ঋষিপনা আর গণতন্ত্রই ভারতের প্রাচীন পথ
আনিস আলমগীর
আগামীকাল ২৬ জানুয়ারি, ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস। বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশন এ দিবসটি ঘটা করে পালন করে। তবে তারা ঢাকায় তাদের স্বাধীনতা দিবস পালন করে না। কারণ ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের জন্য শোকের দিন, বঙ্গবন্ধুর হত্যা দিবস। বেশিরভাগ সময়ে রাজধানীর বড় হোটেলেই তারা প্রজাতন্ত্র দিবসের আয়োজন করে। অতিথি সমাগমেও বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। এবারো ব্যতিক্রম হবে না মনে হয়।
বাংলাদেশে ভারতের প্রথম হাইকমিশনার সুধিমল দত্ত থেকে বর্তমান হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা সবাই সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন এখানে। সবাইকে দেখেছি ঢাকায় এসে বাঙালিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে। বর্তমান হাইকমিশনার হর্ষবর্ধনও সে ধারা অব্যাহত রেখেছেন। বলতে গেলে বিগত হাইকমিশনারদের থেকে তিনি একটু বেশিই অগ্রগামী। খুব সহজে মিশতে পারেন তিনি, সদা হাস্যোজ্জ্বল। তার উপকারিতাও তিনি পাচ্ছেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক তার সময়কালে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও তাকে পছন্দ করেন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রথম ভারতীয় হাইকমিশনার সুধিমল দত্ত বাংলাদেশেরই সন্তান। চট্টগ্রামে ছিল তার পৈতৃক নিবাস। কানুনগো পাড়ার স্যার আশুতোষ কলেজ তারাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুধিমল দত্তের পিতা তার ৭ সন্তান ও স্থানীয় লোকজনের সাহায্যে মাটির দেয়াল দিয়ে নিজেরা নিজেদের কায়িক শ্রমে ওই কলেজটা তৈরি করেছিলেন।
সুধিমল দত্তের ৭ ভাইয়ের মাঝে তিন ভাই আইসিএস এবং চার ভাই এমএ পাস ছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তার মাকে রতœগর্ভা উপাধি দিয়েছিল। সুধিমল বাবুরা কলকাতায় থাকতেন। ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পর তারা আর দেশে ফিরে আসেননি। সে সুবাধে দত্ত পরিবার ভারতীয় হয়ে গেছে।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী প্রান্তরে সিরাজের পরাজয়ের পর ভারতে ব্রিটিশ জাতির দখলদারিত্বের সূচনা হয়। আর ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের করুণ পরিণতির পর সমগ্র ভারত উপমহাদেশ ইংরেজদের পদাতন হয় পরিপূর্ণভাবে। সুদীর্ঘ ১৯০ বছর পর ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারতে ইংরেজ রাজত্বের অবসান হয়। ১৪ আগস্ট পাকিস্তান আর ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়েছিল। আমরা পাকিস্তানের পূর্ব অংশ ছিলাম। বাংলা নাম অব্যাহত ছিল না। নামকরণ করা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা দীর্ঘ নয় মাস পশ্চিম পাকিস্তানির সঙ্গে যুদ্ধ করেছি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করে আমরা পৃথক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি। এখন আমাদের দেশের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
ভারতে আজ পর্যন্ত যত মানুষ জš§গ্রহণ করেছে তাদের মাঝে আমার মতে বৌদ্ধ সর্বশ্রেষ্ঠ। আধুনিককাল ধন্য হয়েছে গান্ধীর মতো আরেক শ্রেষ্ঠ মানব সন্তান জন্ম দিয়ে। উভয়ে আজ বিস্মৃত। 'উপনিষেদ' কথাটির অর্থ অধিবেশন। এই অধিবেশন গুরুকে নিয়ে শলা পরামর্শের বৈঠক। গান্ধী চেয়েছিলেন আদিতে ফিরে যেতে। তাই তিনি চরকায় সুতা কেটে, সমুদ্র উপকূল থেকে লবণ তুলে স্বাধীনতা আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু তার শিষ্যরা সে কথা মানেনি। তারা তাকে মান্য করেছেন শুধু ক্ষমতা আরোহণের জন্য।
সুভাষ বসু তাকে মান্য করেননি, ছিটকে পরে অজ্ঞাত হয়ে গেছেন। গান্ধী মনে করতেন অভ্যন্তরীণ শক্তিকে জাগিয়ে তোলাই আত্মপ্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ। তিনি চেয়েছিলেন ভারতের মধ্য থেকে বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শক্তিকে জাগিয়ে তুলে সমাজকে জাগ্রত করতে। বাইরের ঘোষণা, অনুগ্রহ দ্বারা এটি সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করতেন। গান্ধী পথ চলার যে দিক নির্দেশনার ছক কেটে দিতে চেয়েছিলেন, তা ছিল অন্ধের হাতি দর্শনের লাঠির মতো। কারণ তার শিষ্যরা ছিলেন ইংলিশ লিবারেলিজমের সন্তান।
গান্ধীর প্রচেষ্টা এ ব্যাপারে ব্যর্থ হয়েছিল। ভারত বিভক্তির ব্যাপারেও গান্ধী ব্যর্থ হয়েছেন। ভারত বিভক্তির প্রতিরোধের জন্য তিনি যখন প্রস্তাব দিলেন যে, প্রয়োজনে জিন্নাহকে প্রথম প্রধানমন্ত্রী করা হোক তখন তার মুখ্য শিষ্যরাই ব্যঙ্গ করে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। গান্ধী বলেছিলেন, প্রথম স্বাধীন গণপরিষদ শাসনতন্ত্র রচনা করুক পরে প্রয়োজনে দেশ ভাগ হবে। নেহরু তাও প্রত্যাখ্যান করলেন।
গান্ধী বুঝলেন যে, 'দা প্রসপেক্ট অব পাওয়ার হেজ ডিমোরালাইজড অল'। তিনি ৭ জুনের ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব গ্রহণের বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর আর বিরোধিতা করলেন না। ওয়ার্কিং কমিটিতে বিভক্তির প্রস্তাব পাস হয়ে গেল শুধু বিরোধিতা করলেন মওলানা আজাদ আর আবদুল গাফ্ফার খাঁন। যথা সময়ে ভারত বিভক্ত হলো। ভারত আর পাকিস্তান সৃষ্টি হলো। ইংরেজরা ভারত ত্যাগ করল। দেশ বিভাগের বিষয়টি যখন স্থির হয়ে গিয়েছিল তখন গান্ধী কংগ্রেসের কাছে বাহুল্য হয়ে পড়েন। তাই স্বাধীনতা দিবসের দিন ১৫ আগস্ট তিনি কলকাতার বেলিয়াঘাটার হায়দরি মঞ্জিলে এক মুসলিম নাগরিকের পরিত্যক্ত বাড়িতে অনশন করে দিনটি কাটিয়েছিলেন। মুসলিমদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়াই ছিল তার দাবি।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর ঐতিহাসিক গ্রেট মাইগ্রেশন আরম্ভ হলেও ভারতের স্থপতিরা শাসনতন্ত্র রচনার কাজ স্থগিত না রেখে বিআর অম্বেতকরকে প্রধান করে শাসনতন্ত্র রচনার জন্য কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন। যে কমিটি কঠোর পরিশ্রম করে ভারতের জন্য একটা শাসনতন্ত্র রচনা করেছিলেন। সে শাসনতন্ত্র বহু আলোচনার পর গৃহীত হয় এবং ১৯৫০ সালে ২৬ জানুয়ারি ভারতকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়েছিল। আগামীকাল ভারতের ৬৮তম প্রজাতন্ত্র দিবস।
লোকসভা, রাজ্যসভা আর বিধানসভায় নির্বাচিত না হওয়ায় দুই বছরের জন্য অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন রাজেন্দ্র প্রসাদ। এই শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতেই ১৯৫২ সালের ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং লোকসভা গঠিত হয়। সে থেকে আজ পর্যন্ত ভারতে অব্যাহতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আর আজ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কারণে ভারতের গণতন্ত্র দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ভারতের বিরাট এক মধ্যবিত্ত সমাজও সৃষ্টি হয়েছে। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে ভারতের এ মধ্যবিত্তরাই গণতন্ত্রের প্রাণ আর পাহারাদার। এ কথা সত্য যে, সুয়েজের পূর্ব সীমান্তে এশিয়ায় ভারতই একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে গণতন্ত্রের অব্যাহত চর্চা চলছে। ভারতের ডাম-বাম যত দলই আছে তাদের মাঝে কোনো ভুঁইফোড় নেতৃত্ব নেই। কোনো ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে তারা কখনো গণতন্ত্রকে ব্যাহত করার চেষ্টা করেনি। ইমার্জেন্সিতে ইন্দিরার কিছু বাড়াবাড়ি আমরা লক্ষ্য করেছি, কিন্তু ১৯৭৭ সালে তিনি তো নির্বাচনে ফিরে আসলেন।
ভারতের মুখ্য সৌন্দর্য্য হচ্ছে তার গণতন্ত্র চর্চা। এ অবাধ গণতন্ত্র চর্চা ভারতকে বহু বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছে। বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের সুরক্ষা হচ্ছে এ প্রজাতন্ত্রটির অবাধ গণতন্ত্র চর্চার একক কর্তৃত্বের ফল। এ প্রজাতন্ত্রে বামপন্থিরা কখনো হীন বীর্যের ছিল না। ১৯৪৯ সালে ২৬ ফেব্রুয়ারি তারা পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার দমদমে একদিনের এক বিপ্লব করেছিল। ইংরেজ মালিকানাধীন একটি কোম্পানির তিনজন ইঞ্জিনিয়ারকে জ্বলন্ত ফার্নেসে ফেলে পুড়িয়ে মারে, দমদমের অস্ত্র কারখানা লুট করে। তারপর তারা বশিরহাটের দিকে যাত্রা করে কিন্তু বশিরহাটে তারা জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে। পুলিশের গুলিতে ৪০ জন বিপ্লবীর মৃত্যু হয়, ২৬ জনকে গ্রেফতার করে। বিপ্লবের অবসান হয়। তেলেঙ্গার কৃষক বিপ্লবও সফল হয়নি। চারু মজুমদার, কানু সান্যাল নকশাল বাড়িতে যে বিপ্লব-বিদ্রোহের আয়োজন করেছিলেন তাও ব্যর্থ হয়। বেশ কিছুদিন মাওবাদীরা বেশ উৎপাত সৃষ্টি করেছিল। এখন তাও স্তিমিত। শক্তিশালী মধ্যবিত্তের উপস্থিতি কখনো বিপ্লবের অনুকূল নয়।
প্রাচীনকালেও ভারতের পঞ্চায়েত প্রথা ছিল। সে ছিল গণতন্ত্রের সূচনা পর্ব। তাই বলা যায়, ভারতের গণতন্ত্রের চর্চা কিন্তু প্রাচীন পঞ্চায়েত থেকে। যা মজ্জাগত হয়ে যায় তাকে উপড়ে ফেলা কঠিন। সম্ভবত এ বিষয়টা অনুধাবন করে ভারতের সমাজতন্ত্রীরা ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের পথে ফিরে এসেছেন। উপজাতি যুবকরা মাওবাদী। মনমোহন সিং যখন প্রধানমন্ত্রী মাওবাদীদের আক্রমণে ৪৩ জন পুলিশ নিহত হলে তিনি বলেছিলেন অভাবের তাড়নায় এরা এসব করছে, অভাব চলে গেলে এসব আর কিছু থাকবে না। তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তার উপলব্ধি নিশ্চয়ই অহেতুক নয়।
এখন নতুন সেøাগান হচ্ছে, হিন্দু জাগরণ। তবে জাগরণটা হচ্ছে উল্টো পথে। ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান ধর্মের অনুসারীরা মনে করেন তাদের ধর্মের বাণী এসেছে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে। অন্যদিকে উপনিষেদ বা অধিবেশনে ঋষিদের জ্ঞান চর্চার ফলশ্রুতিই হচ্ছে হিন্দু ধর্ম। ঋষিরা জ্ঞান চর্চা করে সত্যে উপনীত হয়েছিলেন। কিন্তু এখন আর ঋষিদের জ্ঞান চর্চা হচ্ছে না। নাগপুরে আরএসএস সদর দফতরে ধর্মান্তরিত করার ঘরওয়াপসী কর্মসূচি নিয়েই ব্যস্ত আছেন হিন্দুত্ববাদীরা। গণতন্ত্র আর অভ্রান্ত ঋষিপনা ছাড়া ভারত নিজেকে প্রকাশ করতে গেলে বিপদ অনিবার্য। ঋষিপনা আর গণতন্ত্রই হচ্ছে ভারতের প্রাচীন পথ। ঋষি গৌতম বুদ্ধ যেমন 'জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক' বলে অহিংসার বাণী প্রচার করেছিলেন, মহাত্মার পথও ছিল তাই। মহাত্মা গান্ধী আর গৌতম একসূত্রে গাঁথা।
পুরনো আর একটা ঘটনা দিয়ে লেখা শেষ করব। ১৯৪৯ সালে দক্ষিণ কলকাতা বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন হয়েছিল। উপনির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী ছিলেন দক্ষিণ কলকাতা জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি সুরেশ দাস আর স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর বড় ভাই শরৎচন্দ্র বসু। উপনির্বাচনের ফল প্রকাশ হতে দুই দিন বিলম্ব হয়েছিল। ফল প্রকাশের পর দেখা গেল শরৎচন্দ্র বসু নির্বাচনে ১৯ হাজার ভোট বেশি পেয়ে জিতেছেন। নেহরু ফল প্রকাশের বিলম্বটাকে ষড়যন্ত্র মনে করেছিলেন। তাই তিনি মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান রায়কে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরে অবশ্য সর্দার প্যাটেলের হস্তক্ষেপে বিধান রায় পদত্যাগ করা থেকে বিরত হয়েছিলেন। গণতন্ত্র চর্চায় কোনো হেরফেরই নেহরু কখনো সহ্য করেননি।
নেহরুর গণতন্ত্র চর্চা আর মহাত্মার অহিংসার পথ ছাড়া এই প্রজাতন্ত্রটির সুরক্ষার আর কোনো বিকল্প পথ নেই। এই দুটিই ভারতের প্রাচীন পথ। এই পথ থেকে ভারত বিচ্যুত হলে ভারতের বিপদ আসবে অজস্র পথে। আর ভারতের বিপদ তার প্রতিবেশীদের উদ্বেগের কারণ তো বটেই।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক
মানবকণ্ঠ/এসএস
বাংলাদেশে ভারতের প্রথম হাইকমিশনার সুধিমল দত্ত থেকে বর্তমান হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা সবাই সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন এখানে। সবাইকে দেখেছি ঢাকায় এসে বাঙালিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে। বর্তমান হাইকমিশনার হর্ষবর্ধনও সে ধারা অব্যাহত রেখেছেন। বলতে গেলে বিগত হাইকমিশনারদের থেকে তিনি একটু বেশিই অগ্রগামী। খুব সহজে মিশতে পারেন তিনি, সদা হাস্যোজ্জ্বল। তার উপকারিতাও তিনি পাচ্ছেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক তার সময়কালে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও তাকে পছন্দ করেন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রথম ভারতীয় হাইকমিশনার সুধিমল দত্ত বাংলাদেশেরই সন্তান। চট্টগ্রামে ছিল তার পৈতৃক নিবাস। কানুনগো পাড়ার স্যার আশুতোষ কলেজ তারাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুধিমল দত্তের পিতা তার ৭ সন্তান ও স্থানীয় লোকজনের সাহায্যে মাটির দেয়াল দিয়ে নিজেরা নিজেদের কায়িক শ্রমে ওই কলেজটা তৈরি করেছিলেন।
সুধিমল দত্তের ৭ ভাইয়ের মাঝে তিন ভাই আইসিএস এবং চার ভাই এমএ পাস ছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তার মাকে রতœগর্ভা উপাধি দিয়েছিল। সুধিমল বাবুরা কলকাতায় থাকতেন। ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পর তারা আর দেশে ফিরে আসেননি। সে সুবাধে দত্ত পরিবার ভারতীয় হয়ে গেছে।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী প্রান্তরে সিরাজের পরাজয়ের পর ভারতে ব্রিটিশ জাতির দখলদারিত্বের সূচনা হয়। আর ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের করুণ পরিণতির পর সমগ্র ভারত উপমহাদেশ ইংরেজদের পদাতন হয় পরিপূর্ণভাবে। সুদীর্ঘ ১৯০ বছর পর ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারতে ইংরেজ রাজত্বের অবসান হয়। ১৪ আগস্ট পাকিস্তান আর ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়েছিল। আমরা পাকিস্তানের পূর্ব অংশ ছিলাম। বাংলা নাম অব্যাহত ছিল না। নামকরণ করা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা দীর্ঘ নয় মাস পশ্চিম পাকিস্তানির সঙ্গে যুদ্ধ করেছি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করে আমরা পৃথক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি। এখন আমাদের দেশের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
ভারতে আজ পর্যন্ত যত মানুষ জš§গ্রহণ করেছে তাদের মাঝে আমার মতে বৌদ্ধ সর্বশ্রেষ্ঠ। আধুনিককাল ধন্য হয়েছে গান্ধীর মতো আরেক শ্রেষ্ঠ মানব সন্তান জন্ম দিয়ে। উভয়ে আজ বিস্মৃত। 'উপনিষেদ' কথাটির অর্থ অধিবেশন। এই অধিবেশন গুরুকে নিয়ে শলা পরামর্শের বৈঠক। গান্ধী চেয়েছিলেন আদিতে ফিরে যেতে। তাই তিনি চরকায় সুতা কেটে, সমুদ্র উপকূল থেকে লবণ তুলে স্বাধীনতা আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু তার শিষ্যরা সে কথা মানেনি। তারা তাকে মান্য করেছেন শুধু ক্ষমতা আরোহণের জন্য।
সুভাষ বসু তাকে মান্য করেননি, ছিটকে পরে অজ্ঞাত হয়ে গেছেন। গান্ধী মনে করতেন অভ্যন্তরীণ শক্তিকে জাগিয়ে তোলাই আত্মপ্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ। তিনি চেয়েছিলেন ভারতের মধ্য থেকে বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শক্তিকে জাগিয়ে তুলে সমাজকে জাগ্রত করতে। বাইরের ঘোষণা, অনুগ্রহ দ্বারা এটি সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করতেন। গান্ধী পথ চলার যে দিক নির্দেশনার ছক কেটে দিতে চেয়েছিলেন, তা ছিল অন্ধের হাতি দর্শনের লাঠির মতো। কারণ তার শিষ্যরা ছিলেন ইংলিশ লিবারেলিজমের সন্তান।
গান্ধীর প্রচেষ্টা এ ব্যাপারে ব্যর্থ হয়েছিল। ভারত বিভক্তির ব্যাপারেও গান্ধী ব্যর্থ হয়েছেন। ভারত বিভক্তির প্রতিরোধের জন্য তিনি যখন প্রস্তাব দিলেন যে, প্রয়োজনে জিন্নাহকে প্রথম প্রধানমন্ত্রী করা হোক তখন তার মুখ্য শিষ্যরাই ব্যঙ্গ করে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। গান্ধী বলেছিলেন, প্রথম স্বাধীন গণপরিষদ শাসনতন্ত্র রচনা করুক পরে প্রয়োজনে দেশ ভাগ হবে। নেহরু তাও প্রত্যাখ্যান করলেন।
গান্ধী বুঝলেন যে, 'দা প্রসপেক্ট অব পাওয়ার হেজ ডিমোরালাইজড অল'। তিনি ৭ জুনের ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব গ্রহণের বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর আর বিরোধিতা করলেন না। ওয়ার্কিং কমিটিতে বিভক্তির প্রস্তাব পাস হয়ে গেল শুধু বিরোধিতা করলেন মওলানা আজাদ আর আবদুল গাফ্ফার খাঁন। যথা সময়ে ভারত বিভক্ত হলো। ভারত আর পাকিস্তান সৃষ্টি হলো। ইংরেজরা ভারত ত্যাগ করল। দেশ বিভাগের বিষয়টি যখন স্থির হয়ে গিয়েছিল তখন গান্ধী কংগ্রেসের কাছে বাহুল্য হয়ে পড়েন। তাই স্বাধীনতা দিবসের দিন ১৫ আগস্ট তিনি কলকাতার বেলিয়াঘাটার হায়দরি মঞ্জিলে এক মুসলিম নাগরিকের পরিত্যক্ত বাড়িতে অনশন করে দিনটি কাটিয়েছিলেন। মুসলিমদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়াই ছিল তার দাবি।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর ঐতিহাসিক গ্রেট মাইগ্রেশন আরম্ভ হলেও ভারতের স্থপতিরা শাসনতন্ত্র রচনার কাজ স্থগিত না রেখে বিআর অম্বেতকরকে প্রধান করে শাসনতন্ত্র রচনার জন্য কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন। যে কমিটি কঠোর পরিশ্রম করে ভারতের জন্য একটা শাসনতন্ত্র রচনা করেছিলেন। সে শাসনতন্ত্র বহু আলোচনার পর গৃহীত হয় এবং ১৯৫০ সালে ২৬ জানুয়ারি ভারতকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়েছিল। আগামীকাল ভারতের ৬৮তম প্রজাতন্ত্র দিবস।
লোকসভা, রাজ্যসভা আর বিধানসভায় নির্বাচিত না হওয়ায় দুই বছরের জন্য অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন রাজেন্দ্র প্রসাদ। এই শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতেই ১৯৫২ সালের ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং লোকসভা গঠিত হয়। সে থেকে আজ পর্যন্ত ভারতে অব্যাহতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আর আজ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কারণে ভারতের গণতন্ত্র দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ভারতের বিরাট এক মধ্যবিত্ত সমাজও সৃষ্টি হয়েছে। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে ভারতের এ মধ্যবিত্তরাই গণতন্ত্রের প্রাণ আর পাহারাদার। এ কথা সত্য যে, সুয়েজের পূর্ব সীমান্তে এশিয়ায় ভারতই একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে গণতন্ত্রের অব্যাহত চর্চা চলছে। ভারতের ডাম-বাম যত দলই আছে তাদের মাঝে কোনো ভুঁইফোড় নেতৃত্ব নেই। কোনো ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে তারা কখনো গণতন্ত্রকে ব্যাহত করার চেষ্টা করেনি। ইমার্জেন্সিতে ইন্দিরার কিছু বাড়াবাড়ি আমরা লক্ষ্য করেছি, কিন্তু ১৯৭৭ সালে তিনি তো নির্বাচনে ফিরে আসলেন।
ভারতের মুখ্য সৌন্দর্য্য হচ্ছে তার গণতন্ত্র চর্চা। এ অবাধ গণতন্ত্র চর্চা ভারতকে বহু বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছে। বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের সুরক্ষা হচ্ছে এ প্রজাতন্ত্রটির অবাধ গণতন্ত্র চর্চার একক কর্তৃত্বের ফল। এ প্রজাতন্ত্রে বামপন্থিরা কখনো হীন বীর্যের ছিল না। ১৯৪৯ সালে ২৬ ফেব্রুয়ারি তারা পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার দমদমে একদিনের এক বিপ্লব করেছিল। ইংরেজ মালিকানাধীন একটি কোম্পানির তিনজন ইঞ্জিনিয়ারকে জ্বলন্ত ফার্নেসে ফেলে পুড়িয়ে মারে, দমদমের অস্ত্র কারখানা লুট করে। তারপর তারা বশিরহাটের দিকে যাত্রা করে কিন্তু বশিরহাটে তারা জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে। পুলিশের গুলিতে ৪০ জন বিপ্লবীর মৃত্যু হয়, ২৬ জনকে গ্রেফতার করে। বিপ্লবের অবসান হয়। তেলেঙ্গার কৃষক বিপ্লবও সফল হয়নি। চারু মজুমদার, কানু সান্যাল নকশাল বাড়িতে যে বিপ্লব-বিদ্রোহের আয়োজন করেছিলেন তাও ব্যর্থ হয়। বেশ কিছুদিন মাওবাদীরা বেশ উৎপাত সৃষ্টি করেছিল। এখন তাও স্তিমিত। শক্তিশালী মধ্যবিত্তের উপস্থিতি কখনো বিপ্লবের অনুকূল নয়।
প্রাচীনকালেও ভারতের পঞ্চায়েত প্রথা ছিল। সে ছিল গণতন্ত্রের সূচনা পর্ব। তাই বলা যায়, ভারতের গণতন্ত্রের চর্চা কিন্তু প্রাচীন পঞ্চায়েত থেকে। যা মজ্জাগত হয়ে যায় তাকে উপড়ে ফেলা কঠিন। সম্ভবত এ বিষয়টা অনুধাবন করে ভারতের সমাজতন্ত্রীরা ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের পথে ফিরে এসেছেন। উপজাতি যুবকরা মাওবাদী। মনমোহন সিং যখন প্রধানমন্ত্রী মাওবাদীদের আক্রমণে ৪৩ জন পুলিশ নিহত হলে তিনি বলেছিলেন অভাবের তাড়নায় এরা এসব করছে, অভাব চলে গেলে এসব আর কিছু থাকবে না। তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তার উপলব্ধি নিশ্চয়ই অহেতুক নয়।
এখন নতুন সেøাগান হচ্ছে, হিন্দু জাগরণ। তবে জাগরণটা হচ্ছে উল্টো পথে। ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান ধর্মের অনুসারীরা মনে করেন তাদের ধর্মের বাণী এসেছে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে। অন্যদিকে উপনিষেদ বা অধিবেশনে ঋষিদের জ্ঞান চর্চার ফলশ্রুতিই হচ্ছে হিন্দু ধর্ম। ঋষিরা জ্ঞান চর্চা করে সত্যে উপনীত হয়েছিলেন। কিন্তু এখন আর ঋষিদের জ্ঞান চর্চা হচ্ছে না। নাগপুরে আরএসএস সদর দফতরে ধর্মান্তরিত করার ঘরওয়াপসী কর্মসূচি নিয়েই ব্যস্ত আছেন হিন্দুত্ববাদীরা। গণতন্ত্র আর অভ্রান্ত ঋষিপনা ছাড়া ভারত নিজেকে প্রকাশ করতে গেলে বিপদ অনিবার্য। ঋষিপনা আর গণতন্ত্রই হচ্ছে ভারতের প্রাচীন পথ। ঋষি গৌতম বুদ্ধ যেমন 'জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক' বলে অহিংসার বাণী প্রচার করেছিলেন, মহাত্মার পথও ছিল তাই। মহাত্মা গান্ধী আর গৌতম একসূত্রে গাঁথা।
পুরনো আর একটা ঘটনা দিয়ে লেখা শেষ করব। ১৯৪৯ সালে দক্ষিণ কলকাতা বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন হয়েছিল। উপনির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী ছিলেন দক্ষিণ কলকাতা জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি সুরেশ দাস আর স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর বড় ভাই শরৎচন্দ্র বসু। উপনির্বাচনের ফল প্রকাশ হতে দুই দিন বিলম্ব হয়েছিল। ফল প্রকাশের পর দেখা গেল শরৎচন্দ্র বসু নির্বাচনে ১৯ হাজার ভোট বেশি পেয়ে জিতেছেন। নেহরু ফল প্রকাশের বিলম্বটাকে ষড়যন্ত্র মনে করেছিলেন। তাই তিনি মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান রায়কে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরে অবশ্য সর্দার প্যাটেলের হস্তক্ষেপে বিধান রায় পদত্যাগ করা থেকে বিরত হয়েছিলেন। গণতন্ত্র চর্চায় কোনো হেরফেরই নেহরু কখনো সহ্য করেননি।
নেহরুর গণতন্ত্র চর্চা আর মহাত্মার অহিংসার পথ ছাড়া এই প্রজাতন্ত্রটির সুরক্ষার আর কোনো বিকল্প পথ নেই। এই দুটিই ভারতের প্রাচীন পথ। এই পথ থেকে ভারত বিচ্যুত হলে ভারতের বিপদ আসবে অজস্র পথে। আর ভারতের বিপদ তার প্রতিবেশীদের উদ্বেগের কারণ তো বটেই।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক
মানবকণ্ঠ/এসএস
বুধবার, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭, ১২ মাঘ ১৪২৩, ২৬ রবিউস সানি ১৪৩৮
মানবকণ্ঠের সম্পাদক হলেন আনিস আলমগীর - Bangla Tribune
www.banglatribune.com › জাতীয়
দৈনিক মানবকণ্ঠের সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছেন ইরাক যুদ্ধখ্যাত সাংবাদিক আনিস আলমগীর। আজ রবিবার (১ জানুয়ারি) সকালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পত্রিকাটিতে যোগ দিয়েছেন। এ সময় পত্রিকাটির সম্পাদকমণ্ডলীর প্রধান এবং আশিয়ান গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া, মানবকণ্ঠের প্রকাশক জাকারিয়া চৌধুরী,...
ধর্মের নামে কোপাকুপি এবং ১০ ফতোয়া:
আনিস আলমগীর http://explore-bangla.com/postid/865
এই সময়ের রাজনীতি ১৪:৩৬, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৬
__._,_.___