতিহত করা যাবেনা, কারণ একটির সাথে অন্যটি সম্পৃক্ত। নাসিরনগরে চতুর্থ দফা হামলার পর আর কি কোন হিন্দুর বাড়ি বাকি আছে? হিন্দুরা ভাঙ্গা মন নিয়ে ভাঙ্গা প্রতিমা তিতাস নদীতে বিসর্জন দিয়েছে। লক্ষণ ভালো নয়!
ভার্জিনিয়ার একটি শহরের মেয়র মঙ্গলবার (১৫নভেম্বর) পদত্যাগ করেছেন। তার অপরাধ, তিনি ফেইসবুকে ফার্স্টলেডী মিশেল ওবামার বিরুদ্ধে 'রেসিয়াল' মন্তব্য করেছেন। ইমরান এইচ সরকার বলেছেন, "মন্ত্রী মালাউন গালি দিয়ে কিভাবে মন্ত্রী থাকেন বুঝিনা; তবে বিএনপি-জামাত বললে খবর আছিলো"। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জনাব সায়েদুল হক মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন, 'মালাউনের বাচ্চারা বেশি বাড়াবাড়ি করছে'। নাসিরনগরের ঘটনাকে তিনি 'তুচ্ছ ঘটনা' বলে মন্তব্য করেছেন, প্রেসকেও ছাড়েননি। আমাদের আর এক প্রিয় মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর কোন দোষ খুঁজে পাননি! নারায়ণগঞ্জে সেলিম ওসমানেরও কোন দোষ তদন্ত কমিটি খুঁজে পায়নি। আসলে সব দোষ নন্দ ঘোষ নাসিরনগরের জলপুত্র রসরাজ দাস এবং নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল ভক্তের বা এককথায় হিন্দুর।
ঢাকার মেয়র মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানের নাম সবারই জানার কথা। তার পরিচিতি ছিলো 'থিপ অব বাগদাদ' হিসাবে। আশির দশকে ঢাকার রাস্তায় 'মাহমুদুল হাসানের চরিত্র ফুলের মত পবিত্র' দেয়াল লিখনটি সবার চোখে পড়েছে। ওই জেনারেলের মত মন্ত্রী সায়েদুল হক বা সাংসদ নাসিম ওসমান আসলে 'ফেরেস্তার' মত ভালো মানুষ; 'মালাউনরা' শুধু শুধু এদের চরিত্রে কলংক লেপন করছে। 'মালাউন' শব্দটির অর্থ 'অভিশপ্ত'। দিনাজপুরের চিরির বন্দর; চট্টগ্রামের নন্দীরহাট, বাঁশখালী; যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর; ফেনীর জেলেপাড়া, পাবনার সাঁথিয়া; বগুড়া; ঠাকুরগাঁও; সাতক্ষীরা হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং প্রায় একই সময়ে সাঁওতাল পল্লীতে আগুন কি প্রমান করেনা যে হিন্দুরা আসলেই অভিশপ্ত? বাংলাদেশে জন্মই তাদের আজন্ম পাপ?
পত্রিকায় দেখলাম নাসিরনগর ঘটনায় মন্ত্রীসভার আইনশৃঙ্খলা কমিটি ক্ষুব্দ হয়েছেন। হিন্দুর বাপের ভাগ্য যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনার নয়দিন পর নাসিরনগর পরিদর্শন করেছেন। আমরা দেখলাম, দুপুরে ওসি বদল, রাতে পুনর্বহাল। নাসিরনগর ও গোলাপগঞ্জের ঘটনায় বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী আন্দোলন হলো, কিন্তু সংসদে যে ১৪জন হিন্দু এমপি আছেন, তাদের কোন কথা শুনলাম না! একমাত্র ব্যতিক্রম সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, তিনি বলেছেন, হিন্দু খেদাতে সব সরকারই ঐক্যবদ্ধ। এই মুখপোড়া স্বভাবের জন্যে দাদার আর উন্নতি হলোনা। আমরা জানিনা, কোথায় গয়েশ্বর, গৌতম চক্রবর্তী বা নিতাইবাবু? নাসিরনগরে যখন
শ্লোগান উঠলো, 'ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, মালাউনের ফাঁসি চাই'-এরমধ্যে ওনারা পড়েন কিনা কেজানে?
ওই শ্লোগান সম্বলিত ভিডিও ফুটেজ আমি দেখেছি। কাউকে চিনতে পারিনি। আমার আর দোষ কি বলুন, স্থানীয় পুলিশ যখন ওদের চিনতে পারেনা, সিকি শতাব্দী দেশের বাইরে থেকে আমি চিনবো কিকরে? আগুন লাগলো, নিভলো, লুটপাট হলো, মন্দির ভাঙলো, পুলিশ কিছু দেখলো না, কাউকে ধরতে পারলোনা। 'একটা একটা মালু ধর, ধইরা বস্তায় ভর'-শ্লোগান ৫৭ ধারায় পড়েনা। রসরাজ দাস জলপুত্র, পেশায় জেলে। ফটোশপ, আপলোড, ইন্ধন, হামলা সবই করলো কট্টর কিছু মুসলমান; ক্ষতিগ্রস্থ হলো হিন্দুরা। পাবনার মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জহুরুল ইসলামকে হিন্দুধর্ম নিয়ে কটূক্তি করায় আটক করা হয়েছিলো। একইদিন তাকে ছেড়েও দেয়া হয়। কারণ তিনি বলেছেন, তার ফেইসবুক আইডি হ্যাক হয়েছিলো। ভালো কথা। একই নিয়ম রসরাজের জন্যে প্রযোজ্য হচ্ছেনা কেন?
শাহরিয়ার কবির বলেছেন, রসরাজ নির্দোষ, রসরাজের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। প্রশ্ন ওঠে, নাসিরনগরের রসরাজ এখনো জেলে কেন? রামুর নিরপরাধ উত্তমকেও কিন্তু একইভাবে আটকে রাখা হয়েছিলো, এখন উত্তম কোথায়? কেউ কি তার সন্ধান জানেন? রসরাজ যে নির্দোষ, তা প্রমান করা কি সরকারের জন্যে খুবই কঠিন? এদিকে পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য বলেছেন, প্রতিটি দল নিজেদের স্বার্থে হিন্দুদের বলি দিয়েছে। ডাক্তার জোবাইদা রহমান নাসিরনগর ঘটনার ঘটার পরপরই তার ফেইসবুকে লিখেছেন, "জেগে উঠেছেন বাংলাদেশের মুসলমান। বাংলার মাটিতে কোন মুশফিক, কাফের, মালাউন, আমাদের এবং আমাদের কাবা শরীফ নিয়ে---" ইত্যাদি। মনে প্রশ্ন জাগে 'সব রসুনের গোঁড়া কি একই?
সাম্প্রদায়িকতা এখন বাংলাদেশে একটি উন্নত শিল্প। এক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী সায়েদুল হক তিনদিন পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি নাহয় 'রাগের মাথায় 'মালাউন' বলেছেন, তাতে কি? অন্যরা গোপনে বলেন, উনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, এইযা। হজ্ব নিয়ে কথা বলায় লতিফ সিদ্দিকীর চাকুরী গেছে, উনি জেল খেটেছেন, তাই বলে হিন্দুরে গালি দিলে প্রতিমন্ত্রীর চাকুরী যাবে কেন? হিন্দু তো মালাউন! একটি পত্রিকায় দেখলাম, দাবি উঠেছে,'সার্বজনীন মুর্ক্তিভাঙ্গা দিবস চাই'। এমনিতে দেশে প্রতিদিনই মুর্ক্তি ভাঙ্গছে, দিবসটি সার্বজনীন হলে সবাই মিলে একসঙ্গে 'ছোয়াব' কামানো যেতো। হেফাজত বলেছে, নাসিরনগরের হামলাকারীরা প্রকৃত মুসলমান না। কে যে প্রকৃত আর কে অতিপ্রাকৃত তা বুঝতে বুঝতে দেশ হিন্দুশূন্য হয়ে যাচ্ছে। এই গান আর কতকাল শোনাবেন?
জুনাইদ বাবুনগরী বলেছেন, ইসলাম কোন সন্রাসী হামলা, বাড়িঘরে আগুন দেয়া, উগ্রবাদ সমর্থন করেনা। সেটা নাহয় বুঝলাম, কিন্তু শাহবাগ চত্বর, পল্টনে ধ্বংসযজ্ঞ, কোরানে আগুন এগুলো কি ইহুদিরা এসে করেছিলো? মসজিদে লক্ষ্মীমুর্ক্তি পাওয়ার সংবাদে একজন বলেছেন, 'কোন মুসলমান মসজিদে মুর্ক্তি নিতে পারেনা। তাইতো, মুসলমান কেন মসজিদে মুর্ক্তি নেবে? তাহলে তিনি গেলেন কিকরে? হিন্দুরা বলে, লক্ষ্মী জাগ্রত, উনি হয়তো হেঁটে হেঁটে নিরাপদস্থান মসজিদে ঢুকে গেছেন। একটি টিভিতে বলা হয়েছে, তিতাস নদীতে সারারাত গলা চুবিয়ে সম্ভ্রম রক্ষা করেছে নাসিরনগরের নারীরা। ৭১-এর একটি চুটকি মনে এলো: পাকিস্তানী সৈন্যরা একগ্রামে এলে সবাই পালতে শুরু করলো। এক বৃদ্ধাও দৌড়ে পালাচ্ছিল। তা দেখে একজন বলে, ও বুড়ি, তুমি পালাচ্ছ কেন? বুড়ি উত্তর দেয়, মিলিটারীতে বুড়া সৈন্যও আছে।
মাঝে মাঝে ভাবতে ইচ্ছে করে, পাকিস্তানের সাথে আমাদের তফাৎ কোথায়? আগে হানাদার ছিলো পাকিস্তানীরা, এখন হানাদার আপনার আশেপাশেই বিরাজমান। শুনলাম পাকিস্তান ৯২১কোটি টাকা ফেরত চেয়েছে বা চাচ্ছে। ফেইসবুকে একজন লিখেছেন,সমস্যা কি, কিছু হিন্দুর বাড়িঘর লুটপাট করে পাকিস্তানী ভাইদের টাকাটা দিয়ে দেয়া হোক। শত হলেও হিন্দুরা মালাউন, আর পাকিস্তানীরা ভাই বলে কথা। আর একজন পরামর্শ দিয়েছেন, পাকিস্তান শুধু শুধু সরকারের কাছে টাকা না চেয়ে কয়েকটা 'বিকাশ' একাউন্ট খুলে দিলে বাংলাদেশে তাদের পেয়ারের বান্দারা চাঁদা তুলে হয়তো এরচেয়ে বেশিই তুলে দেবে। বড়ভাই অভাবে আছে, ছোটভাই তো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেই পারে! ভাতৃপ্রতিম পাকিস্তান তো আর বন্ধুপ্রতিম ভারত নয়!
এতসব নেতিবাচক সংবাদের মধ্যে ইতিবাচক দিক হলো একজন জামালুদ্দিন নাসিরনগরের দত্তবাড়ীর গেটে দাঁড়িয়ে দুর্বৃত্তদের বাঁধা দিয়েছেন। শুধু তিনি এক নন, তারসাথে ছিলেন আব্দুল মজিদ ও আরো ৮/১০জন এরাও তো মুসলমান, অথচ কত তফাৎ। ১৯৬৪-র দাঙ্গায় হিন্দুদের বাঁচাতে রাঙ্কিং স্ট্রীটে প্রাণ দিয়েছিলেন আমির হোসেন। একাত্তরেও একদল মুসলমান হিন্দুর বাড়িঘর লুটেছে, আর একদল হিন্দুদের বাঁচিয়েছে। কিন্তু এখনকার চিত্র ভিন্ন। আওয়ামী লীগ দুষছে বিএনপি-কে, স্থানীয়রা দুষছেন আওয়ামী লীগকে। তাই হয়তো প্রতিমন্ত্রীর কাছে তিনশ' হিন্দুর বাড়ীঘর ধ্বংস, লুটপাট, ১৫টি মন্দির ভাংচুর, বেশকিছু
বাড়িঘরে আগুন দেয়া অতি 'তুচ্ছ ঘটনা' বটে! এইনা হলে তিনি মন্ত্রী! আর এই মন্ত্রীকে বাঁচাতে সরকার বদ্ধপরিকর?
নাসিরনগর বা গোবিন্দগঞ্জের দুৰ্ভাগ্যজনক ঘটনা 'মানবতার বিপর্যয়'। ব্রিটিশ এমপি চিঠি পাঠিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আমাদের এমপি'রা 'নিরুদ্বিগ্ন'। সাঁওতাল পল্লীতে হামলা নিয়ে লেখার ইচ্ছে থাকলো। তবে তারা প্রধানমন্ত্রী প্রেরিত ত্রাণ গ্রহণ করেছেন। এটা ভাল। এরআগে ওরা প্রশাসনের ত্রাণ নেননি, বরং একজন ইলিখা মার্ডি বলেছেন, "প্রসাশনের সাহায্য নেবোনা। ওরা আমাদের গুলি করেছে, হত্যা করেছে, আগুন দিয়েছে। আগে জমি ফেরৎ চাই"। সারিবাঁধা ২৫০০ ঘরের একটাও অবশিষ্ট নেই। মারা গেছেন ৪জন। সাঁওতালরা কি মানুষ? আবুল বারাকাত বলেছেন, জমি যে সাঁওতালদের তাতে কোন
সন্দেহ নেই। সাঁওতাল দ্বিজেন টুডু, চরণ সায়েন এবং বিমল কিসকু পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন। তারা হাতকড়া বাঁধা অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। আমাদের দায়িত্বশীল পুলিশ কিছুতেই হাতকড়া খুলেনি। শেষে আদালতের নির্দেশে তা খোলা হয়। অথচ একই দায়িত্বশীল পুলিশ ধর্ষণের আসামীকে হাতকড়া ছাড়াই আদালতে নিয়ে যায় এবং আসামী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়! এর কারণ কি?
তবে ৬৫ বছরের সাঁওতাল বেওয়া সোরেন-এর উক্তিটি মনে রাখা দরকার, তিনি বলেছেন, "কথা দিচ্ছি, ভারত চলে যাবো"। নাসিরনগরের ৬টি হিন্দু পরিবারও নাকি ইতিমধ্যে দেশত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশিরা সবাই আমেরিকায় অবৈধ অভিবাসীদের খেদানোর বিরুদ্ধে। ট্রাম্প বলেছেন যে তিনি অবৈধদের খেদাবেন, এতে আমরা নাখোশ। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যে প্রতিদিন বৈধ নাগরিক উপজাতি-আদিবাসী-সাঁওতাল-হিন্দু-বৌদ্ধ-ক্রিষ্টানদের তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, এ বিষয়ে সবার মুখে কুলুপ আটা। 'বিগট্রির' জন্যে বাংলাদেশের মানুষ ট্রাম্পকে অ-পছন্দ করছেন, কিন্তু দেশে ওনারা যে প্রত্যেকেই এক একজন ট্রাম্প তা তারা মানতে চাননা! বেওয়া সোরেন-এর দেশত্যাগের জন্যে যে বাংলাদেশী ট্রাম্পরা দায়ী তা তারা বুঝবেন কবে? নাসিরনগরের আগুন আমেরিকায় লাগলে কি ট্রাম্পকে খুব বেশি দায়ী করা যাবে?
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।১৬ নভেম্বর, নিউইয়র্ক।
__._,_.___