http://www.dailynayadiganta.com/details/13660
প্রথম পাতা
ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়ে আপিলের ব্যবস'া থাকতে হবে : স্টিফেন জে র্যাপ
যুদ্ধাপরাধের বিচার
নিজস্ব প্রতিবেদক
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিযুক্ত যুদ্ধাপরাধবিষয়ক বিশেষ রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র্যাপ বলেছেন, ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায় বিষয়ে মধ্যবর্তী আবেদনের সুযোগ থাকা উচিত। ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ সরাসরি রেডিও-টিভিতে প্রচারের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের সব মানুষের কাছে এ বিচার প্রক্রিয়া উন্মুক্ত থাকতে হবে। যারা আগ্রহী তাদের এ বিচারকাজ সম্পর্কে জানতে দিতে হবে।
ঢাকা সফররত স্টিফেন জে র্যাপ গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এ কথা বলেন। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা এটি দেখতে চাই যে অভিযুক্তদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। বিচার যেন স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে যারা নির্দোষ তাদের নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ দিতে হবে এবং তাদের মুক্তি দেয়া উচিত।
লিখিত বক্তব্যে স্টিফেন জে র্যাপ বলেন, আমাকে দুঃখের সাথে এ কথা বলতে হচ্ছে, আমরা বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ আইন এবং বিচার প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করার জন্য যেসব প্রস্তাব দিয়েছিলাম এর আগে তার বেশির ভাগই মানা হয়নি। কিছু কিছু মানা হয়েছে কিন' আরো অনেক কিছু মানা সম্ভব ছিল।
তিনি বলেন, এই বিচার প্রক্রিয়ায় কী ঘটছে তা সবাইকে জানাতে হবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে আদালতের অধিবেশনে যোগ দেয়া সহজ এবং সম্ভব নয়। তাই সরাসরি রেডিও-টিভিতে সমপ্রচারের ব্যবস'া থাকা উচিত। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিয়েরালিওনে যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত বিশেষ আদালতে প্রতিদিন যে কার্যক্রম হয় তা ইংরেজি এবং সে দেশের ভাষায় বিস্তারিত লিখে ওয়েবসাইটে দিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশেও এটা করা যেতে পারে। তিনি বলেন, এমনভাবে বিচারকাজ পরিচালনা করা উচিত যাতে তা স্বচ্ছ হয় এবং বিশ্বের সবার জন্য উন্মুক্ত হয়।
প্রতিদিন সরাসরি সমপ্রচার করা না গেলেও সাপ্তাহিক প্রতিবেদন প্রচার করে মূল সাক্ষ্য, যুক্তিতর্ক এবং রুলিং দেখানো উচিত। কম্বোডিয়ায় এটি করা হচ্ছে। অথবা নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের এই বিচার প্রক্রিয়া অনুসরণ করার অনুমোদন দিতে হবে, যাতে তারা প্রাত্যহিক ও সাপ্তাহিক প্রতিবেদন তৈরি করে ইন্টারনেট ও অন্যান্য সাংবাদমাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছাতে পারে।
তিনি বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ বলতে কী বোঝায় তা যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত করা উচিত। মানবতাবিরোধী অপরাধ বলতে কী বোঝায় সে বিষয়টি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইনে সংজ্ঞায়িত করা আছে। কিন' বাংলাদেশে বিষয়টি এখনো কোনো সংজ্ঞার মধ্যে ফেলা হয়নি। হত্যা ও ধর্ষণের যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, জাতিগত নিধন করার জন্য বা বর্ণ এবং ধর্মগত কারণে নিধনের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল কি না তা যেমন স্পষ্ট করতে হবে, তেমনি এগুলোর মধ্যে কোন বিষয়টি বিচার প্রক্রিয়ায় প্রমাণ করতে হবে সে বিষয়টিও পরিষ্কার করা হয়নি। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আদালতে যেসব বিচার এবং রায় হয়েছে তাতে এসব বিষয়ের কোনটি তারা প্রমাণ করতে চেয়েছে তা আগেই নির্ধারণ করা হয়েছে।
স্টিফেন জে র্যাপ বলেন, যারা অপরাধের জন্য অভিযুক্ত হয়েছেন তাদের অধিকার রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রমাণাদির যথার্থতা যাচাই করার এবং নিজেদের পক্ষে সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করার। তাই অভিযুক্তদের মধ্যে কেউ যদি নির্দোষ থাকে তবে তাকে নির্দোষ প্রমাণের সব সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে এবং তাদের মুক্তি দেয়া উচিত। আর যারা অপরাধী তাদের শাস্তি প্রদান করা উচিত।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, অভিযুক্ত পক্ষ এবং তাদের আইনজীবীদের মামলার প্রস'তির জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। বাংলাদেশের অন্যান্য মামলায় উভয় পক্ষকে যেমন সম-অধিকার দেয়া হয়, এখানেও তা দিতে হবে। অন্যান্য অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকরা যেসব অধিকার নিশ্চিতভাবে উপভোগ করে যুদ্ধাপরাধের বিচারে অভিযুক্তদেরও সেসব অধিকার চর্চার সুযোগ দেয়া গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এ ট্রাইব্যুনাল একটি বিশেষ এবং স্বাধীন আদালত, যা নিজম্ব ধারা ও প্রক্রিয়াগুলোর জন্য নিজেই দায়ী। বিচারকরা ধারাগুলো সংস্কার করে অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে নির্দোষ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। তেমনি 'যুক্তিসঙ্গত দ্বিধা-সন্দেহের ঊর্ধ্বে ' প্রমাণ ধারাগুলো সংযোজন করা উচিত।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, আইনের ধারাগুলো সংশোধন করে এমন একটি সাক্ষী নিরাপত্তা প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে হবে, যা উভয়পক্ষ ব্যবহার করতে পারে। কেউ যদি এগিয়ে এসে সত্য কথা বলতে চায় তাহলে তাকে যেমন কোনো প্রকার হুমকি এবং ভয়ভীতির শিকার না হতে হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার বর্তমান সফরের উদ্দেশ্য হলো আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল কিভাবে এই বিচারকাজ পরিচালনা করবে তা জানা। যেসব সংবিধি ও ধারা তৈরি করা আছে কিভাবে ওগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করা হচ্ছে তা জানা। এই ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়ার জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা এবং তা করতে দিতে এখনো অনেক কিছুই করার বাকি আছে।
আমরা এখানে এসেছি, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এটা নিশ্চিত করতে চায় যে, এ বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হচ্ছে।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের বিরুদ্ধে অতীতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গণতদন্ত কমিশনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে তাকে সরে দাঁড়ানোর আবেদন জানানো হয়েছে অভিযুক্ত পক্ষ থেকে। গতকাল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক এ বিষয়ে ব্যাখ্যাদানকালে স্বীকার করেছেন, তিনি তদন্ত কমিশনের সেক্রেটারিয়েট সদস্য ছিলেন। ১৪ নভেম্বর অপর দুই বিচারপতির রায়েও চেয়ারম্যানের সদস্য থাকা বিষয়ে অস্বীকার করা হয়নি। তা ছাড়া অপর আরেক অভিযুক্তর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে তার অনুপসি'তিতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আদালত। এ অবস'ায় তার দ্বারা কিভাবে ন্যায় বিচার পাওয়া সম্ভব সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে স্টিফেন জে র্যাপ বলেন, এ জন্য টাইব্যুনালের রায়ের বিষয়ে মধ্যবর্তী আবেদনের সুযোগ থাকা উচিত।
১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে অবস'ান নিয়েছিল। বর্তমানে অভিযুক্তরাও পাকিস্তানের পক্ষে অবস'ান নিয়েছিল। তাই অভিযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র অভিযুক্তদের বাঁচাতে ট্রাইব্যুনালকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চায়। সাংবাদিকদের এ জাতীয় প্রশ্নের জবাবে বলেন, ওই সময়ে যে সরকার ক্ষমতায় ছিল তারা এখন কেউ ক্ষমতায় নেই। সে সময়কার যুক্তরাষ্ট্রের নীতি আর এখনকার নীতি এক নয়। বর্তমানে বারাক ওবামার প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। যুদ্ধাপরাধের যে বিচার বাংলাদেশে চলছে তা যেন স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ হয় এবং অভিযুক্তদের জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত হয় সেটিই দেখতে চায় ওবামা প্রশাসন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ ও বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বিচারকাজ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে গত ১০ জানুয়ারি ঢাকা সফরে আসেন স্টিফেন জে র্যাপ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তিনি বিভিন্ন মহলের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। এর পর আরো একবার বাংলাদেশ সফর শেষে স্টিফেন জে র্যাপ বাংলাদেশ সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করেন বিচারকে স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ করার বিষয়ে। বর্তমানে তৃতীয়বারের মতো তিনি বাংলাদেশ সফর করছেন।
__._,_.___