http://www.dailysangram.com/news_details.php?news_id=67188
অবগুণ্ঠন উন্মোচন : আসিফ আরসালান
স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি সম্পর্কে বেগম জিয়ার বলিষ্ঠ বক্তব্য
ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। বিগত ৪০ বছর ধরে জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য ইসলামী শক্তিকে স্বাধীনতা বিরোধী বলে এক তরফা গালাগালি করে চলেছে আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসররা। স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি এবং বিপক্ষ শক্তি বলে তারা দেশটাকে সুস্পষ্ট ভাবে বিভক্ত করে রেখেছে। একটি দেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। তারপরেও সেই বিভাজন চলছে। সেদিন যাদের বয়স ছিল ৪০, আজ তাদের বয়স ৮০। ৮০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। এদের সিংহ ভাগই স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন। যাদের বয়স ৪০ তাদের সেদিন জন্মই হয় নি। ৪০ বছর পর্যন্ত যাদের বয়স তারা দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। এরা স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষ কোনো পর্যায়েই পড়ে না। মায়ের কোল থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই ওরা দেখে আসছে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ।
সুতরাং জন্মগতভাবেই এরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মী ও সদস্যরাও জনগোষ্ঠির এই ব্র্র্যাকেটের অন্তর্ভুক্ত। সারা দেশব্যাপী ইসলামী ছাত্র শিবিরের যে অসংখ্য নেতা ও কর্মী ছড়িয়ে আছে তাদের একজনের বয়সও ৪০ এর বেশি নয়। অথচ এই সংগঠনটিকে অর্থাৎ ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রতিটি সদস্যকে আওয়ামী শিবির ঢালাওভাবে স্বাধীনতা বিরোধী বলে অব্যাহতভাবে অপবাদ দিয়ে চলেছে। আফসোস, এত বড় একটি ঐতিহাসিক শক্তির প্রকাশ্য বিকৃতি সত্ত্বেও সাহস করে প্রকৃত সত্য কথা বলার জন্য কেই এগিয়ে আসেন না। সুখের বিষয়, ৪০ বছর পরে হলেও বাংলাদেশের অবিসংবাদিত দেশনেত্রী এব্যাপারে দুঃসাহসিকভাবে এগিয়ে এসেছেন। উত্তরবঙ্গ রোডমার্চের সময় বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত জনসভায় লাখ লাখ লোকের জনসমুদ্রে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, দেশের ইসলামী শক্তিসমূহ স্বাধীনতা বিরোধী নয়।
দেশে কোনো স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি নাই। যদি থেকে থাকে তাহলে সেটা আওয়ামী লীগ। বেগম জিয়া আরো ঘোষণা করেছেন যে, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, কামারুজ্জামান, সালাউদ্দিন কাদের যুদ্ধাপরাধী নয়। যুদ্ধাপরাধী আছে আওয়ামী লীগের ভেতর। আগে তাদের বিচার করুন। তারপর অন্যদের কথা। স্মরণাতীতকালে অনুষ্ঠিত বগুড়ার বৃহত্তম জনসভায় বেগম জিয়া ঘোষণা করেন, মানবতা বিরোধী অপরাধে যদি কারো বিচার করতে হয় তাহলে সর্বাগ্রে বিচার করতে হবে তাদের যারা স্বাধীনতার অব্যবহিত পর রক্ষী বাহিনী, লাল বাহিনী, নীল বাহিনী প্রভৃতি প্রাইভেট বাহিনী দিয়ে ৪০ হাজার মানুষ হত্যা করেছে। সর্বাগ্রে এই ৪০ হাজার মানুষের হত্যাকারীদের বিচার করতে হবে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে।
বলাবাহুল্য, বেগম জিয়ার এসব ঘোষণায় সারাদেশে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এসব কথা বছরের পর বছর ধরে অনেকের মনেই গুমরে মরছে। কিন্তু এমন অকপটে এমন চরম কথা বিগত ৪০ বছরে কেউই লাখ লাখ লোকের জনসমুদ্রে বলেননি। সেজন্যই আজকের লেখার শুরুতে বলেছিলাম যে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।
বেগম জিয়ার এমন অকপট সত্য উচ্চারণে যা হবার তাই হয়েছে। আওয়ামী লীগের অস্থির প্রতিক্রিয়া দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, ভীমরুলের চাকে ঢিল পড়েছে। তাই তারা দিশেহারা হয়ে এখন প্রলাপ বকতে শুরু করেছে। প্রলাপের মাত্রা এতদূর বেড়ে গেছে যে, তারা এখন খালেদা জিয়ার বিচার চাই বলেও প্রলাপ বকা শুরু করেছে। তবে তারা বুঝতে পেরেছে, এসব কথা বলার কারণে খালেদা জিয়ার বিচার করা অতো সহজ নয়। এসব কারণে বিচার করতে গেলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে। তখন আওয়ামী লীগের নাড়ীতে টান পড়বে। সেই টানে মানুষ দেখতে পাবে যে আওয়ামী লীগের নাড়ীটি কোথায় পোঁতা আছে।
দুই. বেগম জিয়ার এসব কথার পেছনে কতটুকু যুক্তি আছে এবার সেটি দেখা যাক। প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী কারা হতে পারে? স্বাধীনতা বিরোধী তারাই হতে পারে যারা বাংলাদেশের ভৌগোলিক মানচিত্র বিপন্ন করতে পারে, যারা জাতীয় সংহতি বিনষ্ট করতে পারে। আমাদের মানচিত্র বিপন্ন করতে পারে কারা? বিপন্ন করতে পারে তারাই যারা আমাদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী এবং যারা আমাদের চারদিক বেষ্টন করে আছে। সুনিশ্চিতভাবে এই দেশটি হলো ভারত। আর যারা বাংলাদেশে বসে ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে অর্থাৎ যারা ভারতের দোসর তারাই স্বাধীনতা বিরোধী। জামায়াতে ইসলামী বা ইসলামী শক্তিসমূহ কোনো অবস্থাতেই স্বাধীনতা বিরোধী হতে পারে না। কারণ প্রথমত, তারা দেশের কোনো ক্ষতি করতে চায় না। দ্বিতীয়ত, ক্ষতি করতে চাইলেও সেই ক্ষতি করার ক্ষমতা তাদের নাই। কারণ সেই ক্ষতি করতে হলে তাদেরকে নিতে হবে ভারতের সাহায্য। কিছুদিন আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে যা বলেছেন তাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে জামায়াতে ইসলামীকে বন্ধু ভাবা তো দূরের কথা, ভারত জামায়াতকে শত্রুজ্ঞান করে। সুতরাং বাংলাদেশের ক্ষতি করার কোনো সাধ্য জামায়াতে ইসলামী বা ইসলামী ছাত্র শিবিরের নাই। তাহলে জামায়াতে ইসলামী বা ইসলামী ছাত্র শিবির স্বাধীনতা বিরোধী হতে পারে না। এবং তারা স্বাধীনতা বিরোধী নয়ও। স্বাধীনতা বিরোধী সেই শক্তি যারা বাংলাদেশের ক্ষতি করতে চায় এবং সে ব্যাপারে ভারতের মদদ পেয়ে থাকে। এব্যাপারে আওয়ামী লীগ হলো ভারতের পারফেক্ট ম্যাচ। আওয়ামী লীগ নিজেকে স্বাধীনতার শুধু পক্ষ শক্তিই নয়, নিজেদেরকে স্বাধীনতার সোল এজেন্ট বলে জাহির করে। এবার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ যা কিছু করছে সেগুলোতে স্বাধীনতার সংরক্ষণ বলে কিছু দেখা যায় না। বরং প্রতিটি বিষয়ে দেশের স্বার্থ তারা বিকিয়ে দিচ্ছে ভারতের কাছে। আসুন, আমরা এই ধরনের কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করি।
তিন.
অনেক দিন ধরেই পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে এবং প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে খবর সম্প্রচারিত হচ্ছে যে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদেরকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করছে। তাদের হাতে নিহত বাংলাদেশী বালিকা ফেলানীর লাশ নিয়ে কত কান্ডই না হলো। নিজের নাগরিকদের জানমালের হেফাজত করা যে কোনো সরকারের প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সীমান্তে নাগরিকদের জান মালের হেফাজত করা তো দূরের কথা ,যখন তাদেরকে হত্যা করা হয় তখন সেই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করার সাহসও পায় না। এতই মেরুদন্ডহীন এই সরকার।
আওয়ামী লীগ যে স্বাধীনতা বিরোধী সেই বিষয়টি উৎকটভাবে প্রকাশ পেয়েছে সাম্প্রতিক সীমান্ত চিহ্নিত করার সময়। এখন এটি অনেক বুদ্ধিজীবী, কলামিষ্ট এবং বিবেকবান মানুষ বলছেন যে সীমান্ত চিহ্নিত করার সময় বাংলাদেশ ভারতের নিকট থেকে কয়েক শত একর জমি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিনিময়ে কয়েক হাজার একর জমি ভারতকে দিয়ে দিয়েছে। এর নাম যদি হয় সীমান্ত চিহ্নিতকরণ তাহলে সেই সীমান্ত চিহ্নিতকরণ ব্যবস্থা জনগণ মানতে বাধ্য নয়। ভারতই শিখিয়েছে ঐ কবিতা। সেটা হলো 'বিনা যুদ্ধে নাহি দেবো সূচাগ্র মেদিনী'। কোনো দেশের মূল মানচিত্রের এক ইঞ্চিও পরিবর্তন করার অধিকার কোনো সরকারের নাই। শেখ মুজিব বেরুবাড়ী ভারতকে দিয়েছেন। কিন্তু বিনিময়ে যখন ৩ বিঘা করিডোর বাংলাদেশকে দেয়ার প্রশ্ন উঠলো তখন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছে যে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট যে মানচিত্র নিয়ে ভারত স্বাধীন হয়েছে তার এক ইঞ্চিও পরিবর্তন করার অধিকার ভারতের কোনো সরকারের নাই। সেই কারণে আজ ৩৭ বছর হলো আমরা তিন বিঘা করিডোর পাই নাই। এবার যদিও বা যাতায়াতের জন্য তিন বিঘা করিডোর খুলে দেয়া হয়েছে তার পরেও মালিকানা রাখা হয়েছে ভারতের হাতে। যারা হাজার হাজার বিঘা বাংলাদেশী ভূখন্ড অবলীলাক্রমে ভারতের হাতে তুুলে দেয়, তারা কি স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি? নাকি যারা ঐ জমি ভারতের হাতে তুলে দেয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে তারাই স্বাধীনতার পক্ষশক্তি? কাজেই বেগম খালেদা জিয়া যখন বলেন যে আওয়ামী লীগই স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি তখন তাঁর ভুল হয় কোথায়?
১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল একটি চমৎকার মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন যে এই ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় অবসর প্রাপ্ত এক ডজন সামরিক অফিসারকে গ্রেফতার করে বিচার করা হচ্ছে। কিন্তু এই বাংলাদেশেরই এক শ্রেণীর উপজাতিকে ভারত আশ্রয় দিয়েছিলো, ট্রেনিং দিয়েছিলো এবং অস্ত্র তুলে দিয়েছিলো। ভারতের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ঐসব সশস্ত্র ব্যক্তি বার বার বাংলাদেশে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে্। ভারতের যেসব অফিসার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পার্বত্য উপজাতি অর্থাৎ চাকমাদেরকে ব্যবহার করেছিলো,ভুলেও একবারও তাদের বিচারের প্রশ্ন উত্থাপন করতে আওয়ামী লীগ সাহস পায় না কেন? বাংলাদেশের এইসব অফিসার আর যাই করুক না কেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করেননি। তারপরেও তাদেরকে বছরের পর বছর ধরে জেলে রাখা হয়েছে, দিনের পর দিন রিমান্ডে নেয়া হয়েছে,দিনের পর দিন নির্যাতন করা হয়েছে। ভারতের সংহতি বিপন্ন করার অভিযোগে তাদের বিচার করা হচ্ছে। তাদের বিচার করার ক্ষেত্রে আওয়ামী সরকার অত্যন্ত তৎপর। কিন্তু যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলো তাদের বিচার করার ব্যাপারে আওয়ামী সরকার যখন একটি কথাও বলে না তখন তাদেরকে কি বলব? তখন যদি খালেদা জিয়া বলেন যে ওরা স্বাধীনতা বিরোধী তখন তিনি ভুল বলেন না।
আরেকটি নতুন তথ্য পাওয়া গেছে। সেটি হলো, নেপালে বাংলাদেশের ট্রানজিট লাভ। বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে রোহনপুর রেল লাইন দিয়ে বাংলাদেশকে নেপালে ট্রানজিট দিতে ভারত সম্মত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হলো এই যে রোহনপুর রেল স্টেশন দিয়ে বাংলাদেশের ট্রানজিট অতীতেও ছিল। মাঝখানে রেল লাইনটি ব্রডগেজ থেকে মিটারগেজে রূপান্তরের জন্য বন্ধ করা হয়। এখন আবার সেটি খুলে দেয়া হয়েছে। ভারতকে উদার প্রমাণ করার জন্য বাংলাদেশের যে সরকার তার জনগণের কাছে এমন একটি তথ্য লুকিয়ে রাখে তাদেরকে কি দেশপ্রেমিক বলা যায়? তারা কি স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি?
সবচেয়ে বড় ইস্যুটি এখনো আলোচনা করিনি। সেটি হলো করিডোর। সেটি আলোচনা করব বারান্তরে।
__._,_.___