http://www.bhorerkagoj.net/
ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন অধরা রয়ে গেছে
সোমবার, ৩ এপ্রিল ২০১৭
কখনো সখনো ঘটনার তীব্রতা বা ব্যাপকতা একটি জাতিকে পথপ্রদর্শন করে অথবা ত্বরিত সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ এনে দেয়। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতের গণহত্যা বঙ্গবন্ধুকে সেই ঐতিহাসিক সুযোগ এনে দিয়েছিল। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাই ছাব্বিশে মার্চ স্বাধীনতা দিবস। এর আগে আকারে-ইঙ্গিতে বা ছোটখাটো অনুষ্ঠানে যে স্বাধীনতার কথা আসেনি, তা নয়। এমনকি সাতই মার্চ বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু মুক্তি ও স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। সেখান থেকেও সরে আসার সুযোগ ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি জান্তার পঁচিশে মার্চের গণহত্যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চূড়ান্ত করে দেয়। বঙ্গবন্ধু সেটা বুঝেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন তিনি পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন-এ দাঁড়িয়ে; সময় এসেছে প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতার ডাক দেয়ার। তিনি তাই দেন।
এ বছর 'আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস' প্রস্তাব জাতীয় সংসদ পাস হয়েছে। সুখবর হচ্ছে, ইসলামাবাদে বাংলাদেশ দূতাবাস এই প্রথম পাকিস্তানের মাটিতে গণহত্যা দিবস পালন করেছে। এখন সময় এসেছে 'বিশ্ব গণহত্যা দিবসের' আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রাথর্না। 'আর্মেনীয় গণহত্যা' আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে, 'পঁচিশে মার্চ গণহত্যা'ও একদিন স্বীকৃতি পাবে। একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে প্রবাসীদের অবদান অনেক। পঁচিশে মার্চ গণহত্যা দিবসের যেটুকু স্বীকৃতি মিলেছে বা পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস হয়েছে এ জন্যও আমেরিকান প্রবাসীদের অবদান আছে। ঢাকায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ত্রিশ লাখ শহীদের স্মরণে ত্রিশ লাখ এবং বাংলাদেশের মাটিতে সতের হাজার ভারতীয় সৈন্য নিহতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সতের হাজার গাছ লাগানোর কর্মসূচি নিয়েছে। এটি শুভ উদ্যোগ।
ভৌগোলিক স্বাধীনতা এলেও স্বাধীনতার সুফল আমাদের সবার ঘরে পৌঁছেনি। একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন আজো অধরা রয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আজ একটি আধা-ইসলামিক রাষ্ট্র। পাকিস্তান থেকে বিযুক্ত হলেও কর্ম ও মননে আমরা এখনো পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণার ধারক-বাহক। স্বাধীনতার স্বপ্ন প্রতিদিন ভেঙে খান খান হচ্ছে। নওয়াজ শরিফ বলেছেন, এক ধর্মের মানুষ অন্যদের ওপর জুলুম-নির্যাতন করবে এ জন্য পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়নি। এ যেন 'ভূতের মুখে রামনাম'? বাংলাদেশে ঠিক তাই হচ্ছে। হিন্দুরা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। দেশটি আমাদের কিনা তা নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। একজন একটি ঘটনা বললেন- এক বৌদ্ধ ভদ্রলোক তার দেশের বাড়িতে একটি ছোট্ট ঘর উঠাচ্ছেন। স্থানীয় মাস্তানরা চাঁদা দাবি করল। ভদ্রলোক চেয়ারম্যানের দ্বারস্থ হলেন। চেয়ারম্যান বললেন, ওরা আমাদের কর্মী। কিছু দিয়ে দেন। ভদ্রলোক অনুনয় করে বললেন, আপনারা না দেখলে এবং এভাবে চললে আমরা দেশে থাকি কি করে? চেয়ারম্যান বলেন, 'থাকতে না পারলে ইন্ডিয়া চলে যান'। এটাই মানসিকতা এবং প্রায় সবার।
সিলেটের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে পুলিশ-র্যাব মরেছে। অভিযানটি শক্ত ছিল। জঙ্গিরা শক্তিশালী। অর্থাৎ দেশে জঙ্গিবাদ আছে এবং থাকবে। কারণ মানুষের মাঝে এর সমর্থন আছে। মৌলবাদ এবং জঙ্গিবাদ সমার্থক শব্দ। একটি থাকলে আর একটি থাকবে। দেশীয় রাজনীতি দুধকলা দিয়ে মৌলবাদ পুষছে। ধর্মের সঙ্গে ধর্মান্ধতাকে মিশিয়ে ফেলেছে। দেশে হাজার হাজার জঙ্গি কারখানা খোলা রেখে বা পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রেখে জঙ্গি নির্মূল থিওরি হাস্যকর? বাংলাদেশে আরো ঘটনা ঘটবে। এখন যা ঘটছে, এসব পূর্বাভাস। তবে জঙ্গিবাদকে যারা 'পাতানো খেলা' বলেছেন বা 'বিড়াল-ইঁদুর' গেম বলে মন্তব্য করেছেন, তারা এখন কি বলবেন? পুলিশ বা র্যাব কি পাতানো খেলায় মরে? জঙ্গি নিয়ে এখন বড় দুই দল বাকযুদ্ধে নিয়োজিত। সন্ত্রাস নির্মূলে রাজনৌতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐকমত্য নেই। বরং সুযোগ মতো এরা ওদের নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি যাচ্ছেন। জঙ্গি ইস্যু তো থাকছেই। তিস্তা হবে না তা সবার জানা। মমতা সাফ 'না' বলে দিয়েছেন। এবারকার দিল্লি সফর তাৎপর্যময়। শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রনায়কোচিত দক্ষতার প্রমাণ রাখতে হবে। বিশেষত সামরিক চুক্তি প্রশ্নে? ঢাকা-দিল্লি সখ্য হয়তো আছে, কিন্তু ঠিক আগের মতো নয়? এবার হয়তো কিছুটা বোঝাপড়া থাকবে। গোয়াতে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রনায়কের মতো ভূমিকা প্রদর্শন করতে পেরেছিলেন। বিল ক্লিন্টনের সঙ্গে দেশের স্বার্থে গ্যাস বিক্রি না করে শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারিয়েছিলেন। শোনা যায়, সামনে বেগম জিয়া দিল্লি যাচ্ছেন। নির্বাচন আসছে। বিএনপি ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। বিএনপি জানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের ভাগ্য খুলতে পারে। রাশিয়া বা চীন কাউকে ক্ষমতায় এনে দেবে না। হয়তো এই কারণে নেতানেত্রীদের দিল্লি দৌড়ঝাঁপ বেড়ে যাচ্ছে। দিল্লির আশীর্বাদ দরকার। 'দিল্লি কা লাড্ডু'-বলে কথা?
যা হোক, ট্রাম্প 'ওবামা কেয়ার' বাতিলে হোঁচট খেয়েছেন। বাংলাদেশে যারা ট্রাম্পকে ক্ষমতাসীন দেখে ঘামাচ্ছেন, তাদের জন্য দুঃসংবাদ হলো, দেশে দেশে এখন আরো ট্রাম্প জন্ম নিচ্ছে। উত্তর প্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। এতে অনেকে ভ্রæ কুঁচকাচ্ছেন। কিন্তু এটাই কি অনিবার্য ছিল না? নব্বই দশকের মধ্যভাগে নিউইয়র্কে এক বিজেপি নেতাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ১০০ কোটি হিন্দুর দেশ ভারতে আপনাদের এত হিন্দু হিন্দু করার দরকারটা কি? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, তোমরা যদি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে 'ইসলাম ইসলাম' করতে পারো তবে আমাদের হিন্দু হিন্দু করতে দোষ কি? এটাই বাস্তবতা। বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় উন্মাদনা বাড়ছে। পৃথিবীতে ফ্যাসিবাদ আসছে। বাংলাদেশ এর প্রভাবে ইতোমধ্যেই 'আচ্ছন্ন'। আমি কি পাগলের প্রলাপ বকছি? সেটা হলে তো খুশি হতাম। আমি যেই বাংলাদেশকে চিনতাম, এই বাংলাদেশ কি সেই দেশ?
ট্রাম্প মেস্কিকো সীমান্তে দেয়াল দিচ্ছেন শুনে অনেকের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এখন শুনি, পাকিস্তান আফগান সীমান্ত বরাবর সুউচ্চ দেয়াল নির্মাণের কাজ ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছে। পাকিস্তান বলেছে, যেসব অঞ্চলে জঙ্গিরা হরহামেশা আক্রমণ চালায়, সেখানেই আগে দেয়াল দেয়া হচ্ছে। চীনের দেয়ালের কথা শুনেছি, যাইনি। তবে দুই জার্মানির মধ্যে দেয়াল ভাঙার পর সেখানে গিয়েছিলাম। স্মৃতি হিসেবে ওরা এক টুকরো দেয়াল রেখে দিয়েছে। মনে হয়, পৃথিবীতে এখন দেয়াল ভাঙা নয়, নতুন নতুন দেয়াল ওঠার সময় হয়েছে। মানুষে মানুষে, জাতিতে-জাতিতে, ধর্মে-ধর্মে বিভক্তির এই দেয়াল কিন্তু ভাঙা সোজা হবে না। লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টারে সন্ত্রাসী তৎপরতা এই অদৃশ্য দেয়াল আরো পোক্ত করবে। ফ্রান্সের 'ওরল্যে' বিমানবন্দরের ঘটনা ততটা গুরুত্ব পায়নি, কারণ মানুষ মরেনি, শুধু সন্ত্রাসী মরেছে। সন্ত্রাসী কি মানুষ? বিশ্বব্যাপী এখন নতুন প্রশ্ন উঠেছে, সন্ত্রাসী ঘটনায় নিহতের সংখ্যায় জঙ্গিদের গণনা করা হবে কিনা?
নিউইয়র্ক, ২৮ মার্চ ২০১৭
শিতাংশু গুহ : কলাম লেখক।
__._,_.___