বিদেশের কারাগারগুলোতে মানবেতর জীবনযাপন । তাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে।
পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিভিন্ন দেশে নানা অপরাধে জড়িতে ৯ হাজার ৯৬৭ বাংলাদেশী কারাগারে রয়েছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ায় ২ হাজার ৪৬৯ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১ হাজার ৯৮ জন, ভারতে ২ হাজার ৬৯৭ জন, সৌদি আরবে ৭০৩ জন, যুক্তরাজ্যে ২১৮ জন এবং মিয়ানমারে ৫৭ জন আটক রয়েছে।
উল্লেখ্য, ভিটেমাটি বিক্রি করে, ধার-দেনা আর ব্যাংক থেকে চড়া সুদের টাকায় বিদেশে পাড়ি জমানো অনেক দিনের নিয়মিত ঘটনা। প্রচলিত ও অপ্রচলিত পথে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশীরা। বৈধ পথের পাশাপাশি যাচ্ছে অবৈধ পথেও। অনেকেই গিয়ে আটক হচ্ছে সেখানকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। আবার অনেকে মেয়াদ শেষে বাড়তি অবস্থান করে অবৈধ হয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগই লুকিয়ে থেকে কাজ করছে। কেউ কেউ গ্রেফতার হচ্ছে। আবার কোনো কোনো বাংলাদেশী অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বলেও অভিযোগ আছে। প্রবাসের মাটিতে চুরি, মাদক পাচার থেকে শুরু করে রোমহর্ষক খুন পর্যন্ত করছে বাংলাদেশীদের কেউ কেউ। অবশেষে ঠাঁই হচ্ছে বিদেশের কারাগারে।
এছাড়া অনেকেই কাজের সন্ধানে ভিজিট ভিসায় বিদেশে গিয়ে আর আসে না। আবার অনেকেই ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে থেকে যায়। ভিসার মেয়াদ শেষ হলেই তারা সেদেশে অবৈধ হয়ে যায়। এরপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা পড়লে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া দালালরা অনেককে ভিজিট ভিসায় নিয়ে গিয়ে তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেয়। পাসপোর্ট কেড়ে নেয়ার ফলে সেদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট বৈধ কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারে না। সে কারণে ধরা পড়লে সেসব বাংলাদেশীদের জেলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হলেও এ মুহূর্তে ঠিক কতজন বাংলাদেশী বিদেশের কারাগারগুলোয় বন্দি বা আটক আছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কারণ আটকদের পক্ষ থেকেই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোয় বাংলাদেশ মিশনে যোগাযোগ করলেই কেবল তাদের খোঁজ রাখা সম্ভব হয়। অনেক দেশে নেই মিশনও। তাই তালিকার বাইরেও থেকে যায় অনেক বন্দি।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ একটি জনসংখ্যাবহুল দেশ। আর এ জনসংখ্যা জনসম্পদে রূপান্তর করতে পারলে তা দেশের উন্নয়নে অন্যতম প্রভাব রাখবে এমনটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। সে মোতাবেক সার্বিক পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি দিলে এটা স্পষ্ট যে- আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই বাংলাদেশের নাগরিকরা দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করছে এবং তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতেও রাখছে ইতিবাচক ভূমিকা। কিন্তু উদ্বেগজনক বিষয় হলো, যখন বাইরের বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশীরা নানারকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ার খবরও আসছে, তখন তা অত্যন্ত দুঃখজনক। কেননা এ ধরনের ঘটনা ঘটার অর্থই হলো- দেশের সুনাম ক্ষুণœ হওয়া এবং একই সঙ্গে এদেশ থেকে শ্রমিক আমদানিতে অন্যান্য দেশের অনাগ্রহী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হওয়া।
অতি উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলতে হয়, বিদেশে যাওয়ার আগে প্রত্যেক কর্মীকে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন-কানুন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেয়ার কথা। কিন্তু অভিযোগ আছে, বেশির ভাগ বিদেশগামীকেই তা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির এটা একটা বড় কারণ হতে পারে। আর যখন যথাযথ তথ্য সংগ্রহ ও তদারকি ছাড়াই একজন বিদেশ যায় আর পরবর্তী সময়ে অপরাধে যুক্ত হয়ে পড়ে তখন তার দায় সরকারও এড়াতে পারে না। ১৯৭৬ সালের পর থেকে কয়েক কোটি বাংলাদেশী নাগরিক বিদেশে গমন করলেও তাদের মধ্যে মাত্র ১১ লাখকে ব্রিফিং দেয়া হয়েছে। ফলে যখন একটি বড় অংশই সংশ্লিষ্ট দেশ সম্পর্কে কিছু না জেনে বিদেশে যাচ্ছে এবং নানা আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও অপরাধের দায়ে কারাবরণ করছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী বলেছেন- 'বিদেশে আটক বাংলাদেশীরা যাতে সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত মুক্তি লাভ করতে পারে, সেজন্য সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।' আমাদের কথা- এই 'দ্রুত' যেন সত্যি সত্যি দ্রুত হয়। বন্দিদের দুর্ভোগ দীর্ঘতর না হয়, দেশে স্বজনদের মানসিক যন্ত্রণা দীর্ঘায়িত না হয়। প্রতিবেশী দেশসহ অনেক দেশের কারাগারে বাংলাদেশীদের আটক থাকার সংবাদ প্রকাশিত হয়। এদের অধিকাংশই ভাগ্যান্বেষী। বৈধ, অবৈধভাবে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে তাদের এমন অবস্থায় পড়তে হয়েছে। অনেকে পাচারের শিকারও। এদের মধ্যে নারী-শিশুও রয়েছে। যে যেভাবেই হোক, বিদেশ গিয়ে আটক হওয়া বাংলাদেশীদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া জরুরী। যারা কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি জমান তাদেরও তথ্য-তালাশ করেই পা বাড়ানো উচিত যে- সে বৈধ, নাকি অবৈধভাবে যাচ্ছে, দালাল-প্রতারকের খপ্পরে পড়লো কিনা? গাঁটের পয়সা দিয়ে, জমি-জিরাত বিক্রির টাকা খরচ করে, ঋণ-হাওলাত করে বিদেশে পাড়ি দিয়ে যদি দুর্বিপাকে পড়ে জেলের ঘানি টানতে হয়, তাহলে তার মতো কষ্ট-দুর্ভোগ-ক্ষতির আর কী আছে? তাই সবারই সচেতন হওয়া উচিত।
পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের আত্মীয়-স্বজনেরা প্রবাসের কারাগারে আটক বাংলাদেশীদের ফেরত আনার জন্য সরকার কূটনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি প্রতারক আদম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে।
মূলত, এতে একদিকে যেমন বিদেশে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হচ্ছে, অন্যদিকে সর্বস্বান্ত হচ্ছে এদেশের অনেক পরিবার। বর্তমান সরকারকে এ অবস্থা অবসানে বিদেশ পাঠানোর ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর প্রতারণা প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রসঙ্গত আমরা মনে করি, বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে আগের তুলনায় লেবার উইং আরো অনেক বেশি শক্তিশালী করা উচিত। ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিস ট্রেনিং মডিউলেও পরিবর্তন করা উচিত, যাতে যারা সার্ভিস দেবে তারা যেন জেনে বুঝে বাংলাদেশী কর্মীদের যথাযথ সেবা দিতে পারে।
__._,_.___